Wednesday, July 21, 2021

মানুষের ঘরবাড়ি

সফরে বের হয়েছিলাম। ভ্রমনের সাতদিনের মাথাতে দুই মেয়েই হোম সিক হওয়া শুরু করল। আমার থিওরি হচ্ছে প্রতিটি মানুষের একটা হোমসিকনেস থ্রেশোল্ড আছে। কেউ দুই দিন পরেই হোম সিক হয়, কেউ সাত দিন, কেউ সারাজীবনেও না। নতুন জায়গাতে গেলে তারা সেটাকেই বাড়ি বানিয়ে ফেলে, বাসাবাড়ির অভিকর্ষে আটকা পড়ে না। বর্তমান ভ্রমণের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে আমার মেয়েদের থ্রেশোল্ড এক সপ্তাহ।

"আব্বু আই মিস মাই রুম..."
বাসাতে লিভিংরুমে সিকিউরিটি ক্যামেরা বসিয়ে এসেছি, ট্রিপের জন্য। সেই ক্যামেরা দিয়ে মেয়েদের রুমের দরজা দেখা যায়। মেয়েরা ব্যাকুল হয়ে নিজের বাসা দেখে। সুইজারল্যান্ডের পাহাড় তাদের টানে না, নিজের বিছানায় শোয়ার জন্য মন কেমন করে - উপরে পাখা ঘুরবে, দেয়ালে বাতি, ফোনে স্ন্যাপচ্যাট, কানে স্পটিফাই। এই হচ্ছে মেয়েদের ঘরবাড়ি।
"আব্বু ডু ইউ ফিল হোমসিক?"
আমার থ্রেশোল্ড ১৩/১৪ দিন। বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখেছি, যেখানেই যাই না কেন, দুই সপ্তাহ পরে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে। স্বর্গে গেলেও দুই সপ্তাহ পরে ফিরতে চাইবো বলে মনে হয়। মেয়েদেরকে জানালাম সেটা। আরও জানালাম যে হোমসিক প্রবলভাবে শুরু হওয়ার আগেই ফিরে যাবো।
"আব্বু উইচ ওয়ান ইজ ইউর হোম, ঢাকা অর অস্টিন?"
এটা জটিল প্রশ্ন। এর কোন সহজ উত্তর নেই। ঢাকা থেকে আমেরিকাতে আসার কয়েক বছর পরে আম্মাকে একটা চিঠিতে লিখেছিলাম - যেখানে ফিরলে ভ্রমণ শেষ হয়েছে বলে মনে হয় সেটাই আসলে বাড়ি। তখন ঢাকাতে ফিরলেই মনে হত ভ্রমণ শেষ হয়েছে, একটু শান্তিতে ঘুমানো যাবে। আম্মার পছন্দ হয়েছিল যুক্তিটা, তিনি তখন স্বাস্থ্যগত কারণে কার্যত গৃহবন্দী, তাঁর থ্রেশোল্ড দুই ঘন্টা গিয়ে ঠেকেছে, বাইরে গেলেই একটু পরে ঘরে ফিরতে চান।
এখন আর সেই অবস্থা নেই আমার। আমিও অস্টিনে ফিরতে চাই। নিঃসন্দেহে এটাই আমার বাড়ি - এইখানে ফিরলেই মনে হয় ভ্রমণ শেষ হয়েছে। ঢাকার কথা আমার মনে হয়, কিন্তু সেটা আর ঘরবাড়ি নয়। ঢাকার যেইটুকু আমার ভেতরে রয়ে গেছে, সেটা আর কোথাও নেই, শুধু আছে আমার দীর্ঘশ্বাসে। ঢাকাতে গেলেও অস্টিনে ফেরার জন্য ব্যাকুল লাগে আজকাল।
"হোয়াট ডু ইউ মিস এবাউট হোম?"
অস্টিনের বাসার পেছনে একটা বাগান আছে, সেখানে বড় কয়েকটা গাছ আছে। ভোরে আমি সেইখানে বসে থাকি। একটা কাঠবিড়ালি আসে সেখানে, সামারা নাম দিয়েছে মিস্টার ফ্লাফি। ইদানিং আরেকটা কাঠবিড়ালি আসা শুরু করেছে। তারা বেড়ার উপর দিয়ে দৌড়ে বেড়ায়। সেই সবুজ বাগানে সকাল বেলা চায়ের কাপ নিয়ে বসলে আমি আমার পুরনো শহরটা দেখতে পাই, দেখতে পাই পুরনো ঘরবাড়ি, ভাঙ্গা রাস্তা, মানুষের ভিড়, একটা চিলেকোঠা - তার টিনের চালের ফুটো দিয়ে রোদের রেখা ঢুকে পড়ে - একদম বুকের ভেতরে দাগ রেখে যায়। একদা যেটা দেশ বলে জানতাম, সেই দেশটা একদম ছোট হতে হতে আমার উঠোনে চলে আসে, প্রতিদিন সকালে।
ফেলা আসা ঘরবাড়ির জন্য আমাদের মন কেমন করে। সব কিছু জড়, সব কিছু অস্থাবর, সব কিছুই ছেড়ে দিতে হবে - তার পরেও এর মধ্যে কোথায় যে মায়া লুকানো আছে কেউ জানে না, কেউ জানে না - এক চিলতে জমি, কয়েকটা ঘরদুয়ার, দরজা আর জানালা কী ইন্দ্রজালে একদিন মানুষের ঘরবাড়ি হয়ে যায়!
"সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
রোদ আমার ভেতরে বাজতে থাকে মোহন বাদ্যযন্ত্রের মতো
আর আমি যেন নিভৃত আরোগ্যশালায়
একটু একটু করে স্বাস্থ্য ফিরে পাই। ভোর স্বপ্নের ভাষায়
অপরূপ কোলাহলময় আমার শিরায় শিরায়;
আমি সঙ্গমকালীন একাকিত্বের কথা ভুলে, ভুলে উঠোনের কথা
দিগন্ত আর ধাবমান অশ্বপালের কথা ভাবি।"
(একটি দুপুরের উপকথা/ শামসুর রাহমান)

No comments: