দীর্ঘদিন বাসায় বসে অফিসের কাজ করেছি। এখনও করি মাঝে মাঝে। কাজে বিরতি নেওয়ার জন্য বাইরে গিয়ে বসতাম। প্রতিদিনই পৃথিবী আমাকের মুগ্ধ করত। কোনদিন আকাশে ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো স্তুপ স্তুপ মেঘ, কখনও ঘন নীল আকাশ, আরেকদিন বৃষ্টি নামবো নামবো করছে - একই পৃথিবীর নানান রূপ। পৃথিবী যেন রোজ সকালেই নতুন নতুন বিস্ময় নিয়ে আসে আমার দরজার সামনে।
আমি প্রাণীজগতের খুঁটিনাটি দেখতাম। গর্ডি নামের একটা বিড়াল মাঝে মাঝে আমার খুব কাছেই গম্ভীরভাবে বসে থাকতো। একবার তাকে ইঁদুর মারতে দেখেছি। অনেক চেষ্টা করেও খাতির করতে পারি নি। আমাকে সে অপাংক্তেয় মনে করেছে। প্রতিবেশির কুকুর প্রিন্সেস ফিয়োনাও আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতো।
একদিন পাখিদের সাথে কাঠবিড়ালিদের একপেশে সংঘর্ষ দেখলাম। এক পাখি দম্পতি কাঠবিড়ালির মাথাতে উড়ন্ত হামলা চালাচ্ছিল। আমার ধারণা ছিল পাখি নিরীহ প্রাণী। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই দেখেছি। আধমরা এক সাপের বাচ্চাকে পুরোপুরি পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দিল এক মিনিটেই।
এই জগতটা কোন নিয়মে চলে সেটা প্রকৃতির বাইরের বাস করা মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন। বাকি প্রানীকুল আমাদেরকে খেলায় নিতে চায় না।মানুষের হিংস্রতা এতো বেশি যে আমাদেরকে না নেওয়ারই কথা।
গত বছর লেখালেখির সূত্রে চেনা একটা মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। আমার সহকর্মীদের একজন ক্যান্সার নিয়ে কাজ করে চলেছেন। আমার মা-ও কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বহুক্ষেত্রেই আজকাল এই রোগ নিয়ে মানুষ অনেক অনেক দিন বেঁচে থাকে, কাজ করে, জীবন উপভোগ করে।
মেয়েটাকে আমি সেই কথাই বলেছিলাম।
গতসপ্তাহে মেয়েটা ইহলোক ত্যাগ করেছে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলা কষ্টেরও অবসান হয়েছে।
জীবন আর মৃত্যু দুটোই স্বাভাবিক ঘটনা, আমাদের দরজার বাইরে তাকালেই সেটা বুঝতে পারি। তবুও আমি মৃত্যু, দুঃখ, শোক-সন্তাপ থেকে বহুদূরে পালাতে চাই। বেঁচে থাকতে আমার ভালো লাগে।
বেঁচে থাকা মানেই সম্ভাবনার বেঁচে থাকা।
বেঁচে থাকলে সকালবেলার রোদ্দুর দেখা যাবে। বেঁচে থাকলে হয়তো পাখিদের ডাক শোনা যাবে।
আগামীকাল দিনটা আজকের চেয়ে ভালো হতে পারে।
সামনের সপ্তাহটা আরও সুন্দর।
সামনের মাসটাতে হয়ত যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে।
সামনে বছরটাতে অসুখ বিসুখ উঠে যাবে।
স্বার্থপরের মতো তাই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
আর বেঁচে থাকলেই জীবনের অবধারিত নিয়মে মৃত্যু, শোক, কষ্ট, জরা, ব্যধি, দুঃখ দেখেই যেতে হয়।
হুমায়ুন আজাদ সামান্য কিছুর জন্য মারা যেতে চেয়েছিলেন। অথচ আমি দেখেছি কী সামান্য জিনিসের জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
"যখনই একটু ছুটি পাই আমি ছুটে যাই ছাদে সন্ধ্যের মুখে।
যখনই একটু ছুটি পাই আমি ছুটে যাই ছাদে আকাশ দেখতে। ।
ছাদের মাথায় আকাশ দাঁড়িয়ে, আকাশের গায়ে কত কত রং
রং বদলায়, রং বদলায়, মেঘ পাখি সবই বদলিয়ে যায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব দেখি,
ঝিলিক দিয়েছে বিদ্যুৎ রেখা
হঠাৎ কখন তারা দেখা যায়
অমনি আকাশ রং বদলায়।
মস্ত আকাশ, মগ্ন সাগর দিনে দিনে কত রং বদলায়
দিন রাত চলে আপন নিয়মে আমারো সময় বয়ে চলে যায়।
একদিন আমি সূর্য গ্রহণ দেখেছি হয়ত শ্রাবন ও দেখব
একদিন আমি পূর্ণগ্রহণ দেখেছি হয়ত প্লাবনও দেখব
এত বড় ঢেউ এত ছোট আমি সময়ের তোড়ে ভেসে চলে যাই।"
(যখনই একটু ছুটি পাই/ মৌসুমী ভৌমিক)
No comments:
Post a Comment