Wednesday, December 3, 2014

যাদুকর

ছোটবেলাতে আব্বাকে আমার পাহাড়ের মতো উঁচু মনে হতো। সেটার অবশ্য একটা কারনও আছে। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। আব্বার গায়ের সাথে ঘেঁষে তাঁর কোলে উঠার চেষ্টা করতাম, উপরের দিকে তাকিয়ে। তিনি হয়তো কারো সাথে কথা বলছেন। কথা বলতে বলতেই তিনি আমাকে কোলে তুলে নিতেন - এক নিমিষেই আমি যেন ভূমি থেকে উঁচু একটা চূড়াতে উঠে যেতাম। আমার পায়ে একটা জন্মত্রুটি ছিল, কারো কোলে  উঠতে পারলে আমি আর নামতে চাইতাম না। আব্বার কথা চিন্তা করলেই আমি সেই শৈশবের দৃশ্যটা দেখতে পাই,আমি তাঁর কোলে উঠে আছি, আর তিনি  ক্লান্তিহীনভাবে আমাকে নিয়ে হাঁটছেন...হাঁটছেন...হাঁটছেন...তিনি বাসায় না থাকলে আমি ব্যাকুল হয়ে থাকতাম তাঁর ফেরার অপেক্ষায় - অফিস ফেরৎ তিনি বিকেলে দরজাতে কড়া নাড়লেই ছুটে যেতাম - তাঁর বুক পকেটে রাখা  বলপেনের চেয়ে বড় আর কোন খেলনা কেউ পেয়েছে কোনদিন?

কিংবা আব্বার অফিসে যাওয়ার মতো অ্যাডভেঞ্চার? ফার্মগেটে খামারবাড়ির কাছে ১৯১২ সালে তৈরি একটা পুরনো লাল দালানে আব্বার অফিস ছিল অনেকদিন। সেই অফিসের কালো রঙের ফোনটা নম্বরও এখন মনে আছে - তিনশ বারো - পাচঁশ সাত (৩১২৫০৭)। সেই অফিস থেকে পুরনো এয়ারপোর্টে বিমানের ওঠানামা দেখা যেত, অফিসের পিওন রশীদ ভাইয়ের চমকপ্রদ সব গল্প শোনা যেত...ঢাকার অনেক পুরনো ভবন ভেঙে ফেলা হলেও এটা এখনও টিকে আছে, আমি সেখানে একবার ঢুকতে গিয়েও ঢুকিনি, আমার মাথার ভেতর থাকা নিঁখুত ছবিটাই রেখে দিতে চাই...

একটু বড় হয়ে দেখেছি আব্বা সারাদিন ক্লান্তিহীন কাজ করে যান, অফিসের কাজ, বাসার কাজ, বাজার করা, বাগান করা...তুখোড় অপরেটিং সিস্টেমের মতো নিঁখুত দক্ষতায়। ওইদিকে আমরা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারি, ঘর ভরে উঠে সিগারেটের ধোঁয়াতে...চায়ের কাপে বিশ্বজয় করে ফেলি আর তিনি কাজ করে চলেন অভিযোগহীন, কোথাও তাঁর নিজের জন্য কিছুই যেন নেই।

একটু ভুল বললাম মনে হয়। তাঁর নিজের একটা শখ ছিল। তিনি ম্যাজিক ভালোবাসতেন, নিজেও ছিলেন শখের ম্যাজিশিয়ান। একবার বাংলাদেশের নামকরা ম্যাজিশিয়ানরা আমাদের বাসাতে আসর বসালো - সম্ভবত ওনারা একটা এসোসিয়েশন তৈরি করছিলেন। সেই ঘরোয়া আড্ডায় জুয়েল আইচ একটা দুর্দান্ত যাদু দেখালেন - নাম হচ্ছে মেমরি। আমরা একটার পর একটা জিনিসের নাম বলতে লাগলাম, উনি সব মাথার মধ্যে তুলে নিলেন। এর পর উনি সেই লিস্ট প্রথম থেকে শেষ, শেষ থেকে প্রথম, র‍্যান্ডম সবভাবেই বলে দিলেন। এই যাদু প্রদর্শনীর কয়েকদিনের মধ্যেই আব্বা "সুপার পাওয়ার মেমরি" নামে একটা বই কিনে আনলেন। কয়েকদিন পরে বইটা যখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না - তখন আমরা সবাই টের পেয়ে গেলাম যে এই যাদুটা সম্ভবত আর হবে না।

অনেক অনেকদিন পরে সেই শহর, সেই পুরনো ঘরবাড়ি, সেই প্রাচীন মানুষজন, সেইসব বিগত দিন থেকে দূরত্বে এসে আমি অনুভব করি আমার বাবা অপত্য স্নেহের যাদুকর ছিলেন। সেই যাদুকরী ভালোবাসা তিনি তাঁর সন্তানদের দিয়েছেন, এই জগৎসংসারে নিজের জন্য কিছু চাননি। সকালের ঘোর লাগা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে যখন নিজের শৈশবটা আমার নিজের কাছেই রূপকথা মনে হয়,  আমার বাবা সেই সব গল্পের নায়ক হয়ে যান নিজের অজান্তেই। হাত বাড়িয়েই আমি যেন ছুঁয়ে দিতে পারি বালকবেলা...যদিও পাখির ডানার শব্দে সচকিত সকালবেলার মতো আমার শৈশব প্রত্যাবর্তনের দিকে ফেরাবে না মুখ কস্মিনকালেও।

আমার সেই শৈশবের পাহাড়সম যাদুকর বাবা আজ নব্বুই পূর্ণ করলেন। তাঁর ছেচল্লিশতম জন্মদিনে জন্ম নেওয়া আমি চুয়াল্লিশ পূর্ণ করলাম। কালের আঁচড় কি সেটা আমি হাঁটুর ব্যথায় অনুভব করি, মানুষের স্মৃতি থেকে ৩১২৫০৭ ফোন নম্বর ওয়ালা অফিসের দেওয়াল - সর্বত্রই সময়ের দাগ পড়ে যায়। আমরা কেউই সময়ের লম্বা হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি না। আব্বাও তাই হয়ত কালের প্রাচীরে বন্দি - একটু একটু স্মৃতিক্ষয় শেষ মেষ তাঁকে তাঁর সন্তানদের নামও মাঝে মাঝে ভুলিয়ে দিয়ে যায় ।

কিন্তু এরপরও মনে হয় ভালোবাসাটাই একমাত্র জিনিস যেটা সময়ে কারাগার বন্দি নয়। নাম মনে না করতে পারলেও তাঁর পাশে বসলেই তাঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে, মনে হয় স্কুল থেকে এইমাত্র বাসায় ফিরে এসেছে তাঁর সন্তান। অপত্যস্নেহের প্রকাশে বাক্য লাগে না - পাশাপাশি চুপচাপ বসে থাকলেও সেটা স্পষ্ট উচ্চারণে সেটা শোনা যায়। 

শুভ জন্মদিন আব্বা...আরও অনেক অনেক জন্মদিনে আপনাকে পেতে চাই।

ডিসেম্বর ৪, ২০১৪
অস্টিন, টেক্সাস

No comments: