Tuesday, December 9, 2014

লেকু এবং ব্যক্তিগত আনন্দমেলা

আব্বু তোমাদের পিই টিচার কে ছিল?

আনুশা প্রায়ই আমাকে আমার শৈশব নিয়ে প্রশ্ন করে। সেই সিরিজের প্রশ্ন এটা। পিই মানে হচ্ছে ফিজিক্যাল এডুকেশন, অর্থাৎ আমরা যেটাকে ড্রিল ক্লাস বলি।

আমি বললাম আমাদের পিই টিচারের নাম ছিল - "লেকু"।

উত্তরটা পুরোপুরি ভুল না। আমাদের ড্রিল স্যারের টাইটেল ছিল লেকু। স্যারের নাম মনে নেই। সবাই স্যারকে লেকু বলত।

"শুডনট ইউ সে মিঃ লেকু?"

"ভুল হয়ে গেছে মা - মিঃ লেকু..."

"ওয়াজ হি নাইস?"

তিনি মোটেও নাইস ছিলেন না। নাইস হলে তাঁর ভাগ্যে লেকু টাইটেল জুটত না। ড্রিলের সময় তাঁর হাতে বেত থাকতো। ব্যায়ামে ভুল হলে সপাং সপাং করে বাড়ি মারতেন। আমি ড্রিলে খুব সুবিধার ছিলাম না। পায়ে সমস্যার কারণে। সেই সমস্যা নিয়ে তিনি বেশ রূঢ় কথা বলতেন। ক্লাস থ্রি বালকের উপর কি প্রভাব পড়বে সেই নিয়ে ভাবিত ছিলেন না।

"হি ওয়াজ ওকে..." আমি শুকনা কন্ঠে জবাব দেই।

আমাদের পিই টিচার খুব নাইস। অল অফ দেম আর নাইস...তোমার স্কুলের সব টিচাররা নাইস ছিল?

আমি আকাশ-পাতাল চিন্তা করি। আমাদের স্কুলে সব ডেঞ্জারাস ডেঞ্জারাস স্যার ছিলেন। খুব অল্প দুই একজন ছাড়া প্রায় সবাই ভীষণ মারধোর করতেন। কেউ কারনে করতেন কেউ অকারনে। শফিক নিজামি নামে একজন ছিলেন, ক্লাস টুতে বাচ্চাদের দুই হাতের আঙ্গুলের মাঝে পেনসিল ঢুকিয়ে চেপে ধরতেন। আর মারার সময়ে গোটা তিনেক স্কেল একসাথে নিতেন। খায়ের স্যার ইসলাম ধর্ম পড়াতেন, মোটা ইলেক্ট্রিকের তার দিয়ে একবার ক্লাস আসলেন, ওটাকে চাবুকের মতো ব্যবহার শুরু করলেন। পাশের ক্লাসেই হিন্দু ধর্ম শিক্ষা ক্লাস নিতেন লালমোহন চক্রবর্তী - আমি দশ বছরের স্কুল জীবনে স্যারকে একবারই মারতে দেখেছি। খায়ের স্যারের ক্লাসে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো স্কুলে ভর্তির সময়ে হিন্দু নাম দিয়ে ভর্তি করে দিলে খায়ের স্যারের হাত থেকে বাঁচতে পারতাম।

হঠাৎ করে আমার হাশেম স্যারের নাম মাথায় আসলো...আমি জানালাম হাশেম স্যার খুব নাইস ছিলেন।

হাশেম স্যার অঙ্ক পড়াতেন। সারা ক্লাস জুড়ে বইয়ের প্রথম অংকটা করাতেন, এরপরে দুই থেকে পচাত্তর পর্যন্ত বাড়ির কাজ দিয়ে দিতেন। ব্যাস, চ্যাপ্টার শেষ। আমি কাউকে বাড়ির কাজ আনতে দেখি নি কোনদিন। সঙ্গত কারনেই স্যারের ক্লাসে আমরা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতাম। একমাসের মধ্যে স্যারের সিলেবাস শেষ হয়ে যেত। হাশেম স্যার খয়েরি রঙের একটা প্যান্ট আর সাদা রঙের একটা সার্ট পরে স্কুলে আসতেন, প্রতিদিন। আমাদের ধারনা ছিল স্যারের এই রঙ ছাড়া আর কোন রঙের পোষাক কিনতেন না। স্যারের আলমারিতে থরে থরে খয়েরি প্যান্ট থাকার কথা।

আমার স্কুলের গল্প আরও মনে পড়ে।

আমাদের মধ্যে খুব অল্প কিছু ভালো স্টুডেন্ট ছিল, খুব ভালো স্টুডেন্ট। বাকিরা পড়াশুনা থেকে শত হস্ত দূরে থাকতো। ক্লাসে পড়া ধরলে চোখে-মুখে একটা নির্ভেজাল বিস্ময়ের অভিব্যক্তি দেখা যেত। সেই সঙ্গে বেশির ছাত্রই খুবই দুষ্ট ছিল। স্কুল পালিয়ে বাইরে যাওয়া খুব সাধারন ঘটনা ছিল। আমাদের স্কুলের বেতন ছিল ১৫ টাকা, আমাদের এক বন্ধু সেই বেতনের টাকা পাঁচ পয়সা, দশ পয়সাতে নিয়ে এসেছিল, যাতে স্যারের গুনতে গুনতে জান বের হয়ে যায়। স্যারদের মারধোরও আমরা নির্বিকার মুখে মেনে নিতাম, স্কুলে পড়লে একটু আধটু মার খেতে হবে, এই বিষয়ে আমরা সবাই একমত ছিলাম। স্যারের মারধোর শেষ হলে সেইগুলো নিয়ে ক্লাসের শেষে আবার হাসিঠাট্টাও হতো। মাঝে মাঝে মার খাওয়ার পরেও দুষ্টামি চলতো। ইনফ্যাক্ট আমার ধারনা আমাদের অধিকাংশ স্যারদের আয়ু আমরা অন্তত বিশ বছর কমিয়ে দিয়েছি।

আমাদের শৈশবের গল্প ছিল অ্যাকশন সিনেমার মতো বর্ণাঢ্য- স্কুলের গল্প বলতে গেলেই কেন যেন মনটা ভালো হয়ে যায়।

আমি আগ্রহ নিয়ে আনুশার স্কুলের গল্প শুনি। কোথাও কোন মিল না থাকলেও কেন যেন  আমার মনে হয় আমার ক্লাসের প্রায় সবকয়েকটা চরিত্র ওদের ক্লাসেও উপস্থিত। সব ক্লাসেই দুষ্ট ছাত্র থাকে, ভালো ছাত্র থাকে, ভাবুক ছাত্র থাকে, পরিপাটি ছাত্র থাকে, চুলে চিরুনি না দেওয়া ছাত্র থাকে, কেউ কেউ থাকে নীরেন্দ্রনাথের কবিতার অমলকান্তির মতো।

আমার বন্ধুরা সবাই বড় হয়ে গেছে, শৈশব থেকে অতিদূরে এসে একেকজন একেক রকম মানুষ হয়েছে। যে হয়ত কবি হতে পারতো সে হয়েছে ব্যাংকার, যার রাজনীতি করা উচিত ছিল সে হয়ত হয়েছে মাস্টার। তাদের ধূসর মুখচ্ছবিতে বর্ণাঢ্য শৈশবের দেখা পাওয়া ভার - মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা আমার বন্ধু? হয়ত আমাকে দেখেও ওদের একই কথা মনে হয়। কেন জানি মনে হয় মানুষের শৈশবের চরিত্রগুলো বেশ কাছাকাছি - বড় হলেই হাজার রকম মানুষ তৈরি হয়।

সত্যজিৎ রায় "ক্লাসফ্রেন্ড" নামে একটা ছোটগল্প লিখেছিলেন, সেই গল্পটার মতো আমার মেয়ের বন্ধুদের ঝলমলে মুখ দেখলে আমি আমার বন্ধুদের খুঁজে পাই। শৈশবের আনন্দমেলাতে সবারই কেমন একটা ঐক্য আছে, কোন কিছু না মিললেও অনেক কিছুই আবার মিলে যায়। নিজের শৈশব বিগত তাই আনুশার শৈশবে উঁকি দেই, প্রায় প্রতিদিনই, এ যেন আমার ব্যক্তিগত আনন্দমেলা।



 ছবিঃ ল্যাবরেটরি স্কুল

No comments: