Thursday, December 2, 2021

শ্বেতভালুক

মার্কিন দেশের বাচ্চাদের মধ্যে শ্বেতভালুক - বা পোলার বেয়ারের জন্য প্রেম বেশ প্রবল। প্রাথমিক স্কুলের শেখানো ছড়াতে পোলার বেয়ার নিয়ে কাব্য থাকে। খেলনার দোকানে পুতুল পোলার সাজানো থাকে। গল্পের বইয়ে চরিত্র হিসাবে পোলার বেয়ার উপস্থিত হয়। এমনকি জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারিতে ভেঙে যাওয়া বরফের চাঁইয়ের উপর টলটলায়মান শ্বেতভালুক এই দেশের শিশু-কিশোরদেরকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।


আমাদের বাসার শ্বেতভালুকপ্রেমী হচ্ছে সামারা, পৃথিবীর তাবৎ প্রানীকূলের জন্য তার অপার ভালোবাসা। কিন্তু এদের মধ্যেও উপরের দিকে থাকে যেসব প্রানী নাদুস-নুদুস এবং লোমশ। সেই কারনেই সামারা মোটাসোটা বিড়াল আর শ্বেতভালুক খুবই ভালবাসে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ওর বাবা প্রীতির পেছনেও হয়ত একই কারন আছে।

কিছু দিন আগে পর্যন্ত সামারা তার পরজন্মে শ্বেতভালুক হতে চাইতো। আমাকেও রাজি করিয়েছিল, পরজন্মে ওর শ্বেতভালুক বাবা হওয়ার জন্য। সামারাকে একবার আমি ইউটিউবে মেরুজ্যোতি (অরোরা) দেখিয়েছিলাম, পোলার বেয়ার হলে ফাউ অরোরাও দেখা যাবে। পরজন্মের জন্য আমাদের সব প্ল্যান ঠিকঠাক ছিল।

এরই মধ্যে একদিন ডিজনির বেয়ার ডকুমেন্টারি মুভিটা দেখতে গিয়েছিলাম। আলাস্কার এক ভালুক পরিবার (শ্বেতভালুক না) নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি। ওটা দেখে সামারার পরজন্মে পোলার বেয়ার হওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। মেরু অঞ্চলের ভালুকের জীবন খুবই কঠিন, শীতকালে খাবার থাকে না, গরমের সময়ে প্রচুর পরিমাণে খেতে হয় যাতে পুরো শীতকাল না খেয়ে শীতনিদ্রায় থাকা যায়। একই সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী গ্রীষ্মকালে অন্যান্য ক্ষুধার্ত হিংস্র প্রাণীদের খাদ্য হিসাবে বাচ্চা ভালুক বেশ সহজ শিকার এমনকি - বাবা ভালুকের খাদ্য হওয়ার সম্ভবনা থাকে বাচ্চাদের। আরও মারাত্মক ঘটনা হলো জলবায়ু বিপর্যয়ের কারনে ভালুকের খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে, পরিবেশের বিপর্যয়ের পাশাপাশি ভালুকেরা অস্তিত্বহানির হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে। আমি আরেকদফা বুঝতে পারি যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ বাংলাদেশ অর্ধেক তলিয়ে গেলে যতখানি দুঃখ পাবে পশ্চিমের মানুষেরা - হয়ত তারচেয়ে বেশি বেদনা হারিয়ে যাওয়া ভালুকের জন্য পাবে ওরা। আমি হল থেকে বের হয়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রচারে ভালুকের ব্যবহারটা ভালোমতো উপলব্ধি করি - বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা...এদের সম্মিলিত হাহাকারের চেয়ে শ্বেতভালুক অনেক অনেক বেশি মিডিয়া স্যাভি বস্তু।

প্রতিবারই মাদার নেচারের সাথে মুলাকাৎ হলে সামারা একদফা বিমর্ষ হয়। ভালুকরা কেন ফ্রিজ কিনে ওইখানে খাবার রাখে না এই প্রশ্ন খুবই সঙ্গত মনে হয়। অনেক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত পরজন্মে তাই এই মনুষ্যজীবনটাই আবার চাই। পুনর্মূষিক ভব। তবে আমার বিশ্বাস - মানুষদের জীবনও খুব আনন্দে কাটবে না। জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব কৃষিতে পড়ছে ব্যাপকভাবে। একদিন মানুষের খাদ্যসংকট হবে নিশ্চিত। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে খাদ্য এক মহার্ঘ্য বস্তু হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা আছে। আমরা আমাদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব যেটুকু দেখবো - এরচেয়ে অনেকবেশি দেখবে আমাদের সন্তানেরা, আমাদের সন্তানদের সন্তানেরা আরও অনেক অনেক বেশি বিপর্যয় দেখবে। আলাস্কার ক্ষণকালীন গ্রীষ্মকালে ভালুকের বেঁচে থাকার চিত্রের মতো মানুষকেও মৌলিক অস্তিত্বের জন্য জন্য সংগ্রাম করতে হবে, কেননা খাদ্য হচ্ছে অস্তিত্বের একদম মূল স্তম্ভ।

সামারা গত সপ্তাহে শ্বেতভালুকের ছবি এঁকেছে (কিছুটা আমার সাহায্য নিয়ে), এটা আমাদের হলেও হতে পারতো পরজন্মের ছবি। ছবিতে আকাশের রঙগুলো রংধনু নয়, ওইগুলো অরোরা, হয়ত ইহজনমে এই জিনিস দেখা হবে না। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে পরজন্মেও এই জিনিস দেখার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ।

ছবিটা দেখে এই প্রথমবারের মতো বিপর্যস্ত শ্বেতভালুকের জন্য আমারও মনটা বিষণ্ণ হলো। অন্তত শ্বেতভালুক বাঁচানোর জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত।

বাকি পৃথিবী বাঁচলে সেইটা পুরোই ফাউ। 





পরীক্ষা

পরীক্ষা শব্দটার সাথেই একটা আতংক জড়িয়ে আছে। আমি মাঝে মাঝে এখনো স্বপ্ন দেখি যে বুয়েটে পরীক্ষা দিচ্ছি, সেই পরীক্ষা ভয়াবহ খারাপ হচ্ছে, একটা প্রশ্নেরও উত্তর জানি না। এই ধরণের স্বপ্ন বহু মানুষই দেখে, স্বপ্নে কেউ ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সেটা শুনিনি। পরীক্ষা স্বপ্নে উপস্থিত হলে সে বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয়। তবে আমার পরীক্ষা নামক বিভীষিকার সূত্রপাত বুয়েটে নয় আরও আগে। বুয়েট সেটা অন্য মাত্রা দিয়েছে যদিও। আমি যখন স্কুলের নিচের দিকের ক্লাসে তখন একবার বাংলা পরীক্ষা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। বইতে অনেকগুলো কবিতা ছিল, কিছুতেই মুখস্থ হচ্ছিল না। আব্বা স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, সাত্তার স্যার জানালেন কবিতার প্রথম আট লাইন মনে রাখতে পারলেই হবে, পরীক্ষাতে নাকি প্রথম আট লাইনই থাকবে। আমি অতি কষ্টে সব কবিতার প্রথম আট লাইন শিখলাম। 


যাই হোক পরীক্ষার দিন আমি গিয়ে দেখলাম কবিতার শেষ আট লাইন মুখস্থ লিখতে বলা হয়েছে। ক্লাস টু বা থ্রিয়ের আমি বুঝে গেলাম পরীক্ষা নামক জিনিসটার মূল উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের বিপদে ফেলা, ব্যাপারটা আমার এখনও মনে পড়ে এবং মনে পড়লেই সাত্তার স্যারকে আমি দুটো গালি দেই। কিন্তু সেই থেকে একটা জ্ঞান লাভ হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে জীবনের পদে পদে লুকিয়ে আছে পরীক্ষা, বেশির ভাগ পরীক্ষা খাতা পত্রে হয় না। আমাদের স্কুলে নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। শহীদুর রহমান স্যার নামাজের টাইমে মসজিদের বাইরে দেখলেই ধাওয়া দিতেন। মসজিদের ভেতর মাঝে মাঝে সুরাও জিজ্ঞেস করতেন। মসজিদের ভেতর একবার আয়াতুল কুরসি জানি কিনা এই পরীক্ষাও দিতে হয়েছে। তবে মনুষ্যসৃষ্ট পরীক্ষার মধ্যে কঠিনতম পরীক্ষাগুলো দিয়েছি আমি বুয়েটে। বুয়েটের প্রতিটি পরীক্ষাতে দুটো অংশ থাকতো। প্রতি অংশে ৩টা প্রশ্নের মধ্যে দুটোর (অথবা ৪টার মধ্যে ৩টার) উত্তর করতে হতো। এর মধ্যে একটা প্রশ্ন খুব কঠিন হতো। আর বিপদ হচ্ছে বাকি প্রশ্ন গুলোও খুব সহজ না, হয়ত একটার উত্তর অর্ধেক জানি, আরেকটা ৭৫%। সবগুলো জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে পরীক্ষা শেষ করতে হতো। পরীক্ষার আতংক আগে থাকলেও বুয়েট সেটাকে PTSD  এর লেভেলে নিতে পেরেছে। 

ছাত্রজীবন শেষেও পরীক্ষা শেষ হয় না। প্রকৌশলীদের চাকরির ইন্টারভিউ কার্যত সারাদিনব্যাপী পরীক্ষা। ৪৫ বছর বয়েসে এক কোম্পানি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সকাল নয়টাতে কিছু প্রোগ্রামিং এর সমস্যা দিয়ে ইন্টারভিউ শুরু হলো। উৎরে গেলাম ভালো মতো। এর পরে দুপুর পর্যন্ত ভালোই চলছিল। ইন্টারভিউজনিত ক্ষুধাতে কাতর হয়ে বেশি খাওয়ার ফলে লাঞ্চের পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মতো ব্যাটিং বিপর্যয় শুরু হল। ঘুম ঘুম চোখে কিছুতেই মাথা কাজ করে না। সহজ ও কঠিন দুই ধরণের প্রশ্নতেই উইকেট ভেঙ্গে পড়তে লাগলো তাসের ঘরের মতো। বিধ্বস্ত হয়ে বিকেল পাঁচটাতে ছাড়া পেলাম। এই অবস্থাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সংবাদ সম্মেলন করতে হয় এইটা ভেবে টাইগারদের জন্য কষ্ট লাগলো।

পরীক্ষা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি। পরীক্ষা ব্যাপারটা সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টের অন্য এক নাম। প্রকৃতি আসলে সবচেয়ে বড় পরীক্ষক। দুর্বল, অসহায় এদের কোন স্থান নেই প্রকৃতিতে। এদের বিলুপ্ত হয়ে যেতে হয়। আমি চোখের সামনে আহত সাপের ছানাকে পাখির খাবার হতে দেখেছি। স্কুল, কলেজ অথবা ভার্সিটির মাস্টারেরা অনেক সময় সহৃদয় হয়ে পাশ করালেও প্রকৃতি দুর্বলকে দয়া করে না। ইউরোপের অনেক দেশেই নাকি বাচ্চাদের নিচের দিকের ক্লাসে কোন পরীক্ষা দিতে হয় না। আমেরিকাতেও নিচের ক্লাসগুলোতে পরীক্ষা নামকাওয়াস্তেই হয়। কিন্তু মানুষকে একটা সময়ে পরীক্ষা দিতেই হয়, ক্লাসে, চাকরিতে, ক্লাসের বাইরে, বাসে ওঠা থেকে শুরু করে ভিসার এপ্লিকেশন - সর্বত্রই নানান মোড়কে পরীক্ষা উপস্থিত। জন্ম নিলেই পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা মৃত্যুর মতোই এক অবধারিত সত্য। 

প্রতি বছর অফিসে নানান কোর্স নিতে হয়। আমার জীবন স্পাই থ্রিলারের মতো, আমি সব কিছু শেষ মিনিটে সমাধান করার চেষ্টা করি। সুতরাং ডিসেম্বর মাসে কোর্সের ঝাঁপি খুলে বসেছি। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন  - পৃথিবীতে নাই কোন বিশুদ্ধ চাকুরি। ভদ্রলোক সম্ভবত আমার মতোই অর্থপোর্জনের জন্য কাজ করতেন, আনন্দের জন্য না। তিনি আরও বলেছেন - 

“আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।”

জীবনানন্দ পাঠ নানান দিক থেকেই প্রশান্তিময়। "নট জাস্ট মি" টাইপের একটা ফিলিং তো হয় তবে সেই সঙ্গে একটা জিনিস টের পাওয়া যায় জীবনের পরীক্ষাতে পাশ করতে গেলে প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন তার সানডে মানডে ক্লোজ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করতে হবে, নইলে গভীরভাবে অচল হওয়ার চান্স আছে। সেই জন্য দরকার সাহস এবং সাহস, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। 

লাস্ট কোর্সটা করছি। গোটা কয়েক পরীক্ষা বাকি আছে। 

দোয়াই কাম্য। 

###

Monday, October 11, 2021

৩% চার্জ

মেয়েকে মাঝে মাঝে বলি - "ফোনটা অন রেখো, বান্ধবীর বাসাতে যাচ্ছো, আমি ফোন করলে যেন তোমার খোঁজ পাই।" আজকের দিনের প্রতিটি টিনেজারের কানে একটা করে ইয়ারপড গোঁজা থাকে। আমার কন্যারাও ব্যতিক্রম না। যে কোন প্রশ্নের পরে মেয়ের প্রথম রিএকশন হয়- "Huh!" (এর কোন বাংলা প্রতিশব্দ নেই)। এইবারও ব্যতিক্রম হলো না।

এরপরের বক্তব্য হলো - আই হ্যাভ অনলি ৩% চার্জ অন মাই ফোন।

আমার ধারণা ছিল টিনেজারদের ফোনে ৩% চার্জের বেশি থাকে না। তবে আস্তে আস্তে ধারণাটা পাল্টে যাচ্ছে।

গত কয়েক সপ্তাহের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমার ও আমার বউয়ের ফোনেরও একই অবস্থা। আমারটা কেন আমি জানি। ফোন চার্জে দিয়েই ঘুমাতে যাই। আমি রাতে ইউটিউবে গল্প শুনি। বর্তমানে মির্চি বাংলা রেডিওর সানডে সাসপেন্স শুনছি। এর আগে ওবামা আর মিশেল ওবামার অডিও বুক শুনেছি। অনেকে বই পড়তে পড়তে ঘুমান। আমি দেখেছি বই শুনতে শুনতে ঘুমানো আরও অনেক অনেক বেশি কার্যকর।

কিন্তু ফোনের চার্জার এক প্রপঞ্চক যন্ত্র। এর একটা মাথা ফোনে আর অন্য মাথা থাকে প্লাগ পয়েন্টে। দুই মাথার একটিতে প্রায়ই সমস্যা হচ্ছে। সকালে উঠে দেখছি ফোনে চার্জ বাকি আছে ৩%। সকালে ফোনের চার্জের পরিমাণের সাথে নিজের চার্জের সম্পর্ক সুনিবিড়। সকালে ফোনে ৩% চার্জ দেখলেই নিজের অবস্থাও ওই রকম মনে হয়।

মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছি ওদের ফোনে ৩% চার্জের কারণ। ৯৯% টিনেজার সব প্রশ্নের একটাই উত্তর দেয় - আই ডোন্ট নো।

(অসমাপ্ত)


Sunday, September 19, 2021

পরানের গহীন ভিতর

২০০২ সালের দিকে দেশে গিয়েছিলাম। এর কয়েকদিন আগেই তসলিমা নাসরিনের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ "ক" প্রকাশিত হয়েছে। আমি দেশে পৌঁছানোর দিন সন্ধ্যাতে টিভির নিউজে দেখলাম "ক" নিষিদ্ধ করার জন্য সৈয়দ হক আদালতে গেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বললেন এই বইতে তাঁর জন্য মানহানিকর মালামাল আছে।

