২০০২ সালের দিকে দেশে গিয়েছিলাম। এর কয়েকদিন আগেই তসলিমা নাসরিনের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ "ক" প্রকাশিত হয়েছে। আমি দেশে পৌঁছানোর দিন সন্ধ্যাতে টিভির নিউজে দেখলাম "ক" নিষিদ্ধ করার জন্য সৈয়দ হক আদালতে গেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বললেন এই বইতে তাঁর জন্য মানহানিকর মালামাল আছে।
তসলিমা নাসরিন কোন অবস্থাতেই আমার প্রিয় লেখক নন। তাঁর অন্য অনেক বইয়ের মতোই "ক" ভালো কোন কর্ম মনে হয় নি আমার কাছে। কিন্তু বই নিষিদ্ধ করার জন্য সৈয়দ হকের মতো লেখক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন সেটাও আমার বিশ্বাসের বাইরে ছিল।
সাধারণত তসলিমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য ইসলামি দলগুলো হইচই করে। সেই বার বিপরীত চিত্র দেখা গেল - "ক" বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রগতিপন্থীরাই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার ধার্মিক বন্ধুবান্ধব বরং দেখলাম "ক" এর প্রচার ও প্রসার চাইছে - প্রগতিশীলরা যে কত বড় লুইচ্চা সেটার এতো বড় প্রামাণ্য দলিলের প্রয়োজন তাদের কাছে অনেক। এই প্রথম তারা তসলিমাকে সত্যবাদী তকমা দিয়ে দিল।
আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম সৈয়দ হকের উপর। আমার মনে হয়েছিল উনি কাজটা ভালো করেন নি। এরপরেও অনেকদিন চলে গেছে। আমি আরো কিছুটা হলেও পৃথিবী দেখেছি - দিনে দিনে আমার মনে হয়েছে সৃষ্টি এবং স্রষ্টা দু'টি পৃথক স্বত্ত্বা - কোন অবস্থাতেই এই দুটোকে মিলানো উচিৎ নয়। এই পুরনো বিতর্কে আমি নিজেই আমার অবস্থান পাল্টেছি। কিন্তু দ্বৈরথ দ্বন্দ্ব এখনও কাটেনি। আল মাহমুদকে বর্জনের পাশাপাশি সোনালী কাবিনও কী ফেলে দিব নাকি এই প্রশ্ন আমাকে অনেক বেশি ভাবায় এখন।
মানুষের দোষত্রুটি থাকতে বাধ্য। লেখক আমার মতের মানুষ হবেন এটা ভাবাও অনুচিত। তিনি মহামানুষ হবেন - এই কল্পনাও স্রেফ বাতুলতা। তিনি নারী পুরুষের সমতার ঝাণ্ডা তুলে নিবেন নাকি সমকামীদের জন্য রাস্তায় দাঁড়াবেন সেটা দিয়ে হয়ত মানুষের বিচার চলে কিন্তু সৃষ্টিকে সেই তুলাদণ্ডে উঠালে সেটাকে সুবিচার বলা চলে না। লেখক বিচার্য হবে তাঁর কর্ম দিয়ে - তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। সেই কর্মের গুনেই হয়ত মহাকালের আঁচড় থেকে তিনি মুক্তি পেয়ে যাবেন। সেই সৃষ্টিই তাঁকে অমরত্বের তকমা পড়িয়ে দেবে অথবা বিস্মৃতির অন্ধকূপে ফেলে দিবে।
যারা ৭০ আর ৮০ দশকে বড় হয়েছে - সিনেমা, বিটিভি, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ঈদ সংখ্যা, গল্পের বই, মঞ্চনাটক ও সামরিক শাসনের যুগে - সেই প্রজন্মের কাছে সৈয়দ হক মানেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারাজীবন, খেলারাম খেলে যা, ঈদ সংখ্যাতে পড়া জেসমিন রোড, ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ শেষ করে গুনগুন করে গাওয়া ত্রিশ বছরের পুরনো সিনেমার গান, হৃদ কলমের টান অথবা অকস্মাৎ মনে পড়া বালিকার চন্দ্রযান।
সৈয়দ হককে আমি জীবনে কোনদিনই সামনা সামনি দেখিও নি। কিন্তু আজ সকালে এই অচেনা বুড়ো মানুষটার মৃত্যুসংবাদ নিকটাত্মীয় হারানোর বেদনা নিয়ে এলো। হঠাৎ টের পেলাম এতোকাল পরেও এই লোকটা লোকটা লুকিয়ে ছিলেন আমাদের ভেতরে, আমাদের যৌবনের সাথে, কাব্যময় ক্ষুব্ধ স্বদেশের সাথে, তিনি লুকিয়ে ছিলেন আমাদের একদম পরানের গহীন ভিতর।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।
(রচনাকালঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬)
No comments:
Post a Comment