Monday, December 15, 2014

শাহবাগ

আমি বড় হয়েছি এক অদ্ভুত সময়ে। শামসুর রাহমান যথার্থই লিখেছিলেন "উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ"...সেই সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির উত্থানের সময়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল এক রক্তাক্ত সংগ্রামের  পরে - সেই দেশেই প্রথম স্বাধীনতা বিরোধী মন্ত্রী হয় মাত্র ৮ বছরের মাথাতেই। পত্রপত্রিকা, বইতে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আল-বদর এই শব্দগুলো বাদ দিয়ে বসানো হয় হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর।

খাল কেটে কেটে ইতিহাসকেও অন্য দিকে নেওয়া যায় - সেইটাও জানা গেল।

শামসুর রাহমান আরও লিখেছিলেন...

"হে-পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক,
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন। তাহলেই আমি
দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিরল,
গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগবিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মত অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অব-কাঠামো।"
(একটি মোনাজাতের খসড়া)

সম্ভবত রাজাকারতন্ত্র নিয়ে এতো অল্পকথাতে এতো শক্তিশালী বাক্যমালা আর কেউই লিখতে পারেনি।

তখন কেউ কি কল্পনাও করেছিলও যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাঠগড়ায় অপরাধীদের দাঁড়াতে হবে?

এই মগজ ধোলাইয়ের বিপরীতে যে ক্ষীণ স্রোত ছিল - এবং যে আমাদের অনেকের অজান্তেই সেটা বেগবান হয়েছে। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের গণআদালত সম্ভবত মিথ্যা ইতিহাসের চাকা ঘুরানো প্রথম ধাপ ছিল। তথ্যপ্রবাহ উন্মুক্ত হওয়ার পরে  রেডিও টিভি দখল করে কে কি বলল সেটা হয়ত বিরাট কোন গুরুত্ব বহন করে না।

আমি শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থক। গণজাগরন মঞ্চ এই আন্দোলনের মুখে কালি লেপে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে, আওয়ামী লীগ এটা থেকে যথাসাধ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করেছে, বিএনপি/জামাত/হেফাজত নাস্তিক লেবেল মেরে মানুষ হত্যা করেছে...তবুও এই স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন ছিল ৪০ বছর ধরে চলে আসা মিথ্যা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে একদম যথার্থ এক প্রতিবাদ...

সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা...

Tuesday, December 9, 2014

লেকু এবং ব্যক্তিগত আনন্দমেলা

আব্বু তোমাদের পিই টিচার কে ছিল?

আনুশা প্রায়ই আমাকে আমার শৈশব নিয়ে প্রশ্ন করে। সেই সিরিজের প্রশ্ন এটা। পিই মানে হচ্ছে ফিজিক্যাল এডুকেশন, অর্থাৎ আমরা যেটাকে ড্রিল ক্লাস বলি।

আমি বললাম আমাদের পিই টিচারের নাম ছিল - "লেকু"।

উত্তরটা পুরোপুরি ভুল না। আমাদের ড্রিল স্যারের টাইটেল ছিল লেকু। স্যারের নাম মনে নেই। সবাই স্যারকে লেকু বলত।

"শুডনট ইউ সে মিঃ লেকু?"

"ভুল হয়ে গেছে মা - মিঃ লেকু..."

"ওয়াজ হি নাইস?"

তিনি মোটেও নাইস ছিলেন না। নাইস হলে তাঁর ভাগ্যে লেকু টাইটেল জুটত না। ড্রিলের সময় তাঁর হাতে বেত থাকতো। ব্যায়ামে ভুল হলে সপাং সপাং করে বাড়ি মারতেন। আমি ড্রিলে খুব সুবিধার ছিলাম না। পায়ে সমস্যার কারণে। সেই সমস্যা নিয়ে তিনি বেশ রূঢ় কথা বলতেন। ক্লাস থ্রি বালকের উপর কি প্রভাব পড়বে সেই নিয়ে ভাবিত ছিলেন না।

"হি ওয়াজ ওকে..." আমি শুকনা কন্ঠে জবাব দেই।

আমাদের পিই টিচার খুব নাইস। অল অফ দেম আর নাইস...তোমার স্কুলের সব টিচাররা নাইস ছিল?

আমি আকাশ-পাতাল চিন্তা করি। আমাদের স্কুলে সব ডেঞ্জারাস ডেঞ্জারাস স্যার ছিলেন। খুব অল্প দুই একজন ছাড়া প্রায় সবাই ভীষণ মারধোর করতেন। কেউ কারনে করতেন কেউ অকারনে। শফিক নিজামি নামে একজন ছিলেন, ক্লাস টুতে বাচ্চাদের দুই হাতের আঙ্গুলের মাঝে পেনসিল ঢুকিয়ে চেপে ধরতেন। আর মারার সময়ে গোটা তিনেক স্কেল একসাথে নিতেন। খায়ের স্যার ইসলাম ধর্ম পড়াতেন, মোটা ইলেক্ট্রিকের তার দিয়ে একবার ক্লাস আসলেন, ওটাকে চাবুকের মতো ব্যবহার শুরু করলেন। পাশের ক্লাসেই হিন্দু ধর্ম শিক্ষা ক্লাস নিতেন লালমোহন চক্রবর্তী - আমি দশ বছরের স্কুল জীবনে স্যারকে একবারই মারতে দেখেছি। খায়ের স্যারের ক্লাসে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো স্কুলে ভর্তির সময়ে হিন্দু নাম দিয়ে ভর্তি করে দিলে খায়ের স্যারের হাত থেকে বাঁচতে পারতাম।

হঠাৎ করে আমার হাশেম স্যারের নাম মাথায় আসলো...আমি জানালাম হাশেম স্যার খুব নাইস ছিলেন।

হাশেম স্যার অঙ্ক পড়াতেন। সারা ক্লাস জুড়ে বইয়ের প্রথম অংকটা করাতেন, এরপরে দুই থেকে পচাত্তর পর্যন্ত বাড়ির কাজ দিয়ে দিতেন। ব্যাস, চ্যাপ্টার শেষ। আমি কাউকে বাড়ির কাজ আনতে দেখি নি কোনদিন। সঙ্গত কারনেই স্যারের ক্লাসে আমরা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতাম। একমাসের মধ্যে স্যারের সিলেবাস শেষ হয়ে যেত। হাশেম স্যার খয়েরি রঙের একটা প্যান্ট আর সাদা রঙের একটা সার্ট পরে স্কুলে আসতেন, প্রতিদিন। আমাদের ধারনা ছিল স্যারের এই রঙ ছাড়া আর কোন রঙের পোষাক কিনতেন না। স্যারের আলমারিতে থরে থরে খয়েরি প্যান্ট থাকার কথা।

আমার স্কুলের গল্প আরও মনে পড়ে।

আমাদের মধ্যে খুব অল্প কিছু ভালো স্টুডেন্ট ছিল, খুব ভালো স্টুডেন্ট। বাকিরা পড়াশুনা থেকে শত হস্ত দূরে থাকতো। ক্লাসে পড়া ধরলে চোখে-মুখে একটা নির্ভেজাল বিস্ময়ের অভিব্যক্তি দেখা যেত। সেই সঙ্গে বেশির ছাত্রই খুবই দুষ্ট ছিল। স্কুল পালিয়ে বাইরে যাওয়া খুব সাধারন ঘটনা ছিল। আমাদের স্কুলের বেতন ছিল ১৫ টাকা, আমাদের এক বন্ধু সেই বেতনের টাকা পাঁচ পয়সা, দশ পয়সাতে নিয়ে এসেছিল, যাতে স্যারের গুনতে গুনতে জান বের হয়ে যায়। স্যারদের মারধোরও আমরা নির্বিকার মুখে মেনে নিতাম, স্কুলে পড়লে একটু আধটু মার খেতে হবে, এই বিষয়ে আমরা সবাই একমত ছিলাম। স্যারের মারধোর শেষ হলে সেইগুলো নিয়ে ক্লাসের শেষে আবার হাসিঠাট্টাও হতো। মাঝে মাঝে মার খাওয়ার পরেও দুষ্টামি চলতো। ইনফ্যাক্ট আমার ধারনা আমাদের অধিকাংশ স্যারদের আয়ু আমরা অন্তত বিশ বছর কমিয়ে দিয়েছি।

আমাদের শৈশবের গল্প ছিল অ্যাকশন সিনেমার মতো বর্ণাঢ্য- স্কুলের গল্প বলতে গেলেই কেন যেন মনটা ভালো হয়ে যায়।

আমি আগ্রহ নিয়ে আনুশার স্কুলের গল্প শুনি। কোথাও কোন মিল না থাকলেও কেন যেন  আমার মনে হয় আমার ক্লাসের প্রায় সবকয়েকটা চরিত্র ওদের ক্লাসেও উপস্থিত। সব ক্লাসেই দুষ্ট ছাত্র থাকে, ভালো ছাত্র থাকে, ভাবুক ছাত্র থাকে, পরিপাটি ছাত্র থাকে, চুলে চিরুনি না দেওয়া ছাত্র থাকে, কেউ কেউ থাকে নীরেন্দ্রনাথের কবিতার অমলকান্তির মতো।

আমার বন্ধুরা সবাই বড় হয়ে গেছে, শৈশব থেকে অতিদূরে এসে একেকজন একেক রকম মানুষ হয়েছে। যে হয়ত কবি হতে পারতো সে হয়েছে ব্যাংকার, যার রাজনীতি করা উচিত ছিল সে হয়ত হয়েছে মাস্টার। তাদের ধূসর মুখচ্ছবিতে বর্ণাঢ্য শৈশবের দেখা পাওয়া ভার - মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা আমার বন্ধু? হয়ত আমাকে দেখেও ওদের একই কথা মনে হয়। কেন জানি মনে হয় মানুষের শৈশবের চরিত্রগুলো বেশ কাছাকাছি - বড় হলেই হাজার রকম মানুষ তৈরি হয়।

সত্যজিৎ রায় "ক্লাসফ্রেন্ড" নামে একটা ছোটগল্প লিখেছিলেন, সেই গল্পটার মতো আমার মেয়ের বন্ধুদের ঝলমলে মুখ দেখলে আমি আমার বন্ধুদের খুঁজে পাই। শৈশবের আনন্দমেলাতে সবারই কেমন একটা ঐক্য আছে, কোন কিছু না মিললেও অনেক কিছুই আবার মিলে যায়। নিজের শৈশব বিগত তাই আনুশার শৈশবে উঁকি দেই, প্রায় প্রতিদিনই, এ যেন আমার ব্যক্তিগত আনন্দমেলা।



 ছবিঃ ল্যাবরেটরি স্কুল

Saturday, December 6, 2014

দুই পৃথিবী

গত বছর দেশে যাওয়ার আগে আনুশা আর আমি খুব মনোযোগ দিয়ে টিভিতে বাংলাদেশের নিউজ দেখতাম। ওই সময় সরকার বিরোধীদের আন্দোলন চলছিল। নিউজের একটা বিরাট অংশ ছিল হরতাল, মহাসড়ক অবরোধ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি।

"আব্বু হোয়াই ডিড দ্যাট গাই গেট ডাউন ফ্রম দ্য বাস থ্রু দ্য উইন্ডো?"

টিভির নিউজে একটা আক্রান্ত বাস দেখাচ্ছে, হরতালপন্থীরা ঢিল মারছে, পেছনের জানালা দিয়ে এক ভদ্রলোক তড়িৎগতিতে নেমে গেলেন। তার একটু পরেই  বাসটাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে চারিদিক বোমার শব্দে কেঁপে উঠলো।

আনুশার জিজ্ঞাসার শেষ নেই।

"আব্বু বাংলাদেশে সবাই কি এইভাবে বাস থেকে নামে?"

টিভির এই নিউজ দেখে যদি বাংলাদেশকে বিচার করতে হয় তবে মেনে নিতে হবে যে বাংলাদেশে সব সময় বাস এই ভাবেই থামে এবং যাত্রীরা সব জানালা দিয়ে
বের হয়ে যায়। এর পরেই হয়ত বাসটাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটাই হয়ত বাসে চলাচলের স্বাভাবিক নিয়ম। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে হীরক রাজার দেশ ছাড়া কোথাও এই নিয়ম থাকতে পারে না।

"পুলিশ কেন এই লোকটা মারছে?"

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কোন ব্যাখা চলে না - অন্তত নয় বছরের মার্কিনি মেয়ের কাছে বোধগম্য করার মতো কিছু আমি পেলাম না। এই জিনিস বুঝতে হলে এক জীবন এই দেশে বাস করতে হবে।

"আব্বু - বাংলাদেশের পুলিশ কি গুড না ব্যাড?"

বাংলাদেশের পুলিশ হচ্ছে সর্বভুক, আমি ফার্মগেটে পুলিশকে রিকশাওয়ালার কাছে থেকে আধা খাওয়া বিড়ি পর্যন্ত ঘুষ খেতে দেখেছি।  আগুনকে সর্বভুক না বলে পুলিশকে এই নাম দেওয়া উচিত। পুলিশ গুড না ব্যাড? এর উত্তর কি হতে পারে?

দেশে পৌছানোর পরেও সমস্যা কম না। এয়ারপোর্টের এক সিকিউরিটি গার্ড এবং এক গাড়ির ড্রাইভারের সামান্য তর্ক হচ্ছিল। সিকিউরিটি গার্ড থাপ্পড় মেরে সেই গাড়ির ড্রাইভারকে মাটিতে ফেলে দিল এবং সেই সাথে গোটা দুয়েক লাথিও জুটল লোকটার কপালে (আসলে অন্য জায়গাতে)। এর পরে কি হবে এই আশংকাতে আনুশা আমার হাত চেপে ধরল। কিন্তু দেখা গেল আক্রান্ত ড্রাইভার ভবিতব্যের মতো সে মার হজম করে উঠে দাঁড়ালো এবং তার নিজের কাজে ফিরে গেল।

দেশের রাস্তাতে ঘোরাঘুরির সমস্যাও কম না।

হোয়াই ডু পিপল কল ইচ আদার "কুত্তার বাচ্চা" হোয়েন দে গেট ম্যাড?

জানা গেল রাস্তাতে দুই জনের ঝগড়া থেকে এই জ্ঞান লাভ।

আনুশা থই পায় না - কুত্তার বাচ্চা মানে ডগ'স বেবি, মানে puppy, ইট'স অ্যা কিউট স্টাফ, হাউ ক্যান পিপল সে দিজ টু ইচ আদার হোয়েন দে আর ম্যাড?

আমি জানাতে বাধ্য হলাম যে এর "মোরাল ইক্যুভালেন্ট" গালাগাল ওর নিজের ভাষাতেও আছে।

এই নিয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আনুশা জেনে গেল যে "পিগ'স বেইবিও" বেশ খারাপ একটা গালি।

বাট দ্যাট ইজ সো নট ফেয়ার। হাউ স্টেঞ্জ!!! পিগের বেইবিরাও কত কিউট।

আব্বু হোয়াই ডু বুহা (বুয়া) কুকস ফুড - বাট নেভার ইট ইট?

কিভাবে বলা যায় যে আমরা একেকজন ছোটখাটো সম্রাট - "বুহাদের" আমাদের সাথে বসে খাওয়ার অনুমতি নেই।

নিজ দেশে ফেরার পরে আনুশা তার রায় জানিয়ে দেয়।

আব্বু বাংলাদেশের মানুষেরা খুব মিন...দে আর নেভার নাইস টু ইচ আদার...ওনলি ইয়োর অ্যান্ড মামা'স ফ্যামিলি অ্যান্ড ফ্রেন্ডজ আর নাইস।

আমাকে মিন মিন করে প্রতিবাদ করতে হয়। নিজের দেশের সম্মান বাঁচানোর একটাই উপায়। মার্কিনিরাও কত খারাপ এই উদাহরন আমি দেওয়ার চেষ্টা করি। ওরা রাস্তার পিটাপিটি না করলেও আকাশ থেকে দমাদম বোম মারছে হরদম...
এই দেশের ভেতরের এবং বাইরের নীতির সব নির্মমতা সুশীলতার মোড়কে মোড়া তাই সেটা বোঝা দুষ্কর, কিন্তু আমরা বাংলাদেশিরা আপেলকে রাগ করে পেয়ারা বলে ফেললেই দোষ...মেয়ের সরল জিজ্ঞাসা মাঝে মাঝে আমাকে অথই জলে ফেলে দেয়।

বাবা এবং মেয়ে...আমরা দুই দেশের মানুষ...মাঝে মাঝে এই টানাপোড়েনে আমার বোধদয় হয়...

আমরা আসলে দুই পৃথিবীর মানুষ।

Wednesday, December 3, 2014

যাদুকর

ছোটবেলাতে আব্বাকে আমার পাহাড়ের মতো উঁচু মনে হতো। সেটার অবশ্য একটা কারনও আছে। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। আব্বার গায়ের সাথে ঘেঁষে তাঁর কোলে উঠার চেষ্টা করতাম, উপরের দিকে তাকিয়ে। তিনি হয়তো কারো সাথে কথা বলছেন। কথা বলতে বলতেই তিনি আমাকে কোলে তুলে নিতেন - এক নিমিষেই আমি যেন ভূমি থেকে উঁচু একটা চূড়াতে উঠে যেতাম। আমার পায়ে একটা জন্মত্রুটি ছিল, কারো কোলে  উঠতে পারলে আমি আর নামতে চাইতাম না। আব্বার কথা চিন্তা করলেই আমি সেই শৈশবের দৃশ্যটা দেখতে পাই,আমি তাঁর কোলে উঠে আছি, আর তিনি  ক্লান্তিহীনভাবে আমাকে নিয়ে হাঁটছেন...হাঁটছেন...হাঁটছেন...তিনি বাসায় না থাকলে আমি ব্যাকুল হয়ে থাকতাম তাঁর ফেরার অপেক্ষায় - অফিস ফেরৎ তিনি বিকেলে দরজাতে কড়া নাড়লেই ছুটে যেতাম - তাঁর বুক পকেটে রাখা  বলপেনের চেয়ে বড় আর কোন খেলনা কেউ পেয়েছে কোনদিন?

কিংবা আব্বার অফিসে যাওয়ার মতো অ্যাডভেঞ্চার? ফার্মগেটে খামারবাড়ির কাছে ১৯১২ সালে তৈরি একটা পুরনো লাল দালানে আব্বার অফিস ছিল অনেকদিন। সেই অফিসের কালো রঙের ফোনটা নম্বরও এখন মনে আছে - তিনশ বারো - পাচঁশ সাত (৩১২৫০৭)। সেই অফিস থেকে পুরনো এয়ারপোর্টে বিমানের ওঠানামা দেখা যেত, অফিসের পিওন রশীদ ভাইয়ের চমকপ্রদ সব গল্প শোনা যেত...ঢাকার অনেক পুরনো ভবন ভেঙে ফেলা হলেও এটা এখনও টিকে আছে, আমি সেখানে একবার ঢুকতে গিয়েও ঢুকিনি, আমার মাথার ভেতর থাকা নিঁখুত ছবিটাই রেখে দিতে চাই...

একটু বড় হয়ে দেখেছি আব্বা সারাদিন ক্লান্তিহীন কাজ করে যান, অফিসের কাজ, বাসার কাজ, বাজার করা, বাগান করা...তুখোড় অপরেটিং সিস্টেমের মতো নিঁখুত দক্ষতায়। ওইদিকে আমরা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারি, ঘর ভরে উঠে সিগারেটের ধোঁয়াতে...চায়ের কাপে বিশ্বজয় করে ফেলি আর তিনি কাজ করে চলেন অভিযোগহীন, কোথাও তাঁর নিজের জন্য কিছুই যেন নেই।

