Tuesday, August 31, 2021

যীশু

প্রায়দিনই দরজার সামনে যীশুর আহবান রাখা থাকে। উনি সব সময়েই ইহকাল এবং পরকালের উন্নতি আর আলোর পথে আসার নানান সার্ভিস অফার করেন। ধর্মের সাথে বাজার ব্যবস্থা সম্পর্ক অনেক পুরানো। যীশুর সার্ভিস নিতে গেলেও পকেটের পয়সা খরচ হবে দেখে কোন দিন তার ডাকে সাড়া দেই নি। আজকে একটু ব্যতিক্রম দেখলাম। আজকে দরজার সামনের ফ্লায়ারে জেসাস গাছ কাটার জন্য ১৫% ছাড় দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে যীশুর অন্য কোন বাণীতে আমি এতোটা আপ্লুত হইনি। এইবার সত্যি সত্যি ওনাকে ফোন দিতে পারি। ইহকাল আর পরকাল ঠিক করার বহু বহু ব্যবস্থা থাকলে কম খরচে গাছ কাটার লোক পাওয়া কঠিন।


যীশু প্রসঙ্গে মনে পড়ল - বহুদিন আগে আমরা ৩ বন্ধু একই বাসায় থাকতাম। এর মধ্যে রুমি ছিল ধার্মিক। প্রায়ই রাতে সে ব্লকব্লাস্টার থেকে ধর্মীয় সিনেমা নিয়ে আসতো। নবী রসুলদের জীবনী নিয়ে করা। ইসলাম ধর্ম আর খৃষ্ট ধর্মের নবী রসুল প্রায় একই। সুতরাং মার্কিনি ধর্মীয় সিনেমা কার্যত আমাদের ধার্মিকদের জন্যেও প্রযোজ্য।

রাতে বাসায় ফিরে পানীয় পান করতে করতে আমরা রুমিকে জিজ্ঞেস করতাম - আজকে কোন নবী দোস্ত?

একদিন ইউসুফ নবীর সিনেমা দেখলাম। কাহিনি আমরা যা পড়েছি ঠিক সেই রকমই। সিনেমার শেষে ধর্মীয় গুরুগম্ভীর আলোচনাও হত। নিজে পান না করলেও আমাদের পানীয়তে রুমি বাঁধা দিতো না কদাচও।

রুমির কাছে শুনেছিলাম যে যীশু নাকি আবার ফিরে আসবেন। অস্থির এই পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য তিনি ফিরবেন সিরিয়াতে - দামেস্ক শহরে। ১৫ বছর আগে সিরিয়াতে যুদ্ধ শুরু হয় নি। মার্কিন দেশ মধ্যপ্রাচ্যের বারোটা বাজানোর জন্য ইরাক আর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে। ইংরেজিতে যেটাকে বলে গাং-হো - জাতীয়তাবাদ ঠিক সেই পর্যায়ে আছে। ফ্রান্স আর জার্মানি ইরাক যুদ্ধের বিরোধীতা করাতে কংগ্রেস ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজের নাম পালটিয়ে ফ্রিডম ফ্রাইজ করে দিয়েছে। ফরাসী চুম্বন (ফ্রেঞ্চ কিস) বিষয়ে অবশ্য কবি নীরব। সেটার নাম পালটায় ফ্রিডম কিস করা হয় নাই। জাতীয়তাবাদের চেয়ে বিপদজ্জনক অসুখ এই পৃথিবীতে আর দু'টি নেই।

সিরিয়াতে যীশু ফিরবেন শুনে আমার একটু দুঃখ লাগলো। আমি রুমিকে বললাম - যীশুকে তো মার্কিন দেশ ভিসা দিতে চাবে না। যীশু দেখতেও মধ্যপ্রাচ্যীয় হবেন (আসল যীশুও তা-ই ছিলেন), তার কপালে বহু খারাপি আছে। সকাল বিকালে যীশুর নাম জপা লোকজনও তাকে সন্ত্রাসী বলে ডাকবে। তাছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যসহ বাকি পৃথিবীতে শান্তি আনতে গেলে তো গণতন্ত্র আর শান্তির সোল এজেন্ট মার্কিনিরা ক্ষেপে যাবে।

