গতকাল বিকালে পার্কে হাঁটছিলাম। দুটো মেয়ে আমাকে থামালো। ওদের চেহারা আর বেশভূষা দেখে বোঝা যাচ্ছিল চার্চের কাজে বেরিয়েছে। বহুদিন এই দেশে থাকার কারণে কয়েক সেকেন্ডে বুঝে ফেলতে পারি কে বাড়ির ছাদ সারানোর সার্ভিস বিক্রি করবে আর কে প্রভু যীশুকে বিক্রি করবে।
মেয়ে দুটোর বয়েস খুবই কম। ইতস্ততঃ বোধ করছিল। যীশুর বাণী প্রচারে অত পোক্ত হয় নি। আমাকে থামিয়ে বলল, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারবে কিনা। আমি রেডি হচ্ছিলাম সময় নাই বলার। কিন্তু সেটা বললাম না শেষ পর্যন্ত।
প্রশ্নটা ছিল - আজকে কোন জিনিসটা আমাকে খুশি করেছে? (What made you happy today?)
আমি নিশ্চিত ছিলাম এর সূত্র ধরে পরের আলোচনাতে যাবে এরা। কিন্তু এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি ভাবা শুরু করলাম। সত্যিকার অর্থে খুশি হওয়ার মতো কিছু হয় নি। আমাদের বিড়াল লরেল অসুস্থ, সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনেরা বিদায় নেওয়ার পরে সেখানে ভয়ানক অবস্থা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় এসে হানা দিয়েছে, হু হু করে বাড়ছে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা, অফিসের কাজের জটিলতা চলমান - ঠান্ডা মাথাতে চিন্তা করে দেখলে খুশি হওয়ার কোন কারণ প্রত্যেক দিন ঘটে না, কদাচিৎ আনন্দ এসে দেখা দিতে পারে। তার দেখা পাওয়া ইদানিং দুষ্কর হয়ে গেছে বিশেষত খবরের কাগজ পড়ার পরে।
আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করতে লাগলাম। এই এক লাইনের প্রশ্ন যে বুয়েটে পড়া থার্মডিনামিক্সের পরীক্ষার মতো কঠিন হয়ে যাবে কে জানতো?
আমি শেষ পর্যন্ত জানালাম - আমি যে বেঁচে আছি এইটাই আমার কাছে আপাতত সবচেয়ে আনন্দের খবর। জবাবটা আমি সত্যি সত্যি মন থেকে দিয়েছি।
এর জবাবে ওরা আর কথা বাড়ালো না। বলল - এভ্রি ডে ইজ এ গিফট, তাই না, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ঈশ্বর অবশ্য আমার অনেক মঙ্গলই করেছেন। ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে আমি কোন বিশাল সমস্যাতে নেই। তিনি এখন অন্যান্য কাজে হাত দিতে পারেন।
কিন্তু এভ্রিডে যে গিফট সেটা আজকে সকালে মনে হলো। সকালে ঘুম ভেংগেছে দেরিতে। অফিস শুরু না করে ধীরে সুস্থে চা বানালাম। এরপরে লরেলকে নিয়ে বাইরে গেলাম। গরম সহনীয়, হালকা বাতাস ছিল, সামান্য ফুলের মৌতাতও ছিল। চায়ে চিনি পরিমিত হয়েছে, মাথার উপরের আকাশটাও গাঢ় নীল, ছেলেবেলার মতো, প্রায় দুঃখহীন। আমাদের নিজেদের তৈরি করা এক চিলতে প্রকৃতিতে বসে রইলাম চুপচাপ। নেচার হ্যাজ অল দ্য আনসারস - এক ন্যাশানাল পার্কে এই আপ্তবাক্যটা পেয়েছিলাম। কথাটা খাঁটি।
কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া আর যাবতীয় জিনিস পীড়াদায়ক। এর মধ্যে এক নম্বরে আছে অফিস, দুই নম্বরে আছে দিন দুনিয়ার খবর - এই দুই ইয়ে মিলে পুরোদিনের সুখ, আনন্দ সবই বরবাদ করে দিতে পারে। সামারা যখন ছোট ছিল তখন জিজ্ঞেস করতো মানুষকেই কেন একমাত্র স্কুল আর অফিসে যেতে হয়? অন্য কোন প্রাণীকে এই যন্ত্রণা নিতে হয় না। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। প্রাণীজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান হওয়ার পরেও আমরা নিঃসঙ্গ, নিজেদের তৈরি করা বাজারের ফাঁদে নিজেরাই আটকে গেছি। এই কোলাহলে আর নিজের ভেতরের মানুষটার দেখাই মিলে না একদম।
প্রশ্নটা আজকে করা হলে জবাব দিতে দেরি হতো না। এই সফেদ সকালটা অনেকখানি ভার নিয়ে গেছে, জটিলতা থেকে ২০ ফুট দূরে (মানে আমার কাজের ও অকাজের ল্যাপটপ আরকি) বসেও প্রায় মহামুক্তি পেয়ে গিয়েছিলাম। পাখির পালকের মতো হালকা এই সকালে আবারও টের পেয়ে গেলাম যে অবশেষে মানুষ আসলে একা, একদম একা!
"অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।
ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেন আমি
চলে যাই আজও সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে,
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর!
মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষ্মী চাঁদ তারা
নরম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর
হরিকীর্তনের নদীভূত বোল!
বড় ভাই আসতেন মাঝরাতে মহকুমা শহরের যাত্রাগান শুনে,
সাইকেল বেজে উঠত ফেলে আসা শব্দে যখন,
নিদ্রার নেশায় উবু হয়ে শুনতাম, যেন শব্দে কান পেতে রেখে :
কেউ বলে যাচ্ছে যেন,
বাবলু তোমার নীল চোখের ভিতর এক সামুদ্রিক ঝড় কেন?
পিঠে অই সারসের মতো কী বেঁধে রেখেছ?
আসতেন পাখি শিকারের সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে দুলাভাই!
ছোটবোন ঘরে বসে কেন যেন তখন কেমন
পানের পাতার মতো নমনীয় হতো ক্রমে ক্রমে!
আর অন্ধ লোকটাও সন্ধ্যায়, পাখিহীন দৃশ্য চোখে ভরে!
দিঘিতে ভাসত ঘনমেঘ, জল নিতে এসে
মেঘ হয়ে যেত লীলা বৌদি সেই গোধূলিবেলায়,
পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে, ভাবতুম
এমন দিনে কি ওরে বলা যায়—?
স্মরণপ্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে
সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড়ভাই নিরুদ্দিষ্ট,
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি সাথে করে নিয়ে গেছে গাঁয়ের হালট!
একে একে নদীর ধারার মতো তারা বহুদূরে গত!
বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো
সবার গোচরহীন আছি আজও সুদূরসন্ধানী!
দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি,
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতন একা একজন লোক,
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শতজীবনের শত কুহেলি ও কুয়াশার গান!
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলি মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!"
(পাখি হয়ে যায় প্রাণ - আবুল হাসান)
No comments:
Post a Comment