মীনার কার্টুনের একটা এপিসোড আছে, মীনা আর রাজু দায়িত্ব বদল করে। মীনার কাজ রাজু আর রাজুর কাজ মীনার করতে হবে। সেটার থেকে উদ্ভুত শিক্ষা হচ্ছে পুরুষ আর নারী দুইজনের কাজের কোনটাই কম গুরুত্বপূর্ণ না সেটা শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া। তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে পুরুষ আর নারীর কাজের পার্থক্য থাকা উচিত না, কিন্তু...
মারিয়া তিন সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে। আপাতত বাসাতে আমি মীনা এবং রাজু দুইটি ভূমিকাই পালন করছি। বাসার কাজগুলো সম্বন্ধে আমার মোটামুটি আইডিয়া আছে, আমি কাজ চালানোর মতো রান্না করতে পারি, ঘরদোর পরিষ্কার সবই করতে পারি। বাড়তি কিছু কাজ আছে, বাচ্চারা ঠিক সময়ে ঘুমাতে যাচ্ছে কিনা, পানি খাচ্ছে কিনা এইগুলোও মনিটর করতে হবে আমাকে।
পরিস্থিতি- ১
রাত এগারোটার সময়ে আমি বাচ্চাদের জানালাম ঘুমানোর সময় হয়েছে, বাতি নিভাতে হবে। একই সঙ্গে সারাদিন পান করা পানির পরিমাণ জানতে চাইলাম।
"হেই ইউ ক্যানট আস্ক ইট, ইউ আর নট মাই মাম...”
এমনিতে নারী পুরুষের সমতা নিয়ে মেয়েরা প্রায়ই আমাকে লেকচার দেয়। কিন্তু কার্যত দেখা গেল ভেতরে ভেতরে সবাই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া।
আমি জানালাম আমি ইনচার্জ, সব খোঁজখবরের দায়িত্ব আবার।
উই ডোন্ট হ্যাভ টু লিসেন টু ইউ, কালকে স্কুল নেই, আমরা যতক্ষণ খুশি জেগে থাকতে পারি।
আরো জানালো বাড়াবাড়ি করলে মায়ের কাছে আমার নামে কমপ্লেইন করবে।
বেগতিক দেখে আমি আওয়ামী লীগের পথ ধরি, মানে হেফাজতকে যেমন তোয়াজ করে চলে আওয়ামী লীগ – সেই রাস্তাই ধরি। প্রয়োজনে আমি কঠোর ব্যবস্থা নেব, এই হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজের ঘরে চলে যাই। আরো জানাই যে নিয়মভংগ করা আমি বরদাস্ত করবো না। নিজের ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে তাদের খিলখিল হাসি শুনতে পাই।
মনে মনে ক্ষমতাসীন দলকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। একটা প্রব্লেম সলভড। আমার কাজ হবে নিয়মগুলো জানানো, প্রয়োগ করতে গেলে ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে। কী দরকার এতো ঝামেলার।
পরিস্থিতি- ২
আজকের মেনু হচ্ছে ভাত, ডাল, সব্জি আর সালাদ। ডিনার দেওয়া হবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটাতে। যথাসময়ে ডিনার দিলাম। এরপরে আগের প্রশাসন বাচ্চাদের খেতে আসার জন্য ঘন্টাখানেক ডাকাডাকি করতো, কিন্তু নতুন প্রশাসনে আমি ব্যক্তি স্বাধীনতাতে বিশ্বাস করি। খিদে লাগলেই খাবে। ঘন্টাখানেক পরে তাই হোল।
আই ডোন্ট লাইক দ্যাট ভেজি...
ভালো না লাগলে খাওয়ার দরকার নাই।
হোয়াই আর ইউ সো রুড?
বোবার শত্রু নাই। চুপ থাকি।
দিজ ভাত ইজ টু সফট। মামা'স রাইস ইজ বেটার দেন ইউরস।
আমি নিশ্চুপ থাকি। ভাত একটু জাউ জাউ হয়ে গেছে। ভাত যে কড়কড়ে হবে এই রকম কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নাই। একটু পরে ফোনে শুনলাম বলছে..
মা' আব্বুর ভাতটা নরম হয়ে গেছে।
স্টপ ট্যাটেল টেইলিং...
ডোন্ট বি মিন...
আরে নাহ, আই ওয়াজ জোকিং...খাবাররের পরে আইসক্রিম কে চায়?
পরিস্থিতি- ৩
থার্মোডিনামিক্সের কয়েকটা সূত্র আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক হচ্ছে দ্বিতীয় সূত্র। দ্বিতীয় সূত্রের একটি অনুসিদ্ধান্ত হয়েছে এই মহাবিশ্বের চরিত্র খুব ডিজঅর্ডার্ড আর র্যান্ডম, মানে ঘটনা গুলো গোলযোগপূর্ণ, আর সব কিছু শেষ পর্যন্ত ব্যারাচ্যারা অবস্থাতে পৌঁছায় যায়।
এই সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ প্রতিদিনই দেখা যায়। একটা বিরাট উদাহরণ হচ্ছে ঘর দোর পরিষ্কার করার পরের মিনিট থেকেই ঘর অপরিষ্কার হতে শুরু করে। থার্মোডিনামিক্স আরও বলে যে অর্ডার আনতে হলে সিস্টেমে শক্তি দিতে হবে, এমনিতে ছেড়ে দিলে ছাড়া গরুর মতো অবস্থা হবে। সূত্রের কথা অনুযায়ী আমি ঝাড়ু হাতে নেমে পড়ি। সারা সপ্তাহ ময়লা হতে দিলে উইকেন্ডে প্রচুর শক্তি ব্যয় হবে। আগে এই শক্তি দুই জন মানুষ দিতো, এখন পুরাই যাবে আমার একাউন্ট থেকে। তাই প্রতিদিন ঝাড়ু দেওয়া শুরু করি।
হোয়াই ডু উই হ্যাভ টু ক্লিন এভরি ডে?
ঘর পরিষ্কার করতে অবশ্য মেয়েও হাত লাগায়। আমি এর বিনিময়ে পয়সা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেই। অর্থ যে শক্তির আরেক রূপ সেটা থার্মোডিনামিক্সের বইতে লেখা নেই, কিন্তু আমরা বিলক্ষণ জানি।
থার্মোডিনামিক্সের ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী আরও কেওস দেখা যায় সিংকে জমতে থাক ডিশের স্তুপে। লন্ড্রি বাস্কেটে, লন্ডভন্ড বিছানাতে, বাইরের বাগানের নেতিয়ে পড়া গাছে। আমি টের পাই অভিকর্ষ বলের আবিষ্কার যদি আপেল গাছের নিচে হয়, তাহলে থার্মোডিনামিক্সের সূত্রের আবিষ্কার আমার মতো পরিস্থিতে কেউ বের করেছিল।
সূত্রটা একটু মোলায়েম হলে কী অসুবিধা ছিল?
পরিস্থিতি- ৪
এই দেশে বাচ্চাদের "চোর" থাকে। বাংলা চোর নয়, ইংরেজি চোর। সেটার অর্থ হচ্ছে বাড়ির নির্দিষ্ট কাজ বাচ্চাদের করতে হবে। মারিয়া দেশে যাওয়ার পরে আনুশার কাজ হচ্ছে বাইরের গাছে পানি দেওয়া।
রাত এগারোটার সময়ে মনে পড়ল আমার। আনুশাকে জানালাম।
"ক্যান ইউ প্লিজ ডু ইট, আই এম টু টায়ার্ড?"
আমি বাইরে গিয়ে গাছে পানি দেই। বিছানায় এসে ঘুমের অতলে ডুবে যেতে যেতে মনে হল কি যেন একটা ঠিক নেই। পরদিন সকালে আবিষ্কার করলাম পানি দেওয়ার পরে কলটা বন্ধ করা হয় নি! ঘাসগুলো একটু বাড়তি পানি পেল আরকি!!
প্রতিদিনই আনুশাকে স্মরণ করাই। একদিন আনুশার করতে ইচ্ছে করে না, আরেকদিন হোমওয়ার্ক থাকে, অন্যদিন টিভিতে সিরিজ দেখে মন খারাপ। কোন দিন বৃষ্টি এসে বাঁচিয়ে দেয়, কোন দিন আমি পানি দিয়ে কলটা ভালো মতো বন্ধ করে আসি।
একই সঙ্গে মনে পড়ে আনুশার বয়েসে আমিও ওই রকমই ছিলাম। প্রতিটা কাজই ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেই আমাকেই এখন সব কিছু করে খেতে হচ্ছে। সময় সবাইকেই বাধ্য করে, যতদিন পারুক সময়ের সাথে লুকোচুরি খেলে নিক, ফাইনালি সময় ঠিকই ধরে ফেলবে!!!
টিল দেন গুড জব আনুশা!
No comments:
Post a Comment