আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ভালোবাসা দিবস বলে কিছু ছিল না - মানে বাংলাদেশে পালন হতো না এই দিবস। আমরা কেউ কোনদিন অনুভব করি নি যে ভালোবাসার জন্য একটা দিবস লাগবে। আমি এই দিবসের বিরুদ্ধে না। সত্যি কথা বলতে বর্তমান পৃথিবীর অবস্থা দেখে আমার মনে হয় ভালোবাসার জন্য একটা দিবস বরাদ্দ রাখাটা খুবই জরুরী। টিভির নিউজে অথবা পত্রিকাতে খবর পড়লে পৃথিবীর যেই চিত্রটা দেখতে পাই সেটাতে ভালোবাসার কণামাত্র থাকে না। পৃথিবী জুড়ে ক্রোধ এবং ঘৃণার বাম্পার ফলন হচ্ছে। ঘৃণার চাষাবাদ প্রায় সব জায়গাতেই হয় এবং আগাছার মতো সে বেড়েই চলছে। ঘৃণা যদি আগাছা হয় তাহলে ভালোবাসা নিশ্চিতভাবে খুব পরিপাটি বাগান - যারা গাছপালা লাগান, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে ফুল বাঁচানো পরিশ্রমের কাজ এবং আগাছা উৎপাটন আরো কঠিন কাজ।
"ডিসপ্লেসমেন্ট অফ অ্যাঙ্গার" বলে একটা ব্যাপার আছে। আমার দক্ষিণ ভারতীয় এক সহকর্মী বন্ধু ছিল। নাম ছিল রাহুল। রাহুলের অফিস রুম আমার অফিসের খুব কাছেই ছিল, নানান আলাপ হতো ওর সাথে। ওর কাছে ওর এক প্রতিবেশী বাঙালি ভদ্রলোকের গল্প শুনতাম, কলকাতার লোক। রাহুল আমাকে অনেকবার বলেছে সে আমাকে বাঙালি দাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। রাহুলের বাচ্চার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেই সুযোগ এসে গেল।
জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পরে ভদ্রলোক একটা বিরক্ত "লুক" দিলেন, ওর দেহের ভাষাতে অপছন্দ ফুট উঠছিল, আমার সাথে কথাও হলো ইংরেজিতে। জানলাম দেশ বিভাগের আগে উনারা পূর্ববঙ্গেই থাকতেন। ওনারা পূর্ব পুরুষেররা দেশ বিভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছেন। সম্ভবত সেই ক্রোধ পরিবারে রয়ে গেছে, বংশানুক্রমিকভাবে উনিও হয়ত পেয়েছেন। উনারা পরিবারের দেশত্যাগের পেছনে আমার কোন হাত না থাকলেও আমারই কোন দূরবর্তী জাতভাই ষাট বছর আগে যেই ইতরামি করে ওনাদের বিতাড়িত করেছিল, সেই ক্রোধের ধারাবাহিকতার কিছু অংশ আমাকে দেখে উনার হয়ত চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারলাম যে উনি আমাকে পছন্দ করছেন না। রাহুলও বুঝতে পেরেছিল এবং বিব্রত হয়েছিল।
টুকটাক আলাপের পরে আর কথা বাড়াইনি। উনারা সাথে আমার কোন বিরোধ নেই, আমরা বর্তমানে একই দেশের লোক বলা যায়। কিন্তু পৃথিবীতের যেই ঘৃণার চাষাবাদ চলে তার ফসল সোমালিয়া থেকে আমেরিকা সর্বত্রই পৌঁছে যায়, একটু ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে আরকি। বেকুব হলেও এটা আমি জানি, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে জন্ম নেওয়াটাই মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ।
ঘৃণার চাষাবাদের মতো কি ভালোবাসার চাষবাস করা যায়? এর বিপরীত চিত্রও দেখেছি। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসের এক বিকেলে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানদার যখন জানতে পারলেন আমি ঢাকার, তিনি আপ্লুত হয়ে গেলেন। তাঁর পরিবারও পূর্ববঙ্গের, বরিশাল থেকে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারি যে নিজ বাসভূম মানুষ স্বেচ্ছাতে ছেড়ে যায় না, কিন্তু সেই পড়ন্ত বিকেলে বইয়ের গন্ধওয়ালা দোকানে আমিই ছিলাম তাঁর ফেলে আসা জন্মভূমির স্মৃতিচিহ্ন। আমার সাথে কথা বলতে বলতে তিনি দেশ-কালের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন শৈশবে, একদম তাঁর নিজের দেশে।
সত্যি কথা বলতে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতে ভালোর ঝুড়িটাই ভারী। মারিয়ার গানের শিক্ষিকার সাথে আলাপে জানতে পেরেছিলাম ওনাদের আদি নিবাস ছিল আমাদের গ্রামের একদম কয়েক মাইলের মধ্যে। উনি বলেছিলেন কলকাতাতে বিয়ের কার্ডে পূর্ববঙ্গের লোকেরা নাকি এখনো লিখে...কুমিল্লা জেলার ওমুক পরিবারের, অধুনা কলকাতা নিবাসী তমুকের সাথে...পঞ্চাশ বছর পরেও সেই "দেশ" ধরে টান দেয় মানুষ। মানুষের ভেতর থেকে শৈশবকে বের করা যায় না, আর সেই শৈশবের ভেতরেই রয়ে যায় একটুখানি "দেশ"।
