Tuesday, November 3, 2015

উদ্বাস্তু

আমি দেশ ছেড়েছিলাম এক বর্ষাকালের সকালে। ভোর বেলার আকাশে আস্তে আস্তে কালো মেঘ জমছে। বৃষ্টি তখনও নামেনি। কিন্তু জোর বৃষ্টির সম্ভবনা। বৃষ্টির দিনে নিজের ঘরে শুয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে বই পড়ার অভ্যেস ছিল। সেই সকালে সেসব কিছুর প্রস্তুতি নেই নি, বরং তাড়াহুড়া করে বিমানবন্দরে প্লেন ধরতে যেতে হয়েছে। দিনটার কথা আজকেও মনে পড়ে। আর কিছুদিন পরেই বিশ বছর হয়ে যাবে।

সেই সকালের বৃষ্টি দেখার আগেই ম্যাকডোনাল্ড ডগলাসের বিমান আমাকে একটানে নিয়ে গেছে দূরে। অনেক দূরে। বাংলাদেশের সীমানা পার হতে মাত্র মিনিট বিশেক লাগে। ওদের গতি আমি অর্জন করতে পারিনি। এই জীবনে তাই জন্মভূমি অতিক্রম করতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল একদিন দেশে ফিরে সেই বৃষ্টির বাকি অংশ দেখবো। আরও অনেক অনেক পরিকল্পনার মতো এটাও বাস্তবায়ন হয় নি। আমি যে শুধু দেশ ছেড়ে চলে গেছি তা-না, কোন এক বিকেলে আবিষ্কার করলাম দেশটাও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যেই আকাশটাকে রেখে এসেছিলাম ছাদের চিলেকোঠার উপরে, সেই ভদ্রলোক আমাকে কিছু না জানিয়েই উধাও!!! ফার্মগেটের ব্রিজ থেকে শুরু করে ধানমন্ডি লেকের পাড়ের ঘাসের গালিচা, সবাই কেমন অচেনা হয়ে গেছে। আমি ওদের কাউকে চিনি না ওরাও আমাকে না চেনার ভান করে। যেই বন্ধুদের ক্লাস সিক্সে রেখে এসেছিলাম - তারা সব বড় হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে।

মার্কিন দেশ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। এই জায়গাটা আমি ভালোবাসি। সকালে লুপ ওয়ান থেকে বার্নেট রোডে এক্সিট নিতে ভুল হয় না। বিকেলে মাঝে মাঝে জ্যাম এড়ানোর জন্য মেট্রিক বুলেভার্ড দিয়ে বাসায় ফিরি। হেমন্তকালের বিকেলগুলো কেমন হলদেটে, ছায়াগুলো দীর্ঘ এবং দুঃখ দুঃখ মাখা। এই শহরটাকে হাতের তালুর মতো চিনি। কিন্তু দেশ বললে অন্য সেই শহরের কথা মনে হয়, যেটা হারিয়ে গেছে, জানি না কিভাবে, কখন এবং কেমন করে। এই শহরটাকে এতো
চেনার পরেও নিজের দেশ মনে হয় না।

যদিও ফেরার মতো ঘর আছে তবুও হঠাৎ ঘর ফিরতি নিজেকে কেমন উদ্বাস্তু মনে হয়। মানুষ নিজেকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। হাঙ্গেরি আর জার্মানির সীমান্তে আটকে পড়া বাবা-মা-শিশুকন্যাকে দেখলে অথবা রাতের অন্ধকারে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু পরিবারের খবর পড়লে মনে হয় আমিই হয়ত সপরিবারে দৌড়ে পালাচ্ছি - যাওয়ার মতো দেশ নেই কোথাও। এদের সাথে আমার পার্থক্য হচ্ছে, আমি নিজের ইচ্ছাতেই উদ্বাস্তু হয়েছি। আমি যদি নিজে উদ্বাস্তু এবং সংখ্যালঘু না হতাম, তাহলে হয়তো এই জীবনে ওই জুতোতে পা গলাতে পারতাম না।

২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ সন্ধ্যাতে প্রথম লেখালেখি শুরু করি। দিনটা মনে আছে, কেননা তার পরদিন আমার বয়েস ৩৯ হবে। লেখালেখির মধ্যে আত্মপ্রকাশের আনন্দ আছে। পাঠকের কাছে পৌঁছাতে না পারলেও নিজের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছানো যায়। কিছু কিছু লেখা পাখির পালকের মতো হালকা, কোন কোন লেখার ওজন জগদ্দল পাথরের মতো। কিন্তু লিখলে শান্তি লাগে। আমার যেই দেশটা কোথাও নেই - সেই দেশে পৌঁছাতে পারি। নেভার নেভার ল্যান্ডে যাওয়ার রাস্তাটা আমার জানা ছিল না - অর্ধেক জীবন পর্যন্ত।

এরপরে আরও ছয় বছর কেটে গেছে। আমি লিখে গেছি। সবই অন্তর্জালে। যেটাকে ব্লগ বলে। কোনদিন কোন লেখা ছাপানোর তাগিদ বোধ করি নি। ব্লগ ব্যাপারটা আবিষ্কারের অনেক অনেক আগে থেকে আমি ব্লগার। মনে মনে বহু জিনিস রচনা করেছি, আলস্য কাটিয়ে সেই মানসিক লেখনি কোথাও পৌঁছায়নি। কিন্তু যখন আত্মপ্রকাশের আনন্দ পেয়েছি - তখন থেকে লেখা বন্ধ করি নি।

সচলায়তনে ছয় বছর ধরে লিখছি। শৈশব থেকে শুরু করে টুকটাক গল্প বা ভ্রমণকাহিনি - সবই লেখার অপচেষ্টা করে গেছি। এই প্ল্যাটফর্মটার সাথে নানান দিক মানসিক একটা ঐক্য আছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিসেব পালটে গেল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ উত্তাল। আমার শৈশবের বাংলাদেশ উলটোপথে চলেছে অনেক বছর - হঠাৎ কে যেন ঘুরিয়ে দিল রথের চাকা। আমি আবার নিজের দেশকে নিয়ে আশা দেখতে পেলাম।

কিন্তু সেই আনন্দ ছিল সাময়িক। অতিদ্রুতই আমার এবং অনেকেরই মোহভঙ্গ হলো। অচিরেই ধর্মের সাথে রাজনীতির গোপন যোগাযোগ যেন অনেক প্রকাশ্য হয়ে গেল। আমিই হঠাৎই যেন ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক এক দেশকে দেখতে পেলাম। সেখানে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন মতবাদের মানুষকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়, লাথি আর কোপ মেরে গর্ভপাত থেকে শুরু করে দেশছাড়া সব কিছুই করানো যায়। সরকার থেকে শুরু করে আমজনতা কেউই টু-শব্দটি পর্যন্ত করবে না।

এই দেশটাকে আমি চিনিনা, আমি কোনদিন এই দেশটার নাগরিক ছিলাম না। আমার হারিয়ে
যাওয়া দেশটা মাঝে মাঝে স্বপ্নে ফেরত আসতো, কিন্তু বর্তমানের ঘোর বাস্তবতার এই দেশ আমি দুঃস্বপ্নেও কোনদিন দেখি নি।

অনেক নিকটজন আমাকে লিখতে মানা করেছেন। আমি কোন স্পর্শকাতর (কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের কাতরতা সাংঘাতিক, আবার কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতাও মারাত্মক) বিষয়ে লিখি না। এরপরও লেখা কমিয়ে দিয়েছি। আরও কমিয়ে দেব। হয়ত একদিন বন্ধও করে দেব।

সবাই বলে - এই দুই পয়সার ব্লগ লিখে কোন লাভ নেই। কিন্তু আমি কোন লাভের জন্য লিখি নি, দেশোদ্ধারের জন্য কলম ধরিনি, কাউকে প্রেম নিবেদনের জন্য একটি লাইনও লিখিনি, কারো জন্য ঘৃণা উগরে দেওয়ার জন্যও লিখিনি। প্রশংসা, তোষামোদ, সমালোচনা, ক্রোধ - কোন কিছুর জন্যও লিখি নি। লিখেছিলাম আনন্দের জন্য, একদম নিজের আনন্দের জন্যই। কেননা মাঝে মাঝে খুব সকালে বা গভীর রাতে অথবা আধোঘুমে আমার সেই দেশটা হাজির হয় - কানে কানে জিজ্ঞেস করে - "আমার কথা মনে আছে তো?"

লেখালেখি বন্ধ করে দিলে আরেকদফা উদ্বাস্তু হয়ে যাবো। এক জীবনে কয়বার ঘরছাড়া হওয়া যায়?

"সকাল হলে
একটি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো
আজন্ম-পরিচিত মানুষ ছেড়ে চলে যাবো
মৃত্যুদন্ডিত
মৃত্যুদন্ডিতের মতো,
অথচ নির্দিষ্ট কোন দুঃখ নেই
উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই
শুধু মনে পড়ে
চিলেকোঠায় একটা পায়রা রোজ দুপুরে
উড়ে এসে বসতো হাতে মাথায়
চুলে গুঁজে দিতো ঠোঁট
বুক-পকেটে আমার তার একটি পালক"
(সুনীল সাইফুল্লাহ)

####

Friday, September 4, 2015

সময়

"Time, you old gipsy man,   
Will you not stay,   
Put up your caravan   
Just for one day?"

শহরের বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরতি পথে এক বিমানবন্দরে লম্বা বিরতি। লাঞ্চ সারলাম, অনেক সময় ধরে বাথরুম সারলাম, দুই-একটা কাজের ফোন সারলাম, মেয়েদের সাথে ডু-ইউ-সি-হোয়াট-আই-সি খেললাম, এরপরও দেখি স্টপওভারের সময়টা শেষ হচ্ছে না। এর মধ্যে ফ্লাইটও ডিলেইড হয়েছে। শেষমেষ একটা ম্যাগাজিন স্টলে হানা দিলাম। হালকা কিছু কিনে বাকি সময়টা কাটিয়ে দেব।

হঠাৎই চোখে পড়ল সায়েন্টফিক আমেরিকান পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যাটি। প্রচ্ছদের এই লোকটাকে আমরা প্রায় সবাই চিনি। বলা যায় এই ভদ্রলোকের নামটা আর বিশেষ্য নয় বরং কাউকে ভীষণ রকম জ্ঞানী বোঝাতে হলে আমরা এই লোকের নামকে বিশেষণ হিসেবেই ব্যবহার করি।


এটা ২০১৫ সাল। ঠিক একশ বছর আগে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। বিনা দ্বিধায় পত্রিকাটা কিনে পড়া শুরু করলাম। পড়তে গিয়ে মনে হল স্টপওভারটা আরেকটু বেশি হলেই ভালো হতো। প্লেনটা আরেকটু দেরিতে ছাড়তে পারে?

সময়টাকে একটু প্রসারিত করা যায় না?

এই সংখ্যাতে থিওরি অফ রিলেটিভিটির বিভিন্ন দিক আছে, মহাবিশ্ব ও কসমোলজিতে রিলেটিভিটির প্রয়োগ আছে, বলা যায় গত শতাব্দির সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রতিটি দিক তুলে ধরা হয়েছে এতে। একই সঙ্গে আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, তাঁর ভুলগুলো - কোন কিছুই বাদ যায় নি।

জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশিত হওয়ার বছর দশেক আগে আইনস্টাইন স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। আইনস্টাইন তখন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নন। তিনি তখন কাজ করতেন সুইস পেটেন্ট অফিসে। বর্তমানে এই কাজকে "পেটেন্ট এক্সামিনার" বা পেটেন্ট পরীক্ষক বললেও সেই সময় একে "পেটেন্ট ক্লার্ক" বলা হতো। নতুন কোন আবিষ্কারের জন্য কেউ পেটেন্টের আবেদন করলে পরীক্ষক সেই আবেদন যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষণ করে দেখেন যে আবিষ্কারটা সত্যিকার অর্থেই নতুন। আইনস্টাইন এই কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তাঁর গবেষণা পত্রগুলো তৈরি করেন।

স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটিটা আসলে কি? উইকিপিডিয়া বলছে...

In physicsspecial relativity (SR, also known as the special theory of relativity or STR) is the generally accepted physical theory regarding the relationship between space and time. It is based on two postulates: (1) that the laws of physics are invariant (i.e. identical) in all inertial systems (non-accelerating frames of reference); and (2) that the speed of light in a vacuum is the same for all observers, regardless of the motion of the light source. It was originally proposed in 1905 by Albert Einstein in the paper "On the Electrodynamics of Moving Bodies"

অর্থাৎ সহজ ভাষাতে বললে - স্থান আর কাল - যেই দুটো শব্দ আমরা প্রায় পাশাপাশিই ব্যবহার করি, সেইগুলো জিনিস আসলে সম্পর্কিত। দুটো মূল ধারনার উপরে এটা দাঁড়িয়ে আছে, সে দুটো ধারনার একটা হচ্ছে, পদার্থবিদ্যার সূত্র সকল জড় কাঠামোর জন্য একইভাবে সত্য এবং শূন্যস্থানে আলোর বেগের ধ্রুবক।

একই সঙ্গে এই তত্ত্বের সাথে সাথে আরও কিছু মৌলিক অজানা বিষয় বের হয়ে আসে। একটা হচ্ছে যেকোন বস্তুর জন্য সর্বোচ্চ বেগ হচ্ছে আলোর বেগ। অর্থাৎ আইস্টাইন এসে মহাজাগতিক গতিসীমা ঠিক করে দিলেন। এর পাশাপাশি বস্তু এবং শক্তির রূপান্তরের ব্যাপারটাও প্রমাণিত হয়। বস্তু আর শক্তি সমতুল্য বিষয়,  E = mc 2  সূত্রটা আমরা স্কুলেই পড়েছি।

সেই সঙ্গে সময় প্রসারন বা টাইম ডাইলেশন, দৈর্ঘ্য সংকোচন, আপেক্ষিক ভর এই ব্যাপারগুলোও স্পেশাল রিলেটিভিটি প্রথমবারের মতো প্রমান করেছে। খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে - দুই জন পর্যবেক্ষকের একজন যদি গতিশীল থাকেন এবং অন্যজন যদি স্থির থাকেন, তাহলে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাপা সময়, দৈর্ঘ্য, ভর অপরের তুলনায় ভিন্ন হবে। ঠিক কতখানি ভিন্ন হবে, সেটা খুব নির্দিষ্ট করে বলে দেয় স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি।

আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মনে হয় টাইম ডাইলেশনের ব্যাপারটা। আমার এই লেখাটা টাইম ডাইলেশনেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। লেখাটার নাম তাই দিয়েছি সময়, যেটা আইসক্রিমের মতো, ধরে রাখা যায় না, গলে বেরিয়ে যায়। আমাদের হাতে সময় থাকে না (সম্ভবত ঘড়ি হাতে পরা হয় দেখে হাতে সময়ের ব্যাপারটা এসেছে, এখন অনেকেই ঘড়ি পরেন না, পকেট থেকে সেলফোন বের করে সময় দেখে নেন - এখন সময় আমাদের পকেটে থাকে), পড়ার সময় থাকে না, বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় থাকে না...অঞ্জনের গানের কথায় বললে...

"সেই মন-প্রাণ খুলে গল্প করার দিন শেষ,
শুধু তাড়াহুড়ো করে যদি কিছু কথা বলে ফেলা যায়..
সময় যা ছিলো হাতে সবটাই নিঃশেষ,
পড়ে আছে শুধু অজস্র অসময়.."

সময় নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কিছুটা হাহাকার চলে আসে। কেননা সময় এসে তারুণ্যকে কেড়ে নেয়, স্মৃতিকে ফিকে করে দেয়, মাথার চুলের রঙ পালটে দেয়, শৈশবকে টেনে নিয়ে ফেলে দেয় মধ্যবয়েসে। সময়ের আঁচড় থেকে আমরা কেউই মুক্ত নই। ভদ্রলোক এমনই খতরনাক।

টাইম ট্র্যাভেল করে ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা কি সম্ভব? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই সম্ভব। আমরা প্রতি মিনিটেই ভবিষ্যতে যাচ্ছি, প্রতি মিনিটের আমরা ঠিক এক মিনিট পথ পাড়ি দিচ্ছি সময়ে। এই রেটেই আমরা সবাই টাইম ট্র্যাভেল করি, আজকে যেটা অনাগত ভবিষ্যত, সেটা এক সময়ে আর অনাগত থাকে না, বরং এক সময়ে দূর অতীত হয়ে যায়। প্রশ্নটা হচ্ছে আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত যাত্রার গতি বাড়াতে পারি? স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বলছে সেটা সম্ভব।

নিচের এই সূত্রটা দেখুন - এই সূত্র বলছে অর্থাৎ সাঁই সাঁই করে কোথাও যেতে থাকলে আমরা যে শুধু স্থানে অগ্রগামী হই তা-না, কালেও অগ্রগামী হই। যেটা একটু আগেই বলেছি সময় জিনিসটা আপেক্ষিক, এটা নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের উপর। দুজন পর্যবেক্ষকের একজন স্থির এবং অপরজন গতিশীল হলে, গতিশীল পর্যবেক্ষকের সময় স্থির পর্যবেক্ষকের তুলনাতে ধীরে চলবে। অর্থাৎ গতিশীল পর্যবেক্ষক স্থির পর্যবেক্ষকের তুলনায় তাড়াতাড়ি ভবিষ্যতের দিকে রওনা দিচ্ছেন।







একটা উদাহরণ দেখি।

ধরা যায় দুই যমজ ভাই - হাসান ও হোসেন। দু'জনের বয়েসই ২৫। ঠিক হলো যে হাসান স্পেসশিপে করে দূরের এক গ্রহে যাবে, গ্রহটা ১২ আলোক বর্ষ দূরে। স্পেসশিপের গতি 0.6c তে স্থির হলো। অর্থাৎ আলোর বেগের ষাট শতাংশ। এই বেগে ১২ আলোক বর্ষ যেতে হাসানের ২০ বছর লাগবে। ফিরতে আরও ২০ বছর। অর্থাৎ ৪০ বছর এই দুই ভাইয়ের দেখা হবে না।

হাসান একটু মন খারাপ করলেও বিজ্ঞানের স্বার্থে হোসেনকে গুডবাই বলে স্পেসশিপে উঠে গেল। আরেকটা ব্যাপার দুই ভাই মিলে ঠিক করল যে তারা একে অপরকে প্রতি বছর একটা করে মেসেজ পাঠাবে।

হাসানের স্পেসশিপের বেগ আলোর বেগের ৬০ ভাগ। অর্থা ১২ আলোক বর্ষ পাড়ি দিতে তার লাগবে ১২/০.৬ = ২০ বছর। ফিরতে লাগবে আরও ২০ বছর। সুতরাং ২০ + ২০ = ৪০ বছর পরে সে যখন ফিরবে তার বয়েস তখন ৬৫। এই চল্লিশ বছরে সে হোসেনকে ৪০ টি মেসেজ পাঠাবে।

এই উপরের সূত্রটা প্রয়োগ করে হোসেনের ঘড়ির সময় বের করি।

হোসেনের ঘড়ির সময় = হাসানের ঘড়ির সময় / বর্গমূল( (১ - (হাসানের বেগ/আলোর বেগ) ** ২ ) )

হাসানের সময় ৪০ বছর।
হাসানের বেগ/আলোর বেগ = ০.৬, তার বর্গ হচ্ছে ০.৩৬
সুতরাং হরের অংশটা হচ্ছে ১ - ০.৩৬ = ০.৬৪ এর বর্গমূল = ০.৮

তাহলে হোসেনের ঘড়ির সময় = ৪০ /০.৮ = ৫০ বছর

যেই সময়টা হাসান স্পেসশিপে ছিল, সেই সময়ে হোসেন ৫০ টা মেসেজ পাঠাবে হাসানকে। হাসান যখন ফিরে আসবে হোসেনের বয়েস তখন হবে = ২৫ + ৫০ = ৭৫

হাসান ৬৫ বছর বয়েসে ফিরে এসেছে এমন এক জায়গাতে যেখানে স্থির থাকলে তার বয়েস হতো ৭৫। অর্থাৎ হাসান চল্লিশ বছর গতিশীল থেকে ১০ বছর ভবিষ্যতে পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

আমাদের সাধারণ বেগের জন্য টাইম ডাইলেশনের পরিমাণ তুচ্ছ। আপনারা যদি এই সূত্রে জেট প্লেনের গতিও বসানো তবুও খুবই নগণ্য পার্থক্য পাবেন সময়ের।

আরও একটা উদাহরন দেওয়া যাক, এটা অবশ্য কাল্পনিক উদাহরণ নয়, বরং বেশ বাস্তব।

পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাইম ট্রাভেল করার রেকর্ডটা সার্গেই ক্রিকলায়েভের (Sergei Krikalev)। উনি ৮০৩ দিনের কিছু বেশি সময় মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করেছেন - এই সময়ে বেগের কারণে আমাদের পৃথিবীর মানুষদের থেকে তাঁর ঘড়ি ০.০২ সেকেন্ড কম চলেছে। অর্থাৎ এতোদিন বাইরে থাকার কারণে তাঁর তারুণ্য তিনি ধরে রেখেছেন - আমাদের থেকে পুরো ০.০২ সেকেন্ড বেশি তরুণ তিনি।

তবে ব্যাপারটা সর্বত্রই তুচ্ছ করা যায় না। আমাদের গাড়িতে আমরা যেই জিপিএস ব্যবহার করি সেইগুলো স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ স্থাপনা করে ভূমিতে আমাদের নির্দিষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের গাড়ির তুলনায় স্যাটেলাইটের গতি অনেক। জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইটের বেগ ঘন্টাতে প্রায় ২২,২৩৬ মাইল, বা সেকেন্ডে হিসেব করলে ৩ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। এটা যদিও আলোর বেগের তুলনাতে তুচ্ছ তবুও জিপিএসের ক্লক স্যাটেলাইটের সাথে মিলানোর জন্য সুক্ষ্ম টাইম ডাইলেশনের হিসাবটাও নেওয়া হয়, কেননা জিপিএসকে খুব নির্ভুলভাবে অবস্থান জানাতে হয়।

সুতরাং বন্ধুগন তারুণ্য ধরে রাখতে হলে দৌড়ের উপর থাকতে হবে। আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে দৌড়াতে পারলে চিরতারুণ্য ধরে রাখতে পারবেন। সেটা যদি নাও পারেন, একটু হাঁটাহাটি করলেও সময়ের আঁচড় রুখতে পারবেন, নাহ স্পেশাল রিলেটিভিটির কথা বলছি না, আপনার দেহ ঘড়িটা ঠিক ঠিক টিকটিক করে যাবে।

####


Thursday, July 2, 2015

অ্যালান টুরিং ও সমকামিতা

কম্পিউটারের জনক বলে পরিচিত অ্যালান টুরিং এর জীবন ও কাজ নিয়ে একটা ছবি বানানো হয়েছে গত বছর। নাম হচ্ছে "ইমিটেশন গেম", দেখার ইচ্ছে থাকলেও নানান কাজে দেখা হয়নি। গতকাল ছবিটা দেখলাম, দুবাই থেকে হিউস্টনের ফিরতি ফ্লাইটে। ছবিটা বেশ কয়েকটা অস্কার নমিনেশন পেলেও সম্ভবত একটি মাত্র ক্যাটাগরি পুরস্কার জিতেছে। ছবিটার কাহিনী মোটামুটি বলে দেওয়া হয়েছে, উইকিপিডিয়ার অ্যালান টুরিং ভুক্তিতে। নিচে জুড়ে দিলাম।


"অ্যালান ম্যাথিসন টুরিং একজন অগ্রণী কম্পিউটার প্রকৌশলী, গণিতজ্ঞ, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, গোপন সংকেত বিশেষজ্ঞ, গাণিতিক জীববিজ্ঞানী এবং ম্যারাথন দৌড়বিদ ছিলেন। কম্পিউটার প্রকৌশলের বিকাশে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি তাঁর টুরিং মেশিনের (Turing machine) মাধ্যমে গণনা (computation) ও অ্যালগোরিদম (algorithm) এর ধারণার প্রচলন করেন। টুরিংকে তাত্ত্বিক কম্পিউটার প্রকৌশল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টুরিং ব্লেচলি পার্কে (bletchly park) অবস্থিত ব্রিটেনের গভার্নমেন্ট কোড অ্যান্ড সাইফার স্কুলের (government code and cipher school) জন্য কাজ করতেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি জার্মান নৌবাহিনীর গুপ্তসংকেত বিশ্লেষণে নিয়োজিত হাট-৮ (hut-8) এর নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি জার্মান সাইফার বিশ্লেষণের বেশ কিছু কৌশল আবিষ্কার করেন। তিনি এনিগমা (enigma) মেশিনের বিন্যাস বের করার জন্য তড়িৎযান্ত্রিক (electromagnetic) যন্ত্র তৈরি করেন। গোপন সংকেত বিশ্লেষণে টিউরিং এর অবদান অ্যাটলান্টিকের যুদ্ধে নাৎসীদের হারাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ধারণা করা হয় ব্লেচলি পার্কের অবদানের কারণে ইয়োরোপের যুদ্ধের দৈর্ঘ্য দুই থেকে চার বছর কমে যায়।"

যুদ্ধের দৈর্ঘ্য কমাতে প্রায় ১৪ লক্ষ লোকের প্রাণ বেঁচে যায়। অ্যালান টুরিং এর নাম আমি শুনেছিলাম, তাঁর কাজ সম্বন্ধে সামান্য ধারনা ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। মুভির শেষাংশটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আবারও উইকি থেকে কোট করছি।


"১৯৫২ সালে টুরিংকে সমকামিতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সে সময়ে যুক্তরাজ্যে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। জেলে যাওয়া এড়াতে তিনি এস্ট্রোজেন (oestrogen) ইঞ্জেকশন গ্রহণ মেনে নেন। টিউরিং ১৯৫৪ সালে তাঁর ৪২তম জম্নদিনের ১৬ দিন আগে মারা যান।"

অ্যালান টুরিং এর কাজের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচে যায় - কিন্তু তিনি তাঁর জীবদ্দশাতে সম্মানের বদলে নির্যাতন পেয়েছেন - সমপ্রেমী হওয়ার "দোষে"। এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য - মাত্র ৬০ বছর আগেও ইংল্যান্ডে এইরকম বর্বর আইন বিদ্যমান ছিল। ছবিটা শেষ হওয়ার পরে আমার বেশ কিছুক্ষণ লেগেছে ধাতস্থ হতে।


কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা অস্বাভাবিক সেটা সম্ভবত ঠিক করে দেয় সংখ্যাগুরু মানুষেরা। যেই দেশে সবাই লুঙ্গি পরে অফিসে যায় সেখানে প্যান্ট পরাটাই অস্বাভাবিকতা। আমরা যেটা নিজেরা করিনা সেটাকেই অস্বাভাবিক মনে করি - ব্যাপারটা এই পর্যন্ত হলেই হয়তো অসুবিধা ছিল না - কিন্তু "অস্বাভাবিক" যেকোন কিছুকেই পিটিয়ে সিধে করার অভ্যাসটাও আমরা ত্যাগ করতে পারি না।


সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কিছু নয়, আবার মানুষ সমকামীদের সাথে নির্মম আচরণ করছে, সেটাও সম্ভবত প্রকৃতির বাইরের কিছু নয়। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার প্রকৃতিরই কোডিং এর একটা অংশ। এই প্রসংগে শিশুপালনের একপর্বে লিখেছিলাম...


"আমাদের বাসাতে প্রায়ই একটা বিড়াল আসে। নাম হচ্ছে গর্ডি। প্রতিবেশির বিড়াল। প্রায় সকালে আমরা খাওয়ার টেবিলে বসলে বিড়ালটাকে দেখতে পাই। আমাদের বাসার চরম বিড়ালপ্রেমী ব্যক্তি হচ্ছে আমার ছোট মেয়ে।


গর্ডি আসলেই সে Aww করে শব্দ করে। এইটার অর্থ আমাকে বুঝিয়েছে সে - "কিউট স্টাফ" দেখলে এইটা বলতে হয়। শুধু বিড়াল না সে প্রাণীজগতের প্রায় সবাইকে দেখলেই আপ্লুত হয়।


বৃষ্টি হলে একটা গম্ভীর ব্যাঙ বাসার সামনের শেডে আশ্রয় নেয়, ওটার নাম হচ্ছে ফ্রগি-ওয়াগি, গাছের শুঁয়োপোকার নাম হচ্ছে ফাজি-ওয়াজি...এদের সবাইকে সে "মাদার নেচার" মনে করে।


গর্ডি সাধারণত বাসার পেছনে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু সেইদিন ছিল ব্যতিক্রম। কোথা থেকে একটা ছোট ইঁদুর ঢুকে পড়েছিল। গর্ডি তাকে খেলার ছলে আক্রমণ করছিল। গর্ডির সাথে সেই ইঁদুরের মোলাকাত ছিল অসম যুদ্ধ, ইঁদুরটা যতবারই পালাতে চাইছিল ততবারই গর্ডি তার পথ আটকে দিচ্ছিল। টম আর জেরির যুদ্ধ আমি গত চল্লিশ বছর ধরে দেখছি, সেইখানে কোনদিন বিড়ালকে জিততে দেখিনি। বাস্তবতা আর ইচ্ছাপূরণ এক জিনিস নয় সেটাই প্রমাণিত হলো।


বাচ্চাদের ধারণা ছিল "মাদার নেচার" এক এবং অখন্ড স্বত্ত্বা। সেইখানে মোটামুটি সবার সাথে সবারই ভাব থাকে। মাদার নেচার ভার্সেস মাদার নেচার লড়াই সাধারণত দেখা যায় না, আমি একবার ভেবেছিলাম ইঁদুরটাকে বাঁচাবো, কিন্তু ততক্ষণে গর্ডি ইঁদুরটাকে আহত করে ফেলেছে, ওটাকে বাঁচানো মানে সেটার কষ্টকে বাড়ানোই হবে। সকালের মাখন আর জেলি মাখানো টোস্টও একটু একটু বিস্বাদ লাগলো - রোমান সম্রাটদের গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই দেখতে দেখতে কি মাঝে মাঝে বিবমিষা হতো?


আমাকে ওরা জিজ্ঞেস করল বিড়ালটা ইঁদুরটা খাবে নাকি? ইঁদুরটা হেভেনে যাবে কিনা? পঞ্চত্বপ্রাপ্তির পর ইঁদুরের ডানা গজাবে নাকি? বিড়াল ইঁদুর খাওয়ার জন্য মারে বলে মনে হয় না, গর্ডিও খেলার ছলেই হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল। আমি কুকুরের হাতে(?) বিড়াল হত্যাকান্ডও দেখেছি।


সম্ভবত দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এবং আধিপত্য বিস্তার মাদার নেচারেরই কোডিং এর অংশ - এই পিটাপিটিময় জগতে শেষ পর্যন্ত যোগ্যতমের জয় হয়। সবাই মিলেমিশে থাকাটা অলীক, অবাস্তব এবং কিছুটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ একটা ব্যাপার। সঙ্গত কারনেই এই যুক্তিগুলোও আমার বড় মেয়ের কাছে "নট ফেয়ার" মনে হল।


আমরাও মাদার নেচারের অংশ। শার্ট-প্যান্ট পরলেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না - ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালারা কবেই শিখিয়েছে এই আপ্তবাক্য। সুতরাং মনুষ্য সমাজও যে গর্ডির দূরবর্তী মামাতো ভাই সেই সন্দেহ আমার নেই। আমরা মানুষের সমতা তৈরির আইন করি, সমান অধিকারের আইন করি...কিন্তু দিনশেষে যেই লাউ সেই কদু...সবলের জয়ই সর্বত্র হয়। আমরা যেটা না সেটা কখনোই সামষ্টিকভাবে অর্জন করতে পারি না।"

সেই জন্যই হয়তো সংখ্যালঘু হওয়াটাই দোষের - কখনো কখনো  প্রাণ হারানোর মতো বিপদজ্জনক। একটা সমাজ আস্তে আস্তে যখন উন্নত হতে থাকে, তারা ধীরে ধীরে সংখ্যালঘুদের অধিকারগুলো মেনে নিতে থাকে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে - এই মেনে নেওয়ার ব্যাপারটাই "প্রকৃতিবিরুদ্ধ" - কিন্তু মানুষ যতই উন্নত হতে থাকে ততই বেশি লড়াই হতে থাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে। আমরা যতই উন্নতির দিকে এগিয়েছি ততই প্রকৃতির বাধ্যবাধকতাতে জয় করে সামনে এগিয়ে গিয়েছি। 


গত সপ্তাহে মার্কিন দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমপ্রেমিদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন। এই ব্যাপারে এই দেশের মানুষেরাও দ্বিধাবিভক্ত। রক্ষণশীলরা এর বিরুদ্ধে হলেও উল্লেখযোগ্য মানুষ সমপ্রেমিদের অধিকারের প্রতি সম্মান রাখেন।


অ্যালান টুরিং এর প্রসঙ্গে আবারও ফেরা যাক। ২০০৯ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন অ্যালান টুরিং এর শাস্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। টেলিগ্রাফ নিউজের রিপোর্ট বলছে...

"Thousands of people have come together to demand justice for Alan Turing and recognition of the appalling way he was treated. While Turing was dealt with under the law of the time, and we can't put the clock back, his treatment was of course utterly unfair, and I am pleased to have the chance to say how deeply sorry I and we all are for what happened to him. Alan and the many thousands of other gay men who were convicted, as he was convicted, under homophobic laws, were treated terribly. Over the years, millions more lived in fear in conviction."

এর কয়েক বছর পরে টুরিংকে ইংল্যান্ডের রাণী ক্ষমা করে দেন। বিবিসি রিপোর্টের অংশবিশেষ।

 "Computer pioneer and codebreaker Alan Turing has been given a posthumous royal pardon.It addresses his 1952 conviction for gross indecency following which he was chemically castrated.

He had been arrested after having an affair with a 19-year-old Manchester man. The conviction meant he lost his security clearance and had to stop the code-cracking work that had proved vital to the Allies in World War Two."

ওই সময়ে প্রায় ৪৯০০০ মানুষকে জেলদণ্ডসহ নানান শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, সমকামিতার অভিযোগে। তাদের অনেকেই হয়তো টুরিং এর মতো মেধাবি ছিলেন না। তাদের জন্য পিটিশন করার মতো কেউ ছিল না। কেউ চলচ্চিত্র বানায়নি তাদের জীবনের গল্পগুলো নিয়ে। তাঁরা কেন ক্ষমা পাবেন না? এই ৪৯০০০ মানুষের মধ্যে ১৫০০০ এখনো বেঁচে আছেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন টুরিং এর পরিবার। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার রিপোর্ট

"Turing's great-nephew, Nevil Hunt, his great-niece, Rachel Barnes, and her son, Thomas, will hand over the petition, which attracted almost half-a-million signatures on the website Change.org, to No 10 Downing Street.
 
Ms Barnes, 52, from Taunton, said: "I consider it to be fair and just that everybody who was convicted under the Gross Indecency Law is given a pardon. It is illogical that my great uncle has been the only one to be pardoned when so many were convicted of the same crime.

I feel sure that Alan Turing would have also wanted justice for everybody."

সমকামীদের বিয়ের সমতা নিয়ে মার্কিন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়াতে বাংলাদেশের মানুষের অভিমত দেখছি ফেসবুকে, কয়েকদিন ধরে। বাংলাদেশে এখনো সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সাধারণ মানুষ একেই বিকৃতি বা ব্যাধিই মনে করে। সেই হিসাবে আমি খুব বিস্মিত হই নি - কেননা ষাট বছর আগে ইংল্যান্ডেও অবস্থা এই রকমই ছিল। কিন্তু সমকামীদের অধিকারের পক্ষে অনেক অনেক মানুষকে দাঁড়াতে দেখেছি - আজকে থেকে ২৫ বছর আগেও এই নিয়ে কথা বলাটাই ট্যাবুর মতো ছিল। এটাও কম ব্যাপার নয়।

আমাদের সমাজও নিশ্চিতভাবে কিছুটা এগিয়েছে। হয়ত আরও একশ বছর পরে আমাদের সুপ্রিমকোর্ট এই রকম যুগান্তকারী কোন রায় দিবে। হয়ত একদিন আমরা মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতে পারবো - তার গায়ের রঙ, ধর্ম বা সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনগুলোকে সামনে আনবো না। সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ পরিচয়টাই হবে মানুষ। সেইদিনটা সম্ভবত আমি দেখে যেতে পারবো না - কিন্তু আমি জানি একদিন সেটা আসবেই।

Thursday, May 7, 2015

ম্যামাল

আনুশা তখন নতুন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ওর স্কুলের গালভরা নাম। হারমনি স্কুল অফ সায়েন্স। সকালে লাল রঙের স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যায়। এই স্কুলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কিছু শেখানো হয় - একদম নিচু ক্লাস থেকেই।

একদিন স্কুল থেকে এসে আমাকে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করল - আব্বু আর ইউ অ্যা ম্যামাল?

কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানালো - স্কুলে সে শিখেছে ম্যামালরা দুধ খায়। বাসার ফ্রিজ ভর্তি দুধ থাকা স্বত্ত্বেও আমি এক ফোঁটা দুই খাই না।

স্কুলের প্রজেক্টের জন্য আনুশা তার আশেপাশের ম্যামাল প্রাণীদের তালিকা তৈরি করা শুরু করল। খুব সঙ্গত কারণে আমি প্রথমেই সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেলাম। চল্লিশ বছর ম্যামাল হিসাবে কাটিয়ে আমার ম্যামালত্ব হুমকির সামনে পড়ে গেল। ড্রাইভার'স লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে যে রকম লাগতে পারে আমার ঠিক সেই অনুভূতি হতে লাগলো।

ম্যামালের তালিকাতে প্রথম স্থান পেল সামারা। জন্ম থেকে সামারা দুধের ভক্ত। সামারার কল্যাণে আমাদের পাড়া প্রতিবেশি, ওর ডাক্তার থেকে শুরু করে সবাই জেনে গেলে দুধের বাংলা নাম হচ্ছে "ডুডু"...সামারা আনন্দের সময় ডুডু খায়, দুঃখ পেলেও ডুডু, ডাক্তার টিকা দেওয়ার পরে ওর আতর্নাদ শুনে বিপন্নবোধ করেন এবং চার্টের দিকে তাকিয়ে আমাদের বলেন - গিভ হার ডুডু নাউ। হঠাৎ অবেলাতে ডুডু শেষ হয়ে গেলে বাসা থেকে জরুরী ফোন পাই,  সেই ফোনালাপের ব্যাকগ্রাউন্ডে সামারার ফোঁপানির মধ্যে মধ্যে "দুদু" শব্দটা স্পষ্ট শোনা যায়। সামারার চেয়ে প্রকৃত কোন ম্যামাল আমার চোখেও পড়েনি।

আনুশা বড় হয়ে গেছে। ম্যামাল রহস্য উদাঘটন করে ফেলছে। সেই সঙ্গে দুধ খেতেও আগ্রহ বোধ করে না। বড় হয়ে গেলে মনে হয় কেউ আর ম্যামাল হতে চায় না। অথচ আমি প্রায়ই ওদের ম্যামাল যুগের কথা স্মরণ করি।

আম্যাদের সেই ম্যামাল আমলের ছবি...










Monday, April 20, 2015

পরীক্ষার পূর্বরাত্রি

স্কুলে পরীক্ষার আগের রাত আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বলা যায় আমি ওই একটি দিনই প্রচুর লেখাপড়া করতাম। আমার জন্য ওই রাতটা ছিল রহস্য উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ের মতো। সারা বছর ধরে জমে থাকা রহস্যের জট আস্তে আস্তে খুলতে থাকতো। আমি নতুন নতুন জিনিস জানতে পারতাম, বছর জুড়ে হজম করা মারধোরটা অন্যায্য মনে হতো। সামনের বছর মন দিয়ে পড়তে হবে - এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার আগের রাতটা শেষ হতো।

মাঝের কিছু বছর বাদ দিলে আমি প্রায় সারাজীবন ধরেই এই কাজ করে গেছি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো মাঝে কয়েকদিন গ্যাপ থাকতো। আমি এবং আমার যাবতীয় বন্ধুবান্ধব ওই সময়েই বইয়ের পাতা প্রথম উল্টাতো। সারাবছর নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা ব্যস্ত থাকতাম, আমাদের এতো সময় কোথায়?