প্রশ্নটা অমীমাংসিত রেখেই সেই আলোচনা বন্ধ করতে হয়েছে।

১৬ বছর পরে এখনো আমি মাঝে মাঝে যীশুর পুনর্জন্ম নিয়ে ভাবি। সিরিয়ার অবস্থা আরো টাইট। এখন ওখানে ফিরলে তাকে শরনার্থী হয়ে ইউরোপেও যেতে হতে পারে। সেখানে অনেক যীশুভক্তের লাথি আর গুঁতো অপেক্ষা করছে তার জন্য। ঈশা নাম নিয়ে তিনি নানাবিধ সমস্যাতে থাকবেন। তার পুর্নজন্ম পূর্বের জন্মের চেয়ে সুখের হবে না। আর এই ফ্লায়ারটা যেই যীশু রেখেছে (মেক্সিকান কোম্পানি, এই সব সার্ভিস ওরাই দেয় মূলত - Jesus এর উচ্চারণ হওয়া উচিত হিসুস) সেই জেসাসরাও কম ঝক্কি পোহাচ্ছে না এই দেশে ঢুকতে। Jesus নাম মেক্সিকোতে বেশ পপুলার। আমরা যেমন মোহাম্মদ রাখি নামের সামনে। মার্কিনিরা যীশুকে ডাকলেও যীশুর নামের মানুষ খুব বেশি দেখি নি।

আমার কৃতকর্মের জন্য ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করে দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু আমার উঠোনের বেয়াড়া হয়ে ওঠা গাছ উনি কাটবেন না এটা নিশ্চিত বলা যায়। অচিরেই গাছকর্তক যীশুকে ফোন দেব। নইলে দেখা যাবে এই যীশুও পলাতক। 





Friday, August 27, 2021

গরম ভাত ও নিছক চোরের গল্প

"আনুশা দুই কাপ চাল বের করে ধুয়ে বসায়ে দাও..."

আনুশাকে কিছু কাজকর্ম শেখানো হচ্ছে। ইংরেজিতে এদেরকে বলে - Chore। বাংলা চোর আর আর ইংরেজি চোরের তফাৎ অনেক। আমাদের দেশে প্রচুর চোর থাকলেও শৈশবে বাচ্চাদের Chore করতে হয় না।
যাই হোক এই "চৌরকর্মে" আনুশার অনীহা প্রবল। ছুটির দিনে সে বিছানা ছাড়তে চায় না। দুপুরবেলা পার করে ঘুম থেকে উঠে উদ্ভ্রান্ত মুখে ঘোরাঘুরি করে। আমিও যখন ছোট ছিলাম তখন সুযোগ পেলে সারাদিন ঘুমাতাম। এখন সেই সু্যোগও নেই, সেইরকম ঘুম দেওয়ার মতো স্টকও নেই ঘুমের।
"হোয়াট ইজ চাল আব্বু?" আনুশার বিস্মিত প্রশ্ন।
আমি এইবার বিস্মিত হই।
"চাল মানে হচ্ছে যেটা সিদ্ধ করলে ভাত হয়, যেই ভাত আমরা খাই..."
"তাহলে কথাটা হবে দুই কাপ ভাত বের করে বসায়ে দাও..."
"ভাত বের করলে তো আর সেটা বসাতে হবে না, ভাতটাই হচ্ছে ফিনিশড প্রোডাক্ট, চাল হচ্ছে সেটার কাঁচা রূপ..."
"দিজ ইজ স্ট্রেইঞ্জ...ভাত রান্না না করলে সেটাকে চাল বলে? ইজন্ট ইট উইয়ার্ড? ইংরেজিতে তো দুটোকেই রাইস বলে।"
আমি দমে গেলাম। ওরে সবুজ, ওরে আমার কাঁচা - কাঁচা চাল দিয়ে এই রকম চাল চালা যায় ভাবিনি।
"হোয়াই ইজ বাংলা লাইক দ্যাট?"
"মানে?"
ইতিমধ্যে আনুশার চৌরকর্ম আমিই শুরু করে দিয়েছি। চাল ধুতে ধুতে চিন্তা করছি আর কোন উদাহরণ আছে কিনা, রান্না না করলে এক নাম রান্না করার পরে আরেক নাম।
এমনই সময়ে দ্বিতীয় প্রশ্নবান উড়ে আসে।
"তোমরা কোক-টোক চাও, চা-টা চাও, হোয়াট ইজ টোক, হোয়াট ইজ টা?"
আনুশার ভাষাতে আমি "ভাত" ধুয়ে পরিস্কার করে পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলাম, উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাত রান্না। দ্বিতীয় প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত হই। কোক-টোক মানে সম্ভবত শুধু কোক নয়, কোকের কাছাকাছি পানীয়ও ইনক্লুডেড - ফান্টা আর পেপসিকেও "টোক" দিয়ে প্রকাশ করা যায়।
আনুশা এর মধ্যেই বাংলাকে জটিল ভাষা ঘোষণা করে নিজের রুমে চলে গেছে - বাংলা খুব কঠিন ভাষা, হাইস্কুলের জ্যামিতিও এরচেয়ে সোজা।

Thursday, August 26, 2021

পথচলা

আনুশা স্কুল অপছন্দ করতো। শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে আনুশা হারমনি স্কুলে যেত। হারমনি স্কুলের অনেক সুনাম। কিন্তু আনুশার পছন্দ হয় নি। নিয়ম কানুন খুব কড়া, স্কুলের একটা ড্রেস আছে। খেলার জায়গা সীমিত। আনুশার লেজে লেজে সামারারও লেখাপড়ার শুরু একই স্কুলে। বোনের মতো তারও স্কুল অপছন্দ।


একদিন আমি হারমনি স্কুলের পার্কিং লট গাড়ি পার্ক করছি, ওদের অফিসে কি একটা কাজ আছে। স্কুলের মাঠ থেকে আনুশা আমাকে দেখতে পেল। সে দৌড়ে ছুটে এলো, বেড়ার ভেতর দিয়ে ছোট হাতটা দিয়ে আমার আঙ্গুল ধরল। আমাকে দেখে আনুশা খুশি, ও ভেবেছে আমি ওকে বাসায় নিয়ে যাবো। আনুশার মন খারাপ ছিল, একদম পাশে দাঁড়িয়ে আছে টার্কিশ মেয়ে মেরিয়াম, আনুশার হারমনি জীবনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। আনুশার মন খারাপ হলে সে আনুশাকে স্বান্তনা দেওয়ার কাজটা করত। সেইদিন আমি আনুশা স্কুল থেকে বাসায় নিতে আসি নি। মন খারাপ অবস্থাতে মেয়েটাকে রেখে এসেছিলাম।

এর কিছুদিন পরে স্কুলের অফিস থেকে আনুশার ফোন। ওকে বলা ছিল স্কুলে যদি কোন অসুবিধে হয় তাহলে যেন আমাকে ফোন দেয়। আনুশার মন খারাপ লাগছিলো, সে বাসাতে যেতে চায়। আমি এইবার আর ভুল করলাম না। ওকে দ্রুত বাসাতে নিয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে ঠিক করলাম, হারমনি স্কুল আর না। স্কুলের উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন, কিন্তু সেটা একমাত্র উদ্দেশ্য না। হারমনি স্কুল ছেড়ে আনুশা আর সামারা দুইজনই আবার পাব্লিক স্কুলে ফেরত এলো। দুই বোনই বিস্তর খুশি হয়েছিল।

আমি সারাজীবন পাব্লিক স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটিতে পড়েছি। যেই পৃথিবীতে আমরা বাস করি, সেই পৃথিবীর ছোটখাটো স্যাম্পল দেখতে হলে পাব্লিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে ভালো। পাব্লিক স্কুলে ফেরার পরে আনুশা আর কোন দিন ফোন করেনি, আমাকে স্কুলে দেখার পরেও বাড়ি ফিরতে চায় নি। দুই বোনই এরপরে স্কুলকে পছন্দ করা শুরু করেছে। আনুশা এলিমেন্টারি স্কুল শেষ করেছে, মিডল স্কুল শেষ করেছে, এই গত সপ্তাহে হাই স্কুলের প্রথম ক্লাস, যেটাকে ফ্রেশম্যান ইয়ার বলে, সেটাও শেষ করল। সামারা এলিমেন্টারি স্কুল শেষ করেছে, মিডল স্কুলের সপ্তম শ্রেণী শেষ করল। আর তিনমাস পরে ক্লাস টেন আর এইট শুরু হবে দুই বোনের।

অন্য সব কাজের মতো শিক্ষাটাও আনন্দময় পরিবেশে হলে সেটার ফলাফল ভালো হতে বাধ্য। আমার ক্ষেত্রে এটা সত্য, আমার মেয়েদের জন্যও সত্য। আনুশা আর সামারা দুইজনেই খুব ভালো ফলাফল করেছে, আনন্দ নিয়ে স্কুলে গেছে, ঝুড়ি ঝুড়ি এওয়ার্ড পেয়েছে, ন্যাশানাল অনার সোসাইটিতে যোগ দিতে পেরেছে। হাইস্কুলে আনুশা এডভান্সড কোর্স নিয়েছে, মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে এবং তার ফলাফলও পেয়েছে। এরপরেও স্কুলে যাওয়া কোনদিন নিরানন্দময় মনে হয় নি।

গত মার্চ মাসের ১২ তারিখের পর আর স্কুল যেতে হয় নি - তিন সপ্তাহ ছুটির পরে ডিস্ট্যান্ট লার্নিং শুরু হয়েছে স্কুলগুলোতে। সেখানেও বেশ চাপের মধ্যেই ছিল দুই বোন। যেই মেয়েরা স্কুল যেতে চাইতো না, তারাই এই দীর্ঘ বন্ধে স্কুলকে মিস করছে, মনে প্রাণে চাইছে যেন স্কুল খুলে যাক। আমরাও তাই চাইছি। আবারও আমি টের পাচ্ছি যে স্কুল শুধু পড়ালেখার জায়গা না। এতো বছর পরে আমি যখন আমি আমার স্কুলের কথা ভাবি তখন আমার বন্ধুদের কথা মনে হয়, মনে হয় স্কুলের বিশাল মাঠটার কথা - লেখাপড়ার কথা আমার মনেই পড়ে না। স্কুলের কথা মনে হলেই আমার মনে হয় এক অবাধ ছুটির সময়।

আমার দুটো মেয়ে আরও একটি ধাপ পেরিয়ে গেল। সব ঠিক থাকলে আনুশার স্কুলের পাঠ চুকে যাবে তিন বছর পরে, সামারার আর পাঁচ বছর। আমি চাই ওরা ওদের স্কুলের সময়টা আনন্দে শেষ করুক – সকালের বাস ধরে ঘুম ঘুম চোখে স্কুলে যাক, সারাদিন ক্লাস শেষে ঘরে ফিরুক ক্লান্ত হয়ে, এরই মাঝে চলুক বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্প আর হই হুল্লোড়।

আমরা সবাই যে সুখে ছিলাম সেটা এই অসুখের সময়ে আরও বেশি বেশি বুঝতে পারছি। আশাকরি এই দুঃসময়ের অবসান হবে, আনুশা সামারাসহ এই পৃথিবী লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোর ফিরতে পারবে স্কুলে। সবার পথাচলা হোক বাধাঁহীন।







জনান্তিকে

 আব্বাকে আমি মাঝে মধ্যে স্বপ্নে দেখি। গত সপ্তাহেও দেখেছি। দেখেছি যে - হন্তদন্ত হয়ে ট্রেন ধরতে যাচ্ছি, স্টেশনে গিয়ে দেখি আব্বাও উপস্থিত। আব্বাকে কোথাও দেখলে আমার টেনশন কমে যায়। স্বপ্নেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমার জীবনের প্রথম ২৫ বছর কেটে গেছে তাঁর ছায়াতে। তিনি সর্বত্রই উপস্থিত ছিলেন আমার সাথে - হাসপাতালের অপরেশন থিয়েটারের বাইরে (সম্ভব হলে ভেতরেও থাকতেন), প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দাতে, ঢাকা কলেজের করিডরে, ল্যাবরেটরি স্কুলের গেটে, আমার শৈশবের আলিন্দে।


সত্যি কথা বলতে এক সময়ে ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী উঠতাম আমার জীবনে তাঁর সর্বব্যাপী উপস্থিতিতে। ১৯৯৬ সালের অগাস্ট মাসে সুযোগ এসে গেল। আব্বাকে এয়ারপোর্টে রেখে আমি পাড়ি দেই দূরদেশে। এরপরে প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেছে। আমি একাই হেঁটে বেড়িয়েছি এই পৃথিবীতে, পাহাড়ে উঠেছি, পাতালে নেমেছি, পরীক্ষাতে পাশ করেছি, চাকরি পেয়েছি, চাকরি হারিয়েছি, সুখ দুঃখ বিষাদও পেয়েছি - এই পৃথিবীর যা যা অনুষঙ্গ ছিল সবই স্পর্শ করেছি। আমার জীবনে তিনি দর্শকের আসনে বসে গেলেন।

এখন তিনি আর উপস্থিত নন কোথাও, কোনও দেশে তিনি নেই, নতুন কোন গল্পে তিনি আর নেই, নেই নতুন তোলা কোন ছবিতে, এই ত্রিভুবনের কোথাও তিনি আর নেই। এরপরেও তিনি রয়ে গেছেন অনেকখানিই – আমার বিষণ্ণতা, আনন্দে, দুঃখে, গল্পে, ভোররাতে দেখা স্বপ্নে, যার রেশটা রয়ে যায় সারাদিন। সবিস্ময়ে আমি তার উপস্থিতি টের পাই, তিনি যেন রয়ে গেছেন জনান্তিকে।



অখন্ড অবসর

 অখন্ড অবসর বলে একটা জিনিস আছে। সত্যি সত্যি কোন অবসর অখন্ড হতে পারে? ঠিক কতখানি খন্ডিত না হলে তাকে অখন্ড অবসর বলে? মাঝে মাঝে মধ্যরাতে এই প্রশ্ন হানা দেয়। অবসর আমার যে নেই তা না, কিন্তু সবই খন্ড বিখন্ড।


অফিসের ফাঁকে বাইরে বসে ৫ মিনিট রোদ পোহানো, কিংবা মধ্যরাতে বসে একটু গল্পের বই পড়া - আমার এইটুকু অবসর আছে। ছুটি নিলে কোথাও ঘুরতে যাই, বা নিজের ব্যক্তিগত কাজ সারি। আমি অলস লোক, সকালে বেলা করে ঘুম থেকে উঠবো, ইচ্ছে হলে কাজ করবো, ইচ্ছে হলে নেটফ্লিক্স দেখবো, ইচ্ছে হলে নাস্তা করব - আমার কাছে ছুটি মানে আসলে নিজের ইচ্ছের জয়। সেই অর্থে ছুটি পাইনি বহু বহুদিন।

[অসমাপ্ত]

