Thursday, December 2, 2021

পরীক্ষা

পরীক্ষা শব্দটার সাথেই একটা আতংক জড়িয়ে আছে। আমি মাঝে মাঝে এখনো স্বপ্ন দেখি যে বুয়েটে পরীক্ষা দিচ্ছি, সেই পরীক্ষা ভয়াবহ খারাপ হচ্ছে, একটা প্রশ্নেরও উত্তর জানি না। এই ধরণের স্বপ্ন বহু মানুষই দেখে, স্বপ্নে কেউ ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সেটা শুনিনি। পরীক্ষা স্বপ্নে উপস্থিত হলে সে বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয়। তবে আমার পরীক্ষা নামক বিভীষিকার সূত্রপাত বুয়েটে নয় আরও আগে। বুয়েট সেটা অন্য মাত্রা দিয়েছে যদিও। আমি যখন স্কুলের নিচের দিকের ক্লাসে তখন একবার বাংলা পরীক্ষা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। বইতে অনেকগুলো কবিতা ছিল, কিছুতেই মুখস্থ হচ্ছিল না। আব্বা স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, সাত্তার স্যার জানালেন কবিতার প্রথম আট লাইন মনে রাখতে পারলেই হবে, পরীক্ষাতে নাকি প্রথম আট লাইনই থাকবে। আমি অতি কষ্টে সব কবিতার প্রথম আট লাইন শিখলাম। 


যাই হোক পরীক্ষার দিন আমি গিয়ে দেখলাম কবিতার শেষ আট লাইন মুখস্থ লিখতে বলা হয়েছে। ক্লাস টু বা থ্রিয়ের আমি বুঝে গেলাম পরীক্ষা নামক জিনিসটার মূল উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের বিপদে ফেলা, ব্যাপারটা আমার এখনও মনে পড়ে এবং মনে পড়লেই সাত্তার স্যারকে আমি দুটো গালি দেই। কিন্তু সেই থেকে একটা জ্ঞান লাভ হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে জীবনের পদে পদে লুকিয়ে আছে পরীক্ষা, বেশির ভাগ পরীক্ষা খাতা পত্রে হয় না। আমাদের স্কুলে নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। শহীদুর রহমান স্যার নামাজের টাইমে মসজিদের বাইরে দেখলেই ধাওয়া দিতেন। মসজিদের ভেতর মাঝে মাঝে সুরাও জিজ্ঞেস করতেন। মসজিদের ভেতর একবার আয়াতুল কুরসি জানি কিনা এই পরীক্ষাও দিতে হয়েছে। তবে মনুষ্যসৃষ্ট পরীক্ষার মধ্যে কঠিনতম পরীক্ষাগুলো দিয়েছি আমি বুয়েটে। বুয়েটের প্রতিটি পরীক্ষাতে দুটো অংশ থাকতো। প্রতি অংশে ৩টা প্রশ্নের মধ্যে দুটোর (অথবা ৪টার মধ্যে ৩টার) উত্তর করতে হতো। এর মধ্যে একটা প্রশ্ন খুব কঠিন হতো। আর বিপদ হচ্ছে বাকি প্রশ্ন গুলোও খুব সহজ না, হয়ত একটার উত্তর অর্ধেক জানি, আরেকটা ৭৫%। সবগুলো জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে পরীক্ষা শেষ করতে হতো। পরীক্ষার আতংক আগে থাকলেও বুয়েট সেটাকে PTSD  এর লেভেলে নিতে পেরেছে। 

ছাত্রজীবন শেষেও পরীক্ষা শেষ হয় না। প্রকৌশলীদের চাকরির ইন্টারভিউ কার্যত সারাদিনব্যাপী পরীক্ষা। ৪৫ বছর বয়েসে এক কোম্পানি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সকাল নয়টাতে কিছু প্রোগ্রামিং এর সমস্যা দিয়ে ইন্টারভিউ শুরু হলো। উৎরে গেলাম ভালো মতো। এর পরে দুপুর পর্যন্ত ভালোই চলছিল। ইন্টারভিউজনিত ক্ষুধাতে কাতর হয়ে বেশি খাওয়ার ফলে লাঞ্চের পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মতো ব্যাটিং বিপর্যয় শুরু হল। ঘুম ঘুম চোখে কিছুতেই মাথা কাজ করে না। সহজ ও কঠিন দুই ধরণের প্রশ্নতেই উইকেট ভেঙ্গে পড়তে লাগলো তাসের ঘরের মতো। বিধ্বস্ত হয়ে বিকেল পাঁচটাতে ছাড়া পেলাম। এই অবস্থাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সংবাদ সম্মেলন করতে হয় এইটা ভেবে টাইগারদের জন্য কষ্ট লাগলো।

পরীক্ষা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি। পরীক্ষা ব্যাপারটা সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টের অন্য এক নাম। প্রকৃতি আসলে সবচেয়ে বড় পরীক্ষক। দুর্বল, অসহায় এদের কোন স্থান নেই প্রকৃতিতে। এদের বিলুপ্ত হয়ে যেতে হয়। আমি চোখের সামনে আহত সাপের ছানাকে পাখির খাবার হতে দেখেছি। স্কুল, কলেজ অথবা ভার্সিটির মাস্টারেরা অনেক সময় সহৃদয় হয়ে পাশ করালেও প্রকৃতি দুর্বলকে দয়া করে না। ইউরোপের অনেক দেশেই নাকি বাচ্চাদের নিচের দিকের ক্লাসে কোন পরীক্ষা দিতে হয় না। আমেরিকাতেও নিচের ক্লাসগুলোতে পরীক্ষা নামকাওয়াস্তেই হয়। কিন্তু মানুষকে একটা সময়ে পরীক্ষা দিতেই হয়, ক্লাসে, চাকরিতে, ক্লাসের বাইরে, বাসে ওঠা থেকে শুরু করে ভিসার এপ্লিকেশন - সর্বত্রই নানান মোড়কে পরীক্ষা উপস্থিত। জন্ম নিলেই পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা মৃত্যুর মতোই এক অবধারিত সত্য। 

প্রতি বছর অফিসে নানান কোর্স নিতে হয়। আমার জীবন স্পাই থ্রিলারের মতো, আমি সব কিছু শেষ মিনিটে সমাধান করার চেষ্টা করি। সুতরাং ডিসেম্বর মাসে কোর্সের ঝাঁপি খুলে বসেছি। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন  - পৃথিবীতে নাই কোন বিশুদ্ধ চাকুরি। ভদ্রলোক সম্ভবত আমার মতোই অর্থপোর্জনের জন্য কাজ করতেন, আনন্দের জন্য না। তিনি আরও বলেছেন - 

“আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।”

জীবনানন্দ পাঠ নানান দিক থেকেই প্রশান্তিময়। "নট জাস্ট মি" টাইপের একটা ফিলিং তো হয় তবে সেই সঙ্গে একটা জিনিস টের পাওয়া যায় জীবনের পরীক্ষাতে পাশ করতে গেলে প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন তার সানডে মানডে ক্লোজ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করতে হবে, নইলে গভীরভাবে অচল হওয়ার চান্স আছে। সেই জন্য দরকার সাহস এবং সাহস, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। 

লাস্ট কোর্সটা করছি। গোটা কয়েক পরীক্ষা বাকি আছে। 

দোয়াই কাম্য। 

###

No comments: