মার্কিন দেশের বাচ্চাদের মধ্যে শ্বেতভালুক - বা পোলার বেয়ারের জন্য প্রেম বেশ প্রবল। প্রাথমিক স্কুলের শেখানো ছড়াতে পোলার বেয়ার নিয়ে কাব্য থাকে। খেলনার দোকানে পুতুল পোলার সাজানো থাকে। গল্পের বইয়ে চরিত্র হিসাবে পোলার বেয়ার উপস্থিত হয়। এমনকি জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারিতে ভেঙে যাওয়া বরফের চাঁইয়ের উপর টলটলায়মান শ্বেতভালুক এই দেশের শিশু-কিশোরদেরকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
আমাদের বাসার শ্বেতভালুকপ্রেমী হচ্ছে সামারা, পৃথিবীর তাবৎ প্রানীকূলের জন্য তার অপার ভালোবাসা। কিন্তু এদের মধ্যেও উপরের দিকে থাকে যেসব প্রানী নাদুস-নুদুস এবং লোমশ। সেই কারনেই সামারা মোটাসোটা বিড়াল আর শ্বেতভালুক খুবই ভালবাসে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ওর বাবা প্রীতির পেছনেও হয়ত একই কারন আছে।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত সামারা তার পরজন্মে শ্বেতভালুক হতে চাইতো। আমাকেও রাজি করিয়েছিল, পরজন্মে ওর শ্বেতভালুক বাবা হওয়ার জন্য। সামারাকে একবার আমি ইউটিউবে মেরুজ্যোতি (অরোরা) দেখিয়েছিলাম, পোলার বেয়ার হলে ফাউ অরোরাও দেখা যাবে। পরজন্মের জন্য আমাদের সব প্ল্যান ঠিকঠাক ছিল।
এরই মধ্যে একদিন ডিজনির বেয়ার ডকুমেন্টারি মুভিটা দেখতে গিয়েছিলাম। আলাস্কার এক ভালুক পরিবার (শ্বেতভালুক না) নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি। ওটা দেখে সামারার পরজন্মে পোলার বেয়ার হওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। মেরু অঞ্চলের ভালুকের জীবন খুবই কঠিন, শীতকালে খাবার থাকে না, গরমের সময়ে প্রচুর পরিমাণে খেতে হয় যাতে পুরো শীতকাল না খেয়ে শীতনিদ্রায় থাকা যায়। একই সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী গ্রীষ্মকালে অন্যান্য ক্ষুধার্ত হিংস্র প্রাণীদের খাদ্য হিসাবে বাচ্চা ভালুক বেশ সহজ শিকার এমনকি - বাবা ভালুকের খাদ্য হওয়ার সম্ভবনা থাকে বাচ্চাদের। আরও মারাত্মক ঘটনা হলো জলবায়ু বিপর্যয়ের কারনে ভালুকের খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে, পরিবেশের বিপর্যয়ের পাশাপাশি ভালুকেরা অস্তিত্বহানির হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে। আমি আরেকদফা বুঝতে পারি যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ বাংলাদেশ অর্ধেক তলিয়ে গেলে যতখানি দুঃখ পাবে পশ্চিমের মানুষেরা - হয়ত তারচেয়ে বেশি বেদনা হারিয়ে যাওয়া ভালুকের জন্য পাবে ওরা। আমি হল থেকে বের হয়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রচারে ভালুকের ব্যবহারটা ভালোমতো উপলব্ধি করি - বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা...এদের সম্মিলিত হাহাকারের চেয়ে শ্বেতভালুক অনেক অনেক বেশি মিডিয়া স্যাভি বস্তু।
প্রতিবারই মাদার নেচারের সাথে মুলাকাৎ হলে সামারা একদফা বিমর্ষ হয়। ভালুকরা কেন ফ্রিজ কিনে ওইখানে খাবার রাখে না এই প্রশ্ন খুবই সঙ্গত মনে হয়। অনেক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত পরজন্মে তাই এই মনুষ্যজীবনটাই আবার চাই। পুনর্মূষিক ভব। তবে আমার বিশ্বাস - মানুষদের জীবনও খুব আনন্দে কাটবে না। জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব কৃষিতে পড়ছে ব্যাপকভাবে। একদিন মানুষের খাদ্যসংকট হবে নিশ্চিত। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে খাদ্য এক মহার্ঘ্য বস্তু হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা আছে। আমরা আমাদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব যেটুকু দেখবো - এরচেয়ে অনেকবেশি দেখবে আমাদের সন্তানেরা, আমাদের সন্তানদের সন্তানেরা আরও অনেক অনেক বেশি বিপর্যয় দেখবে। আলাস্কার ক্ষণকালীন গ্রীষ্মকালে ভালুকের বেঁচে থাকার চিত্রের মতো মানুষকেও মৌলিক অস্তিত্বের জন্য জন্য সংগ্রাম করতে হবে, কেননা খাদ্য হচ্ছে অস্তিত্বের একদম মূল স্তম্ভ।
সামারা গত সপ্তাহে শ্বেতভালুকের ছবি এঁকেছে (কিছুটা আমার সাহায্য নিয়ে), এটা আমাদের হলেও হতে পারতো পরজন্মের ছবি। ছবিতে আকাশের রঙগুলো রংধনু নয়, ওইগুলো অরোরা, হয়ত ইহজনমে এই জিনিস দেখা হবে না। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে পরজন্মেও এই জিনিস দেখার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ।
ছবিটা দেখে এই প্রথমবারের মতো বিপর্যস্ত শ্বেতভালুকের জন্য আমারও মনটা বিষণ্ণ হলো। অন্তত শ্বেতভালুক বাঁচানোর জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত।
বাকি পৃথিবী বাঁচলে সেইটা পুরোই ফাউ।
No comments:
Post a Comment