Friday, July 30, 2021

বাঁটু করিম

আনওয়ারুল করিম নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। অংকের স্যার। আমরা যখন থ্রিতে পড়ি তখন স্যার ল্যাবরেটরি স্কুলে এলেন। আমাদের ক্লাসের শ্রেণী শিক্ষক। অতি দ্রুতই স্যারের নাম হয়ে গেল বাঁটু করিম, আমাদের বা আমাদের আশেপাশের ব্যাচেরই দেওয়া নাম। বাঁটু নামটার শানে নযুল ব্যাখ্যার দরকার নেই।


কিছুদিন পরে বাঁটু করিম নামটা সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া হলো। হয়ে গেল বিকে। মাঝে মাঝে টাইটেল আসল নামকে ছাড়িয়ে যায়। বিকের ব্যাপারে তাই হলো। বিকে নামটা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেল। সবাই তাঁকে বিকে স্যার হিসাবে জানে, জন্মসূত্রে "একে" কর্মসূত্রে হয়ে গেলেন "বিকে"।

আমার এবং আমাদের বন্ধুদের স্কুল জীবনটার একটা অংশ কেটেছে বিকের আতংকে। ক্লাস থ্রি, ফাইভ, সেভেন, নাইন, টেন - প্রতি শ্রেণীতে তিনি অংক শিক্ষক। যোগ বিয়োগ দিয়ে শুরু করে - ভগ্নাংশ, শতকরা, উৎপাদকে বিশ্লেষণ, ত্রিকোনমিতি, ঘন জ্যামিতি - সবর্ত্রই বিকে। পাঞ্জাবি, পায়জামা পরা সাদামাটা অংকের যাদুকর। এর হাত থেকে পালানোর উপায় নেই। নিউমার্কেটে স্যারের কাপড়ের দোকান আছে (নামটা মনে আছে - টপ ইন দ্য টাউন), ওখানে সন্ধ্যার পরে ঘোরাঘুরি করতে গেলে স্যারের নজরে আসার সম্ভবনা আছে - যেটার ফলাফল হবে পরদিন অংক ক্লাসে নাজেহাল।

নাজেহালের বর্ণনা দেওয়া যায়। স্যার নিজের ডাস্টার আনতেন, সেই সাথে স্কুলের পিকনিকের সময় মধুপর থেকে আনা ডোরাকাটা সাদা বাদামী বেত আসতো কখনো কখনো। বিকে প্রায় প্রতি ক্লাসে বোর্ডে অংক করতে পাঠাতেন। প্রায় সব ছাত্রের নাম ও রোল নম্বর জানা ছিল স্যারের - সেই সঙ্গে কে কেমন অংক জানতো সেটাও বিলক্ষণ জানতেন। স্যারের ভাষাতে যারা "দুর্বল সেন" তাদেরকে বোর্ডে পাঠানো হতো অঙ্ক করার জন্য।

যারা জানেনা তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি - স্কুলের বোর্ডে অংক ঠিকঠাক মতো করা পৃথিবীর পাঁচটা জটিল কাজের একটা। অংকে ভুল করা ছাত্রদের লাইনে দাঁড়া করানো হতো। সেই কঠিন জালে ভালো ছাত্রেরাও আটকা পড়ত প্রায়ই, কেননা বোর্ডের সামনে দাঁড়ালেই যাবতীয় জ্ঞান মাথা থেকে দূর হয়ে যায়।

যাই হোক মোটামুটি সংখ্যক ছাত্র জমা হলে স্যার বলতেন এই বার এরা খেলা দেখাবেন। এরপরে স্যার যত্ন করে নিজের হাতের ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখতেন, আস্তে আস্তে পাঞ্জাবির আস্তিন গুটাতেন...এরপর খেলা শুরু হতো। খেলাটা হচ্ছে ডাস্টার দিয়ে পিঠের মধ্যে দমাদম বাড়ি, অথবা বেত দিয়ে সপাং সপাং বাড়ি। প্রায়ই দেখা যেত বেত ভেঙ্গে গেছে। সেই বেত ভেঙ্গে গেলেও স্যার দমতেন না, অফিস রুম থেকে আরেকটা আনা হতো। স্যার এমনকি স্কুলের গাছের ডাল ভেঙ্গেও ছাত্রদের "পৃষ্ঠপোষকতা" করেছেন। একবার আমাদের বন্ধু জাকিরকে অন্ধের মতো পিটাতে পিটাতে ঘন্টা পড়ে গিয়েছিল, স্যার বিদায় নেবার সময়ে জানালেন সিক্সথ পিরিয়ডে এসে আবার জাকিরকে মারবেন। ক্লাসের প্রতিটি ছেলে মার খেয়েছে এমন ঘটনাও বিরল না। স্যার কৌতুক করে বলতেন যে - এমন জায়গাতে উনি মারবেন যে বাসাতে গিয়ে কেউ অভিভাবককে প্যান্ট খুলে দেখাতে পারবে না।

বাটু করিমের অংক বোঝানোর স্টাইলটা অবশ্য চমৎকার ছিল। সত্যিকথা বলতে এতো ভালো অংকের শিক্ষক আমি এই জীবনে আর দ্বিতীয়টি পাইনি। কিন্তু একই সঙ্গে বলতে হচ্ছে স্কুল জীবনে দেখা উল্লেখযোগ্য ধরণের সাইকো হচ্ছেন বাঁটু করিম। এমনও দিন গেছে যে আমি সকালে যে অংকটা বাসা থেকে করে এসেছি, সেটা বোর্ডে গিয়ে পারিনি। বহুরাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি, বহু রাতে দোয়া দরূদ পড়েছি যেন স্যার পরদিন স্কুলে না আসেন অথবা অকস্মাৎ ভূমিকম্পে যেন স্কুলের বিল্ডিংটা ধ্বসে পড়ে।

বলা বাহুল্য যে সেই সব দোয়া কবুল হয় নি। আমাদের এই স্টিম রোলারের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। বহু কষ্ট করে আমিও শেষ পর্যন্ত অংক শিখেছি - সত্যি কথা বলতে স্কুল জীবনের পরে যেসব অংক শিখেছিলাম সেগুলো সব মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে - শুধু রয়ে গিয়েছে ক্লাস টেনের পাটিগণিত আর সেই সঙ্গে রয়ে গেছে কালান্তক বাঁটু করিম। মেয়ের অংকে সাহায্য করতে গিয়ে আটকে গেলে এখন আমার মনে হয় ডাস্টার হাতে আড়ালে কোথাও দাঁড়িয়ে আছেন স্যার।

ঈশ্বর আমাদের অবশ্য একটা করুণা করেছেন। বাঁটু করিম নামটা পার্মানেট হয়ে গেছে - আমরা পাশ করে আসার ত্রিশ বছর পরেও স্যারকে এই নামেই ডাকতে শুনেছি সবাইকে। মনে হয় আমাদের তরফ থেকে এইটুকু প্রতিশোধটা রয়ে গেল। খ্যাতি বাড়তে বাড়তে তিনি হয়ে গেলেন প্রবাদতুল্য অংকের শিক্ষক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সবাই তাঁকে এই নামেই চিনে। অভিভাবকেরা স্যারের বাসাতে কলিং বেল চাপ দিয়ে খুব বিনীতস্বরে জিজ্ঞেস করেন - বিকে স্যার বাসায় আছেন? শুনেছি স্যার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন - কিন্তু অভিভাবককে তো আর ডাস্টার দিয়ে পিটানো যায় না!

কেমন আছেন স্যার? উনি বেঁচে আছেন কিনা জানি না, আমি ওনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি যেন এক সকালে কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করতে পারি - বিকে স্যার কেমন আছেন?

###

Friday, July 23, 2021

শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ

 সিএনএনে এক পাকিস্তানি জেনারেলের সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম। বিন লাদেনকে মারার পরপর। সেই লোক অভিযোগ করলেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ফাঁসানো (ফ্রেম) হয়েছে - বিন লাদেনকে নাকি মার্কিন দেশ অনেক আগেই হত্যা করেছিল, শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর বদনাম করার জন্য এই অভিযান করে বিন লাদেনকে হত্যার নাটক করা হয়েছে।

আমার কর্মক্ষেত্রেও কিছু পাকিস্তানি সহকর্মী আছেন। উনারা মাঝে মাঝে বলেন যে পাকিস্তানের অবস্থা নাকি খুবই ভালো - এই সব তালেবানি হামলা-টামলা সব মিডিয়ার সৃষ্টি। পাকিস্তান দ্রুত উন্নতির পথে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই রকম এক আলাপচারিতার এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের এক স্কুলে হামলা করে অনেক অনেক বাচ্চাকে মেরে ফেলল তালেবানরা। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি - করলে অনেক ইঙ্গ-মার্কিন বহুজাতিক ষড়যন্ত্রের গল্প শোনা যেত।
পাকিস্তানি সম্বন্ধে আমার দুটি অবজার্ভেশন আছে। প্রথমটা হচ্ছে যে কোন ব্যাপারে এরা মিথ্যা কথা বলতে পারে। শিক্ষিত লোক আরও বেশি পারে।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে, সজ্জন, দুর্জন, ভদ্রলোক, অভদ্রলোক নানান রকম পাকিস্তানি আছে, থাকাই উচিৎ, একটা দেশে নানান ধরনের মানুষ থাকবে কিন্তু ১৯৭১ প্রশ্নে এরা সবাই একেক জন টিক্কা খান।
আজকে বাংলাদেশের জন্মদিন। এই দেশ ৪৫ বছরে পা দিয়েছে। আমার নিজের ৪৫ বছর হয়েছে কয়েকমাস আগে। আমি সহ আমার বেশিরভাগ বন্ধুবান্ধবই বাংলাদেশের সমবয়েসি। বাংলাদেশের শৈশবের গল্প আর আমাদের শৈশবের গল্প একই সময়কার।
সেই বিক্ষুব্ধ সময়ে বড় হতে হতে দেখেছি যে ইতিহাসের চাকা উলটো দিকে ঘুরানোর চেষ্টা হয়েছে। যেই প্রজন্মটার মুক্তিযুদ্ধকে সবচেয়ে বেশি করে ধারন করা উচিৎ ছিল সেটাই সবচেয়ে বেশি মগজ ধোলাই করা।
আমি বিস্মিত হই না যখন দেখি আমার অনেক বন্ধুর চিন্তাভাবনা কিছুটা আমার পাকিস্তানি সহকর্মীদের মতোই। ওনারা ডিফারেন্সিয়াল ইক্যুয়েশনের সমাধা করে ফেলতে পারেন নিমেষেই - কিন্তু সহজ সত্যটা অস্বীকার করতে পারেন অবলীলাতে। বাংলাদেশি মার্কিনিদের মধ্যে অনেকেই হিলারি বা বার্নি স্যান্ডার্সকে চান ক্ষমতাতে - কিন্তু নিজের দেশে হেফাজতে ইসলামকে দেখতে চান ক্ষমতায়। এ সবই আমাদের পাকিস্তান অভিমুখে যাত্রার ফলাফল।
কিন্তু আনন্দের বিষয় নতুন প্রজন্ম এই রকম নয়, এবং সর্বোপরি আমি এটা বিশ্বাস করি যে এটা পুরো বাংলাদেশের চিত্র নয়। মগজ ধোলাই সবচেয়ে হয়েছে শহুরে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনিতে।
স্বাধীনতার সুফল আমরা সবাই পেয়েছি। আমরা যে পাকিস্তান নই এবং পাকিস্তানি নই - সম্ভবত এটা সবচেয়ে বড় সুফল। আমরা সন্ত্রাসের প্রস্তুতকারী নই, সন্ত্রাসের পরিবেশক নই, সন্ত্রাসের দোকানদার নই। আমাদের সমস্যা আছে, দুর্নীতি আছে, দুঃশাসন আছে, খুন আছে, ধর্ষণ আছে - আছে না পাওয়ার বেদনা। কিন্তু মার্কিন দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৬ কোটি মানুষকে খাইয়ে, পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে।
দিনের শেষে আমাদের নিজেদের একটা দেশ আছে, একটা পতাকা আছে, সমস্যা সমাধানের সম্ভবনা আছে। এই সম্ভবনাটাই আমাদের সাথে পাকিস্তানিদের পার্থক্য।
যেই বরাহশাবকটা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে খেলার মাঠে লাফ-ঝাঁপ দেয় - সেও স্বাধীনতার সুফল পেয়েছে। যেই সব শিক্ষিত ছাগল ফেসবুকে আজগুবি জিনিস শেয়ার দেয় - তারাও পেয়েছে। যেই প্রবাসী "লিবারেল বাংলাদেশি" নিজ দেশে হেফাজতের নারী নীতির বাস্তবায়ন চায় সেও পেয়েছে।
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ!!! শুভ জন্মদিন!!!
"তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব'লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব'লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।"

মীনা আর রাজু

মীনার কার্টুনের একটা এপিসোড আছে, মীনা আর রাজু দায়িত্ব বদল করে। মীনার কাজ রাজু আর রাজুর কাজ মীনার করতে হবে। সেটার থেকে উদ্ভুত শিক্ষা হচ্ছে পুরুষ আর নারী দুইজনের কাজের কোনটাই কম গুরুত্বপূর্ণ না সেটা শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া। তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে পুরুষ আর নারীর কাজের পার্থক্য থাকা উচিত না, কিন্তু...

মারিয়া তিন সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে। আপাতত বাসাতে আমি মীনা এবং রাজু দুইটি ভূমিকাই পালন করছি। বাসার কাজগুলো সম্বন্ধে আমার মোটামুটি আইডিয়া আছে, আমি কাজ চালানোর মতো রান্না করতে পারি, ঘরদোর পরিষ্কার সবই করতে পারি। বাড়তি কিছু কাজ আছে, বাচ্চারা ঠিক সময়ে ঘুমাতে যাচ্ছে কিনা, পানি খাচ্ছে কিনা এইগুলোও মনিটর করতে হবে আমাকে।
পরিস্থিতি- ১
রাত এগারোটার সময়ে আমি বাচ্চাদের জানালাম ঘুমানোর সময় হয়েছে, বাতি নিভাতে হবে। একই সঙ্গে সারাদিন পান করা পানির পরিমাণ জানতে চাইলাম।
"হেই ইউ ক্যানট আস্ক ইট, ইউ আর নট মাই মাম...”
এমনিতে নারী পুরুষের সমতা নিয়ে মেয়েরা প্রায়ই আমাকে লেকচার দেয়। কিন্তু কার্যত দেখা গেল ভেতরে ভেতরে সবাই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া।
আমি জানালাম আমি ইনচার্জ, সব খোঁজখবরের দায়িত্ব আবার।
উই ডোন্ট হ্যাভ টু লিসেন টু ইউ, কালকে স্কুল নেই, আমরা যতক্ষণ খুশি জেগে থাকতে পারি।
আরো জানালো বাড়াবাড়ি করলে মায়ের কাছে আমার নামে কমপ্লেইন করবে।
বেগতিক দেখে আমি আওয়ামী লীগের পথ ধরি, মানে হেফাজতকে যেমন তোয়াজ করে চলে আওয়ামী লীগ – সেই রাস্তাই ধরি। প্রয়োজনে আমি কঠোর ব্যবস্থা নেব, এই হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজের ঘরে চলে যাই। আরো জানাই যে নিয়মভংগ করা আমি বরদাস্ত করবো না। নিজের ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে তাদের খিলখিল হাসি শুনতে পাই।
মনে মনে ক্ষমতাসীন দলকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। একটা প্রব্লেম সলভড। আমার কাজ হবে নিয়মগুলো জানানো, প্রয়োগ করতে গেলে ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে। কী দরকার এতো ঝামেলার।
পরিস্থিতি- ২
আজকের মেনু হচ্ছে ভাত, ডাল, সব্জি আর সালাদ। ডিনার দেওয়া হবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটাতে। যথাসময়ে ডিনার দিলাম। এরপরে আগের প্রশাসন বাচ্চাদের খেতে আসার জন্য ঘন্টাখানেক ডাকাডাকি করতো, কিন্তু নতুন প্রশাসনে আমি ব্যক্তি স্বাধীনতাতে বিশ্বাস করি। খিদে লাগলেই খাবে। ঘন্টাখানেক পরে তাই হোল।
আই ডোন্ট লাইক দ্যাট ভেজি...
ভালো না লাগলে খাওয়ার দরকার নাই।
হোয়াই আর ইউ সো রুড?
বোবার শত্রু নাই। চুপ থাকি।
দিজ ভাত ইজ টু সফট। মামা'স রাইস ইজ বেটার দেন ইউরস।
আমি নিশ্চুপ থাকি। ভাত একটু জাউ জাউ হয়ে গেছে। ভাত যে কড়কড়ে হবে এই রকম কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নাই। একটু পরে ফোনে শুনলাম বলছে..
মা' আব্বুর ভাতটা নরম হয়ে গেছে।
স্টপ ট্যাটেল টেইলিং...
ডোন্ট বি মিন...
আরে নাহ, আই ওয়াজ জোকিং...খাবাররের পরে আইসক্রিম কে চায়?
পরিস্থিতি- ৩
থার্মোডিনামিক্সের কয়েকটা সূত্র আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক হচ্ছে দ্বিতীয় সূত্র। দ্বিতীয় সূত্রের একটি অনুসিদ্ধান্ত হয়েছে এই মহাবিশ্বের চরিত্র খুব ডিজঅর্ডার্ড আর র্যান্ডম, মানে ঘটনা গুলো গোলযোগপূর্ণ, আর সব কিছু শেষ পর্যন্ত ব্যারাচ্যারা অবস্থাতে পৌঁছায় যায়।
এই সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ প্রতিদিনই দেখা যায়। একটা বিরাট উদাহরণ হচ্ছে ঘর দোর পরিষ্কার করার পরের মিনিট থেকেই ঘর অপরিষ্কার হতে শুরু করে। থার্মোডিনামিক্স আরও বলে যে অর্ডার আনতে হলে সিস্টেমে শক্তি দিতে হবে, এমনিতে ছেড়ে দিলে ছাড়া গরুর মতো অবস্থা হবে। সূত্রের কথা অনুযায়ী আমি ঝাড়ু হাতে নেমে পড়ি। সারা সপ্তাহ ময়লা হতে দিলে উইকেন্ডে প্রচুর শক্তি ব্যয় হবে। আগে এই শক্তি দুই জন মানুষ দিতো, এখন পুরাই যাবে আমার একাউন্ট থেকে। তাই প্রতিদিন ঝাড়ু দেওয়া শুরু করি।
হোয়াই ডু উই হ্যাভ টু ক্লিন এভরি ডে?
ঘর পরিষ্কার করতে অবশ্য মেয়েও হাত লাগায়। আমি এর বিনিময়ে পয়সা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেই। অর্থ যে শক্তির আরেক রূপ সেটা থার্মোডিনামিক্সের বইতে লেখা নেই, কিন্তু আমরা বিলক্ষণ জানি।
থার্মোডিনামিক্সের ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী আরও কেওস দেখা যায় সিংকে জমতে থাক ডিশের স্তুপে। লন্ড্রি বাস্কেটে, লন্ডভন্ড বিছানাতে, বাইরের বাগানের নেতিয়ে পড়া গাছে। আমি টের পাই অভিকর্ষ বলের আবিষ্কার যদি আপেল গাছের নিচে হয়, তাহলে থার্মোডিনামিক্সের সূত্রের আবিষ্কার আমার মতো পরিস্থিতে কেউ বের করেছিল।
সূত্রটা একটু মোলায়েম হলে কী অসুবিধা ছিল?
পরিস্থিতি- ৪
এই দেশে বাচ্চাদের "চোর" থাকে। বাংলা চোর নয়, ইংরেজি চোর। সেটার অর্থ হচ্ছে বাড়ির নির্দিষ্ট কাজ বাচ্চাদের করতে হবে। মারিয়া দেশে যাওয়ার পরে আনুশার কাজ হচ্ছে বাইরের গাছে পানি দেওয়া।
রাত এগারোটার সময়ে মনে পড়ল আমার। আনুশাকে জানালাম।
"ক্যান ইউ প্লিজ ডু ইট, আই এম টু টায়ার্ড?"
আমি বাইরে গিয়ে গাছে পানি দেই। বিছানায় এসে ঘুমের অতলে ডুবে যেতে যেতে মনে হল কি যেন একটা ঠিক নেই। পরদিন সকালে আবিষ্কার করলাম পানি দেওয়ার পরে কলটা বন্ধ করা হয় নি! ঘাসগুলো একটু বাড়তি পানি পেল আরকি!!
প্রতিদিনই আনুশাকে স্মরণ করাই। একদিন আনুশার করতে ইচ্ছে করে না, আরেকদিন হোমওয়ার্ক থাকে, অন্যদিন টিভিতে সিরিজ দেখে মন খারাপ। কোন দিন বৃষ্টি এসে বাঁচিয়ে দেয়, কোন দিন আমি পানি দিয়ে কলটা ভালো মতো বন্ধ করে আসি।
একই সঙ্গে মনে পড়ে আনুশার বয়েসে আমিও ওই রকমই ছিলাম। প্রতিটা কাজই ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেই আমাকেই এখন সব কিছু করে খেতে হচ্ছে। সময় সবাইকেই বাধ্য করে, যতদিন পারুক সময়ের সাথে লুকোচুরি খেলে নিক, ফাইনালি সময় ঠিকই ধরে ফেলবে!!!
টিল দেন গুড জব আনুশা!

বাজার করার জটিলতাসমূহ

বাজার করা কঠিন কাজ। শিব্রাম চক্রবর্তীর একটা গল্প আছে, বাজার করা হাজার ঠ্যালা নামে। আক্ষরিক অর্থেই এইটা সত্য। সেই সঙ্গে বলতে হচ্ছে আমাদের দেশি লোকদের বাজার আরও কঠিন কাজ। আমরা নানান রকম জিনিস কিনি, সব কিছু এক জায়গাতে পাওয়া অসম্ভব। এই বাইরেও নানান জটিলতা আছে, আমার কাছে বাজার করা বুয়েটের পরীক্ষার মতো লাগে। ব্যাপারটা বুঝায়ে বলি।

জটিলতা -১
মারিয়া বাজারের লিস্ট করে দেয়। সেই লিস্টের ব্যাপ্তি এক থেকে শুরু করে ৫৫ পর্যন্ত...আমার কাছে সেটা অসীমের কাছাকাছি। আমি একদিন আপত্তি করলাম – এতো জিনিস আনা সম্ভব না। মারিয়া এরপর থেকে ছোট লিস্ট দেয়। লিস্টে পাঁচটা আইটেম থাকে।
১/ ডিম, দুধ, মাংস...(১০ টা আইটেম)
২/ চা পাতা, বিস্কিট... (১০ টা আইটেম)
৩/ (১০ টা আইটেম)
৪/ (১০ টা আইটেম)
৫/ (১০ টা আইটেম)
লিস্ট দৈর্ঘ্যে কম কিন্তু প্রস্থে বড়। আমি টের পেলাম লিস্টের দৈর্ঘ্য কমালে প্রস্থে সে বাড়বে। কাঠিন্য থেকেই যাবে। ধারে না কাটলেও সে ভারে কাটবে।
জটিলতা -২
একবার লিস্টে লেখা ছিল
পোলাওয়ের চাল, শনিবারের দাওয়াতের জন্য।
এইখানে বুয়েটের পরীক্ষার সাথে সবচেয়ে মিল। একটা তথ্য থেকে অন্য তথ্য বের করতে হবে। এখানে সরাসরি বলা নেই কয় পাউন্ডের প্যাকেট কিনতে হবে। বুয়েটের পরীক্ষার প্রশ্নতেও সরাসরি তথ্য দেওয়া থাকতো না। শনিবারের দাওয়াতে কতজন লোক আসবে এইটা জানা থাকতে হবে, সেই অনুযায়ী পোলাওর চাল কিনতে হবে। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অংকের মতো, গ্যাসের নাম বলা আছে, আর একটা গ্রাফ দেওয়া আছে, ওইখান থেকে খেটেখুটে বাকি সব কিছু বের করতে হবে।
জীবনটা আসলে পরীক্ষা, বুয়েটের সেমেস্টার ফাইনালের মতো। বাজারে গেলে সেটা আরো বেশি করে টের পাওয়া যায়।
জটিলতা - ৩
বাজারের লিস্টের সব জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না। বুয়েটের পরীক্ষার সাথে এখানেও মিল আছে। আমাদেরকে তিনটা প্রশ্নের মধ্যে দুটোর উত্তর করতে হতো (অথবা চারটার মধ্যে তিনটি), দেখা যেত একটা প্রশ্নের উত্তর পুরো জানি, আর বাকিগুলো অর্ধেক করে জানা, অর্থাৎ দুই নম্বর প্রশ্নের ক অংশের উত্তর জানি, কিন্তু খ অংশের উত্তর জানি না। তিন নম্বর প্রশ্নের খ অংশ জানি তো ক অংশ জানি না।
লিস্টে এই রকম জিনিস থাকে
রুটি, ডিম, ময়দা, সবুজ বিস্কুটের প্যাকেট যেখানে হালকা মেরুন স্ট্রাইপ আছে।
এইখানে সহজ অংশ আছে, রুটি, ডিম, ময়দা বেসিক জিনিস। কিন্তু সবুজ রঙ্গের প্যাকেটের বিস্কুট, তাতে হালকা মেরুন রংয়ের স্ট্রাইপ? এইটা সেই না পারা প্রশ্নের অংশের মতো। সিলেবাসের এক চিপা থেকে উঠায়ে দেওয়া হয়েছে, এর উত্তর ক্লাসের প্রথম ১০ জন ছাড়া কেউই জানে না।
বাজার করা এতো কঠিন কেন?
জটিলতা - ৪
জটিলতা-৩ নিরসনের জন্য ফোন দেই মারিয়াকে। ভিডিও কল করি, প্রতিটি বিস্কুটের প্যাকেটের ছবি দিয়ে কাংখিত সবুজ প্যাকেটের বিস্কুট বের করি যাতে হালকা মেরুন রং এর স্ট্রাইপ আছে। কিন্তু সমস্যা বেড়ে যায়...
"শুনো, কয়েকটা জিনিস ভুলে গেছিলাম। একটা রসুনের প্যাকেট দরকার, খোলা কোয়া রসুন, গোটা না, আর দরকার ছোট সাইজের শসা, বড়গুলো না কিন্তু, একটা কিসমিসের প্যাকেট হলুদ রংয়েরটা...
দেখা যাচ্ছে বাজার করা আসলে লাইফ মোমেন্ট, জটিলতা-৩ নিরসন করতে গেলে জটিলতা-৪ এর উদ্ভব হয়। জটিলতা-৪ ঠিক করতে গেলে জটিলতা-৫ এর উদ্ভব হবে এবং এই চক্র চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে, পৌনপুনিক ভংগ্নাশের মতো।
প্রায় তিন সপ্তাহ আমি একাই বাড়ি, ঘর, রান্না, বাজার সব সামলাচ্ছি। আমার ধারণা ছিল বাজার করার জটিলতা আমি কমাতে পারবো। আমার বাজারের লিস্ট ছোট, সত্যিকার অর্থে ৪/৫ টি জিনিস কিনতে আমি বাজারে ঢুকি। ইন এন্ড আউট পাঁচ মিনিটের কম সময় লাগে। কিন্তু গত ১৮ দিনে অন্তত ১৪ বার যেতে হয়েছে বাজারে...একবার আলু শেষ, বাজার করে এসে টের পাই পেঁয়াজও বাড়ন্ত ঘরে, এরপরে হয় চাল নেই, তারপরে রুটি...বাজার করা জটিল কাজ সন্দেহ নেই, প্রতিদিনই একবার যাচ্ছি …যেতে হচ্ছে আরকি!

রান্না করার জটিলতা সমূহ

রান্না করা সহজ কাজ না। ছোটবেলাতে রুশদেশের বইতে মিশকার রান্নাবান্না নামে একটা গল্প পড়েছিলাম। সেই থেকে আমি জানি রান্না আদতে খুব কঠিন একটা কাজ। আমি পাঁচ বছর এই দেশে একদম একা থেকেছি। সেই জটিলতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। জটিলতাগুলোর কিছু উদাহরণ দেই

-১-
সকালে হালুয়া দিয়ে আটার রুটি আমার খুব প্রিয় ছিল। ক্ষমতার হালুয়া রুটির স্বাদ না পেলেও সত্যিকারের হালুয়া রুটির স্বাদ আমার জানা ছিল। প্রচুর ভারতীয় থাকার কারণে এইখানে ঘরে বানানো আটারুটি বিরল নয়। আমার ধারণা ছিল হালুয়া আর রুটির মধ্যে জটিল কাজ রুটি বানানো। কঠিন কাজটা আরেকজন করে দিচ্ছে, আমার কাজ শুধু হালুয়া বানানো। হালুয়া তৈরি করা কঠিন কিছু হতে পারে না, কেননা জিনিসের অবস্থা শোচনীয় হলেই সেটাকে হালুয়া বলে। এমন জিনিস কিভাবে জটিল হবে?
যাই হোক এক সকালে আমি সুজির হালুয়া বানানো শুরু করলাম। ফ্রেশ গরম রুটি কিনে এনেছি অলরেডি। আম্মা হালুয়া বানাতেন, ঠিক কিভাবে বানাতেন সেটা দেখিনি, কিন্তু বিভিন্ন স্টেপে কি রকম গন্ধ আসে সেটা জানা আছে। সেইটুকু ভরসা করে নেমে গেলাম। সিদ্দিকা কবীরের বইটাতেও চোখ বুলিয়ে নিলাম একটু।
ওপেনিংটা ভালোই হচ্ছিল। গন্ধটাও চেনা লাগছিল। এরপরে এক পর্যায়ে চিনি দিতে বলা হয়েছিল। আমার আত্মবিশ্বাস তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো। সিদ্দিকা কবীর ঠিক মতো পড়ে দেখার ঝামেলাতে গেলাম না। আমি হালুয়াতে চিনি দিতেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। হালুয়াটা জমাট বাঁধা শুরু করল। আমি ঠিক কি ভুল করেছি সেটার ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নই। কিন্তু হালুয়া টাইট শব্দের আক্ষরিক মানেটা দেখতে পেলাম। আমার চোখের সামনেই হালুয়াটা টাইট হওয়া শুরু করলো।
এহেন ব্যাটিং বিপর্যয়ে আমার অবস্থা সেই মিশকার পরিজ রান্নার মতোই হয়ে গেল। আগুনের তাপ বাড়ালে পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী কঠিন পদার্থের গলে যাওয়ার কথা, কিন্তু এর মধ্যে যে পুড়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে সেইটা ফিজিক্স বইতে লেখা নেই ঠিকমতো। প্রায় জমে যাওয়া হালুয়া পুড়ে যেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত হালুয়া এবং হালুয়ার পাত্র দুটোই বিসর্জন দিতে হলো।
হালুয়া টাইট পর্বের পরে আমি এই জীবনে সুজির হালুয়াসহ আর অন্য কোন হালুয়া বানানোর চেষ্টা করিনি। কাজের চাপে জীবন হালুয়া হয়ে গেছে, সেই হালুয়া নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থেকেছি, চুলার পাশে গিয়ে সেটার সচিত্র রূপ আর দেখতে চাইনি।
-২-
রান্নার বইতে একটা জিনিস লেখা থাকে - লবণ আন্দাজ মতো বা লবণ স্বাদের জন্য পরিমাণ মতো - এর কোন মানে হয়? আন্দাজ আর পরিমাণ সম্বন্ধে যদি ধারণা থাকতো তাহলে রান্নার বইটাই তো খুলতাম না। আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া সব কিছুর মাপ বলে দিচ্ছে কিন্তু লবণের বেলায় এমন বিমাতা সুলভ আচরণ কেন রান্নার বইয়ের?
লবণ অবশ্য জটিল জিনিস। ছোটবেলাতে নুনের মতো ভালোবাসার গল্প যারা পড়েছেন তারা জানেন সামান্য লবণ কতখানি ভালোবাসা আনতে পারে। আমি রান্নার বই লিখলে সবার আগে ঠিক কতো দানা লবণ দিলে মার খেতে হবে না সেই মাপ দিয়ে দিতাম।
লবণের জটিলতা আরও আছে। আমাদের বাসাতে আমি ডাল আর সব্জি রান্না করি। এইগুলো লো এন্ড কাজ বলে মারিয়া আমাকে আউট সোর্স করে দিয়েছে। ইন্সটাপটে ডাল গলাতে ২০ মিনিটের মতো লাগে, এরপরে বাগার দিলেই ঝামেলা শেষ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লবণ – সেই নুনের মতো ভালোবাসা। কোনদিন সেই ভালোবাসা কম বা কোনদিন বেশি! আরেকটা বিরাট সমস্যা হচ্ছে আগের দিনের রান্না করা ডাল পরের দিন একটু ঘন হয়ে যায়, আগের দিনের পারফেক্ট নুন দেওয়া ডাল পরদিন নোনতা ঠেকে। লাইফ মোমেন্ট, জীবন যে আসলে পারফেক্ট না, প্রতিবার বাসি ডাল খেতে গেলে আমার মনে হবেই। আমি চেষ্টা করি ঠিক ততটুকু ডাল রান্না করতে যেটা একবার খেলেই শেষ হয়ে যাবে।
তবে আমার ডালের নুন নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমি কানে তুলি না, বরং নুন খাই যার গুণ গাই তার – এই আপ্তবাক্য মনে করিয়ে দেই। বেশি নুন গেলে বেশি গুন গাইতে হবে।
-৩-
ধনেপাতার ইংরেজি নাম হচ্ছে সিলানট্রো (cilantro), বাজারে যেখানে ধনেপাতা রাখা থাকে তার ঠিক পাশেই পার্সলে (Parsley) নামের একটা জিনিস রাখা থাকে। দেখতে দুটো প্রায় একই রকম। আমাদের খাবারে ধনেপাতা লাগে কিন্তু পার্সলে খুব বেশি ব্যবহার হয় না। কিন্তু তাড়াহুড়া করে ধনেপাতার বদলে পার্সলে কিনে আনা খুব সাধারণ ঘটনা। আমি বহু বহু দিন রান্না করতে গিয়ে ধনেপাতার স্টেপে এসে আবিষ্কার করেছি যেটাকে আমি ধনেপাতা ভেবে বাজারের ব্যাগে ঠাঁই দিয়েছি, সে আসলে ছদ্মবেশি, প্রপঞ্চক পার্সলে।
এই প্রপঞ্চনাময় পার্সলেকে কেন ধনেপাতার পাশেই রাখে দোকানিরা? রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের শেষ কবিতায় লিখেছিলেন
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
পাশাপাশি রাখা ধনেপাতা আর পার্সলে এই কবিতার ভাবসম্প্রসারণে ব্যবহার হতে পারে। এহেন ছলনা আর মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ এই সংসারে কমই দেখা যায়। তাই দোকানে গেলে আমি একটু পাতা ছিড়ে ডলে গন্ধ নিয়ে চিনে নেই ধনে পাতা নিচ্ছি কিনা।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
পুরো কবিতাটা আমার কাছে আরও পরিষ্কার হয়। প্রতিবার ঠিকঠাক মতো ধনেপাতা কিনলে মহৎ কাজের আনন্দ পাই।
আমি যদি কোনদিন মুদির দোকান দেই – ধনেপাতা আর পার্সলে এই দুই বস্তু দোকানের দুই মাথাতে রাখবো। একই সঙ্গে পার্সলের উপরে বড় বড় লেখা থাকবে - আমি ধনেপাতা নই!!!

যখনই একটু ছুটি পাই

দীর্ঘদিন বাসায় বসে অফিসের কাজ করেছি। এখনও করি মাঝে মাঝে। কাজে বিরতি নেওয়ার জন্য বাইরে গিয়ে বসতাম। প্রতিদিনই পৃথিবী আমাকের মুগ্ধ করত। কোনদিন আকাশে ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো স্তুপ স্তুপ মেঘ, কখনও ঘন নীল আকাশ, আরেকদিন বৃষ্টি নামবো নামবো করছে - একই পৃথিবীর নানান রূপ। পৃথিবী যেন রোজ সকালেই নতুন নতুন বিস্ময় নিয়ে আসে আমার দরজার সামনে।
আমি প্রাণীজগতের খুঁটিনাটি দেখতাম। গর্ডি নামের একটা বিড়াল মাঝে মাঝে আমার খুব কাছেই গম্ভীরভাবে বসে থাকতো। একবার তাকে ইঁদুর মারতে দেখেছি। অনেক চেষ্টা করেও খাতির করতে পারি নি। আমাকে সে অপাংক্তেয় মনে করেছে। প্রতিবেশির কুকুর প্রিন্সেস ফিয়োনাও আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতো।
একদিন পাখিদের সাথে কাঠবিড়ালিদের একপেশে সংঘর্ষ দেখলাম। এক পাখি দম্পতি কাঠবিড়ালির মাথাতে উড়ন্ত হামলা চালাচ্ছিল। আমার ধারণা ছিল পাখি নিরীহ প্রাণী। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই দেখেছি। আধমরা এক সাপের বাচ্চাকে পুরোপুরি পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দিল এক মিনিটেই।
এই জগতটা কোন নিয়মে চলে সেটা প্রকৃতির বাইরের বাস করা মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন। বাকি প্রানীকুল আমাদেরকে খেলায় নিতে চায় না।মানুষের হিংস্রতা এতো বেশি যে আমাদেরকে না নেওয়ারই কথা।
গত বছর লেখালেখির সূত্রে চেনা একটা মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। আমার সহকর্মীদের একজন ক্যান্সার নিয়ে কাজ করে চলেছেন। আমার মা-ও কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বহুক্ষেত্রেই আজকাল এই রোগ নিয়ে মানুষ অনেক অনেক দিন বেঁচে থাকে, কাজ করে, জীবন উপভোগ করে।
মেয়েটাকে আমি সেই কথাই বলেছিলাম।
গতসপ্তাহে মেয়েটা ইহলোক ত্যাগ করেছে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলা কষ্টেরও অবসান হয়েছে।
জীবন আর মৃত্যু দুটোই স্বাভাবিক ঘটনা, আমাদের দরজার বাইরে তাকালেই সেটা বুঝতে পারি। তবুও আমি মৃত্যু, দুঃখ, শোক-সন্তাপ থেকে বহুদূরে পালাতে চাই। বেঁচে থাকতে আমার ভালো লাগে।
বেঁচে থাকা মানেই সম্ভাবনার বেঁচে থাকা।
বেঁচে থাকলে সকালবেলার রোদ্দুর দেখা যাবে। বেঁচে থাকলে হয়তো পাখিদের ডাক শোনা যাবে।
আগামীকাল দিনটা আজকের চেয়ে ভালো হতে পারে।
সামনের সপ্তাহটা আরও সুন্দর।
সামনের মাসটাতে হয়ত যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে।
সামনে বছরটাতে অসুখ বিসুখ উঠে যাবে।
স্বার্থপরের মতো তাই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
আর বেঁচে থাকলেই জীবনের অবধারিত নিয়মে মৃত্যু, শোক, কষ্ট, জরা, ব্যধি, দুঃখ দেখেই যেতে হয়।
হুমায়ুন আজাদ সামান্য কিছুর জন্য মারা যেতে চেয়েছিলেন। অথচ আমি দেখেছি কী সামান্য জিনিসের জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
"যখনই একটু ছুটি পাই আমি ছুটে যাই ছাদে সন্ধ্যের মুখে।
যখনই একটু ছুটি পাই আমি ছুটে যাই ছাদে আকাশ দেখতে। ।
ছাদের মাথায় আকাশ দাঁড়িয়ে, আকাশের গায়ে কত কত রং
রং বদলায়, রং বদলায়, মেঘ পাখি সবই বদলিয়ে যায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব দেখি,
ঝিলিক দিয়েছে বিদ্যুৎ রেখা
হঠাৎ কখন তারা দেখা যায়
অমনি আকাশ রং বদলায়।
মস্ত আকাশ, মগ্ন সাগর দিনে দিনে কত রং বদলায়
দিন রাত চলে আপন নিয়মে আমারো সময় বয়ে চলে যায়।
একদিন আমি সূর্য গ্রহণ দেখেছি হয়ত শ্রাবন ও দেখব
একদিন আমি পূর্ণগ্রহণ দেখেছি হয়ত প্লাবনও দেখব
এত বড় ঢেউ এত ছোট আমি সময়ের তোড়ে ভেসে চলে যাই।"
(যখনই একটু ছুটি পাই/ মৌসুমী ভৌমিক)

বাবার গল্প

আব্বার সাথে একবার চশমা কিনতে গেলাম। গ্রিন সুপার মার্কেটে। আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম, আমাদের এক বন্ধুর চশমার দোকান আছে। একটা ফ্রেম পছন্দ হল। আব্বার ব্যক্তিগত পলিসি হচ্ছে দরাদরি করে জিনিস কিনতে হবে। উনি একটা দাম বলতে যাচ্ছিলেন। এমনি সময় আমার বন্ধু উপস্থিত হল। আব্বা দাম বলার আগেই সে দাম কমিয়ে দিল। যেই মূল্য ধার্য করা হল সেটা সম্ভবত আব্বার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম। এই অপ্রত্যাশিত মূল্য হ্রাসে আব্বা পুরোই ভ্যাবাচাকা খেয়ে ​গেছেন। ওনার ভাষাতে "মুলামুলি" না করে জিনিস কেনা মানেই হচ্ছে ঠকা। জীবনে সম্ভবত এই প্রথম উনি মুলামুলি করার কোন সুযোগ পেলেন না।

চশমার দোকান থেকে বের হলাম আমরা, হেঁটে হেঁটে ফার্মগেটে যাচ্ছি। আব্বাকে খুব চুপচাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে উনি একটা অস্বস্তির মধ্যে আছেন। আনন্দ হলের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আমাকে নিয়ে একটা হোটেলে গেলেন। আমাকে বললেন খাবার অর্ডার দিতে। উনি দ্রুত রেঁস্তোরা থেকে বের হয়ে রাস্তার উল্টো দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি সাত পাঁচ ভাবছি - বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। উনি একটু পরেই চলে আসলেন। কিছুক্ষণ আগের অস্বস্তি চলে গেছে। এই সংক্ষিপ্ত সফর শেষে ওনাকে অনেক প্রশান্ত মনে হচ্ছে।
আব্বা জানালেন উনি রাস্তার উল্টোদিকের চশমার দোকানগুলো ঢুঁ মেরেছেন। যেই ফ্রেমটা একটু আগেই উনি কিনেছেন গ্রিন সুপার থেকে - সেটা খুঁজে বের করেছেন। বের করে সেটা দামাদামি করে দেখেছেন। এটার কারণ হচ্ছে উনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে একটু আগে কেনা ফ্রেমটা উনি "ন্যায্য" মূল্যে পেয়েছেন। সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরে শান্ত হয়েছেন। রেঁস্তোরাতে খেতে খেতে উনি আমাকে বহুবার যেই উপদেশটা দিয়েছেন - সেটা আবারও দিলেন - মুলামুলি ছাড়া কোন কিছু কিনবা না, কিনলেই ঠকবা।
আব্বা বেশি উপদেশ দিতেন না, ইনফ্যাক্ট সব মিলিয়ে ৪/৫টার বেশি উপদেশ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ওনার উপদেশগুলো খুবই বাস্তবসম্মত ছিল। আরেকটা কয়েকটা উপদেশ হচ্ছে - টাকা নষ্ট করবা না, টাকা সবচেয়ে বড় বন্ধু - হ্যাভ দ্য এবিলিটি বাট ডু নট বাই। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ফিক্সড প্রাইজ বলে কিছু নেই। ইনফ্যাক্ট এই হানাহানিময় ভুবনে সবাই চাইবে গলা কাটতে, সেটার হাত থেকে বাঁচতে হলে লাইফস্কিল শিখতে হবে। মুলামুলি আসলে লাইফস্কিল বিশেষ। দ্বিতীয়ত - মানুষকে বিশ্বাস করার আগে তার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে দেখা উচিত। বুদ্ধিমান লোকেরা তাই করে।
এই ঘটনাটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে কেননা এর সমতুল্য কোন শিক্ষা আমি আর পাইনি। চাকরি, বিনিয়োগ, ভালোবাসা - সর্বত্রই অপরপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ের দরকার আছে, এবং সেই সঙ্গে দরকার উপযুক্ত দরাদরির। এই পৃথিবীতে পদে পদে মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পাতা আছে। আব্বা আমাকে এই পৃথিবীর অপার সত্যটা দর্শন করাতে চেয়েছেন। সফল হয়েছেন কিনা জানি না - কিন্তু ধরা খাওয়ার পরে আমি অন্তত বুঝতে পেরেছি ভুলটা কোথায় ছিল।
অনেক অনেক দূরে বসে আমি মাঝে মাঝে আব্বার কথা ভাবি। অসম্ভব দূরত্ব থেকে তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করি। মিনিমালিস্ট লাইভস্টাইল মুভমেন্টের উপর একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে আমার আব্বার কথা মনে হচ্ছিল - উনি নিশ্চিত ভাবে মিনিমালিস্ট মুভমেন্টের যুগ্ম আহবায়ক পদ পেতে পারতেন। উনার পুরো জীবনটাই ছিল বাহুল্য বর্জিত, যাবতীয় পার্থিব জিনিস একটা আলমারির দুটো ড্রয়ারে এঁটে যেত। রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়তেন, ভোর পাঁচটাতে উঠতেন। নিজের হাতে প্রচুর কাজ সারতেন। সবুজ ভালোবাসতেন, যত্রতত্র গাছ লাগাতেন। কোথাও গাছ কাটা হলে কষ্ট পেতেন।
যেই সময়টা আমি ওনার সাথে কাটিয়েছি, সেই সময়টাতে আমি ওনাকে বুঝতে চাইনি বরং বিদ্রোহী হয়েছি। অনেক অনেকদিন পরে সেই বোঝার কাজটি করার চেষ্টা করছি। আমি ঠিক জানি না সংসার থেকে কখনও উনি ছুটি চাইতেন কিনা, জ্যোৎস্না রাতে সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগের ইচ্ছে হত কিনা তাঁর। কোন এক ঝড়ের রাতে কি মনে হত - নাহ, এই জীবনটা আমি চাই নি? সকালবেলাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি ভেবেছিলেন কখনও এই মানুষটাকে আমি চিনি না? অথবা ফিরতে কী চাইতেন দূর শৈশবে, যেখানে বাতাসে বাতাবী লেবুর মতো আনন্দের গন্ধ মাখা থাকে?
কোন কিছুই জানা হয় নি, শুধু দেখে গেছি সংসারের অভিকর্ষে আটকে থাকা ঘোর বাস্তবতা নিয়ে বাস করা একজন মানুষ, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যার কেটে যায় দায়িত্ব পালনে। আমি আমার পিতাকে চিনি, কিন্তু একদম ভেতরের মানুষটাকে জানতে পারি নি। জানতে চাইও নি। আব্বা, আপনার কাছে আর ফেরার উপায় নেই, তবুও বাকিটা জীবন আমি খুঁজে যাবো আপনাকেই।

Thursday, July 22, 2021

মৃত্যু

- ১-

আমি তখন খুব ছোট। পাঁচের নিচেই হবে। আমার একমাত্র বন্ধু তিথি, আমাদেরই বাসাতে ভাড়া থাকে। ওরা একতলাতে, আমরা দোতলায়। একদিন দেখি ওদের বাসাতে অনেক লোক। তিথির দাদার (অথবা নানার) শরীর খুব খারাপ।
আমি আর তিথি শোবার ঘরে দাদাকে দেখতে গেলাম। বুড়ো বিছানাতে শুয়ে আছেন, শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। নাকে নল দেওয়া, পাশে সবুজ রংয়ের একটা সিলিন্ডারের মতো জিনিস। কষ্ট করে যেটুকু নিঃশ্বাস নিতে পারছেন, সেটা সম্ভবত ওইটার কল্যাণেই সম্ভব হচ্ছে।
পুরো ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক আমাদের হটিয়ে দিলেন। বাচ্চাদের এখানে থাকার দরকার নেই। একদম ঠিক কাজই করেছিলেন বলা যায়। যদিও আমরা কাছে ধারেই ঘুরঘুর করছিলাম। আমরা হটে গেলেও মৃত্যু সেখান থেকে হটে যায় নি। চারিপাশের রাশি রাশি উদ্বিগ্ন মুখ বলে দিচ্ছিল মৃত্যু যেন ধারে কাছে কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে।
আমার মনে নেই ভদ্রলোকের মৃত্যু হাসপাতালে নাকি আমাদের বাসাতেই হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যাতে নিচ থেকে অনেক কান্নার রোল ভেসে এলো – সেই থেকে মৃত্যু যেন আমার কাছে সবুজ অক্সিজেন সিলিন্ডার, কষ্ট করে নেওয়া শ্বাস, মাথার উপরে টিমটিমে হলদে চল্লিশ পাওয়ারের বাতি আর দূর থেকে শোনা কান্না। এর থেকে যতদূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
এরপরে প্রায় এক জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে, আমার বহু বহু প্রিয়জন চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু আমাকে কারো মৃত্যুযন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করতে হয়নি। আমি প্রায় পুরো জীবন দূর থেকেই মৃত্যুর সংবাদ শুধু শুনে গেছি, দেখিনি সামনে থেকে – জীবনের এই অবশ্যসম্ভাবী যন্ত্রণাময় পরিণতি দর্শন থেকে আমি পালিয়ে থাকতে চাই। যতদিন না পর্যন্ত নিজের দরজায় তার টোকা না পড়ে।
- ২ –
আমাদের দুটো পাখি আছে। টুপুর আর টাপুর। বৃষ্টির শব্দের নামে। বারো বছর আগে টুপুরকে আমি ঘরে আনি। প্যারাকিট বা বাজি। আনুশার বয়েস ৪ আর সামারার ২। কোথা থেকে এনেছিলাম, কিভাবে এনেছিলাম সবই মনে আছে। বাচ্চারা খুবই খুশি। এর কিছুদিন পরে টাপুরকে নিয়ে আসি আমরা একই জায়গা থেকে। আনুশা আর সামারা খুবই খুশি – টুপুরের সঙ্গী জুটে গেল।
প্রথমে চিন্তা করিনি কিন্তু খাঁচায় বন্দী পাখি আমাকে আস্তে আস্তে বিষণ্ণ করে তুললো। একবার ভেবেছিলাম মুক্ত করে দিবো। কিন্তু সেটা প্রায় মৃত্যুদণ্ডের মতোই হবে। টুপুর আর টাপুর রয়ে যায়, আনুশা আর সামারাও বড় হতে থাকে। একটা সময়ের পর পাখিদের ব্যাপারে ওদের আগ্রহে ভাঁটা পড়ে। পাখি দুটো নিজেরাই কিচির মিচির করে দিন কাটিয়ে দেয়।
পাখিরাও বুড়ো হয়, তাদেরও জরাব্যাধি গ্রাস করে। প্যারাকিট বেশ আজব পাখি। এদের অসুস্থতা বোঝার উপায় নেই। একদম শেষ সময়ে গিয়ে টের পাওয়া যায়। গত রবিবার বিকালে আমি লক্ষ্য করি টুপুর খাঁচার নিচে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে অল্প ডানা ঝাপটাচ্ছে। সেই সঙ্গে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। টুপুরের সঙ্গী টাপুর এসে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে একটু পর পর। কিছুক্ষণ পরে টুপুর অনেক কষ্ট করে খাবারের দানি থেকে অল্প অল্প খাবার মুখে দিলো।
বহু বহু বছর পরে আমি আবারও মৃত্যুযন্ত্রণা দেখতে পেলাম চোখের সামনে। টুপুর খুবই কষ্ট পাচ্ছিল, আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ওর সঙ্গী টাপুর খুব বিচলিত হয়ে আছে। বহুকাল পরে সেই সবুজ অক্সিজেন, হলুদ আলোয় দূর থেকে শোনা কান্না যেন ফেরত এলো। মৃত্যুকে ভালোবাসা সম্ভব না আমার পক্ষে, মৃত্যুকে ভালোবাসতে গেলে জীবনকে নাকচ করে দিতে হয়। কিন্তু এর থেকে পালানোও সম্ভব না এই সত্যটা আবারও টের পেলাম।
অসহায় আমি টের পেলাম এই যন্ত্রণা লাঘব করার মতো কিছুই নেই আমার হাতে। রবিবার রাতে পাখির ডাক্তার পাওয়ার সম্ভবনা নেই। সোমবার সকালে এক জায়গাতে ফোন দিবো ঠিক করে রাখলাম। গভীর রাত পর্যন্ত খাঁচার পাশে বসে রইলাম। টুপুরের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম। আমি আবারও টের পেলাম সবাই বেঁচে থাকতে চায়, টুপুরের ডানা ঝাপটানো, কষ্ট করে খাবার মুখে দেওয়া, বেঁচে থাকার জন্য আকুলতা মনে করিয়ে দেয় "আট বছর আগের একদিন" কবিতার লাইন।
“গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।“
(আট বছর আগের একদিন/জীবনানন্দ দাশ)
আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগেও টুপুর বেঁচে ছিল, ডানা ঝাপটাচ্ছিল। সকালে উঠে দেখি সব চুপচাপ। টাপুর এসে ওকে খাওয়ানোর প্রচুর চেষ্টা করছে – ও সাড়া দিচ্ছে না। টুপুরকে বাসার পেছনে সমাহিত করার পরেও দেখলাম টাপুর এসে বসে আছে খাঁচার সেইখানে, যেখানে টুপুর পড়েছিল। পাখিরাও ভালোবাসতে জানে, পাখিরাও দুঃখ শোকে মৃত্যুতে কাতর হয়।
যতগুলো মৃত্যু থেকে পালিয়ে দূরে ছিলাম এতোদিন, প্রতিটি মৃত্যুর যন্ত্রণা আর শোক এই সোমবারের প্রবল বর্ষণময় সকালে আবারও ফিরে এলো চুপচাপ, সপ্তপর্ণে। খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল টুপুর এক বৃষ্টির দিনে।
“নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করলে, প্রতিটা সম্পর্কই স্থাপিত হওয়া মাত্রই এ সম্পর্কের জন্য কষ্ট পাওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। সম্পর্কগুলি অনেকটা টাইম বম্বের মতো। একটা সম্পর্কের শুরু মানেই যেন কেউ টাইমার অন করে দিলো। যতো আনন্দই আসুক, যতো প্রাপ্তিই আসুক, এ সম্পর্কের থেকে নির্ধারিত কষ্টটুকু নিশ্চিতভাবেই পেতে হবে। এই কষ্টের সবটুকুই অনতিক্রম্য নিয়তি। এই দুঃখ, এই বিষণ্ণতা, এই শূন্যতাই শ্বাশত, ন হন্যতে।“
(ন হন্যতে/সবজান্তার ব্লগ - সচলায়তন)

Wednesday, July 21, 2021

মানুষের ঘরবাড়ি

সফরে বের হয়েছিলাম। ভ্রমনের সাতদিনের মাথাতে দুই মেয়েই হোম সিক হওয়া শুরু করল। আমার থিওরি হচ্ছে প্রতিটি মানুষের একটা হোমসিকনেস থ্রেশোল্ড আছে। কেউ দুই দিন পরেই হোম সিক হয়, কেউ সাত দিন, কেউ সারাজীবনেও না। নতুন জায়গাতে গেলে তারা সেটাকেই বাড়ি বানিয়ে ফেলে, বাসাবাড়ির অভিকর্ষে আটকা পড়ে না। বর্তমান ভ্রমণের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে আমার মেয়েদের থ্রেশোল্ড এক সপ্তাহ।

"আব্বু আই মিস মাই রুম..."
বাসাতে লিভিংরুমে সিকিউরিটি ক্যামেরা বসিয়ে এসেছি, ট্রিপের জন্য। সেই ক্যামেরা দিয়ে মেয়েদের রুমের দরজা দেখা যায়। মেয়েরা ব্যাকুল হয়ে নিজের বাসা দেখে। সুইজারল্যান্ডের পাহাড় তাদের টানে না, নিজের বিছানায় শোয়ার জন্য মন কেমন করে - উপরে পাখা ঘুরবে, দেয়ালে বাতি, ফোনে স্ন্যাপচ্যাট, কানে স্পটিফাই। এই হচ্ছে মেয়েদের ঘরবাড়ি।
"আব্বু ডু ইউ ফিল হোমসিক?"
আমার থ্রেশোল্ড ১৩/১৪ দিন। বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখেছি, যেখানেই যাই না কেন, দুই সপ্তাহ পরে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে। স্বর্গে গেলেও দুই সপ্তাহ পরে ফিরতে চাইবো বলে মনে হয়। মেয়েদেরকে জানালাম সেটা। আরও জানালাম যে হোমসিক প্রবলভাবে শুরু হওয়ার আগেই ফিরে যাবো।
"আব্বু উইচ ওয়ান ইজ ইউর হোম, ঢাকা অর অস্টিন?"
এটা জটিল প্রশ্ন। এর কোন সহজ উত্তর নেই। ঢাকা থেকে আমেরিকাতে আসার কয়েক বছর পরে আম্মাকে একটা চিঠিতে লিখেছিলাম - যেখানে ফিরলে ভ্রমণ শেষ হয়েছে বলে মনে হয় সেটাই আসলে বাড়ি। তখন ঢাকাতে ফিরলেই মনে হত ভ্রমণ শেষ হয়েছে, একটু শান্তিতে ঘুমানো যাবে। আম্মার পছন্দ হয়েছিল যুক্তিটা, তিনি তখন স্বাস্থ্যগত কারণে কার্যত গৃহবন্দী, তাঁর থ্রেশোল্ড দুই ঘন্টা গিয়ে ঠেকেছে, বাইরে গেলেই একটু পরে ঘরে ফিরতে চান।
এখন আর সেই অবস্থা নেই আমার। আমিও অস্টিনে ফিরতে চাই। নিঃসন্দেহে এটাই আমার বাড়ি - এইখানে ফিরলেই মনে হয় ভ্রমণ শেষ হয়েছে। ঢাকার কথা আমার মনে হয়, কিন্তু সেটা আর ঘরবাড়ি নয়। ঢাকার যেইটুকু আমার ভেতরে রয়ে গেছে, সেটা আর কোথাও নেই, শুধু আছে আমার দীর্ঘশ্বাসে। ঢাকাতে গেলেও অস্টিনে ফেরার জন্য ব্যাকুল লাগে আজকাল।
"হোয়াট ডু ইউ মিস এবাউট হোম?"
অস্টিনের বাসার পেছনে একটা বাগান আছে, সেখানে বড় কয়েকটা গাছ আছে। ভোরে আমি সেইখানে বসে থাকি। একটা কাঠবিড়ালি আসে সেখানে, সামারা নাম দিয়েছে মিস্টার ফ্লাফি। ইদানিং আরেকটা কাঠবিড়ালি আসা শুরু করেছে। তারা বেড়ার উপর দিয়ে দৌড়ে বেড়ায়। সেই সবুজ বাগানে সকাল বেলা চায়ের কাপ নিয়ে বসলে আমি আমার পুরনো শহরটা দেখতে পাই, দেখতে পাই পুরনো ঘরবাড়ি, ভাঙ্গা রাস্তা, মানুষের ভিড়, একটা চিলেকোঠা - তার টিনের চালের ফুটো দিয়ে রোদের রেখা ঢুকে পড়ে - একদম বুকের ভেতরে দাগ রেখে যায়। একদা যেটা দেশ বলে জানতাম, সেই দেশটা একদম ছোট হতে হতে আমার উঠোনে চলে আসে, প্রতিদিন সকালে।
ফেলা আসা ঘরবাড়ির জন্য আমাদের মন কেমন করে। সব কিছু জড়, সব কিছু অস্থাবর, সব কিছুই ছেড়ে দিতে হবে - তার পরেও এর মধ্যে কোথায় যে মায়া লুকানো আছে কেউ জানে না, কেউ জানে না - এক চিলতে জমি, কয়েকটা ঘরদুয়ার, দরজা আর জানালা কী ইন্দ্রজালে একদিন মানুষের ঘরবাড়ি হয়ে যায়!
"সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
রোদ আমার ভেতরে বাজতে থাকে মোহন বাদ্যযন্ত্রের মতো
আর আমি যেন নিভৃত আরোগ্যশালায়
একটু একটু করে স্বাস্থ্য ফিরে পাই। ভোর স্বপ্নের ভাষায়
অপরূপ কোলাহলময় আমার শিরায় শিরায়;
আমি সঙ্গমকালীন একাকিত্বের কথা ভুলে, ভুলে উঠোনের কথা
দিগন্ত আর ধাবমান অশ্বপালের কথা ভাবি।"
(একটি দুপুরের উপকথা/ শামসুর রাহমান)