আমাদের
ছোটবেলাতে এই ঢাকা শহরে ভূতের
কোনো অভাব ছিল না। আমাদের
তেজগাঁয়ের গীর্জার কবরস্থানে
তেনারা ছিলেন বহাল তবিয়তে।
গীর্জার পাশের রাস্তাটা রাতে
একদম নিস্তব্ধ হয়ে যেত,
মানুষজন দোয়া-দরূদ
পড়ে যাওয়া আসা করতো। ওরা সব্বাই
ছিলেন বিদেশি ভূত। বছরের পর
বছর এই দেশে থাকতে থাকতে আমাদের
বন্ধুর মতোই হয়ে গিয়েছিলেন।
আমাদের বাসায় প্ল্যানচেট
করলে সব পর্তুগীজ ভূত আসতো।
ওদের স্বভাব ছিল মোলায়েম।
তবুও রাতে ওদের ভয়ে বাথরুমে
যেতাম না।আমাদের বাসার বাথরুম
থেকে গীর্জার কবরস্থান দেখা
যেত – ঘুমঘুম চোখে কবরস্থানের
টিমেটিমে আলোতে অনেকবারই
ছায়ামূর্তি দেখেছি আমি।
শুধু
বাসা নয়, আমাদের
স্কুলেও ভূতের উপদ্রব ছিল।
বায়োলজি ল্যাবের কঙ্কালটা
নাকি রাতে করিডোরে হাঁটাহাঁটি
করতো। বিশেষত গ্রীষ্ম বা রোজার
বন্ধের সময় তার সময় একদমই
কাটতো না। যদিও ঘন্টাবাদক
মালুম ভাই ছাড়া ওকে আর কেউই
দেখেনি। কিন্তু সেই গল্প শুনেই
ছুটির পরে শেষ বিকালের আলোয়
আমাদের সেই প্রিয় স্কুল ঘরটাও
কেমন ভূতুড়ে মনে হতো।
এছাড়াও
ঢাকা কলেজের পুকুরে আততায়ী
শেকল, পেছনের
জঙ্গলে ভৌতিক বিড়াল,
ভূতের গলিতে
ভৌতিক বাড়ি, শীতের
রাতের রমনা পার্ক -
সব মিলিয়ে ঢাকা
খুবই ভূতবান্ধব একটা শহর ছিল।
ভূতহীন শৈশব একদম পানসে লাগে
আমার কাছে।
ভূতের
চেয়ে জীবিত মানুষ অনেক বেশি
ভয়ংকর সেটা বড় হতে হতে বুঝেছি।
আমি যতই বড় হতে থাকলাম ঢাকা
শহরও ততই বড় হতে লাগলো। আমার
উচ্চতা একটা সীমানাতে থেমে
গেলেও আমার প্রিয় শহর শুধুই
উপরে উঠতে লাগলো। সেই ক্রমবর্ধমান
শহর থেকে ভূতদের পালানো ছাড়া
আর কোন উপায় রইল না। এতো দাম
দিয়ে ফ্ল্যাট কিনবে কোন ভূত?
কারও বাসাতে
ভূতের উপদ্রব হলে বাসার মালিক
নিশ্চিতভাবে ভূতের কাছে ভাড়া
চাইবে। বিনা পয়সায় একটা উটকো
জিনিস কে পালবে?
ভাড়া দেওয়ার মতো
এতো পয়সা ভূতরা কোথায় পাবে?
এক সময় সেই ভূতদের
মতো আমিও পালিয়ে গেলাম সেই
শহর থেকে।
এমনি
এক ভূতহীন শহরে বেড়াতে গেলাম
গত বছর দুয়েক আগে। এপ্রিল
মাসের প্রখর রোদ্দুর মাথার
ওপর, রাস্তায়
জ্যাম, বাসায়
বিদ্যুৎ নেই, কলে
পানি নেই, ঘরে
বুয়া নেই, আইন
শৃংখলা নেই, মাঠে
ঘাস নেই...নেই...নেই...নেই...নেই... পুরো
শহর জুড়ে শুধু নেই নেই হাহাকার...আর
হ্যাঁ আমার পুরানো স্মৃতির
লেশমাত্র নেই।
ঢাকার
বাইরে এক সপ্তাহ কাটিয়ে আসলাম,
সেখানেও নেই নেই
ধ্বনি। প্রতিটি মানুষই আমাকে
বিদেশ থেকে ফিরতে মানা করল,
প্রত্যেকেই
জানালো যে আমি অনেক সুখেই আছি।
শহরের সব মানুষই মনে হয় অন্তরে
কোনো "অসুখ"
ধারণ করেন। এই
শহর থেকে অতিদূরের কোনো বিদর্ভ
নগরে পালালেই মনে হয় সেই জ্বালা
জুড়াবে। আমার ছেলেবেলার সঙ্গী
শহরটাকে আজ আর কেউ ভালোবাসে
না...না
ভূত...না
মানুষ।
দেখতে
দেখতে চারটা সপ্তাহ চলে গেল,
এবার বিদায় নেবার
পালা। ফিরে যাওয়ার আর মাত্র
কয়েকদিন বাকি। বাচ্চাদের
নিয়ে বউ বাপের বাড়ি বেড়াতে
গেছে। আমারও যাওয়ার কথা ছিল,
কিন্তু শেষ
মুহুর্তে কেন জানি বাদ দিতে
হয়েছে।
এখন
আর তেঁজগায়ে থাকা হয় না। লালরঙের
এক মস্ত ফ্ল্যাটবাড়ির পাঁচ তলায়
থাকি আমরা। পেছনে একটুখানি
আকাশ দেখা যায়। দু-পাশেই
একই আকারের দুটো মস্তবড় বাড়ি।
চাইলে আমাদের বারান্দা থেকে
ওদের বারান্দাতে লাফিয়ে চলে
যাওয়া যায়, এমনি
কম দূরত্ব দুটো বাড়ির মধ্যে।
ঢাকা শহরের জমির প্রচন্ড দাম,
এক ইঞ্চিও কেউ
ফেলে রাখতে নারাজ।
খালি
ঘরে শরদিন্দু বন্দ্যোপধ্যায়ের
ব্যোমকেশ নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পাশের বাড়ির বাচ্চাদের আওয়াজ
শোনা যাচ্ছ, মনে
হচ্ছে যেন হাত বাড়ালেই ওদের
কান মুলে দিতে পারবো। বুয়াকে
ধমকালেন বেগম সাহেব,
টিভির আওয়াজ
শুনতে পাচ্ছি কোথাও যেন,
জীবনপ্রবাহমান।
বাইরে রাতের আকাশে মেঘ নেই
এক ফোঁটা -ঠিক
এমনি এক সময়ে -
লোডশেডিং।
সারাজীবন
এয়ারকুলার ছাড়াই বড় হয়েছি,
কিন্তু বর্তমানে
এমনি এক লাটসাহেবে পরিণত হয়েছি
যে ঠান্ডা হাওয়া ছাড়া আর ঘুমাতে
পারি না। এক সময়ে প্রবল গরমেও
দিব্যি ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমাতে
পারতাম। কারেন্ট কখন আসবে
তার কোনো নিশ্চয়তা নেই...এখন
সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে ঘরটা
ঠান্ডা থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে
পড়া।
অনেক
রাতে ঘুম ভেঙে গেল। তখন কয়টা
বাজে কে জানে। এর মধ্যে বিদুৎ
এসেছে - বলা
যায় না হয়তো বার কয়েক গিয়েছেও।
বাইরে আর কোন আওয়াজ নেই,
আশেপাশের অট্টালিকার
সব্বাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঠিক
এই সময়েই হঠাৎ – বাথরুম থেকে
টিপ...টিপ...টিপ...টিপ...টিপ... টিপ
শব্দ। ঠিক সেই শব্দ শুনতাম
ছোটবেলাতে। ভয়ার্ত স্বরে
আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম ওটা
কি ভূত? আম্মাও
ঘুম জড়ানো গলায় জবাব দিতেন...হুম...তবে
ছোট ভূত ওগুলো,
ভয়ের কিছু নেই।
একটু বড় হওয়ার পরে আমি রাতে
কল ভালো বন্ধ করেও ওই শব্দ
শুনেছি। সারারাত ব্যাপি শব্দ
নয়, রাতের
কোনো একটা সময়ে অল্প কিছুক্ষণ
চলা টিপটিপ শব্দ। আমি বাথরুমে
ঢুকলেই সেই শব্দ বন্ধ হয়ে
যেতো।
নাহ...এইবার
আর ভয় নয়...বিছানায়
শুয়ে শুয়ে আমি পাশের বাথরুম
থেকে শুনলাম
টিপ...টিপ...টিপ...টিপ...টিপ... টিপ...খুব
মনোযোগ দিয়ে...যেন
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর গল্প
শুনছি। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার
আগে ওই ছোট্ট ভূতের কাছে খুবই
কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। আহ বেচারা
নিশ্চয় অনেক দূর থেকে এসেছে
আমার সাথে দেখা করতে। বলা যায়
না, হয়তো
ওই ছোট্ট ভূতটা এখনো এখানেই
থাকে...এই
মনুষ্যবাসের অনুপযোগী শহরে
রয়ে গেছে...আমারই
জন্য হয়ত। মানুষদের দোয়া করে
বলতে হয়..."বেঁচে
থাকো বাবা”, ভূতদের
দোয়া করতে হলে কি বলতে হয়?
আমার চোখ জড়িয়ে
আসে...ওই
টিপ টিপ শব্দটার মধ্য কোথাও
যেন অনেক দূরের দূরন্ত এক
আনন্দ লুকিয়ে আছে।
যাক
এই শহরে আমাকে সবাই ভুলে
যায়নি...মাঝে
মাঝে হঠাৎই তারা ফিরে আসে...একদম
বুকের কাছেই।