Thursday, August 19, 2021

সুখী নীলগঞ্জ

মতিউল্লাহ স্যারকে সবাই ভয় পেত। কাঁচা পাকা চুল, ভারী চশমা, রাশভরী মানুষ। অংক করাতেন। একটু চিবিয়ে কথা বলতেন, আর কথাতে একটু চন্দ্রবিন্দুর প্রভাব থাকতো। এক সময়ে স্কুলের টেরর স্যার ছিলেন। সব গরম জিনিসই ঠান্ডা হয়ে যায় এক সময়ে। আমরা যখন স্যারের ক্লাস করি তখন স্যার অনেকটাই ঠাণ্ডা। একদিন ক্লাসে উনি ছয় ইঞ্চি একটি রেখাকে দুই ভাগ করতে দিলেন। আমি দ্রুত স্কেল বের করে ছয় ইঞ্চি রেখা টানলাম, মাঝের পয়েন্টটা মার্ক করে স্যারের কাছে নিয়ে গেলাম। সমস্যাটা আসলে স্কেল দিয়ে মেপে দুই ভাগ করার জন্য না, এরচেয়ে অনেক জটিল।
স্যার আমার কাজ দেখে হুংকার দিলেন। "এইঁ অংঁক কোঁথায় শিঁখেছো? ঘোঁড়ার ঘাঁসটাও কাটতে পারবা না। স্কুঁল পাঁশ করে সিঁটি কঁলেজের নাঁইট সেঁকশনে ভর্তি হতে হবে।"
স্যারের মতে অধঃপতনের দুটো ধাপ আছে। প্রথমটা ঘোড়ার ঘাস কাটা আর শেষ পর্যন্ত ভালো কোন কলেজে চান্স না পেয়ে সিটি কলেজের নাইট সেকশনে ভর্তি হওয়া। আমি নিজের বাসার ঘাস একবার কাটতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম ঘাস কর্তন সহজ কাজ না। সিটি কলেজও কালক্রমে খুব ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। দুটোই আদতে ফেলা দেওয়ার মতো কাজ না।
ধমক খেয়ে আমি ম্রিয়মান হয়ে গেলাম। স্যার অবশ্য মারধোরের দিকে গেলেন না। ক্লাসে মূলত মার খেতো টুলু। স্যারের কনিষ্ঠ পুত্র। আমাদেরই বাল্যবন্ধু। অংক শেখানোর জন্য টুলুর উপর স্ট্যান্ডিং অর্ডার ছিল যে সে যেন তার ক্লাসের প্রতিটি প্রাইভেট ব্যাচের সাথে অংক শেখার জন্য বসে। কিন্তু অংক জটিল জিনিস। প্যাঁচ লেগে যায়। দুর্গে ৫০ জন সৈন্যের খাবারে ৭০ জনের কতদিন চলবে এই জটিলতা অথৈ জলে ফেলে দেয়। এই অংক মনে হয় আফগানিস্তানে লাগতে পারে। ভীষণ গোলযোগের ভেতর ওদের ঐকিক নিয়ম করতে হয় ওদের।
যাই হোক পরীক্ষাতে একবার একটু ইয়ে হয়ে গেল টুলুর। অবস্থা বেগতিক দেখে সে এক সকালে গৃহত্যাগ করলো। টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের "এইসব দিনরাত্রি" প্রবল জনপ্রিয়। সেই নাটকের এক চরিত্র কবির মামা তাঁর গ্রামকে আদর্শ বানাবেন। সেখানে দুঃখ থাকবে না, অনাচার থাকবে, মানুষের মধ্যে থাকবে সমতা আর বন্ধুত্ব। সেই গ্রামের নাম দিয়েছেন উনি সুখী নীলগঞ্জ। পরীক্ষাতে একটু ইয়ে হয়ে গেলে সুখী নীলগঞ্জ এক অবশ্য গন্তব্য।
তবে গৃহত্যাগের পরে দ্রুতই টুলু ফিরে এলো। অল্প সময়ে সে আবিষ্কার করে ফেলল যে এই দুনিয়ার কোথাও সুখী নীলগঞ্জ নেই, নীললোহিতের দিকশূন্যপূরের মতো সে অস্তিত্বহীন। দুনিয়া জোড়া আছে দুঃখী নীলগঞ্জ। বঞ্চনা, অনাচার, অসাম্য আর কষ্ট সর্বত্রই, পালিয়ে কোন লাভ নেই।
টুলু অবশ্য সরাসরি বাসায় ফিরে নি। সে ঢুকে গেলে সকাল বেলার ছাত্রদের ব্যাচে। হঠাৎই স্যারের নজরে এলো।
আঁরে টুঁলু সাহেব যে? একটু বিরতি দিয়ে - আঁরো এক ঘঁড়া মাঁর্বেল কিঁনে দেঁই?
এরপরে কী হয়েছিল আমার জানা নেই। কিন্তু আন্দাজ করতে পারি।
একদিন আমরা সবিস্ময়ে টের পাই আমরাও বড় হয়ে গেছি। পালানোর সব পথই বন্ধ। কিন্তু ঘর পালানো কাউকে দেখলে আমার বালকবেলার কথা মনে হয়। কয়েক বছর আগে পত্রিকাতে দেখেছিলাম কয়েকজন কিশোর ঘর থেকে পালিয়ে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপে যাওয়ার প্ল্যান করার সময়ে ধরা পড়েছে। আমরা বুড়ো হয়ে গেলে কোথাও না কোথাও শৈশব আর কৈশোর বেঁচে আছে। কেউ না কেউ স্বপ্ন দেখছে।
স্বপ্ন আমিও দেখি। অনেক দূরের ফেলা আসা দিনের স্বপ্ন। ওরা একদম তাজা বাতাস দিয়ে আসে, এজমার টান ভুলে যাই, ভুলে যাই অদ্ভুত এই বাস্তবতাকে। টের পাই অনেক দূরের কোন এক সুখী নীলগঞ্জ এখনও বেঁচে আছে, এখনও তাকে স্পর্শ করা যায়, এমনকি চাইলে ঘুরেও আসা যায়। এই অস্থির সময়ে দূর থেকে দেখা সেই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্ন দেখায়, কানে কানে বলে - শোন কালকের দিনটা কিন্তু অনেক ভালো হবে।
সেই আশা নিয়ে এখনও বেঁচে আছি।