আমাদের সময়ে বুয়েটের পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে দুটো অংশ থাকতো। প্রতিটি অংশে চারটি প্রশ্ন থাকতো। সেই চারটি প্রশ্নের মধ্যে তিনটির উত্তর করতে হতো। সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি থাকতো ভয়ানক মাত্রার জটিল, যারা পরীক্ষার মাঝে মাঝে পড়াশুনা করে তাদের জন্য। বাকি তিনটা প্রশ্নের মধ্যে আমি আড়াইটার মতো উত্তর করতে পারতাম। মানে আমার স্ট্রাইক রেট ছিল ৮০ এর একটু উপরে। বুয়েটের খুব কম পরীক্ষাতেই আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি।

এইভাবে যারা পরীক্ষা দেয় তাদের জন্য পরীক্ষাটা জ্ঞান সাধনার চেয়ে অনেক বেশি স্ট্র্যাটেজিক গেইম। আমাদেরকে নানান অ্যাসাম্পশন করতে হতো, ঠিক কিভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবহার করে সবচেয়ে ভালো ফল পেতে হবে এই বিষয়ে সাংঘাতিক গবেষণা করতে হতো।

তবে মাঝে মাঝে সব স্ট্র্যাটেজি ফেল মেরে যেতো। সেই সময়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাইতে হতো। আমার মতো যেই সব ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বই খুলে বসে, তাদের প্রিপারেশনের একটা অংশ নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কামনা করা। উনিও সাহায্য করেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এইসব ছেলেপেলেদের পরীক্ষাতে সাহায্য করতে গিয়েই ঈশ্বর আর এই পৃথিবীর জটিল জটিল সব সমস্যা সমাধান করার সময় পান না।

তড়িৎ প্রকৌশলের দ্বিতীয় বর্ষ ছিল বিভীষিকার মতো। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা কোর্স নিতে হতো সেকেন্ড ইয়ারে, কোর্সের নাম ছিল থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স। আমার সব সময়ে মনে হতো এই কোর্সের নামটা বাংলা ছায়াছবি থেকে অনুপ্রাণিত। মানে হচ্ছে "সুজন সখী" সিনেমার নায়ক ও নায়িকার নাম যেন সুজন আর সখী - ঠিক তেমনি থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স কোর্সটা আসলে দুটো কোর্স, থার্মো ডাইনামিক্স আর ফ্লুইড মেকানিক্স। দুটো আসলেই আলাদা আলাদা কোর্স হিসাবে অফার করা হয়। তড়িৎ কৌশলের জন্য এক টিকেটে দুই ছবির মতো একত্রে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

থার্মোফ্লুইড পরীক্ষার আগের ছুটিতে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম যে এই কোর্স গ্যাপে পড়ে পাশ করার বিষয় নয়। এই ছাড়াও যেই স্যার প্রশ্ন করবেন তিনি ছাত্রদের ফেল করাতে ভালোবাসেন। বিচিত্র কারণে মেকানিক্যালের অধিকাংশ শিক্ষক ছাত্রদের ব্যক্তিগত শত্রু মনে করেন। আমি থার্মো ফ্লুইডে ডাব্বা মারার জন্য রেডি হতে লাগলাম।

ঈশ্বর এইবারও মুখ তুলে তাকালেন। পরীক্ষার দুই দিন আগে একদল সন্ত্রাসী বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকে স্যারদের গাড়ি ভাংচুর করে দিল। স্যারেরা সেই দুঃখে ধর্মঘটে গেলেন। আমাদের পরীক্ষা প্রায় একমাস পিছিয়ে গেল। আমার হিসাবে এই কোর্সের পড়া শেষ করতে ৭/৮ দিন লাগার কথা। আমি ঠিক ২৩ দিন পরে আবার পড়া শুরু করলাম এবং বিনা বাধাতে থার্মোফ্লুইড থেকে গলে বেরিয়ে এলাম।

পুরো ছাত্রজীবনে আমি একবার মাত্র ফেল করেছি। ক্লাস ফাইভের অংক পরীক্ষাতে। অংকে ১৯ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষাগুলো আমার কাছে ছিল জেমস বন্ডের মুভির মতো উত্তেজনাকর। বহু বহু বার আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে, খাদের ধার থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি।

আনুশার আগামিকাল স্টার টেস্ট (Staar Test)। স্টারের অর্থ হচ্ছে - State of Texas Assessments of Academic Readiness, এটা টেক্সাস রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের নেওয়া পরীক্ষা। ক্লাস থ্রি থেকে শুরু করে ক্লাস এগারো পর্যন্ত সবাইকেই বছরে দুটো বা তিনটা বিষয় পরীক্ষা দিতে হয়। আনুশার জায়গাতে আমি থাকলে আমি এখন দমবন্ধ করতে পড়তাম। কিন্তু আনুশার টিচার বলেছেন - পড়াশুনা না করে ঘুম দিতে। সকালে ভারি নাশতা করে পরীক্ষার হলে যেতে।

আনুশা একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়েছে। আমার জন্য বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। তবে পুরনো বছরের স্টার টেস্টের প্রশ্ন দেখে আমিও একমত, এই পরীক্ষার জন্য পড়ে লাভ নেই। প্রশ্নপত্র হবে সৃজনশীল। সারা বছর না পড়লে এই পরীক্ষা থার্মোফ্লুইড মেকানিক্সের মতোই জটিল লাগবে। আনুশা আমার মেয়ে হলেও আমার মতো পরীক্ষার আগের রাতের ফাইটার নয়। সারা বছর পড়াশুনা করে সে পরীক্ষার আগের রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম দিতে চায়। আমি আনুশাকে দেখে ঈর্ষিত হই।

গুড লাক আনুশা - আমি ক্লাস ফোরে ফিরতে পারলে সারা বছর মন দিয়ে পড়ব - এই প্রতিজ্ঞা আবারও করছি। গুড লাক সুইট হার্ট।


Thursday, April 16, 2015

শিম্পাঞ্জি

সামারার পছন্দের তালিকাতে আসতে হলে কি যোগ্যতা লাগবে সেটা আমি বের করে ফেলেছি। ওখানে ঢুকতে হলে লোমশ এবং সম্ভব হলে নাদুস-নুদুস হতে হবে। সেই কারণেই লিস্টের এক নম্বরে আছে বিড়াল, মোটা বিড়াল হলে ভালো হয়, দুই নম্বরে কুকুর - তিন নম্বরে আছে শিম্পাঞ্জি।

আমি ছোটবেলাতে যেই সব জিনিসকে ইতর জিনিস বা গালাগাল হিসাবে জেনেছি সেইগুলোই দেখা যাচ্ছে সামারার লিস্টের উপরের দিকে থাকে। আতাহার হোসেন স্যার রেগে গেলে "হনুমান স্টুপিড" বলে গালাগাল করতেন। হালদার স্যার "লেজখসা বানর" বলতেন। সারমেয়র ছানা-পোনা এবং বরাহ শাবকও বেশ খারাপ গালি বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু বড় হওয়ার আমি দেখেছি এইগুলো সামারার বিবেচনাতে খুবই কিউট প্রাণী। ভালো লক্ষ্য করার পরে আমিও এই বিষয়ে একমত। 

 শিম্পাঞ্জি বললেই জেন গুডালের নাম চলে আসে। "হু ইজ জেন গুডাল?" বইটা পড়লে আমরা জানতে পারি যে জেন গুডালের জন্ম লন্ডন শহরে - ১৯৩৪ সালে। তাঁর বয়েস যখন এক বছর তখন তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে একটা পুতুল শিম্পাঞ্জি উপহার পান। সেই বছরই প্রথম লন্ডন চিড়িয়াখানাতে একটা বাচ্চা শিম্পাঞ্জির জন্ম হয়, জঙ্গলের বাইরে সেটাই ছিল জন্ম নেওয়া প্রথম শিম্পাঞ্জি। সেই বাচ্চা শিম্পাঞ্জিটার নাম ছিল জুবিলি - সেটার সাথে নাম মিলিয়ে জেন গুডালের খেলার পুতুল শিম্পাঞ্জিটারও একই নাম রাখা হয়। জেন সর্বত্রই জুবিলিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং এই শিম্পাঞ্জি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তাঁর শৈশবেই থেমে থাকে নি। তিনি সারা জীবন শিপাঞ্জি নিয়েই কাজ করেছেন। অবধারিতভাবেই তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থের নাম - My Life with the Chimpanzees।

শুধু নিজে যে করেছেন তা-ই নয়, বহু বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছেন জেন গুডালের কাজে। সচলায়তনে তারেক অণু লিখেছেন...

"সারা বিশ্বে বর্তমানে যত জন প্রাইমেটোলজিস্ট ( যারা প্রাইমেটদের নিয়ে কাজ করেন ) আছেন তদের শতকরা ৯৫ জনই এই বিষয়ে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেন গুডালের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে। গত ৫০ বছরের বেশী সময় ধরে শিম্পাঞ্জীদের নিয়ে গবেষণা এবং তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন এই মহীয়সী।"

লিঙ্কঃ তারেক অণুর জেন গুডালকে নিয়ে লেখা

 বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সামারাকেও তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। সিনেমা হলে প্রায়ই প্রাণীজগত নিয়ে ডকুমেন্টারি টাইপের মুভি আসে। সামারা সেইগুলোর খবর রাখে। নতুন ছবি মুক্তি পেলেই আমরা সেইগুলো দেখতে যাই। কয়েক বছর আগে শিম্পাঞ্জি নিয়ে ডিজনির ডকুমেন্টারি দেখতে গিয়েছিলাম। এই ছবিটা বানানোর পেছনে জেন গুডালের ভূমিকা আছে।

শিম্পাঞ্জি বা বাঁদরগোত্রীয় প্রাণী নিয়ে ডকুমেন্টারি আমিও দেখতে চাই। ওদের এবং আমাদের, মানে মানুষদের পূর্বপুরুষ একই, অর্থাৎ এক সময়ে আমরা হরিহর আত্মা ছিলাম - বর্তমানে বিবর্তনের দৌড়ে আমরা এগিয়ে গিয়েছি (সভ্য হয়েছি এই দাবী করা অসম্ভব)। ওদের ব্যাপার আমার কৌতুহল প্রাচীন। 

 ছবিটার কাহিনি এই রকম - গল্পের নায়ক অস্কার বনের শিশু শিম্পাঞ্জি। তার শৈশব আনন্দময়। তাদের জঙ্গলে খাবারের অভাব নেই। অস্কার সারাদিন তার মা ঈষার সাথে লেপ্টে থাকে। শিম্পাঞ্জিরা দলবদ্ধ জীব। ওরা টুকটাক টুল বানাতে পারে। প্রকৃতির পাঠশালাতে অস্কার শিক্ষানবীস, ঈষার দায়িত্ব শিক্ষকের। শৈশব খুব আনন্দের হওয়ার কথা। সেই রকমই হচ্ছিল। কিন্তু পুষ্পে কীট সম - সর্বত্রই তৃষ্ণা জেগে রয়। ওই জংগলে শিম্পাঞ্জিদের দুটো দল ছিল। তাদের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। বরং প্রায় নিয়মিতই গ্যাঞ্জাম লেগে থাকতো। দুই বিবদমান দলের এক সংঘর্ষে অস্কারের মা ঈষা আহত এবং নিহত হয়।

অস্কার বুঝতেও পারেনি যে তার মা আর নেই। সে নানান জায়গাতে তার মায়ের খোঁজ করে। তার অবস্থা সেই হারিয়ে যাওয়া পাখির বাচ্চার মতো। জঙ্গলে বাস করার নানান বিদ্যাও সে শিখতে পারে নি, সুতরাং একা একা জীবন ধারণ করাও অসম্ভব তার জন্য। মা-কে খুঁজে না পেয়ে সে অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদের কাছে আশ্রয় খুঁজে এবং ব্যর্থ হয়। এই পর্যায়ে অনাথ অস্কারের মৃত্যু প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়ে।

অস্কার শেষ পর্যন্ত শিম্পাঞ্জি গোত্রের লিডার ফ্রেডির কাছে যায়। ফ্রেডি পিছে পিছে সে ঘুরতে থাকে। ফ্রেডি রাজনৈতিক নেতাদের মতো। তার মূল কাজ পিটাপিটি আর মারামারি। অনাথ শিশু প্রতি সদয় হওয়ার কোন ইচ্ছেই তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু কি এক মায়ামন্ত্রবলে ফ্রেডি আর অস্কার আস্তে আস্তে কাছে আসে। তাদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। অস্কার শেষ পর্যন্ত প্রায় ফ্রেডির পালকপুত্রে পরিণত হয়।


ছবিটা দেখে সামারার চোখ অশ্রুসজল হয়ে গিয়েছিল। অস্কারের জন্য আমিও বেদনা ও আনন্দ দুটোই অনুভব করেছিলাম। সেই সঙ্গে মানুষের নিকটতম আত্মীয়ের মধ্যেও অমানুষিক ছায়া দেখে চমকেও গিয়েছিলাম। ছবিটা ছিল একটি আই-ওপেনার। প্রকৃতি বললেই একজন উদার ভদ্রলোকের ছবি ভেসে উঠতো আমার মনে, কিন্তু বাস্তবে প্রকৃতি বেশ খতরনাক প্রকৃতির লোক। তার কিছু অংশ প্রায় জর্জ বুশের মতো। জোর যায় মুল্লুক তার। কিন্তু নির্মম বাস্তবে ছুঁড়ে ফেলাটা প্রকৃতির যেমন অবধারিত নিয়তি, তেমনি ফ্রেডির মধ্যে জেগে ওঠা অপত্যস্নেহটাও প্রকৃতিরই নিয়ম।

মানুষের চরিত্রের প্রতিটি বৈপরীত্য - হিংস্রতা, ভালোবাসা, ক্রোধ, স্নেহ, প্রতিটা পর্বই যেন বিবর্তনের পরিক্রমাতে আর ধারালো হচ্ছে। শিম্পাঞ্জিদের চেয়ে আমরা মানুষেরা বিবর্তনের দৌড়ে এগিয়ে আছি, আমাদের ক্রোধ আর হিংসা যেমন ওদের চেয়েও নিঁখুত তেমনি আমাদের ভালোবাসাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওদের চেয়ে ব্যাপক। শিম্পাজিরা বড়জোর নিজেদের মাথা ফাটাতে পারে কিন্তু মানুষেরা জীব এবং জড় যা যা কিছু আছে তাদের সব কিছুই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম এবং প্রস্তুত।


শিম্পাজি মুভিটা ইউটিউবে আপলোড হয়েছে।




ছবিটার পোস্টার। ছবি সূত্র উইকিপিডিয়া।



সেই সঙ্গে সত্যিকারের জেন গুডাল আর আমাদের বাসার জেন গুডালের ছবি জুড়ে দিলাম। সত্যিকারের জেন গুডালের ছবি উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া।





[এই লেখাটা সচলায়তনে আমার প্রিয় মুখ তারেক অণুকে উৎসর্গ করছি]
 

Thursday, March 26, 2015

বড় হওয়া এবং ছোট হওয়া

অফিসে যাওয়ার সময়ে চারটা জিনিস সাথে রাখতে হয়। অফিসের রুমের চাবি, মেইন গেটের জন্য ব্যাজ, মানিব্যাগ আর রিডিং গ্লাস। প্রায় প্রতি মাসে অন্তত একদিন এই চারটি জিনিসের একটি বাসাতে ফেলে আসি।

অথচ ৩০ বছর আগের শীতকালের বিকালে খাওয়া নরম খিচুরির গন্ধটা সেদিন মনে পড়ে গেল নির্ভুল। শিপুদের বাসায় আব্বার সাথে প্রথম যাওয়া, বিকেলে ওদের বাসার পিছে দৌড়াদৌড়ি। শিপু "র" উচ্চারণ করতে পারতো না, আমি "ক" উচ্চারণ করতে পারতাম না। শিপু স্যারকে বলত "সাল", আমি কাককে বলতাম "তাত"।

স্মৃতি অপ্রয়োজনীয় জিনিস মনে রাখে নাকি বর্তমানটাই বিভীষিকাময় একটা অদরকারি জিনিস?
অফিসে গত বছর যাদের সাথে কাজ করেছি, তাদের দুই একজনের নাম ভুলে গেছি ইতিমধ্যে।
কিন্তু ক্লাস ওয়ানের বন্ধুদের অনেকের পুরো নাম আর রোল নম্বর মনে আছে।

মস্তিষ্ক এমন কেন? গতকালের গল্প বিস্মৃতি হলেও আব্বার অফিসের পিওন রশীদ ভাইয়ের জামার রঙটা মনে রয়ে যায় ঠিকঠাক। আনুশা আমাকে সেইদিন বলল - ও আর বড় হতে চায় না। সম্ভব হলে আমিও পিটার প্যান হতাম। দাড়ি পেকে গেলে পিটার প্যানরা দলে নেয় না।

তবে সবাইকেই একদিন শৈশবমুখি হতে হয়। চুপচাপ একাকী কোন বিকেল বেলা ভেতরের অবাধ্য বালকটা ডেকে আনতে হয়। তার চোখের পাতায় এখন আছে বিস্ময়।

এর পরে আবার একসাথে উজানে যাত্রা।

বড় হতে হতে আবার একদিন ছোট হতে হয়।

Thursday, March 5, 2015

একা একা

 

আমার বয়েস যেদিন দশ বছর হয়েছিল সেই দিনটিতে আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল, আমারই দাবির প্রেক্ষিতে। আমার মেজভাই আমাকে একা একা মনির ট্রেডার্সে যেতে বললেন। মনির ট্রেডার্স আমাদের বাসা থেকে তিনশ গজ দূরের একটা দোকান। ওইখান থেকে আমরা মূলত মিমি চকলেট কিনতাম। পয়ত্রিশ বছর আগের সেই দিনটিতে  আমি প্রথম একদম একা একা বাসা থেকে বের হলাম। ফিরে আসার পরে জানলাম আমার মেজভাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আমার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন। আমি যদি হারিয়ে-টারিয়ে যাই।

দশ বছর বয়েসে আমার ভাই আমাকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। আমার বয়েস এক ডিজিট থেকে দুই ডিজিটে পৌঁছেছে - সেখান থেকে তিন ডিজিটে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।

সেই থেকে শুরু। তিনশ গজের পরে হাজার গজ, এর পরে হয়তো এক মাইল, দুই মাইল, পাঁচ, দশ বা একশ মাইল, একটা সময় সেটা আর গজফিতার মাপে থাকে না। পড়াশুনা শেষ করে একা একা বাইরে পাড়ি দিয়েছি, একাই পাহাড়ে চড়েছি, পাতালের এক গুহাতেও নেমেছি, মহাসমুদ্র দেখেছি। আমাকে আর কেউ চোখে চোখে দেখে রাখেনি। জীবনের নিয়মই এটা। শৈশবের দেওয়ালটা একদিন টপকাতেই হয়। এরপরে অজানা মানুষের সাথে মিশতে হয়, অজানা জায়গাতে পাড়ি দিতে হয়, অজানা পরিস্থিতিতে পড়তে হয় এবং মাঝে মাঝে অজানা এবং অচেনা একটা মানুষের জীবন যাপন করতে হয় - দিন দিন প্রতিদিন। ইচ্ছে থাকলেও আর হারিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বাস্তবতার চাপ অভিকর্ষের মতোই প্রবল, সেটা কাটিয়ে উঠার মতো  মুক্তিবেগ অর্জন করা খুব কম মানুষের জন্যই সম্ভব হয়। আর এইটুকু পথের অভিজ্ঞতা থেকে আমার তিন ডিজিটে পৌঁছানোর ইচ্ছে একদমই নেই।

আজ ছয়ই মার্চ আনুশার দশ বছর পূর্ণ হলো। ঠিক দশ বছর আগে এই দিনটিতে ওর জন্ম। সকাল থেকেই ঠাণ্ডা আর বৃষ্টি, সারাদিন সূর্যের মুখই দেখা যায় নি। রাত ঠিক ১২:৪৪ মিনিটে আনুশাকে আমি প্রথম কোলে নেই, জন্ম মূহুর্তের কান্না বন্ধ করে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে সে, আর আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে।  সেই বিস্ময় আমার এখনও রয়ে গেছে... ওর প্রথম হাঁটতে শেখা, প্রথম কথা বলা, প্রথম স্কুলে নিয়ে যাওয়া, প্রথম কার্টুন, প্রথম আইসক্রিম, প্রথম দোকানে যাওয়া, প্রথম ভ্যালেন্টাইন ড্যান্স - ওর এই পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মাইলস্টোনগুলোই আমার জানা, আমার বিস্মিত চোখের সামনেই এইটুকু মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুতই।

সেদিন আনুশা দাবি করে বসল ওকে একা একা স্কুল থেকে ফিরতে দিতে হবে। নিমেষেই আমার নিজের দশ বছর বয়েসের ঘটনাটা মনে পড়ল। জীবন এক চক্রের মতো - আমি হঠাৎ টের পেয়ে গেলাম আনুশার একা একা চলার সময় আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। জ্যোতিষী না হয়েও এর পরের ঘটনা আমি মোটামুটি জানি। যদিও আমি সব সময় আর পাশে থাকবো না - তবু পুরনো চোখ দিয়ে আমি দেখতে পাই বাস্তব পৃথিবীটা তার আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, ভালোবাসা, কদর্যতা সব কিছ নিয়েই ধেয়ে আসছে।

আমি যদি পারতাম তাহলে সারাজীবনই পাশে পাশে থাকতাম, মাঝে মাঝে আমার নিজেরও মনে হয় কেউ ছায়া দিয়ে রাখলে কি দারুণটাই না হতো। তবু সাহস নিয়ে একদিন আকাশে উড়তে হয়। পৃথিবীতে চলতে হলে জ্ঞান, বুদ্ধি আর শিক্ষার চেয়ে আমার মনে হয় সাহসটাই দরকার সবচেয়ে বেশি।

শুভ জন্মদিন আনুশা, আমার ছোট্ট পাখি। জীবন থেকে সোনার মেডেল শিউলি ফোঁটা সকাল নিয়ে বড় হও, সাহসী, সুন্দর ও সহজ মানুষ হও, পৃথিবীতেই দ্রুতই কমে আসছে এদের সংখ্যা।

ড্যাডি লাভস ইউ।

Friday, February 13, 2015

ভালোবাসা

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ভালোবাসা দিবস বলে কিছু ছিল না - মানে বাংলাদেশে পালন হতো না এই দিবস। আমরা কেউ কোনদিন অনুভব করি নি যে ভালোবাসার জন্য একটা দিবস লাগবে। আমি এই দিবসের বিরুদ্ধে না। সত্যি কথা বলতে বর্তমান পৃথিবীর অবস্থা দেখে আমার মনে হয় ভালোবাসার জন্য একটা দিবস বরাদ্দ রাখাটা খুবই জরুরী। টিভির নিউজে অথবা পত্রিকাতে খবর পড়লে পৃথিবীর যেই চিত্রটা দেখতে পাই সেটাতে ভালোবাসার কণামাত্র থাকে না। পৃথিবী জুড়ে ক্রোধ এবং ঘৃণার বাম্পার ফলন হচ্ছে। ঘৃণার চাষাবাদ প্রায় সব জায়গাতেই হয় এবং আগাছার মতো সে বেড়েই চলছে। ঘৃণা যদি আগাছা হয় তাহলে ভালোবাসা নিশ্চিতভাবে খুব পরিপাটি বাগান - যারা গাছপালা লাগান, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে ফুল বাঁচানো পরিশ্রমের কাজ এবং আগাছা উৎপাটন আরো কঠিন কাজ।

"ডিসপ্লেসমেন্ট অফ অ্যাঙ্গার" বলে একটা ব্যাপার আছে। আমার দক্ষিণ ভারতীয় এক সহকর্মী বন্ধু ছিল। নাম ছিল রাহুল। রাহুলের অফিস রুম আমার অফিসের খুব কাছেই ছিল, নানান আলাপ হতো ওর সাথে। ওর কাছে ওর এক প্রতিবেশী বাঙালি ভদ্রলোকের গল্প শুনতাম, কলকাতার লোক। রাহুল আমাকে অনেকবার বলেছে সে আমাকে বাঙালি দাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। রাহুলের বাচ্চার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেই সুযোগ এসে গেল।

জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পরে ভদ্রলোক একটা বিরক্ত "লুক" দিলেন, ওর দেহের ভাষাতে অপছন্দ ফুট উঠছিল, আমার সাথে কথাও হলো ইংরেজিতে। জানলাম দেশ বিভাগের আগে উনারা পূর্ববঙ্গেই থাকতেন। ওনারা পূর্ব পুরুষেররা দেশ বিভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছেন। সম্ভবত সেই ক্রোধ পরিবারে রয়ে গেছে, বংশানুক্রমিকভাবে উনিও হয়ত পেয়েছেন। উনারা পরিবারের দেশত্যাগের পেছনে আমার কোন হাত না থাকলেও আমারই কোন দূরবর্তী জাতভাই ষাট বছর আগে যেই ইতরামি করে ওনাদের বিতাড়িত করেছিল, সেই ক্রোধের ধারাবাহিকতার কিছু অংশ আমাকে দেখে উনার হয়ত চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারলাম যে উনি আমাকে পছন্দ করছেন না। রাহুলও বুঝতে পেরেছিল এবং বিব্রত হয়েছিল।

টুকটাক আলাপের পরে আর কথা বাড়াইনি। উনারা সাথে আমার কোন বিরোধ নেই, আমরা বর্তমানে একই দেশের লোক বলা যায়। কিন্তু পৃথিবীতের যেই ঘৃণার চাষাবাদ চলে তার ফসল সোমালিয়া থেকে আমেরিকা সর্বত্রই পৌঁছে যায়, একটু ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে আরকি। বেকুব হলেও এটা আমি জানি, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে জন্ম নেওয়াটাই মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ।

ঘৃণার চাষাবাদের মতো কি ভালোবাসার চাষবাস করা যায়? এর বিপরীত চিত্রও দেখেছি। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসের এক বিকেলে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানদার যখন জানতে পারলেন আমি ঢাকার, তিনি আপ্লুত হয়ে গেলেন। তাঁর পরিবারও পূর্ববঙ্গের, বরিশাল থেকে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারি যে নিজ বাসভূম মানুষ স্বেচ্ছাতে ছেড়ে যায় না, কিন্তু সেই পড়ন্ত বিকেলে বইয়ের গন্ধওয়ালা দোকানে আমিই ছিলাম তাঁর ফেলে আসা জন্মভূমির স্মৃতিচিহ্ন। আমার সাথে কথা বলতে বলতে তিনি দেশ-কালের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন শৈশবে, একদম তাঁর নিজের দেশে।

সত্যি কথা বলতে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতে ভালোর ঝুড়িটাই ভারী। মারিয়ার গানের শিক্ষিকার সাথে আলাপে জানতে পেরেছিলাম ওনাদের আদি নিবাস ছিল আমাদের গ্রামের একদম কয়েক মাইলের মধ্যে। উনি বলেছিলেন কলকাতাতে বিয়ের কার্ডে পূর্ববঙ্গের লোকেরা নাকি এখনো লিখে...কুমিল্লা জেলার ওমুক পরিবারের, অধুনা কলকাতা নিবাসী তমুকের সাথে...পঞ্চাশ বছর পরেও সেই "দেশ" ধরে টান দেয় মানুষ। মানুষের ভেতর থেকে শৈশবকে বের করা যায় না, আর সেই শৈশবের ভেতরেই রয়ে যায় একটুখানি "দেশ"।

যেটা আগেও বলেছি - ভালোবাসা আর ঘৃণার মধ্যে - ঘৃণা অনেক শক্তিশালী, এর আওয়াজ শোনা যায় অনেক দূর থেকে। দেশের সীমান্ত সে অনায়াসে পাড়ি দিতে পারে। এর বিপরীতে ভালোবাসা স্কুলের ভালো ছাত্রের মতো নিরীহ, ব্যক্তি সীমানার বাইরে এর আওয়াজ মোটামুটি মিনমিনে। মারিয়ার একচিলতে বাগানে মোটাতাজা আগাছা উপড়ানোর সময় আমি আধমরা গোলাপ গাছটার দিকে তাকাই মাঝে মাঝে - নানান যত্ন করার পরেও তাঁর অবস্থা টাইট।  অথচ আগাছাগুলো কি দুর্দান্ত সবুজ, সতেজ স্বাস্থ্য।

দুইদিন আগে নর্থ ক্যারোলিনাতে তিন তরুণ মুসলমানের মৃত্যু হলো। পত্রিকা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, ছেলে-মেয়েগুলো ছিল একদম আদর্শ মানুষ। একটা দেশ ঠিক যেই রকম মানুষ দিয়ে গড়ে উঠে। কিন্তু কোথায় কোন উন্মাদ কি করেছে, সেটার দায় হয়তো এদেরকে দিতে হয়েছে। যদিও বিষয়টা প্রমাণিত নয়, কিন্তু বুঝতে পারি যে আগাছার মতো দ্রুত বেড়ে ওঠা ঘৃণার কিছু নিশ্চয় ভূমিকা আছে। যদিও দেশে মুসলমান মৌলবাদীদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে মুসলমানরাই, কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এদের কর্মকান্ডের দামটাও দিতে হবে মুসলমানদেরকেই। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে এটা পুরোই "নট ফেয়ার"...কিন্তু পৃথিবীটাই বোধকরি "ফেয়ার" নয়।

ঘৃণার আগুন বোমা মেরে নিভানো যায় না। আমি তাই ভালোবাসা দিবসে পক্ষে। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের পরিবারকে ভালোবাসুন, নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবাসুন, নিজের সন্তানদের ভালোবাসুন, সেই সাথে সামান্য কিছু ভালোবাসা রেখে দিন অন্যদের জন্য। এই সামান্য ভালোবাসাটাই অন্যকে দিলে পৃথিবীটা অসামান্য হয়ে উঠতে পারে। গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে ভালোবাসাতে টান পড়ার সম্ভবনা নেই। ঘৃণার সাপ্লাই যেমন অফুরন্ত, ভালোবাসটাও সেই রকম।

ঘৃণার চাষাবাদ রুখে দিতে পারে একমাত্র ভালোবাসা। এর শক্তিটাও কম নয়, একটা সুযোগ দিয়েই দেখুন না।

Wednesday, February 11, 2015

কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে?


 মার্কিন দেশে এক সময় দাস প্রথা ছিল। আফ্রিকা থেকে জাহাজে করে মানুষ ধরে নিয়ে আসা হতো। নির্মম অত্যাচার করা হতো ক্রীতদাসদের উপর। সেই প্রথা উঠে যাওয়ার পরেও ভয়ংকর বর্ণবাদ ছিল। কেউ এইগুলো অস্বীকার করে না। সিভিল রাইটস মুভমেন্টের পরে আইন করে আর মানুষের মধ্যে একটু একটু সচেতনতা তৈরি করে সেই সব বৈষম্য কমিয়ে আনা হয়েছে।

হিটলার ছয় মিলিয়ন ইহুদি হত্যা করেছে। এই কথা কেউ অস্বীকার করে না। আরেকজন হিটলার যাতে তৈরি না হয়, সেই জন্য ইউরোপের দেশে দেশে আইন আছে, নাৎসীবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপটা হচ্ছে সমস্যাটা স্বীকার করতে হবে। এরপরে দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করা যাবে।

আমি বাংলাদেশি কমিউনিটিতে গিয়ে কখনো রাজনৈতিক আলাপ করি না। কিন্তু আমি না করলেও আলাপ শুরু হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করা যায়, কিন্তু কান বন্ধ করা যায় না। বিএনপি আর জামাতের সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে, কিন্তু এই কাজগুলো নাকি বিএনপি অথবা জামাতের না। এইগুলো সবই নাকি আওয়ামী লীগ করছে। এই ছাড়াও আরও অনেক তথ্য পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে জানলাম ৯/১১ মার্কিন সরকারের কাজ। এর আগে একজন জানালেন যে আইসিসও আসলে পশ্চিমাদের এজেন্ট।

মানুষ এতো বলদ বা মূর্খ না। এই অস্বীকার ইচ্ছাকৃত। ৯/১১ বা আইসিস পশ্চিমাদের তৈরি হলে জঙ্গীবাদের সমাধান করার আর প্রয়োজন নেই। আওয়ামী লীগই যদি আগুন দিয়ে মানুষ মারে তাহলে বিএনপিকে জামাতি কলুষতামুক্ত করার কাজটা করার আর দরকার নেই।

অনেক বছর আগে ফুটবলের যাদুকর পেলে তাঁর টিম কসমসকে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন - প্রীতি ম্যাচ খেলতে। পত্রিকাতে পড়েছিলাম, পেলে নাকি প্রথমার্ধে কসমস আর দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিপক্ষের হয়ে খেলেছিলেন। তিনি সেই মাপে পৌঁছে গিয়েছেন, দুই দলের হয়েই খেলে দিতে পারেন।

এই সব বিশ্লেষণ শুনে শুনে আমার মাঝে মাঝে পেলের কথা মনে হয়। আওয়ামী লীগ সম্ভবত পেলের মাপের রাজনীতিতে পৌঁছে গেছে। শিক্ষিত বাংলাদেশিদের কথা অনুযায়ী, বিএনপি মিটিং করছে না, মিছিল করছে না, রাস্তাতেও নেই, আর বাসেও আগুন দিয়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি তাহলে কি করছেটা কি? আওয়ামী লীগই দেখি দুই সাইডে খেলছে।

বিএনপি-জামাত প্রতিদিন পুড়ায়ে মানুষ মারছে। এই সত্য কথাটা বলাটা খুব খুব কঠিন আমাদের জন্য, বিশেষত শিক্ষিত মানুষদের জন্য। কেননা এইটা স্বীকার করলেই বিএনপিকে দূষণমুক্ত করার দরকার পড়বে, জামাত নামক বিষফোঁড়া মুক্ত করার দরকার পড়বে।

ভালোবাসা আর ঘৃণা দুটোই মানুষের একদম মৌলিক অনুভূতি। ভালোবাসা ছোঁয়াচে কিন্তু ঘৃণা অনেক বেশি সংক্রামক এবং এর বিস্তার অনেক সরব। ঘৃণার সড়কে চলাচল দ্বিমুখি - আজকের পৃথিবীতে ঘৃণার সড়কে ট্র্যাফিক জ্যাম লেগে আছে, সেই ভিড় বাড়ছে আস্তে আস্তে। প্রতিদিনই নতুন নতুন জায়গা দখল করেই চলছে ক্রোধ আর প্রতিশোধের আগুন।

কিন্তু সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপটাই পার হতে পারিনি আমরা - নিজের ঘরে কতখানি নোংরা ময়লা আছে সেইটাই স্বীকার করতে পারি না। 

আমরা প্যালেস্টাইনে ইজরাইল মানুষ মারলে হ্যাশট্যাগ দেই, সিরিয়াতে আইসিস মারলে চুপ করে থাকি। মার্কিন দেশে হেইট ক্রাইমে মুসলমান মরলে সরব হই, প্যারিসে পত্রিকা অফিসে গুলি চালালে সেই আওয়াজ না শোনার ভান করি। প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, গায়ের রঙসহ আর যা যা আবজাব আছে সেইগুলো প্রথমে বের করি। আক্রান্ত মানুষগুলোর সাথে আমাদের কোন ঐক্য থাকলে সহমর্মি হই। দিনশেষে তাই আমরা মুসলমান অথবা হিন্দু অথবা বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ, কিন্তু আমরা কেউই মানুষ পরিচয়টা সামনে আনি না।

ঠিক এই কারনেই নিজের দেশে প্রধান বিরোধীদল দিনের পর দিন মানুষ মারলে সেটা এড়ায়ে যাই - পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে বলতে পারি না, এই বর্বরতা বন্ধ হোক।

Thursday, January 1, 2015

গল্পকার

আমি তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। আমাদের বাসার সামনে সাদা রঙের একটা গেট ছিল। যেটার উপরে চড়া যেত। মাটিতে লাথি মেরে ওটাতে চড়ে বসলে মনে হত জাহাজে চড়ে বসেছি। আমি প্রায় দুপুরেই জাহাজ চালাতাম। একদিন সেই কাজ করছিলাম, এই সময়ে এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলা এসে হাজির। পরনে নানের পোষাক। আমাকে খাঁটি বাংলাতে জিজ্ঞেস করলেন - তোমার মা বাসাতে আছে?

আমি জানলাম ভদ্রমহিলার নাম সিস্টার লিওনারা। উনি সম্ভবত হলিক্রস কলেজে কাজ করতেন। আমাদের পাড়াতেই স্কুলটা। আম্মার সাথে মিলে বই লিখবেন। সরকার তখন পুরনো পাঠ্যবই পরিবর্তন করে নতুন বই প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আম্মা ক্লাস থ্রি-এর ইংরেজি বই লিখবেন। বইয়ের নাম "ইংলিশ ফর টুডে"।

এই বই লেখাতে আমার একটা ছোট ভূমিকা ছিল। আম্মা বইটা লেখার সময় মাঝে মাঝে আমাকে পড়ে শুনাতেন, দেখতেন আমি বুঝতে পারছি কিনা। কেননা আমি এবং আমার সমবয়েসিরাই এই বইয়ের পাঠক হবে। আমাদের বইটা বুঝতে হবে।

এই লেখা থেকে মনে হতে পারে আমি ইংরেজিতে নিশ্চয় খুব ভালো ছিলাম। কথাটা পুরোপুরি ভুল। ক্লাস থ্রি-এর ইংরেজিতে পেয়েছিলাম ৩৬, যদিও আমার নিজের মা-ই সেই বইয়ের লেখক। আম্মা ক্লাস ফাইভের ইংরেজি বইয়ের অনেকটাই লিখেছিলেন, ওটাতেও আমার ফলাফল প্রায় কাছাকাছিই ছিল। এর পেছনে একটা কারন ছিল। আম্মার ধারণা ছিল বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বেশি চাপাচাপি করতে হয় না। এতে পড়ার আগ্রহ নাকি কমে যেতে পারে। সুতরাং পড়ার আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি পড়াশোনা থেকে অনেক দূরত্বে থাকতাম।

আম্মার দ্বিতীয় থিওরি ছিল যে - নিচু ক্লাসে পড়ার চাপ না থাকলে বড় হয়ে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। এটার কিছু বাস্তব প্রমাণ আমি পেয়েছি। ক্লাস নাইন থেকে আমি পড়াতে মনোযোগী হই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ পর্যন্ত আমার আগ্রহ ছিল - দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পরে আমি আবার ক্লাস থ্রি মোডে চলে যাই। ইঞ্জিনিয়ারিং এর লেখাপড়া আমার অপছন্দ ছিল। এই শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পরও আমার কোন আগ্রহ জন্মে নি। এখনও নেই।

আম্মা অনেক পাঠ্যবই লিখেছেন। অনেক কারিকুলাম তৈরির কাজ করেছেন, স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের জন্য ম্যানুয়েল লিখেছেন। এই সবই ছিল তাঁর পেশাগত কাজ।

এর বাইরেও তাঁর অসাধারণ একটা দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন অসামান্য গল্পকথক। তিনি মুখে মুখে গল্প বানিয়ে বলতেন। গল্পলেখক না বলে গল্পকথক বলতে হচ্ছে কেননা তিনি কোনদিন সেই সব মুখে মুখে বলা গল্প লেখার চেষ্টা করেন নি। বেশি লিখলে হাতে ব্যথা করে। অকাট্য যুক্তি।

আম্মা একটা গল্প বলেছিলেন যেটার নায়িকা ছিলেন তিনি নিজেই। তাঁর বাস ছিল পরীদের দেশে - সেখানে নানান ঘটনা ঘটে, শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেই দেশ থেকে এই মানুষের পৃথিবীতে নির্বাসন নিতে হয়। পরীদের দেশের মেয়েদের পায়ের পাতা ছোট হয়, গল্পের শেষে তিনি প্রমাণ দিয়ে দেন যে তিনি আসলেই ওই দেশ থেকে এসেছেন। গল্পটা শুনে আমার খুবই দুঃখ হয়েছিল, মনে হয়েছিল, এতোসব গ্যাঞ্জাম না হলে আমিও ওই দেশে থাকতাম, এতো এতো পড়াশোনা করতে হতো না।

 এই গল্পের একটা মারমেইড ভার্সান আমি আমার মেয়েকে শুনিয়েছি। সেইখানে আমিই নায়ক। আমাকে বাধ্য হয়ে মারমেইডদের দেশ ছাড়তে হয়, আমার নিবাস ছিল বেগুনবাড়ি খাল অর্থাৎ যেটার বর্তমান নাম হাতিরঝিল। এই গল্প শুনে আনুশারও খুব দুঃখ হয়েছিল, মারমেইডদের দেশ বাধ্য ছেড়ে আসাটা সম্পূর্ণ "নট ফেয়ার" একটা ঘটনা - কেননা আনুশার মারমেইড হওয়ার খুবই শখ।

ডিসেম্বর মাসে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলাম। ছোটবড় সবারই হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে সেইখানে। ওয়াল্ট ডিজনির কল্পনা ছিল সেই সাথে সাথে ব্যবসার বুদ্ধিও ছিল। এই দুইয়ের সংমিশ্রন সাধারণত পাওয়া যায় না, কল্পনাপ্রবণ মানুষেরা সাধারণত ব্যবসা ভালো বুঝে না। কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনি বুঝতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান চাইলে যে কোন কিছু সম্ভব করতে পারে। ডিজনি চলচ্চিত্র দেখেও তা-ই মনে হয়।

কিন্তু কল্পনা করতে শেখাটাও একটা বড় গুণ, যেটা অর্জন করতে হয়। সেটা করতে গেলে প্রচুর বই পড়তে হয়, মাথার ভেতরে সিনেমা তৈরি করতে হয়, নিজেকেই সত্যজিৎ রায় হতে হয়। ডিজনির বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ ওইখানেই, ভদ্রলোকের প্রতিষ্ঠান শিশুদের জন্য কল্পনার রাজ্য তৈরি করে দিয়ে তাদের কল্পনার ধারটা সম্ভবত কমিয়ে দিচ্ছে। উনি তৈরি না করলে হয়ত প্রতিটি শিশুই নিজেরা একেকজন পিটার প্যান চলচ্চিত্র তৈরি করতো মাথার ভেতর।

আমার মা এই দেশে জন্ম নিলে অনায়াসে নাম করা শিশু সাহিত্যিক হতে পারতেন বলেই আমার মনে হয়। ডিজনিতে গিয়ে আমি বুঝলাম, ছোটবেলাতে মুগ্ধ হয়ে শোনা সেই সব গল্প আমার মনের কল্পনার রাজ্যের দরজাগুলো খুলে দিয়েছে, আমাকে চিন্তা করতে শিখেয়েছে, আমাকে ভাবিয়েছে। আমার নতুন করে উপলব্ধি হলো, সারা জীবনে একটি গল্পের বই না লিখেও আমার মা আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পকার - আমার দুঃসময় পাড়ি দেওয়ার জাহাজের রূপকার।