যেটা আগেও বলেছি - ভালোবাসা আর ঘৃণার মধ্যে - ঘৃণা অনেক শক্তিশালী, এর আওয়াজ শোনা যায় অনেক দূর থেকে। দেশের সীমান্ত সে অনায়াসে পাড়ি দিতে পারে। এর বিপরীতে ভালোবাসা স্কুলের ভালো ছাত্রের মতো নিরীহ, ব্যক্তি সীমানার বাইরে এর আওয়াজ মোটামুটি মিনমিনে। মারিয়ার একচিলতে বাগানে মোটাতাজা আগাছা উপড়ানোর সময় আমি আধমরা গোলাপ গাছটার দিকে তাকাই মাঝে মাঝে - নানান যত্ন করার পরেও তাঁর অবস্থা টাইট। অথচ আগাছাগুলো কি দুর্দান্ত সবুজ, সতেজ স্বাস্থ্য।
দুইদিন আগে নর্থ ক্যারোলিনাতে তিন তরুণ মুসলমানের মৃত্যু হলো। পত্রিকা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, ছেলে-মেয়েগুলো ছিল একদম আদর্শ মানুষ। একটা দেশ ঠিক যেই রকম মানুষ দিয়ে গড়ে উঠে। কিন্তু কোথায় কোন উন্মাদ কি করেছে, সেটার দায় হয়তো এদেরকে দিতে হয়েছে। যদিও বিষয়টা প্রমাণিত নয়, কিন্তু বুঝতে পারি যে আগাছার মতো দ্রুত বেড়ে ওঠা ঘৃণার কিছু নিশ্চয় ভূমিকা আছে। যদিও দেশে মুসলমান মৌলবাদীদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে মুসলমানরাই, কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এদের কর্মকান্ডের দামটাও দিতে হবে মুসলমানদেরকেই। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে এটা পুরোই "নট ফেয়ার"...কিন্তু পৃথিবীটাই বোধকরি "ফেয়ার" নয়।
ঘৃণার আগুন বোমা মেরে নিভানো যায় না। আমি তাই ভালোবাসা দিবসে পক্ষে। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের পরিবারকে ভালোবাসুন, নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবাসুন, নিজের সন্তানদের ভালোবাসুন, সেই সাথে সামান্য কিছু ভালোবাসা রেখে দিন অন্যদের জন্য। এই সামান্য ভালোবাসাটাই অন্যকে দিলে পৃথিবীটা অসামান্য হয়ে উঠতে পারে। গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে ভালোবাসাতে টান পড়ার সম্ভবনা নেই। ঘৃণার সাপ্লাই যেমন অফুরন্ত, ভালোবাসটাও সেই রকম।
ঘৃণার চাষাবাদ রুখে দিতে পারে একমাত্র ভালোবাসা। এর শক্তিটাও কম নয়, একটা সুযোগ দিয়েই দেখুন না।
"ডিসপ্লেসমেন্ট অফ অ্যাঙ্গার" বলে একটা ব্যাপার আছে। আমার দক্ষিণ ভারতীয় এক সহকর্মী বন্ধু ছিল। নাম ছিল রাহুল। রাহুলের অফিস রুম আমার অফিসের খুব কাছেই ছিল, নানান আলাপ হতো ওর সাথে। ওর কাছে ওর এক প্রতিবেশী বাঙালি ভদ্রলোকের গল্প শুনতাম, কলকাতার লোক। রাহুল আমাকে অনেকবার বলেছে সে আমাকে বাঙালি দাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। রাহুলের বাচ্চার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেই সুযোগ এসে গেল।
জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পরে ভদ্রলোক একটা বিরক্ত "লুক" দিলেন, ওর দেহের ভাষাতে অপছন্দ ফুট উঠছিল, আমার সাথে কথাও হলো ইংরেজিতে। জানলাম দেশ বিভাগের আগে উনারা পূর্ববঙ্গেই থাকতেন। ওনারা পূর্ব পুরুষেররা দেশ বিভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছেন। সম্ভবত সেই ক্রোধ পরিবারে রয়ে গেছে, বংশানুক্রমিকভাবে উনিও হয়ত পেয়েছেন। উনারা পরিবারের দেশত্যাগের পেছনে আমার কোন হাত না থাকলেও আমারই কোন দূরবর্তী জাতভাই ষাট বছর আগে যেই ইতরামি করে ওনাদের বিতাড়িত করেছিল, সেই ক্রোধের ধারাবাহিকতার কিছু অংশ আমাকে দেখে উনার হয়ত চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারলাম যে উনি আমাকে পছন্দ করছেন না। রাহুলও বুঝতে পেরেছিল এবং বিব্রত হয়েছিল।
