Sunday, September 19, 2021

পরানের গহীন ভিতর

২০০২ সালের দিকে দেশে গিয়েছিলাম। এর কয়েকদিন আগেই তসলিমা নাসরিনের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ "ক" প্রকাশিত হয়েছে। আমি দেশে পৌঁছানোর দিন সন্ধ্যাতে টিভির নিউজে দেখলাম "ক" নিষিদ্ধ করার জন্য সৈয়দ হক আদালতে গেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বললেন এই বইতে তাঁর জন্য মানহানিকর মালামাল আছে।

তসলিমা নাসরিন কোন অবস্থাতেই আমার প্রিয় লেখক নন। তাঁর অন্য অনেক বইয়ের মতোই "ক" ভালো কোন কর্ম মনে হয় নি আমার কাছে। কিন্তু বই নিষিদ্ধ করার জন্য সৈয়দ হকের মতো লেখক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন সেটাও আমার বিশ্বাসের বাইরে ছিল।
সাধারণত তসলিমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য ইসলামি দলগুলো হইচই করে। সেই বার বিপরীত চিত্র দেখা গেল - "ক" বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রগতিপন্থীরাই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার ধার্মিক বন্ধুবান্ধব বরং দেখলাম "ক" এর প্রচার ও প্রসার চাইছে - প্রগতিশীলরা যে কত বড় লুইচ্চা সেটার এতো বড় প্রামাণ্য দলিলের প্রয়োজন তাদের কাছে অনেক। এই প্রথম তারা তসলিমাকে সত্যবাদী তকমা দিয়ে দিল।
আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম সৈয়দ হকের উপর। আমার মনে হয়েছিল উনি কাজটা ভালো করেন নি। এরপরেও অনেকদিন চলে গেছে। আমি আরো কিছুটা হলেও পৃথিবী দেখেছি - দিনে দিনে আমার মনে হয়েছে সৃষ্টি এবং স্রষ্টা দু'টি পৃথক স্বত্ত্বা - কোন অবস্থাতেই এই দুটোকে মিলানো উচিৎ নয়। এই পুরনো বিতর্কে আমি নিজেই আমার অবস্থান পাল্টেছি। কিন্তু দ্বৈরথ দ্বন্দ্ব এখনও কাটেনি। আল মাহমুদকে বর্জনের পাশাপাশি সোনালী কাবিনও কী ফেলে দিব নাকি এই প্রশ্ন আমাকে অনেক বেশি ভাবায় এখন।
মানুষের দোষত্রুটি থাকতে বাধ্য। লেখক আমার মতের মানুষ হবেন এটা ভাবাও অনুচিত। তিনি মহামানুষ হবেন - এই কল্পনাও স্রেফ বাতুলতা। তিনি নারী পুরুষের সমতার ঝাণ্ডা তুলে নিবেন নাকি সমকামীদের জন্য রাস্তায় দাঁড়াবেন সেটা দিয়ে হয়ত মানুষের বিচার চলে কিন্তু সৃষ্টিকে সেই তুলাদণ্ডে উঠালে সেটাকে সুবিচার বলা চলে না। লেখক বিচার্য হবে তাঁর কর্ম দিয়ে - তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। সেই কর্মের গুনেই হয়ত মহাকালের আঁচড় থেকে তিনি মুক্তি পেয়ে যাবেন। সেই সৃষ্টিই তাঁকে অমরত্বের তকমা পড়িয়ে দেবে অথবা বিস্মৃতির অন্ধকূপে ফেলে দিবে।
যারা ৭০ আর ৮০ দশকে বড় হয়েছে - সিনেমা, বিটিভি, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ঈদ সংখ্যা, গল্পের বই, মঞ্চনাটক ও সামরিক শাসনের যুগে - সেই প্রজন্মের কাছে সৈয়দ হক মানেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারাজীবন, খেলারাম খেলে যা, ঈদ সংখ্যাতে পড়া জেসমিন রোড, ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ শেষ করে গুনগুন করে গাওয়া ত্রিশ বছরের পুরনো সিনেমার গান, হৃদ কলমের টান অথবা অকস্মাৎ মনে পড়া বালিকার চন্দ্রযান।
সৈয়দ হককে আমি জীবনে কোনদিনই সামনা সামনি দেখিও নি। কিন্তু আজ সকালে এই অচেনা বুড়ো মানুষটার মৃত্যুসংবাদ নিকটাত্মীয় হারানোর বেদনা নিয়ে এলো। হঠাৎ টের পেলাম এতোকাল পরেও এই লোকটা লোকটা লুকিয়ে ছিলেন আমাদের ভেতরে, আমাদের যৌবনের সাথে, কাব্যময় ক্ষুব্ধ স্বদেশের সাথে, তিনি লুকিয়ে ছিলেন আমাদের একদম পরানের গহীন ভিতর।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।

(রচনাকালঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬)

Thursday, September 2, 2021

সেপ্টেম্বর

    ।।১।।


সেপ্টেম্বর আসলেই যশোর রোডের কবিতাটা মনে পড়ে। সুনীলের লেখার সূত্রে গিন্সবার্গের এই কবিতাটা অনেক আগেই পড়া। পরে মৌসুমী ভৌমিক বাংলা অনুবাদ করে সুর দিয়েছেন। কিন্তু এরও অনেক আগে অকাল প্রয়াত লেখক/কবি খান মোহাম্মদ ফারাবী কবিতাটির একটা বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। 


"Millions of daughters walk in the mud

Millions of children wash in the flood

A Million girls vomit & groan

Millions of families hopeless alone


Millions of souls nineteenseventyone

homeless on Jessore road under grey sun

A million are dead, the million who can

Walk toward Calcutta from East Pakistan"


ফারাবী অনুবাদ করেছিলেন...


"হাঁটছে পাকে লক্ষ পিতার কন্যারা

অবোধ শিশু ভাসিয়ে নিল বন্যারা

লক্ষ মেয়ে করছে বমন আর্তনাদ

লক্ষ পরিবারের আশা চূর্ণ সাধ।

.

লক্ষ প্রাণের উনিশ শত একাত্তর

উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর

সূর্য জ্বলে ধূসর রঙে মৃতপ্রায়।

হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়।"


সেপ্টেম্বর আসলেই আমি যেন না দেখা যশোর রোড দেখতে পাই। ধূসর, মলিন, কর্দমাক্ত - লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল - হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়। নির্বাক সেই ছায়াছবির আবহ সঙ্গীতের মতো মাথার ভেতর গান করে চলেন মৌসুমী ভৌমিক। 


এই কবিতাটার বয়েস প্রায় ৪৬ হবে। প্রায় আমার সমবয়েসি। এরই মধ্যে গ্রামাফোন রেকর্ড বদলে গিয়ে আইপড টাচ এসেছে, বই পড়ার -বুক রিডার এসেছে, স্মার্টফোন এসেছে, স্ন্যাপচ্যাট, ইন্সট্যাগ্রাম আরও কত কত কিছু এসেছে। আমরা আগামীকালের বিস্ময়ের প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছি। কালকের প্রযুক্তিটা হয়ত আজকের সবকিছুকে বাতিল করে দিবে, পুরনো করে দিবে। কিন্তু মানুষ কতটা পাল্টেছে? ৪৬ বছর পরে এই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শরনার্থী মানুষের ঢল নামছে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে। গিন্সবার্গ নেই, যশোর রোডের কাদামাটিতে মানুষের ঢল নেই - কিন্তু কবিতাটা যেন ধ্রুব সত্য, মানুষের বর্বরতার চিরকালের চলচ্চিত্র। কাদামাটি পেরিয়ে, নদীতে ভেসে, গুলির যখম নিয়ে, ভয়ংকর নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে মানুষ আসছে বানের জলের মতো...টিভির নিউজে প্রতিদিন ভেসে আসে গিন্সবার্গের কবিতা।


"কাদামাটি মাখা মানুষের দল

গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে

আকাশে বসত মরা ঈশ্বর

নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে"


ওদের মাথার উপরের আকাশটা বিস্ময়কর রকমের ধূসর!!!


।।২।।


মানুষের নির্মমতার কারণ আমি অনেক খুঁজেছি। প্রকৃতির সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট নিয়মের যথার্থ মানে হচ্ছে জোর যার মুল্লুক তার। দুর্বলকে অবধারিত ভাবে মার খেতে হবে। অন্য যেকোন প্রাণীর তুলনায় আমাদের হিংস্রতা অনেক অনেক বেশি। সেই কারণে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে মানুষ, শিশুদের মাথা ধড় থেকে নামিয়ে দিতে বুক কাঁপে না, ধর্ষণ, খুন প্রায় ডালভাত। পালিয়ে যাওয়া মানুষের যাত্রাপথে মাইন পেতে রেখে দেওয়া যায়। দুর্বল হয়ে জন্মগ্রহন করার চেয়ে বড় আর অন্যায় এই পৃথিবীতে নেই। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। 


ধর্ম নিয়ে হানাহানি হয়, অর্থ নিয়ে হানাহানি হয়, ভূমি নিয়ে হানাহানি হয়। পৃথিবী থেকে সব ধর্ম, সব অর্থ, সব ভূমি, সব অর্গানাইজড মতবাদ উঠিয়ে নিলে কী হানাহানি বন্ধ হবে?


উত্তরটা আমি জানি। 


হবে না। মানুষ আত্মঘাতী প্রানী। মানুষের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসবে না। 


যতদিন মনুষ্যজাতি পৃথিবীর বুকে থাকবে, ততদিন এই পৃথিবী নিরাপদ হওয়ার কোন সম্ভবনা আমি দেখছি না। 


।।৩।।


সকালে বাংলাদেশের টিভি দেখি। প্রতিদিন। মানুষের চাপ যেইভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় / লাখ মানুষ চলে আসবে অচিরেই। বর্ডার কার্যত খোলাই। 


আমি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে। অনেক জটিল সমীকরণ আছে, রোহিঙ্গাদের জঙ্গীবাদে যুক্ত করা সহজ - ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের "ধর্ম নিরপেক্ষ" শক্তি ক্ষমতাতে থাকার পরে জঙ্গীবাদ যেই পরিমাণ বেড়েছে তাতে আমার মনে হয় না রোহিঙ্গারা আসলে ১৯/২০ হবে কিছু। জঙ্গীতে আমাদের ডোমাস্টিক সাপ্লাই ভালোই আছে। আমাদের আলো হাওয়াতেই আন্তর্জাতিক মানের জঙ্গী তৈরি করা সম্ভব সেই প্রমাণ আমরা প্রায় প্রতিমাসেই পাচ্ছি।  


এর সমাধান কী? 


আমি নিশ্চিত নই কিন্তু সম্ভবত আন্তর্জাতিক চাপই একমাত্র সমাধান। সেটাও খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তুরস্ক, পাকিস্তান বা মালদ্বীপ এদের চাপে কিছুই হবে না। বার্মা বহুদিন একঘরে ছিল - সুচি সামনে থাকাতে মিলিটারিরা গায়ে গণতন্ত্রের ছাল পরেছে। গণতন্ত্র শব্দটা পশ্চিমাবিশ্ব খুব পছন্দ করে, বার্মিজ লুঙ্গিতে গণতন্ত্রের ছাপেই ওরা খুশি। চাপ দিতে পারতো ভারত অথবা চিন। দেখা যাচ্ছে এরা হয় বার্মার সাথে আছে অথবা নিরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পায়ের নিচে তেল নেই - মার্কিনিরা এদের নিয়ে চিন্তিত না। গণতন্ত্র বেচতে হলেও পয়সা খরচ হয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে - 'আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি' ব্যাপারটা গোলমেলে এইটা মূলত সন্ত্রাসী সংগঠন এবং রোহিঙ্গাদের উপর এই হামলা যে ওদের হামলার জবাবে - সেটা বার্মার কূটনীতির সেলিং পয়েন্ট। বর্তমান বিশ্বে এটা বেশ মার্কেট ভালো। সবগুলো প্যারামিটারই বার্মার পক্ষে। 


আমি জানি না বাংলাদেশের কি করার আছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ফোকাস বাড়ানোর চেষ্টা করা যেত, চিন আর ভারতের সাথে দেন দরবার করা যেত, বিশেষত ভারতের সাথে।সরকারের কাজকর্ম দেখে মনে হয় সেই ইচ্ছে বা যোগ্যতা তাদের আছে কিনা। 


।।৪।।


কিছু কিছু কবিতা অমর না হলেই ভালো হতো। 


যেই কবিতাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা সম্ভবত অমর হয়ে যাবে। লুট হয়ে যাওয়া মন্দির, ভেঙে ফেলা প্রতিমা, রাতে আধাঁরে পালনো হিন্দু পরিবার অথবা অথবা ভয়ার্ত রোহিঙ্গা শিশু, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া সিরিয়ান পরিবার - যতদিন শরণাগত মানুষের ঢল থাকবে, যতদিন নির্মমতা থাকবে, যতদিন হিংস্রতা থাকবে - ততদিন বেঁচে থাকবে সেপ্টেম্বর মাসের যশোর রোড। অমরত্বের চাবিকাঠি লুকানো আছে এর প্রতিটি লাইনেই। আরও একশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন কিনা জানি না - কিন্তু মানুষের নির্মমতার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে রয়ে যাবে...


"সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর

ঘর ভেঙ্গে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে

যশোর রোডের দুধারে মানুষ

এতো এতো লোক শুধু কেন মরে?"