Tuesday, May 18, 2021

মৃত্যু

- ১- 
আমি তখন খুব ছোট। পাঁচের নিচেই হবে। আমার একমাত্র বন্ধু তিথি, আমাদেরই বাসাতে ভাড়া থাকে। ওরা একতলাতে, আমরা দোতলায়। একদিন দেখি ওদের বাসাতে অনেক লোক। তিথির দাদার (অথবা নানার) শরীর খুব খারাপ। 

আমি আর তিথি শোবার ঘরে দাদাকে দেখতে গেলাম। বুড়ো বিছানাতে শুয়ে আছেন, শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। নাকে নল দেওয়া, পাশে সবুজ রংয়ের একটা সিলিন্ডারের মতো জিনিস। কষ্ট করে যেটুকু নিঃশ্বাস নিতে পারছেন, সেটা সম্ভবত ওইটার কল্যাণেই সম্ভব হচ্ছে। 

পুরো ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক আমাদের হটিয়ে দিলেন। বাচ্চাদের এখানে থাকার দরকার নেই। একদম ঠিক কাজই করেছিলেন বলা যায়। যদিও আমরা কাছে ধারেই ঘুরঘুর করছিলাম। আমরা হটে গেলেও মৃত্যু সেখান থেকে হটে যায় নি। চারিপাশের রাশি রাশি উদ্বিগ্ন মুখ বলে দিচ্ছিল মৃত্যু যেন ধারে কাছে কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। 

আমার মনে নেই ভদ্রলোকের মৃত্যু হাসপাতালে নাকি আমাদের বাসাতেই হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যাতে নিচ থেকে অনেক কান্নার রোল ভেসে এলো – সেই থেকে মৃত্যু যেন আমার কাছে সবুজ অক্সিজেন সিলিন্ডার, কষ্ট করে নেওয়া শ্বাস, মাথার উপরে টিমটিমে হলদে চল্লিশ পাওয়ারের বাতি আর দূর থেকে শোনা কান্না। এর থেকে যতদূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। 

এরপরে অনেক প্রায় এক জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে, আমার বহু বহু প্রিয়জন চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু আমাকে কারো মৃত্যুযন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করতে হয়নি। আমি প্রায় পুরো জীবন দূর থেকেই মৃত্যুর সংবাদ শুধু শুনে গেছি, দেখিনি সামনে থেকে – জীবনের এই অবশ্যসম্ভাবী  যন্ত্রণাময় পরিণতি দর্শন থেকে আমি পালিয়ে থাকতে চাই। যতদিন না পর্যন্ত নিজের দরজায় তার টোকা না পড়ে। 

- ২ – 
আমাদের দুটো পাখি আছে। টুপুর আর টাপুর। বৃষ্টির শব্দের নামে। বারো বছর আগে টুপুরকে আমি ঘরে আনি। প্যারাকিট বা বাজি। আনুশার বয়েস ৪ আর সামারার ২। কোথা থেকে এনেছিলাম, কিভাবে এনেছিলাম সবই মনে আছে। বাচ্চারা খুবই খুশি। এর কিছুদিন পরে টাপুরকে নিয়ে আসি আমরা একই জায়গা থেকে। আনুশা আর সামারা খুবই খুশি – টুপুরের সঙ্গী জুটে গেল। 

প্রথমে চিন্তা করিনি কিন্তু খাঁচায় বন্দী পাখি আমাকে আস্তে আস্তে বিষণ্ণ করে তুললো। একবার ভেবেছিলাম মুক্ত করে দিবো। কিন্তু সেটা প্রায় মৃত্যুদণ্ডের মতোই হবে। টুপুর আর টাপুর রয়ে যায়, আনুশা আর সামারাও বড় হতে থাকে। একটা সময়ের পর পাখিদের ব্যাপারে ওদের আগ্রহে ভাঁটা পড়ে। পাখি দুটো নিজেরাই কিচির মিচির করে দিন কাটিয়ে দেয়। 