একটু ভুল বললাম মনে হয়। তাঁর নিজের একটা শখ ছিল। তিনি ম্যাজিক ভালোবাসতেন, নিজেও ছিলেন শখের ম্যাজিশিয়ান। একবার বাংলাদেশের নামকরা ম্যাজিশিয়ানরা আমাদের বাসাতে আসর বসালো - সম্ভবত ওনারা একটা এসোসিয়েশন তৈরি করছিলেন। সেই ঘরোয়া আড্ডায় জুয়েল আইচ একটা দুর্দান্ত যাদু দেখালেন - নাম হচ্ছে মেমরি। আমরা একটার পর একটা জিনিসের নাম বলতে লাগলাম, উনি সব মাথার মধ্যে তুলে নিলেন। এর পর উনি সেই লিস্ট প্রথম থেকে শেষ, শেষ থেকে প্রথম, র‍্যান্ডম সবভাবেই বলে দিলেন। এই যাদু প্রদর্শনীর কয়েকদিনের মধ্যেই আব্বা "সুপার পাওয়ার মেমরি" নামে একটা বই কিনে আনলেন। কয়েকদিন পরে বইটা যখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না - তখন আমরা সবাই টের পেয়ে গেলাম যে এই যাদুটা সম্ভবত আর হবে না।

অনেক অনেকদিন পরে সেই শহর, সেই পুরনো ঘরবাড়ি, সেই প্রাচীন মানুষজন, সেইসব বিগত দিন থেকে দূরত্বে এসে আমি অনুভব করি আমার বাবা অপত্য স্নেহের যাদুকর ছিলেন। সেই যাদুকরী ভালোবাসা তিনি তাঁর সন্তানদের দিয়েছেন, এই জগৎসংসারে নিজের জন্য কিছু চাননি। সকালের ঘোর লাগা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে যখন নিজের শৈশবটা আমার নিজের কাছেই রূপকথা মনে হয়,  আমার বাবা সেই সব গল্পের নায়ক হয়ে যান নিজের অজান্তেই। হাত বাড়িয়েই আমি যেন ছুঁয়ে দিতে পারি বালকবেলা...যদিও পাখির ডানার শব্দে সচকিত সকালবেলার মতো আমার শৈশব প্রত্যাবর্তনের দিকে ফেরাবে না মুখ কস্মিনকালেও।

আমার সেই শৈশবের পাহাড়সম যাদুকর বাবা আজ নব্বুই পূর্ণ করলেন। তাঁর ছেচল্লিশতম জন্মদিনে জন্ম নেওয়া আমি চুয়াল্লিশ পূর্ণ করলাম। কালের আঁচড় কি সেটা আমি হাঁটুর ব্যথায় অনুভব করি, মানুষের স্মৃতি থেকে ৩১২৫০৭ ফোন নম্বর ওয়ালা অফিসের দেওয়াল - সর্বত্রই সময়ের দাগ পড়ে যায়। আমরা কেউই সময়ের লম্বা হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি না। আব্বাও তাই হয়ত কালের প্রাচীরে বন্দি - একটু একটু স্মৃতিক্ষয় শেষ মেষ তাঁকে তাঁর সন্তানদের নামও মাঝে মাঝে ভুলিয়ে দিয়ে যায় ।

কিন্তু এরপরও মনে হয় ভালোবাসাটাই একমাত্র জিনিস যেটা সময়ে কারাগার বন্দি নয়। নাম মনে না করতে পারলেও তাঁর পাশে বসলেই তাঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে, মনে হয় স্কুল থেকে এইমাত্র বাসায় ফিরে এসেছে তাঁর সন্তান। অপত্যস্নেহের প্রকাশে বাক্য লাগে না - পাশাপাশি চুপচাপ বসে থাকলেও সেটা স্পষ্ট উচ্চারণে সেটা শোনা যায়। 

শুভ জন্মদিন আব্বা...আরও অনেক অনেক জন্মদিনে আপনাকে পেতে চাই।

ডিসেম্বর ৪, ২০১৪
অস্টিন, টেক্সাস