টুকটাক আলাপের পরে আর কথা বাড়াইনি। উনারা সাথে আমার কোন বিরোধ নেই, আমরা বর্তমানে একই দেশের লোক বলা যায়। কিন্তু পৃথিবীতের যেই ঘৃণার চাষাবাদ চলে তার ফসল সোমালিয়া থেকে আমেরিকা সর্বত্রই পৌঁছে যায়, একটু ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে আরকি। বেকুব হলেও এটা আমি জানি, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে জন্ম নেওয়াটাই মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ।
ঘৃণার চাষাবাদের মতো কি ভালোবাসার চাষবাস করা যায়? এর বিপরীত চিত্রও দেখেছি। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসের এক বিকেলে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানদার যখন জানতে পারলেন আমি ঢাকার, তিনি আপ্লুত হয়ে গেলেন। তাঁর পরিবারও পূর্ববঙ্গের, বরিশাল থেকে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারি যে নিজ বাসভূম মানুষ স্বেচ্ছাতে ছেড়ে যায় না, কিন্তু সেই পড়ন্ত বিকেলে বইয়ের গন্ধওয়ালা দোকানে আমিই ছিলাম তাঁর ফেলে আসা জন্মভূমির স্মৃতিচিহ্ন। আমার সাথে কথা বলতে বলতে তিনি দেশ-কালের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন শৈশবে, একদম তাঁর নিজের দেশে।
সত্যি কথা বলতে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতে ভালোর ঝুড়িটাই ভারী। মারিয়ার গানের শিক্ষিকার সাথে আলাপে জানতে পেরেছিলাম ওনাদের আদি নিবাস ছিল আমাদের গ্রামের একদম কয়েক মাইলের মধ্যে। উনি বলেছিলেন কলকাতাতে বিয়ের কার্ডে পূর্ববঙ্গের লোকেরা নাকি এখনো লিখে...কুমিল্লা জেলার ওমুক পরিবারের, অধুনা কলকাতা নিবাসী তমুকের সাথে...পঞ্চাশ বছর পরেও সেই "দেশ" ধরে টান দেয় মানুষ। মানুষের ভেতর থেকে শৈশবকে বের করা যায় না, আর সেই শৈশবের ভেতরেই রয়ে যায় একটুখানি "দেশ"।
যেটা আগেও বলেছি - ভালোবাসা আর ঘৃণার মধ্যে - ঘৃণা অনেক শক্তিশালী, এর আওয়াজ শোনা যায় অনেক দূর থেকে। দেশের সীমান্ত সে অনায়াসে পাড়ি দিতে পারে। এর বিপরীতে ভালোবাসা স্কুলের ভালো ছাত্রের মতো নিরীহ, ব্যক্তি সীমানার বাইরে এর আওয়াজ মোটামুটি মিনমিনে। মারিয়ার একচিলতে বাগানে মোটাতাজা আগাছা উপড়ানোর সময় আমি আধমরা গোলাপ গাছটার দিকে তাকাই মাঝে মাঝে - নানান যত্ন করার পরেও তাঁর অবস্থা টাইট। অথচ আগাছাগুলো কি দুর্দান্ত সবুজ, সতেজ স্বাস্থ্য।
দুইদিন আগে নর্থ ক্যারোলিনাতে তিন তরুণ মুসলমানের মৃত্যু হলো। পত্রিকা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, ছেলে-মেয়েগুলো ছিল একদম আদর্শ মানুষ। একটা দেশ ঠিক যেই রকম মানুষ দিয়ে গড়ে উঠে। কিন্তু কোথায় কোন উন্মাদ কি করেছে, সেটার দায় হয়তো এদেরকে দিতে হয়েছে। যদিও বিষয়টা প্রমাণিত নয়, কিন্তু বুঝতে পারি যে আগাছার মতো দ্রুত বেড়ে ওঠা ঘৃণার কিছু নিশ্চয় ভূমিকা আছে। যদিও দেশে মুসলমান মৌলবাদীদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে মুসলমানরাই, কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এদের কর্মকান্ডের দামটাও দিতে হবে মুসলমানদেরকেই। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে এটা পুরোই "নট ফেয়ার"...কিন্তু পৃথিবীটাই বোধকরি "ফেয়ার" নয়।
ঘৃণার আগুন বোমা মেরে নিভানো যায় না। আমি তাই ভালোবাসা দিবসে পক্ষে। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের পরিবারকে ভালোবাসুন, নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবাসুন, নিজের সন্তানদের ভালোবাসুন, সেই সাথে সামান্য কিছু ভালোবাসা রেখে দিন অন্যদের জন্য। এই সামান্য ভালোবাসাটাই অন্যকে দিলে পৃথিবীটা অসামান্য হয়ে উঠতে পারে। গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে ভালোবাসাতে টান পড়ার সম্ভবনা নেই। ঘৃণার সাপ্লাই যেমন অফুরন্ত, ভালোবাসটাও সেই রকম।
ঘৃণার চাষাবাদ রুখে দিতে পারে একমাত্র ভালোবাসা। এর শক্তিটাও কম নয়, একটা সুযোগ দিয়েই দেখুন না।
No comments:
Post a Comment