পাখিরাও বুড়ো হয়, তাদেরও জরাব্যাধি গ্রাস করে। প্যারাকিট বেশ আজব পাখি। এদের অসুস্থতা বোঝার উপায় নেই। একদম শেষ সময়ে গিয়ে টের পাওয়া যায়। গত রবিবার বিকালে আমি লক্ষ্য করি টুপুর খাঁচার নিচে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে অল্প ডানা ঝাপটাচ্ছে। সেই সঙ্গে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। টুপুরের সঙ্গী টাপুর এসে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে একটু পর পর। কিছুক্ষণ পরে টুপুর অনেক কষ্ট করে খাবারের দানি থেকে অল্প অল্প খাবার মুখে দিলো। 

বহু বহু বছর পরে আমি আবারও মৃত্যুযন্ত্রণা দেখতে পেলাম চোখের সামনে। টুপুর খুবই কষ্ট পাচ্ছিল, আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ওর সঙ্গী টাপুর খুব বিচলিত হয়ে আছে। বহুকাল পরে সেই সবুজ অক্সিজেন, হলুদ আলোয় দূর থেকে শোনা কান্না যেন ফেরত এলো। মৃত্যুকে ভালোবাসা সম্ভব না আমার পক্ষে, মৃত্যুকে ভালোবাসতে গেলে জীবনকে নাকচ করে দিতে হয়। কিন্তু এর থেকে পালানোও সম্ভব না এই সত্যটা আবারও টের পেলাম। 

অসহায় আমি টের পেলাম এই যন্ত্রণা লাঘব করার মতো কিছুই নেই আমার হাতে। রবিবার রাতে পাখির ডাক্তার পাওয়ার সম্ভবনা নেই। সোমবার সকালে এক জায়গাতে ফোন দিবো ঠিক করে রাখলাম। গভীর রাত পর্যন্ত খাঁচার পাশে বসে রইলাম। টুপুরের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম। আমি আবারও টের পেলাম সবাই বেঁচে থাকতে চায়, টুপুরের ডানা ঝাপটানো, কষ্ট করে খাবার মুখে দেওয়া, বেঁচে থাকার জন্য আকুলতা মনে করিয়ে দেয় "আট বছর আগের একদিন" কবিতার লাইন। 

“গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।“
(আট বছর আগের একদিন/জীবনানন্দ দাশ) 

আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগেও টুপুর বেঁচে ছিল, ডানা ঝাপটাচ্ছিল। সকালে উঠে দেখি সব চুপচাপ। টাপুর এসে ওকে খাওয়ানোর প্রচুর চেষ্টা করছে – ও সাড়া দিচ্ছে না। টুপুরকে বাসার পেছনে সমাহিত করার পরেও দেখলাম টাপুর এসে বসে আছে খাঁচার সেইখানে, যেখানে টুপুর পড়েছিল। পাখিরাও ভালোবাসতে জানে, পাখিরাও দুঃখ শোকে মৃত্যুতে কাতর হয়। 

যতগুলো মৃত্যু থেকে পালিয়ে দূরে ছিলাম এতোদিন, প্রতিটি মৃত্যুর যন্ত্রণা আর শোক এই সোমবারের প্রবল বর্ষণময় সকালে আবারও ফিরে এলো চুপচাপ, সপ্তপর্ণে। খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল টুপুর এক বৃষ্টির দিনে। 

“নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করলে, প্রতিটা সম্পর্কই স্থাপিত হওয়া মাত্রই এ সম্পর্কের জন্য কষ্ট পাওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। সম্পর্কগুলি অনেকটা টাইম বম্বের মতো। একটা সম্পর্কের শুরু মানেই যেন কেউ টাইমার অন করে দিলো। যতো আনন্দই আসুক, যতো প্রাপ্তিই আসুক, এ সম্পর্কের থেকে নির্ধারিত কষ্টটুকু নিশ্চিতভাবেই পেতে হবে। এই কষ্টের সবটুকুই অনতিক্রম্য নিয়তি। এই দুঃখ, এই বিষণ্ণতা, এই শূন্যতাই শ্বাশত, ন হন্যতে।“

 (ন হন্যেতে/সবজান্তার ব্লগ/সচলায়তনে প্রকাশিত)