Thursday, March 26, 2015

বড় হওয়া এবং ছোট হওয়া

অফিসে যাওয়ার সময়ে চারটা জিনিস সাথে রাখতে হয়। অফিসের রুমের চাবি, মেইন গেটের জন্য ব্যাজ, মানিব্যাগ আর রিডিং গ্লাস। প্রায় প্রতি মাসে অন্তত একদিন এই চারটি জিনিসের একটি বাসাতে ফেলে আসি।

অথচ ৩০ বছর আগের শীতকালের বিকালে খাওয়া নরম খিচুরির গন্ধটা সেদিন মনে পড়ে গেল নির্ভুল। শিপুদের বাসায় আব্বার সাথে প্রথম যাওয়া, বিকেলে ওদের বাসার পিছে দৌড়াদৌড়ি। শিপু "র" উচ্চারণ করতে পারতো না, আমি "ক" উচ্চারণ করতে পারতাম না। শিপু স্যারকে বলত "সাল", আমি কাককে বলতাম "তাত"।

স্মৃতি অপ্রয়োজনীয় জিনিস মনে রাখে নাকি বর্তমানটাই বিভীষিকাময় একটা অদরকারি জিনিস?
অফিসে গত বছর যাদের সাথে কাজ করেছি, তাদের দুই একজনের নাম ভুলে গেছি ইতিমধ্যে।
কিন্তু ক্লাস ওয়ানের বন্ধুদের অনেকের পুরো নাম আর রোল নম্বর মনে আছে।

মস্তিষ্ক এমন কেন? গতকালের গল্প বিস্মৃতি হলেও আব্বার অফিসের পিওন রশীদ ভাইয়ের জামার রঙটা মনে রয়ে যায় ঠিকঠাক। আনুশা আমাকে সেইদিন বলল - ও আর বড় হতে চায় না। সম্ভব হলে আমিও পিটার প্যান হতাম। দাড়ি পেকে গেলে পিটার প্যানরা দলে নেয় না।

তবে সবাইকেই একদিন শৈশবমুখি হতে হয়। চুপচাপ একাকী কোন বিকেল বেলা ভেতরের অবাধ্য বালকটা ডেকে আনতে হয়। তার চোখের পাতায় এখন আছে বিস্ময়।

এর পরে আবার একসাথে উজানে যাত্রা।

বড় হতে হতে আবার একদিন ছোট হতে হয়।

Thursday, March 5, 2015

একা একা

 

আমার বয়েস যেদিন দশ বছর হয়েছিল সেই দিনটিতে আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল, আমারই দাবির প্রেক্ষিতে। আমার মেজভাই আমাকে একা একা মনির ট্রেডার্সে যেতে বললেন। মনির ট্রেডার্স আমাদের বাসা থেকে তিনশ গজ দূরের একটা দোকান। ওইখান থেকে আমরা মূলত মিমি চকলেট কিনতাম। পয়ত্রিশ বছর আগের সেই দিনটিতে  আমি প্রথম একদম একা একা বাসা থেকে বের হলাম। ফিরে আসার পরে জানলাম আমার মেজভাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আমার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন। আমি যদি হারিয়ে-টারিয়ে যাই।

দশ বছর বয়েসে আমার ভাই আমাকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। আমার বয়েস এক ডিজিট থেকে দুই ডিজিটে পৌঁছেছে - সেখান থেকে তিন ডিজিটে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।

সেই থেকে শুরু। তিনশ গজের পরে হাজার গজ, এর পরে হয়তো এক মাইল, দুই মাইল, পাঁচ, দশ বা একশ মাইল, একটা সময় সেটা আর গজফিতার মাপে থাকে না। পড়াশুনা শেষ করে একা একা বাইরে পাড়ি দিয়েছি, একাই পাহাড়ে চড়েছি, পাতালের এক গুহাতেও নেমেছি, মহাসমুদ্র দেখেছি। আমাকে আর কেউ চোখে চোখে দেখে রাখেনি। জীবনের নিয়মই এটা। শৈশবের দেওয়ালটা একদিন টপকাতেই হয়। এরপরে অজানা মানুষের সাথে মিশতে হয়, অজানা জায়গাতে পাড়ি দিতে হয়, অজানা পরিস্থিতিতে পড়তে হয় এবং মাঝে মাঝে অজানা এবং অচেনা একটা মানুষের জীবন যাপন করতে হয় - দিন দিন প্রতিদিন। ইচ্ছে থাকলেও আর হারিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বাস্তবতার চাপ অভিকর্ষের মতোই প্রবল, সেটা কাটিয়ে উঠার মতো  মুক্তিবেগ অর্জন করা খুব কম মানুষের জন্যই সম্ভব হয়। আর এইটুকু পথের অভিজ্ঞতা থেকে আমার তিন ডিজিটে পৌঁছানোর ইচ্ছে একদমই নেই।

আজ ছয়ই মার্চ আনুশার দশ বছর পূর্ণ হলো। ঠিক দশ বছর আগে এই দিনটিতে ওর জন্ম। সকাল থেকেই ঠাণ্ডা আর বৃষ্টি, সারাদিন সূর্যের মুখই দেখা যায় নি। রাত ঠিক ১২:৪৪ মিনিটে আনুশাকে আমি প্রথম কোলে নেই, জন্ম মূহুর্তের কান্না বন্ধ করে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে সে, আর আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে।  সেই বিস্ময় আমার এখনও রয়ে গেছে... ওর প্রথম হাঁটতে শেখা, প্রথম কথা বলা, প্রথম স্কুলে নিয়ে যাওয়া, প্রথম কার্টুন, প্রথম আইসক্রিম, প্রথম দোকানে যাওয়া, প্রথম ভ্যালেন্টাইন ড্যান্স - ওর এই পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মাইলস্টোনগুলোই আমার জানা, আমার বিস্মিত চোখের সামনেই এইটুকু মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুতই।

সেদিন আনুশা দাবি করে বসল ওকে একা একা স্কুল থেকে ফিরতে দিতে হবে। নিমেষেই আমার নিজের দশ বছর বয়েসের ঘটনাটা মনে পড়ল। জীবন এক চক্রের মতো - আমি হঠাৎ টের পেয়ে গেলাম আনুশার একা একা চলার সময় আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। জ্যোতিষী না হয়েও এর পরের ঘটনা আমি মোটামুটি জানি। যদিও আমি সব সময় আর পাশে থাকবো না - তবু পুরনো চোখ দিয়ে আমি দেখতে পাই বাস্তব পৃথিবীটা তার আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, ভালোবাসা, কদর্যতা সব কিছ নিয়েই ধেয়ে আসছে।

আমি যদি পারতাম তাহলে সারাজীবনই পাশে পাশে থাকতাম, মাঝে মাঝে আমার নিজেরও মনে হয় কেউ ছায়া দিয়ে রাখলে কি দারুণটাই না হতো। তবু সাহস নিয়ে একদিন আকাশে উড়তে হয়। পৃথিবীতে চলতে হলে জ্ঞান, বুদ্ধি আর শিক্ষার চেয়ে আমার মনে হয় সাহসটাই দরকার সবচেয়ে বেশি।

শুভ জন্মদিন আনুশা, আমার ছোট্ট পাখি। জীবন থেকে সোনার মেডেল শিউলি ফোঁটা সকাল নিয়ে বড় হও, সাহসী, সুন্দর ও সহজ মানুষ হও, পৃথিবীতেই দ্রুতই কমে আসছে এদের সংখ্যা।

ড্যাডি লাভস ইউ।