তসলিমা নাসরিন কোন অবস্থাতেই আমার প্রিয় লেখক নন। তাঁর অন্য অনেক বইয়ের মতোই "ক" ভালো কোন কর্ম মনে হয় নি আমার কাছে। কিন্তু বই নিষিদ্ধ করার জন্য সৈয়দ হকের মতো লেখক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন সেটাও আমার বিশ্বাসের বাইরে ছিল।
সাধারণত তসলিমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য ইসলামি দলগুলো হইচই করে। সেই বার বিপরীত চিত্র দেখা গেল - "ক" বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রগতিপন্থীরাই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার ধার্মিক বন্ধুবান্ধব বরং দেখলাম "ক" এর প্রচার ও প্রসার চাইছে - প্রগতিশীলরা যে কত বড় লুইচ্চা সেটার এতো বড় প্রামাণ্য দলিলের প্রয়োজন তাদের কাছে অনেক। এই প্রথম তারা তসলিমাকে সত্যবাদী তকমা দিয়ে দিল।
আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম সৈয়দ হকের উপর। আমার মনে হয়েছিল উনি কাজটা ভালো করেন নি। এরপরেও অনেকদিন চলে গেছে। আমি আরো কিছুটা হলেও পৃথিবী দেখেছি - দিনে দিনে আমার মনে হয়েছে সৃষ্টি এবং স্রষ্টা দু'টি পৃথক স্বত্ত্বা - কোন অবস্থাতেই এই দুটোকে মিলানো উচিৎ নয়। এই পুরনো বিতর্কে আমি নিজেই আমার অবস্থান পাল্টেছি। কিন্তু দ্বৈরথ দ্বন্দ্ব এখনও কাটেনি। আল মাহমুদকে বর্জনের পাশাপাশি সোনালী কাবিনও কী ফেলে দিব নাকি এই প্রশ্ন আমাকে অনেক বেশি ভাবায় এখন।
মানুষের দোষত্রুটি থাকতে বাধ্য। লেখক আমার মতের মানুষ হবেন এটা ভাবাও অনুচিত। তিনি মহামানুষ হবেন - এই কল্পনাও স্রেফ বাতুলতা। তিনি নারী পুরুষের সমতার ঝাণ্ডা তুলে নিবেন নাকি সমকামীদের জন্য রাস্তায় দাঁড়াবেন সেটা দিয়ে হয়ত মানুষের বিচার চলে কিন্তু সৃষ্টিকে সেই তুলাদণ্ডে উঠালে সেটাকে সুবিচার বলা চলে না। লেখক বিচার্য হবে তাঁর কর্ম দিয়ে - তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। সেই কর্মের গুনেই হয়ত মহাকালের আঁচড় থেকে তিনি মুক্তি পেয়ে যাবেন। সেই সৃষ্টিই তাঁকে অমরত্বের তকমা পড়িয়ে দেবে অথবা বিস্মৃতির অন্ধকূপে ফেলে দিবে।
যারা ৭০ আর ৮০ দশকে বড় হয়েছে - সিনেমা, বিটিভি, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ঈদ সংখ্যা, গল্পের বই, মঞ্চনাটক ও সামরিক শাসনের যুগে - সেই প্রজন্মের কাছে সৈয়দ হক মানেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারাজীবন, খেলারাম খেলে যা, ঈদ সংখ্যাতে পড়া জেসমিন রোড, ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ শেষ করে গুনগুন করে গাওয়া ত্রিশ বছরের পুরনো সিনেমার গান, হৃদ কলমের টান অথবা অকস্মাৎ মনে পড়া বালিকার চন্দ্রযান।
সৈয়দ হককে আমি জীবনে কোনদিনই সামনা সামনি দেখিও নি। কিন্তু আজ সকালে এই অচেনা বুড়ো মানুষটার মৃত্যুসংবাদ নিকটাত্মীয় হারানোর বেদনা নিয়ে এলো। হঠাৎ টের পেলাম এতোকাল পরেও এই লোকটা লোকটা লুকিয়ে ছিলেন আমাদের ভেতরে, আমাদের যৌবনের সাথে, কাব্যময় ক্ষুব্ধ স্বদেশের সাথে, তিনি লুকিয়ে ছিলেন আমাদের একদম পরানের গহীন ভিতর।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।

(রচনাকালঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬)

Thursday, September 2, 2021

সেপ্টেম্বর

    ।।১।।


সেপ্টেম্বর আসলেই যশোর রোডের কবিতাটা মনে পড়ে। সুনীলের লেখার সূত্রে গিন্সবার্গের এই কবিতাটা অনেক আগেই পড়া। পরে মৌসুমী ভৌমিক বাংলা অনুবাদ করে সুর দিয়েছেন। কিন্তু এরও অনেক আগে অকাল প্রয়াত লেখক/কবি খান মোহাম্মদ ফারাবী কবিতাটির একটা বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। 


"Millions of daughters walk in the mud

Millions of children wash in the flood

A Million girls vomit & groan

Millions of families hopeless alone


Millions of souls nineteenseventyone

homeless on Jessore road under grey sun

A million are dead, the million who can

Walk toward Calcutta from East Pakistan"


ফারাবী অনুবাদ করেছিলেন...


"হাঁটছে পাকে লক্ষ পিতার কন্যারা

অবোধ শিশু ভাসিয়ে নিল বন্যারা

লক্ষ মেয়ে করছে বমন আর্তনাদ

লক্ষ পরিবারের আশা চূর্ণ সাধ।

.

লক্ষ প্রাণের উনিশ শত একাত্তর

উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর

সূর্য জ্বলে ধূসর রঙে মৃতপ্রায়।

হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়।"


সেপ্টেম্বর আসলেই আমি যেন না দেখা যশোর রোড দেখতে পাই। ধূসর, মলিন, কর্দমাক্ত - লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল - হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়। নির্বাক সেই ছায়াছবির আবহ সঙ্গীতের মতো মাথার ভেতর গান করে চলেন মৌসুমী ভৌমিক। 


এই কবিতাটার বয়েস প্রায় ৪৬ হবে। প্রায় আমার সমবয়েসি। এরই মধ্যে গ্রামাফোন রেকর্ড বদলে গিয়ে আইপড টাচ এসেছে, বই পড়ার -বুক রিডার এসেছে, স্মার্টফোন এসেছে, স্ন্যাপচ্যাট, ইন্সট্যাগ্রাম আরও কত কত কিছু এসেছে। আমরা আগামীকালের বিস্ময়ের প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছি। কালকের প্রযুক্তিটা হয়ত আজকের সবকিছুকে বাতিল করে দিবে, পুরনো করে দিবে। কিন্তু মানুষ কতটা পাল্টেছে? ৪৬ বছর পরে এই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শরনার্থী মানুষের ঢল নামছে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে। গিন্সবার্গ নেই, যশোর রোডের কাদামাটিতে মানুষের ঢল নেই - কিন্তু কবিতাটা যেন ধ্রুব সত্য, মানুষের বর্বরতার চিরকালের চলচ্চিত্র। কাদামাটি পেরিয়ে, নদীতে ভেসে, গুলির যখম নিয়ে, ভয়ংকর নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে মানুষ আসছে বানের জলের মতো...টিভির নিউজে প্রতিদিন ভেসে আসে গিন্সবার্গের কবিতা।


"কাদামাটি মাখা মানুষের দল

গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে

আকাশে বসত মরা ঈশ্বর

নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে"


ওদের মাথার উপরের আকাশটা বিস্ময়কর রকমের ধূসর!!!


।।২।।


মানুষের নির্মমতার কারণ আমি অনেক খুঁজেছি। প্রকৃতির সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট নিয়মের যথার্থ মানে হচ্ছে জোর যার মুল্লুক তার। দুর্বলকে অবধারিত ভাবে মার খেতে হবে। অন্য যেকোন প্রাণীর তুলনায় আমাদের হিংস্রতা অনেক অনেক বেশি। সেই কারণে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে মানুষ, শিশুদের মাথা ধড় থেকে নামিয়ে দিতে বুক কাঁপে না, ধর্ষণ, খুন প্রায় ডালভাত। পালিয়ে যাওয়া মানুষের যাত্রাপথে মাইন পেতে রেখে দেওয়া যায়। দুর্বল হয়ে জন্মগ্রহন করার চেয়ে বড় আর অন্যায় এই পৃথিবীতে নেই। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। 


ধর্ম নিয়ে হানাহানি হয়, অর্থ নিয়ে হানাহানি হয়, ভূমি নিয়ে হানাহানি হয়। পৃথিবী থেকে সব ধর্ম, সব অর্থ, সব ভূমি, সব অর্গানাইজড মতবাদ উঠিয়ে নিলে কী হানাহানি বন্ধ হবে?


উত্তরটা আমি জানি। 


হবে না। মানুষ আত্মঘাতী প্রানী। মানুষের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসবে না। 


যতদিন মনুষ্যজাতি পৃথিবীর বুকে থাকবে, ততদিন এই পৃথিবী নিরাপদ হওয়ার কোন সম্ভবনা আমি দেখছি না। 


।।৩।।


সকালে বাংলাদেশের টিভি দেখি। প্রতিদিন। মানুষের চাপ যেইভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় / লাখ মানুষ চলে আসবে অচিরেই। বর্ডার কার্যত খোলাই। 


আমি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে। অনেক জটিল সমীকরণ আছে, রোহিঙ্গাদের জঙ্গীবাদে যুক্ত করা সহজ - ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের "ধর্ম নিরপেক্ষ" শক্তি ক্ষমতাতে থাকার পরে জঙ্গীবাদ যেই পরিমাণ বেড়েছে তাতে আমার মনে হয় না রোহিঙ্গারা আসলে ১৯/২০ হবে কিছু। জঙ্গীতে আমাদের ডোমাস্টিক সাপ্লাই ভালোই আছে। আমাদের আলো হাওয়াতেই আন্তর্জাতিক মানের জঙ্গী তৈরি করা সম্ভব সেই প্রমাণ আমরা প্রায় প্রতিমাসেই পাচ্ছি।  


এর সমাধান কী? 


আমি নিশ্চিত নই কিন্তু সম্ভবত আন্তর্জাতিক চাপই একমাত্র সমাধান। সেটাও খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তুরস্ক, পাকিস্তান বা মালদ্বীপ এদের চাপে কিছুই হবে না। বার্মা বহুদিন একঘরে ছিল - সুচি সামনে থাকাতে মিলিটারিরা গায়ে গণতন্ত্রের ছাল পরেছে। গণতন্ত্র শব্দটা পশ্চিমাবিশ্ব খুব পছন্দ করে, বার্মিজ লুঙ্গিতে গণতন্ত্রের ছাপেই ওরা খুশি। চাপ দিতে পারতো ভারত অথবা চিন। দেখা যাচ্ছে এরা হয় বার্মার সাথে আছে অথবা নিরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পায়ের নিচে তেল নেই - মার্কিনিরা এদের নিয়ে চিন্তিত না। গণতন্ত্র বেচতে হলেও পয়সা খরচ হয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে - 'আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি' ব্যাপারটা গোলমেলে এইটা মূলত সন্ত্রাসী সংগঠন এবং রোহিঙ্গাদের উপর এই হামলা যে ওদের হামলার জবাবে - সেটা বার্মার কূটনীতির সেলিং পয়েন্ট। বর্তমান বিশ্বে এটা বেশ মার্কেট ভালো। সবগুলো প্যারামিটারই বার্মার পক্ষে। 


আমি জানি না বাংলাদেশের কি করার আছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ফোকাস বাড়ানোর চেষ্টা করা যেত, চিন আর ভারতের সাথে দেন দরবার করা যেত, বিশেষত ভারতের সাথে।সরকারের কাজকর্ম দেখে মনে হয় সেই ইচ্ছে বা যোগ্যতা তাদের আছে কিনা। 


।।৪।।


কিছু কিছু কবিতা অমর না হলেই ভালো হতো। 


যেই কবিতাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা সম্ভবত অমর হয়ে যাবে। লুট হয়ে যাওয়া মন্দির, ভেঙে ফেলা প্রতিমা, রাতে আধাঁরে পালনো হিন্দু পরিবার অথবা অথবা ভয়ার্ত রোহিঙ্গা শিশু, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া সিরিয়ান পরিবার - যতদিন শরণাগত মানুষের ঢল থাকবে, যতদিন নির্মমতা থাকবে, যতদিন হিংস্রতা থাকবে - ততদিন বেঁচে থাকবে সেপ্টেম্বর মাসের যশোর রোড। অমরত্বের চাবিকাঠি লুকানো আছে এর প্রতিটি লাইনেই। আরও একশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন কিনা জানি না - কিন্তু মানুষের নির্মমতার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে রয়ে যাবে...


"সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর

ঘর ভেঙ্গে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে

যশোর রোডের দুধারে মানুষ

এতো এতো লোক শুধু কেন মরে?"