বাজার করা কঠিন কাজ। শিব্রাম চক্রবর্তীর একটা গল্প আছে, বাজার করা হাজার ঠ্যালা নামে। আক্ষরিক অর্থেই এইটা সত্য। সেই সঙ্গে বলতে হচ্ছে আমাদের দেশি লোকদের বাজার আরও কঠিন কাজ। আমরা নানান রকম জিনিস কিনি, সব কিছু এক জায়গাতে পাওয়া অসম্ভব। এই বাইরেও নানান জটিলতা আছে, আমার কাছে বাজার করা বুয়েটের পরীক্ষার মতো লাগে। ব্যাপারটা বুঝায়ে বলি।
জটিলতা -১
মারিয়া বাজারের লিস্ট করে দেয়। সেই লিস্টের ব্যাপ্তি এক থেকে শুরু করে ৫৫ পর্যন্ত...আমার কাছে সেটা অসীমের কাছাকাছি। আমি একদিন আপত্তি করলাম – এতো জিনিস আনা সম্ভব না। মারিয়া এরপর থেকে ছোট লিস্ট দেয়। লিস্টে পাঁচটা আইটেম থাকে।
১/ ডিম, দুধ, মাংস...(১০ টা আইটেম)
২/ চা পাতা, বিস্কিট... (১০ টা আইটেম)
৩/ (১০ টা আইটেম)
৪/ (১০ টা আইটেম)
৫/ (১০ টা আইটেম)
লিস্ট দৈর্ঘ্যে কম কিন্তু প্রস্থে বড়। আমি টের পেলাম লিস্টের দৈর্ঘ্য কমালে প্রস্থে সে বাড়বে। কাঠিন্য থেকেই যাবে। ধারে না কাটলেও সে ভারে কাটবে।
জটিলতা -২
একবার লিস্টে লেখা ছিল
পোলাওয়ের চাল, শনিবারের দাওয়াতের জন্য।
এইখানে বুয়েটের পরীক্ষার সাথে সবচেয়ে মিল। একটা তথ্য থেকে অন্য তথ্য বের করতে হবে। এখানে সরাসরি বলা নেই কয় পাউন্ডের প্যাকেট কিনতে হবে। বুয়েটের পরীক্ষার প্রশ্নতেও সরাসরি তথ্য দেওয়া থাকতো না। শনিবারের দাওয়াতে কতজন লোক আসবে এইটা জানা থাকতে হবে, সেই অনুযায়ী পোলাওর চাল কিনতে হবে। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অংকের মতো, গ্যাসের নাম বলা আছে, আর একটা গ্রাফ দেওয়া আছে, ওইখান থেকে খেটেখুটে বাকি সব কিছু বের করতে হবে।
জীবনটা আসলে পরীক্ষা, বুয়েটের সেমেস্টার ফাইনালের মতো। বাজারে গেলে সেটা আরো বেশি করে টের পাওয়া যায়।
জটিলতা - ৩
বাজারের লিস্টের সব জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না। বুয়েটের পরীক্ষার সাথে এখানেও মিল আছে। আমাদেরকে তিনটা প্রশ্নের মধ্যে দুটোর উত্তর করতে হতো (অথবা চারটার মধ্যে তিনটি), দেখা যেত একটা প্রশ্নের উত্তর পুরো জানি, আর বাকিগুলো অর্ধেক করে জানা, অর্থাৎ দুই নম্বর প্রশ্নের ক অংশের উত্তর জানি, কিন্তু খ অংশের উত্তর জানি না। তিন নম্বর প্রশ্নের খ অংশ জানি তো ক অংশ জানি না।
লিস্টে এই রকম জিনিস থাকে
রুটি, ডিম, ময়দা, সবুজ বিস্কুটের প্যাকেট যেখানে হালকা মেরুন স্ট্রাইপ আছে।
এইখানে সহজ অংশ আছে, রুটি, ডিম, ময়দা বেসিক জিনিস। কিন্তু সবুজ রঙ্গের প্যাকেটের বিস্কুট, তাতে হালকা মেরুন রংয়ের স্ট্রাইপ? এইটা সেই না পারা প্রশ্নের অংশের মতো। সিলেবাসের এক চিপা থেকে উঠায়ে দেওয়া হয়েছে, এর উত্তর ক্লাসের প্রথম ১০ জন ছাড়া কেউই জানে না।
বাজার করা এতো কঠিন কেন?
জটিলতা - ৪
জটিলতা-৩ নিরসনের জন্য ফোন দেই মারিয়াকে। ভিডিও কল করি, প্রতিটি বিস্কুটের প্যাকেটের ছবি দিয়ে কাংখিত সবুজ প্যাকেটের বিস্কুট বের করি যাতে হালকা মেরুন রং এর স্ট্রাইপ আছে। কিন্তু সমস্যা বেড়ে যায়...
"শুনো, কয়েকটা জিনিস ভুলে গেছিলাম। একটা রসুনের প্যাকেট দরকার, খোলা কোয়া রসুন, গোটা না, আর দরকার ছোট সাইজের শসা, বড়গুলো না কিন্তু, একটা কিসমিসের প্যাকেট হলুদ রংয়েরটা...
দেখা যাচ্ছে বাজার করা আসলে লাইফ মোমেন্ট, জটিলতা-৩ নিরসন করতে গেলে জটিলতা-৪ এর উদ্ভব হয়। জটিলতা-৪ ঠিক করতে গেলে জটিলতা-৫ এর উদ্ভব হবে এবং এই চক্র চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে, পৌনপুনিক ভংগ্নাশের মতো।
প্রায় তিন সপ্তাহ আমি একাই বাড়ি, ঘর, রান্না, বাজার সব সামলাচ্ছি। আমার ধারণা ছিল বাজার করার জটিলতা আমি কমাতে পারবো। আমার বাজারের লিস্ট ছোট, সত্যিকার অর্থে ৪/৫ টি জিনিস কিনতে আমি বাজারে ঢুকি। ইন এন্ড আউট পাঁচ মিনিটের কম সময় লাগে। কিন্তু গত ১৮ দিনে অন্তত ১৪ বার যেতে হয়েছে বাজারে...একবার আলু শেষ, বাজার করে এসে টের পাই পেঁয়াজও বাড়ন্ত ঘরে, এরপরে হয় চাল নেই, তারপরে রুটি...বাজার করা জটিল কাজ সন্দেহ নেই, প্রতিদিনই একবার যাচ্ছি …যেতে হচ্ছে আরকি!
No comments:
Post a Comment