Friday, January 22, 2021

সময়

ছবিটা ১৯৮৫ সালে তোলা। দিন তারিখ মনে নেই, তবে গ্রীষ্মকালে তোলা ছবি। বেশ গরম ছিল সেদিন, এইটুকু মনে আছে। আমাদের পরিবারের সবাই দাঁড়িয়ে আছি আমাদের ২৯ নম্বর বাসার ছাদে। রোদের কারণে কিছু চোখ কুচকানো। আমাদের বাসাটা দোতলা, ঢাকা শহরে তখনও দোতলা বাসা বিরল হয়ে যায় নি। তবে কিছু কিছু ৪/৫ তলা বাসা তৈরি হচ্ছে, আস্তে আস্তে শহরের উচ্চতা বাড়ছে।

আমাদের বাসার পেছনেই এক পাঁচতলা বাসা দেখা যাচ্ছে। ওই বাসার পেছনে আরও তিনটা পাঁচতলা বাসা আছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। ছবিতে ডানপাশটা ফাঁকা। ছবিতে নেই, কিন্তু অনেকখানিই ফাঁকা জায়গার মধ্যে ছোট একটা একতলা বাড়ি আছে সেখানে। ঢাকা শহরে একতলা বা দোতলা বাড়ির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে যদিও। ওই একতলা বাসাটার কম্পাউন্ডে প্রকান্ড একটা জামগাছ ছিল, ছবিতে সেটার সামান্য অংশ কি দেখা যাচ্ছে? আমি নিশ্চিত নই। জামগাছটার প্রাণদন্ড কবে কার্যকর হয়েছে সেটা মনে করতে পারলাম না।

ডানদিকের ফাঁকা জায়গাতে আমাদের দেওয়াল ঘেঁষে একটা কামরাঙ্গা গাছ ছিল, ছবিতে দেখা সম্ভব না এবং আমার ধারণা এই ছবি তোলার আগেই সে নিহত হয়েছে। ওই গাছটার বিরাট একটা অংশ আমাদের বাসার ভেতরে ছিল। কামরাঙ্গা গাছে বিস্তর ফল হতো, আর সেই সাথে ছিল প্রচুর টিয়াপাখির আনাগোনা। ঠিক সন্ধ্যে নামার কেমন একটা গা ছমছমে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরতো যেন ওই গাছ দুটোকে।

ছবিতে সর্ববামে আমার বড়ভাইকে দেখা যাচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মেজভাই। ভাইয়া সম্ভবত ওই বছরই চাকরি শুরু করেছিলেন, এই গতমাসে তিনি অবসরে গেলেন। আমার মেজভাই তখন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন হয়ত, কিন্তু ক্লাস শুরু হয় নি। এখন উনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক। আব্বা এই ছবি তোলার বছর খানেক আগে অবসরে গেছেন। ছবিতে আম্মার যা বয়েস আমি সেই বয়েসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, অথচ এই ছবিতে আমি ক্লাস টেনের বালক, সামনেই হয়ত প্রিটেস্ট পরীক্ষা।

আব্বা আর আম্মা পরলোকে - এই জুলাইতে আম্মার চলে যাওয়ার ৮ বছর পূর্তি হবে। আব্বাও চলে গেছেন ৪ বছরের বেশি হয়ে গেল। আমরা তিন ভাই এখন থাকি তিন মহাদেশে। যেই বাড়িতে এই ছবিটা তোলা, সেটা টিকে ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত, পেছনের নারিকেল গাছগুলোও টিকে ছিল ততদিন- কিন্তু ঢাকা শহরের আর বাদবাকি বাড়ির মতো ওখানেও অট্টালিকা উঠে গেছে।

সময়ের হাত থেকে কারোই নিস্তার নেই, সে এসে থাবা বসাবেই - মাথার চুল থেকে, বাড়ির দেওয়াল, গাছের পাতা থেকে স্মৃতিকোষ - তার কবল থেকে কেউ পালাতে পারবে না। সময় শুধু থাবাই বসায় না, সে বাস্তবতাও পাল্টে দেয়। এই ছবিতে আমরা পাঁচজনই ঘর বলতে এই বাসাটাকেই বুঝতাম, আজকে প্রায় ৩৬ বছর পরে দিনের শেষে আমরা ভিন্ন ঠিকানাতে ঘরে ফিরি।

সুনীল তার সেই সময়ের বইয়ের ভূমিকাতে সম্ভবত লিখেছিলেন এই কাহিনীর প্রকৃত নায়ক সময় - আমি আসলে টের পাই পৃথিবীর যাবতীয় গল্পের নায়ক বা খলনায়ক হচ্ছে সময়।

"তবু এইটুকু জীবনের মধ্যে কত কি যে ঘটেছিল - কত মুগ্ধতা, সন্তাপ, উল্লাস, দ্রবণ! ভোলা যায় না। তবু তার উপর শান্তি নামে - সময়ের শান্তি, ক্ষয়ের শান্তি। অক্ষয় মালবেরি গাছকে ঘিরে তীব্র ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ টের পাই, কখন সঙ্গীদের হাত ফসকে গেছে। প্রৌঢ় মুখের উপর ছায়া পড়ে। নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয় না, প্রাণী বলে মনে হয়। নিশ্বাস নিই তাই বেঁচে থাকি। ভিতরে একা, সুখী না, দুঃখীও না। দশদিকে অসীম শূন্য এবং চিররহস্য।"

(অক্ষয় মালবেরী - মণীন্দ্র গুপ্ত)




Friday, January 15, 2021

উদ্বাস্তু

আমার এক বন্ধু ফেসবুকে মাঝে মাঝে পুরনো ছবি পোস্ট করে। ডিজিটাল যুগের আগের। একটু হলদেটে হয়ে যাওয়া ছবি সব। আমি সেই সব আগ্রহ নিয়ে দেখি। ছবির নিচে বা পোস্টে তারিখ থাকলে সেটাও দেখি। তারিখটা কি আমি দেশ ছেড়ে চলে আসার পরের নাকি আগের? বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি প্রায় সব ছবিই আমি দেশ ছেড়ে চলে আসার পরের। মানে আমি চলে আসার পরের ছবিগুলোও পুরনো হলদে হয়ে গেছে। হয়ে যাওয়ারই কথা, আজ আমার দেশ ছেড়ে আসার ২৩ বছর পূর্ণ হল। সেই দিন জন্ম নেওয়া শিশুর বয়েস এখন ২৩। কিন্তু মাথার ভেতরের ছবিগুলো হলদে হয় নি কেন? এখনও কেন তারা এতো উজ্জ্বল? কেন নিজেকে মাঝে মাঝে জাতিস্মর মনে হয়?

ঢাকা শহরের বিপুল পরিবর্তন হয়েছে এই ২৩ বছরে। ভালো, খারাপ দুই দিকেই। আমাকে সেসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি। আমার কাছে এই শহর থেমে গেছে ১৯৯৬ সালের অগাস্ট মাসের পাঁচ তারিখের ভোরবেলাতে, আকাশে তখন অনেক মেঘ, টিপটিপ বৃষ্টিও হয়েছিল। যেসব মানুষ, যেসব স্থান, যেসব গল্প আমার শহরকে তৈরি করেছিল তারা কেউ হারিয়ে গেছে, কেউ পাল্টে গেছে। ঢাকাতে ফিরলে হঠাৎ হঠাৎ জলছবির মতো তাদের চিহ্ন দেখতে পাই, এখানে ওখানে, স্থানে অস্থানে কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু মোটের উপর শহরটা হারিয়ে গেছে যদিও পুরনো বইয়ের ছেঁড়া পাতার মতো এখনও কিছু কিছু পাঠযোগ্য অক্ষর রয়ে গেছে।
মার্কিন দেশ আমার ভালো লাগে। কথাটা পুরো মিথ্যা না, পুরো সত্যিও না। গত ২৩ বছর যদি আমি দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকতাম তাহলেও একই কথাই বলতাম। এইখানে প্রতিদিন সকালে উঠি, প্রাতরাশ সারি, বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাই, অফিসে যাই, গান শুনি, রেডিওতে খবর শুনি, নেটে পত্রিকা পড়ি, নিয়ম করে কিছু রাজনৈতিক নেতাদের গালাগাল করি, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি, বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক করাই, হাঁটতে যাই, খাবার খাই - একটা দেশে মানুষ যা যা করে সবই করছি আমি। কোথাও কোন দুঃখ, শোক, পরিতাপ নেই। এটা আমারই দেশ - ঠিক সেই অর্থে যে অর্থে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের নিজের একটা দেশ আছে। কিন্তু নিজের ভেতরে একটা দেশকে লালন করতে হয়, এই দেশটা সেই ভেতরের দেশটা না।
সেই ভেতরের দেশটা কোনটা? বাংলাদেশের ভালো বা মন্দ বিচার না করেই বলা যায়, বাংলাদেশও সেই দেশটা না। সেই দেশটা আসলে কোথাও নেই, কোত্থাও নেই। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনে হয়, একটু আগে স্বপ্নে দেখা দেশটা কোথায়?
হঠাৎ করেই টের পাই, আমি বিশ্বনাগরিক নই, দিনশেষে আমি একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ, কোন আক্ষেপ নেই, কোন বেদনা নেই, সামান্য একটু শূন্যতা নিয়ে অনুভব করি আসলে আমি মানসিকভাবে উদ্বাস্তু এক মানুষ।

(৬ই অগাস্ট ২০১৯ সালে লেখা)

দাঁড়াবার জায়গা

আনুশা তখন ছোট ছিল। ক্লাস ওয়ান বা কেজিতে পড়ত। আমি বাসায় আসতেই দুই বোন ছুটে আসতো। নানান গল্প। 

আনুশা একদিন বলল - "আব্বু আই নো হাউ টু এড বিগ নম্বরস"। আমি বললাম তাই নাকি? 

পরীক্ষা নেওয়ার আগেই আনুশা জানালো দুই মিলিয়নের সাথে দুই মিলিয়ন যোগ করলে চার মিলিয়ন হয়। ইজন্ট দ্যাট টু বিগ নাম্বারস? 

আমার মনের ভার কেটে যেত। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল বিনোদন এবং সবচেয়ে সহজ সত্যগুলো আসে বাচ্চাদের কাছ থেকে। এই পৃথিবী যেই ভার নিয়ে বুকের ভেতর চেপে বসে, শিশুদের সঙ্গ সেই যন্ত্রণা শুষে নেয়। 

বাড়ি ফিরে গল্প করতাম ওদের সাথে - ভূতের গল্প, বিড়ালের গল্প, আমার অফিসের সামনে বাস করা বাদামী সাপের গল্প। আনুশা ওদের স্কুলের গল্প করত। সামারাও কাল্পনিক এক স্কুলের গল্প করত। 

কোন বন্ধুটা ভালো, কোন বন্ধুটা মিন, কোন বন্ধুটার হাসতে ভালোবাসে, কোন বন্ধুটা অল্পতেই দুঃখ পায়, আমি যেন সবাইকেই চিনতাম, কেউ আমার অচেনা নয়, দূর শৈশবে আমিও এই রকম অনেককে রেখে এসেছি। 

কিন্তু এখন এক বিপরীত জীবন। আনুশাও বড় হয়ে গেছে - তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সমকামীদের অধিকার সব বিষয়ে তার অভিমত আছে। স্কুল থেকে ফিরেই টেক্সট করে - আজকে ম্যাথ হোমওয়ার্কে  সাহায্য লাগবে। সেই অংকও বড়দের অংক - একটি রেখা থেকে ঢাল বের করে সেই রেখার লম্ব রেখার ইকুয়েশন বের করতে হবে। মিজাইলের মতো একেকটা অংক। 

শৈশব যদি সরলতার সময় হয়, বড় মানুষের জীবন নিশ্চয়ই কুটিলতাতে পূর্ন থাকে। বাচ্চাদের কাছে ভালো আর খারাপের মধ্যে তেমন কিছু নেই। বড়দের সবই গ্রে এরিয়া, বড়দের জীবনের প্রায় পুরোটাই রিড বিটুইন দ্য লাইনস। তাই ভালোবাসার মোড়কে ঘৃণা থাকে, প্রশংসার মোড়কে বিদ্বেষ থাকে, আনন্দের আড়ালে বিষাদ থাকে। বড় হওয়া মানেই নিজেকে লুকিয়ে রাখা, আড়াল করে রাখা। সফল একজন মানুষ লুকোচুরি খেলার ওস্তাদ।  

আমি অনেকবার বলেছি, আমি বড় হতে চাইনি। সত্যি সত্যি চাইনি। সময়ের ষড়যন্ত্রে বড় হয়েছি। পুরো বড় হতে পারিনি এখন যদিও এই বেঁচে থাকলে এই বছরই হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ হবে। হাঁটুর ব্যথা, রক্তের চাপ, কানের অসুখ  থাকলেও কিছু শৈশব রয়ে গেছে এখনও। 

আনুশা আর সামারা বড় হয়ে গেছে অনেকটাই। আমার সাথে গল্পে ওরা আগ্রহী নয়। কে-পপ, ওয়ান ডিরেকশন, টিকটক এইগুলোও আমি বুঝতে পারি না। তাই অনেকের মধ্যেও একা থাকতে হয়, আর সঙ্গী থাকে সেই পিটারপ্যান। এই দুঃসময় সে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, কোথা থেকে নিয়ে আসে বিশুদ্ধ হাওয়া। 

আমার এক বন্ধু ছিল (এখনও আছে) তার নাম অঞ্জন। বাল্যকালে অতি বিচ্ছু ছিল সে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গম্ভীর শিক্ষক, আমি শুনেছি ধর্মচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এই বিষয়ে তার জ্ঞান প্রচুর। ক্লাস সেভেনে বাংলা ব্যকরণ  স্যার ব্যাস বাক্য পড়াতে পড়াতে জিজ্ঞেস করলেন, এই কয়টা বাজে দেখতো। অঞ্জন উত্তর দিল - স্যার দুইটা বেজে পঁচাত্তর মিনিট। স্যার হুংকার দেওয়ার আগেই বলল স্যার, ৩ টা ১৫ এর ব্যাসবাক্য বললাম। 

আজকে সারাদিনের কাজের আর নানান চাপের মধ্যে এই অতি তুচ্ছ গল্পটা মনে পড়েছে বার বার। তুচ্ছ বা লেইম যাই হোক না কেন - সারাদিন যেন ফুয়েল দিয়ে গেছে এই গল্পটা। বাচ্চারা বড় হয়ে যাচ্ছে, আমি এখনও পুরো পারিনি। কিন্তু সবিস্ময়ে আমি টের পাই - আমার দাঁড়াবার জায়গা সেই রোদ্দুর আর ছায়াতে ঘেরা একটু খানি শৈশব।

“আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙ্গিয়ে খায, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার।”

"জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দু:খ, যে দু:খে অনেক ভালোবাসা, যে ভালবাসায় অনেক ছেলেবেলা...”

(কালো বরফ/ মাহমুদুল হক)

Monday, January 11, 2021

ঈশ্বর

।।১।।

"ব্যাধি হিসেবে এই তিনটিই মারাত্মক - এই ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা। তেমন করে ধরতে পারলে এ বস্তু কাউকে ছাড়ে না, রেহাই দেয় না সহজে, আজীবন ভোগায়, আপাদমস্তক গ্রাস করে বসে। সংসার, সারাৎসার আর...আর ভালোবাসার কী আখ্যা দেব?"

[ঈশ্বর পৃথবী ভালোবাসা - শিবরাম চক্রবর্তী]

উপরের লাইনগুলো শিবরাম চক্রবর্তীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থের। ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা - কালে কালে এই তিনটই ভয়াবহ ব্যাধি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তিনি বলেছেন বাল্যকালে অন্যান্য অসুখের টিকার মতো যদি এই তিনটার প্রতিষেধক টিকা দেওয়া যায় তাহলে পরবর্তী জীবনে এই তিন বস্তুর থেকে ভোগান্তি অনেক অনেক কম হয়। শিবরাম শৈশবেই একটু ঈশ্বর, একটু পৃথিবী আর একটু ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছিলেন - সেটা নিয়ে এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। এই বইটা পড়ার সময়ে আমার অনেকবার কিছু পুরনো এবং নতুন কথা মনে হয়েছে। আজকের লেখা সেই সব গল্প নিয়ে।

।।২।।

আমার দাদি এক সময়ে আমাদের সাথে থাকতেন। আমার তখন বালক বয়েস। তিনি খুব ঈশ্বরভক্ত মানুষ ছিলেন। ভোররাতে উঠে নামাজ পড়তে শুরু করতেন - অন্যদেরকেও সেটাই করতে বলতেন। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অসাধারণ। তাঁর অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও তিনি সংস্কারমুক্ত মানুষ ছিলেন। মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ - সবাইকে নিয়েই বিশ্বসংসার - কেউ কারো চেয়ে কম ভালো বা মন্দ নয়, এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল। দাদি নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বলতেন - সামান্য সর্দি বসা গলার স্বর। মাঝে মাঝে কথা বুঝতে একটু অসুবিধে হত। উনি রেগে গিয়ে বলতেন - আমি কি ইংরেজিতে কথা বলছি?

সেই সময়ে প্রায়ই আমি জ্বরে কাতর হয়ে থাকতাম। দাদি গভীর রাতে ঘরে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যেতেন। সেই স্পর্শের কোথাও হয়তো ঈশ্বরের অনুগ্রহ লেগে থাকতো। জ্বরতপ্ত কপালে কেউ হাত রাখলে এখনো নির্ভুল মনে পড়ে যায় তাঁর কথা। আমি গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যেতাম।

সেবার ক্লাস সিক্সের ফাইনালে আমার পরীক্ষা অংক পরীক্ষা খুব খারাপ হলো। পাশ মার্ক ৩৩। আমি কোন মতেই ৩০ এর বেশি পেতে পারি না। আমি দাদির শেখানো নিয়ম অনুযায়ী ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলাম। এই পরিস্থতিতে আর অন্য কিছুই মাথায় আসলো না। রেজাল্টের দিন যতই ঘনিয়ে আসলো ততই হাত-পা গুলো যেন পেটের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগলো।

রেজাল্টের দিন স্কুলে গেলাম না। একদিন পরে স্কুলের অফিস রুমে রমিজউদ্দীন মোল্লাকে (উনি স্কুলের কেরানি ছিলেন, স্যার বললে খুব খুশি হতেন) স্যার সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করলাম মার্কশিট পাওয়া যাবে কিনা। উনি আমাকে হেড স্যারের রুমে যেতে বললেন, রেজাল্টের দিন যারা ফল নেয়নি, তাদের মার্কশিট নিতে হবে হেডস্যারের রুম থেকে। আমাদের স্কুলের মার্কশিট দেওয়া হতো হালকা সবুজ রঙের একটা বইতে। বইতে দশ দু'গুনে বিশটা পেজ থাকতো। অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান থেকে টেন, হাফইয়ার্লি এবং ফাইনাল সব ফলাফল একসাথে রাখা থাকবে। ফেল্টুদের জন্য অতিরিক্ত পাতা নেই। ফেল করলে কি হবে সেইটা হয়ত আমি আজকেই জানতে পারবো।

হেড স্যার ফোনে কথা বলছিলেন। ব্যস্ত ছিলেন। সামনে একগাদা মার্কশিট। আমার সাথে কোন কথা না বলে তিনি সামনে মার্কশিটের স্তুপের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি মার্কশিট তুলে নিয়ে দেখলাম - অংকে আমি ৩৪ পেয়েছি। আমি হতবাক। প্রার্থনাতে কাজ হয়। ৩৩ পেলেই চলতো, বোনাস হিসাবে এক নম্বর বেশি। আমি ঈশ্বরের প্রতি খুব কৃতজ্ঞবোধ করলাম। বাসায় ফেরার সময়ে নিউমার্কেট থেকে শীর্ষেন্দুর "মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি" বইটা কিনে আনলাম। শীতের দুপুরবেলা একটানা সেই বইটা পড়ে শেষ করলাম। বাইরে শুনশান নিরবতা। শান্তি শব্দটা শুনলে আমার সেই নিস্তরঙ্গ দুপুরবেলাটার কথা মনে হয়। সেইরকম শান্তি আমার জীবনে দ্বিতীয়বার আসে নি। দাদি আমাকে ঈশ্বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছে ঈশ্বরের অনুগ্রহেই।

এরপরে অনেক কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন কেটে গেছে এবং যাচ্ছে। অসম্ভবকে সম্ভব করার আর কোন নজীর ঈশ্বর আমাকে আর দেখান নি। সম্ভবত দাদি আমাকে শিব্রামীয় ঈশ্বরের টিকা দিয়েছিলেন। তাঁর অস্তিত্ব অথবা অনস্তিত্ব আর আমাকে ভোগায় না। কিন্তু সেই সবুজ মার্কশিটটা এখনও কোথাও আছে - যেখানে তাঁর যাদুকরী নিদর্শন আছে।আমার কন্যাদের আমি ঈশ্বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই নি। ভদ্রলোককে আমি নিজেই পুরোপুরি চিনি না। তবে জানি চাইলে তিনি সিক্সের ফাইনালে ৪ নম্বর বাড়িয়ে দিতে পারেন।

।।৩।।

একটা কাজে কাছের শহরে গিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। বাচ্চাদের নিয়েই গিয়েছিলাম। বন্ধুর বাসাতে ছিলাম। ওইখানে সমবয়েসি বাচ্চা আছে। ওরা ধার্মিক। প্রচুর দৌড় ঝাঁপে সময় গেল। তিনদিন পরে গাড়ি চালিয়ে নিজ শহরে ফিরছি। তাড়াতে আছি - জোরেই গাড়ি চালাচ্ছি। পেছন থেকে বড় মেয়ে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল...

"আব্বু বেশি জোরে গাড়ি চালালে কুনাহ হবে না তো?"

বোঝা গেল কুনাহ মানে পাপ - গুনাহ শব্দটা ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেনি সে। মেয়ে বন্ধুর বাচ্চাদের কাছে নানান শিক্ষা পেয়েছে। জানা গেল ঈশ্বর বড় খতরনাক লোক। তিনি ক্ষেপে গেলে মানুষকে "কুনাহ" দেন এবং সেই কুনাহতে চোখ দিয়ে লাভা বের হয়ে যেতে পারে।

আমি নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। রাতে গাড়ি চালালে কুনাহ হয় কিনা, ঠিক মতো দাঁত ব্রাশ না করলে কুনাহ সম্ভবনা আছে নাকি, স্কুল কামাই করলে ঈশ্বর রাগান্বিত হন কিনা - নানাবিধ জিজ্ঞাসা ধেয়ে আসলো। ঈশ্বরের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে মেয়ে সারাপথ সংকুচিত হয়ে রইল।

আমি বিস্মিত হলাম। ঈশ্বরকে যতটুকু দাদি চিনিয়েছিলেন তাতে মনে হয়েছিল তিনি এই রকম নন। ক্লাস সিক্সের অংক পরীক্ষাতে ৪ নম্বর যোগ করে দিয়ে দেন - হয়ত এরবেশি নিদর্শন এক জীবনে দেখা যায় না। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরে তিনি এমন ক্ষেপে গেলেন কেন? এটা অবশ্য এখন আর অজানা কিছুই নয়। ক্ষ্যাপা ঈশ্বরভক্তের দেখা মেলা বিরল নয়। পৃথিবী ধনী দেশ থেকে শুরু করে দরিদ্রতম দেশগুলোতেও তারা আছে, তারা যেমন ক্ষ্যাপা, তাদের ঈশ্বরও ক্ষ্যাপাটে। আমি শৈশবে এদের দেখা পাই নি।

।।৪।।

আব্বু আই স' গড টুডে - উত্তেজিত হয়ে খবর দিল মেয়ে।

আমিও বিস্মিত। এই বয়সেই ঈশ্বর দর্শন। কত মুনি-ঋষী সারাজীবন ধরে চেষ্টা করেও যেটা করতে পারেনি, একরত্তি মেয়ে সেটা বন্ধুর বাসা থেকে ঘুরে এসেই পেয়ে গেল?

জানা গেল ঈশ্বর ওর ভারতীয় বন্ধু ঈশিতার রুমের উপরে রাখা তাকে থাকেন। সেই ঈশ্বরের হাতির মতো শুঁড় আছে - হালকা গোলাপী গাত্রবর্ণ। সেই ঈশ্বরের চেহারার সাথে কিছুদিন আগে পাওয়া তথ্যের বেশ মিল আছে বলে মনে হয়েছে। তাকের উপর থেকে ভদ্রলোক সর্বদাই কটমট করে তাকিয়ে ছিলেন - দেখে মনে হয় ক্ষেপে টেপে অস্থির হয়ে গেলে চোখ দিয়ে লাভার স্রোত বইয়ে দিতে পারেন তিনি। ঈশিতাও জানিয়েছে যে তাকের উপরে বাস করা ঈশ্বরে বেশ তোয়াজ করে রাখতে হয়।

ঈশ্বরের টিকা দেওয়াটা কতখানি দরকার সেটা আমি আরেকবার বুঝে যাই। টিভির সংবাদ, ফেসবুকের ফিড, পত্রিকার পাতা - এগুলো দেখেও প্রায়ই একই কথা মনে হয়।

আমি এতোদিনে বুঝে গেছি - আমাদের একদম ভেতরে একধরনের ভয় এবং একাকীত্ব আছে - সেখান থেকে ঈশ্বরের সাম্রাজ্য শুরু। তিনি অবশ্যই আছেন - বিশ্বাসী মানুষের যেমন আছে তেমনি বহু বহু অবিশ্বাসী মানুষের ভেতরেও ঈশ্বর আছে। সেই ভেতরের ঈশ্বর তাঁদের নিজেদের মতোই - জর্জ বুশের ঈশ্বর এফ-১৬ নিয়ে ধেয়ে আসে, কারও ঈশ্বর চাপাতি নিয়ে ধাওয়া দেয়, কারও ঈশ্বর গোমাংস খেলে রক্তস্রোত বইয়ে দেয়। কারও ঈশ্বর আবার আমার দাদির ঈশ্বরের মতোই - ভাত খেয়ে সুখে থাকার উপদেশ দেয়। আমি নিশ্চিত - আমার দাদির ঈশ্বর নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে - একটু সর্দিতে বসা গলা তাঁর।

এই বাজারে আর পাঁচটা জিনিসের মতো ঈশ্বরও পণ্য, নানান মাপে, নানান মতবাদে, নানান ঘৃণার মোড়কে, নানান ভাষায়, নানান ভয়ে ও ভালোবাসাতে তাকে নিয়ে ব্যবসা চলে। কিন্তু সেই বাজারের বাইরেও তাঁকে প্রতিদিন মানুষ একদম ভেতর থেকেই ডেকে চলে - সিরিয়ার দগ্ধ বালক তাকে ডাকে, আইসিসের বাজারে বিক্রি হওয়া ইয়াজেদি মেয়েরা তাকে ডাকে, রেঁস্তোরাতে খেতে গিয়ে জবাই হওয়া মানুষগুলো তাকে ডাকে, স্টক ব্যবসায়ী তাকে ডাকে, চোর, ডাকাত, ব্যর্থ প্রেমিক - সব্বাই তাকে ডেকেই চলছে। এতো এতো মানুষের ডাকেও তিনি সাড়া দেন না, তিনি নিরব থেকে যান। আমাদের পাপ-পূন্য-বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোন কিছুতেই যেন তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এক নির্মোহ সাংবাদিক - দ্রুত হাতে লিখে রাখছেন পৃথিবীর যাবতীয় নির্মমতা, ক্রোধ, মমতা আর ভালোবাসা কড়চা।


ঈশ্বরের চোখ

আমাদের শরীরের প্রতিটি ফুটোয়

জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ

ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস

ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের হাসি

তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে বালক তার

পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের

অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে

(রণজিৎ দাশ)

লেখালেখি খেলা

আমার অফিসে এক মহিলা সহকর্মী আছেন। উনি লেখালেখি করেন। অ্যামাজনে ই-বুক পাব্লিশ করেন। বেশ গোছানো কাজ। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে সব কিছুতেই প্রফেশন্যালইজমের ছাপ আছে। উনার গল্প ও উপন্যাসগুলো মূলত ভ্যাম্পায়ারের প্রেম কাহিনী। আমি যদি twilight ছবিটা না দেখতাম তাহলে এই জনপ্রিয় জনরাঁ আমার আছে অচেনাই থেকে যেত।

আমি উনার একটা বই পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ইংরেজিতে যেটাকে বলে "নট মাই কাপ অফ টি" - সেটা মনে হয়েছে। ওনার বইয়ের বিক্রি খুব বেশি না। মাসে হয়ত ৫০/১০০ কপি বিক্রি হয়। কিন্তু এই ধারার বই থেকে মিলিওনিয়ার হয়েছে মানুষ। উনিও সেই আশাতে লেখালেখি আর মার্কেটিং দুটোই চালিয়ে যাচ্ছেন।

ওনার কাছ থেকে কিছুদিন আগে এক তথ্য জানলাম। এক রোমান্টিক ভ্যাম্পায়ার গল্পের লেখিকা গত পাঁচ বছর ধরে আরও কয়েকজনের লেখা চুরি বই ছাপাচ্ছেন। সেই লেখা চোর নাকি এক মিলিওন ডলারের বেশি কামিয়েছে এই কুম্ভিলকতা থেকে। কিন্তু চোরের দশ দিন আর গেরস্তের একদিন।

এই কাহিনী শুনে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল এই ডিজিটাল যুগে চুরি ধরতে এতো দিন লাগলো কেন? উনি জানালেন যে চোর লেখিকা কয়েকটা কাহিনী মিলিয়ে গল্প বানান - এবং সেই সঙ্গে স্ট্রেইট রিলেশনশিপের গল্পকে গে আর লেসবিয়ান রিলেশনের গল্প বানান। আমি প্রথমবারের মতো জানলাম এই এই জনরাঁর গে এবং লেসবিয়ান ভার্সনও আছে। আমার অজ্ঞানতা সীমাহীন। এটা থাকাই উচিৎ। আমার জানার পরিধি বাড়াতে হবে।

এইবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে আসি। আমার এক অনুজপ্রতিম লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলাম বই মেলাতে যখন কোন বই ভালো চলে তখন আসলে কত কপি বিক্রি হয়। সে জানালো ১০০০/১২০০ অতিক্রম করলে সেটাকে বেশ ভালো বিক্রি বলে গণ্য করা যায়। এই থ্রেশোল্ড খুব কম লেখকই অতিক্রম করতে পারেন।

বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ। আর মেলাতে বই বিক্রি হয় নগন্য পরিমানে। বেস্ট সেলার বইয়ের বিক্রি মাত্র হাজারের ঘরে। এই পরিসংখ্যান আমাকে অবাক করেনি। আমি মানুষের বাসাতে গেলে কী পরিমান বই আছে সেটা মন দিয়ে লক্ষ্য করি। সেটার সাথে চিন্তাভাবনার সুক্ষ্ম সংযোগ থাকে। যেই চিত্রটা দেখি সেটা আশংকা করার মতো।। আমি নিজেও তেমন পড়ুয়া নই। আরও অনেক বেশি পড়া উচিৎ সেটা অনুভব করি। মার্কিন দেশে বই পড়াকে উৎসাহিত করা হয়। মেয়েদেরকে বড় করতে গিয়ে দেখছি সেটা। মানুষ যে এখনও চিন্তা করতে পারে সেটার অন্যতম প্রামান্য দলিল হচ্ছে বই।

আমরা কে কী বই পড়ব অথবা প্রকাশ করব, কোনটা আবর্জনাতে ফেলে দিব আর কোনটা তাকে সাজিয়ে রাখব, কোন কবিতার লাইন প্রেমিকাকে শোনাব, কোন গল্পের লাইন আড্ডাতে কোট করব, কোন বই গভীর রাতে বালকবেলা ডেকে আনবে, কোন বই আমাদের হাসাবে, কাঁদাবে, ভাবাবে সেটার সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে এবং একমাত্র আমাদেরই হাতে। গানের জলসাতে যেমন প্রধান অতিথি হচ্ছে শ্রোতা তেমনি বইকে বাঁচিয়ে রাখা অথবা বিস্মৃতির অতলে ফেলে দেওয়া পাঠকেরই কাজ।

সেই হিসাবে যৌনতা মিশ্রিত রোমান্টিক ভ্যাম্পায়ার উপন্যাসের যেমন পাঠক থাকবে তেমনি রিচার্ড ডকিন্সেরও পাঠক থাকবে। একটি দেশ, একটি সমাজ, একটি প্রজন্ম, একটি জনপদ ঠিক এইভাবেই চিন্তাতে, দর্শনে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ঋদ্ধ হয়। এইভাবেই অন্ধবিশ্বাসের কারাগার থেকে মুক্তি মেলে।

কিন্তু লেখালেখির জন্য যদি লেখককে নিজ বাসা থেকে শুরু করে ব্যস্ত রাজপথে মরে পড়ে থাকতে হয়, তখন বুঝতে হবে আমাদের কোন সমস্যা আচ্ছে। আমরা যদি বুদ্ধিমান হই তাহলে মানুষের বাসার তাকে বইয়ের সংখ্যা থেকেই চট করে বুঝতে পারি আমরা কোন পথে ধাবমান।

আমাদের দেশে যাদের বই প্রচুর বিক্রি হয় তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বইয়ে পাঠক তৈরি করেছেন। তৈরি পাঠক এই দেশে খুব কম। রসময় গুপ্ত ছাড়া আর সবাইকে পাঠক তৈরি করে বই লিখতে হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই আমার ফেসবুক ফিডে প্রচুর লেখক বন্ধুদের নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপনে নামতে দেখি। অনেক বছর আগে ফার্মগেটের এক ক্যাসেটের দোকানে এক লোককে দেখেছিলাম কিছু ক্যাসেট দোকানিকে গছানোর চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে দেখলাম ক্যাসেটের কভারে সেই লোকেরই ছবি। ফেব্রুয়ারি আসলেই সেই গায়ক কাম হেড অফ মার্কেটিংয়ের কথা মনে পড়বেই!!! ব্যাপারটা আমার কাছে একটু কেমন কেমন লাগলেও পরে বুঝেছি - যস্মিন দেশে যদাচার। এতো আয়োজন করে বইমেলা করা হলেও শেষ পর্যন্ত বইটা আসলে একটা ব্যবসা, আলু পটল, পেঁয়াজের মতো আরও একটি পণ্য। বই বিক্রি না হলে এই ব্যবসারও লালবাতি জ্বলতে বাধ্য।

আর একদিন পরেই অভিজিৎ রায় হত্যার এক বছর পূর্ণ হবে। আমাদের প্রকাশনা জগতে এই ঘটনা এক বিরাট মাইলস্টোন। এর পর পরই আমরা জেনে গেছি যে আমাদের বুঝেশুনে লেখা উচিৎ। দুর্দান্ত কলামিস্ট, মিডিয়া কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, সরকারী আমলা সবাই একই সুরে কথা বলেছে। দুই মলাটের মধ্যে এমন এক মরাণাস্ত্র যে লুকিয়ে রাখা যায় আমরা কেউই আগে জানতাম না। বহুদিন এমন ঐকমত্য দেখতে পাইনি।

অভিজিৎ রায়ের লেখা অনেক বছর ধরে পড়ছি। ১৯৯৭/৯৮ সালে সম্ভবত যায় যায় দিন পত্রিকাতে অভিজিতের লেখা প্রথম পড়েছিলাম। মুক্তমনা নামে একটা ইমেইল গ্রুপ ছিল, সেটারও সদস্য ছিলাম। সচলায়তনেও অভিজিৎ সক্রিয় ছিল, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সে। আমি অভিজিতের সাথে ফেসবুকে যুক্ত ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র একবার মাত্র যোগাযোগ করেছিলাম। একটা বই কিনতে চেয়ে মেসেজ দিয়েছিলাম তাকে। সে বইটার পিডিএফ আমাকে পাঠিয়ে দেয়।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে অভিজিৎ চাইতো মানুষ পড়ুক। যেখানে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার সেইখানেই আলোর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অভিজিৎ সম্ভবত সেটা জানতো। অন্ধকারে আততায়ী লুকিয়ে থাকে। আলোতে তার প্রকাশ অনিবার্য। অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হলে সেটাও কারো কারো জন্য মুনাফা নিয়ে আসে।

লেখালেখির মধ্যে আনন্দ আছে। আত্মপ্রকাশের আনন্দ। সৃষ্টির আনন্দ। কিছু কিছু লেখা মনকে বিবশ করে দেয়। কিছু কিছু লেখা পাখির পালকদের মত হালকা। কোন কোন লেখার ভার বয়ে বেড়াতে হয় দীর্ঘকাল। কিন্তু দিনশেষে ওরা সবাই আনন্দ নিয়ে আসে। সেই সামান্য আনন্দটাই অসামান্য। সেই আনন্দটা পাটিগণিতের নিয়মে চলে না - সেটা যতজন মিলে ভাগ করে নিবে, ততই বেড়ে যাবে!!! এই প্রতিদিন অঙ্ক কষে যাপন করা জীবনের মাঝে ওই ভাগ করে নেওয়া আনন্দাটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। অমরত্বের লোভে কেউই লেখে না, সবচেয়ে বড় নির্বোধটাও না। কিন্তু কেউ কেউ অমরত্ব পেয়ে যায়। সেটা লেখার প্রোডাক্ট নয় বরং বাই প্রোডাক্ট।

অভিজিৎ বহু বহু মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, সম্ভবত সে নিজেও জানতো না ঠিক কতখানি শক্তিশালী হতে পারে হাতের কলম।

বেঁচে থাকো অভিজিৎ তোমার সৃষ্টির আনন্দে, সেই আনন্দের আলোকধারাতে দূর হয়ে যাক অন্ধকার। 

পরজন্ম

"আব্বু দাদাভাইয়ের একবার নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স হয়েছিল না?"

আজ রবিবার। আমাদের টাকো দিবস। প্রায় প্রতি রবিবারই আমরা মেক্সিক্যান খাবার খাই। আজকে দুই কন্যাসহ চলছি টাকো বেল নামক ফাস্ট ফুডের দোকানে। এই সময়টাতে মেয়েদের সাথে বিশ্বসংসার নিয়ে আলাপ করি। আরিয়ানা গ্রান্ডে থেকে করে উত্তর কোরিয়া - আমাদের আলাপের কোন সীমারেখা নেই।
আব্বার কাছে শুনেছিলাম - উনি একবার বাল্যকালে কী একটা অসুখে প্রায় মরতে বসেছিলেন। সেই গল্প মেয়েদের কাছে বলেছিলাম। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে যেসব লেখা পড়েছিলাম আব্বার বর্ণনার সাথে সেইগুলোর মিল আছে। উনি আলোকময় এক টানেল নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।
"আমার ধারণা ওই টানেলটা আগের জন্ম আর পরের জন্মের ব্রিজ। জন্মের ঠিক পর পর যেই উজ্জ্বল আলো আমরা দেখি সেই আলোটাই আগের জীবনের শেষে টানেল দিয়ে দেখা যায়..."
আমি চমৎকৃত হলাম। এটা প্রায় উপন্যাসের প্লট হতে পারে। জন্ম থেকে জন্মান্তরে টানেল দিয়ে যাওয়া আসা...
আনুশা বলে চলে - আগের জন্মের মৃত্যুর কারণটা হয় এই জন্মের সবচেয়ে ভীতিকর জিনিস।
"আব্বু তুমি কী সবচেয়ে ভয় পাও?"
আমার ভয় মাকড়শা। আনুশার বক্তব্য অনুযায়ী আগের জন্মে আমি মাকড়শার কামড়ে পঞ্চত্ব পেয়েছিলাম। খুবই সম্ভব। ফেলুদার বইতে ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারের কথা পড়েছিলাম। এক কামড়ে পরকালের টানেলে ফেলে দিতে পারে তারা।
আনুশার ভয় এলিভেটর, সামারা ভয় পায় বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি। আগের আর এই জন্মের পারাপারের ব্যাখাটা সহজ - ঝড়বৃষ্টি, লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত কারণ হতে পারে।
"কিন্তু মা-যে বিড়াল ভয় পায়..."
আগের জন্মে মারিয়া কি বিড়ালের আক্রমণে নিহত হয়েছিল? সেটা কিভাবে সম্ভব?
"বাঘের কামড়ে হয়ত - বাঘ আর বিড়াল একই পরিবারের।" গত জন্মের সেই বাঘের ডিনার হওয়ার স্মৃতিই এই জন্মে বিড়ালদের প্রতি অসঙ্গত অপ্রীতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বাংলাভাষাতে জাতিস্মর বলে একটা শব্দ আছে, যার অর্থ হচ্ছে আগের জন্মের স্মৃতি মনে পড়া। আনুশাকে জানালাম। আমাদের অঞ্চলে সম্ভবত পূর্বজন্ম আর পরজন্ম স্বীকৃত বিষয়।
"ডু ইউ রিমেমবার এনি থিং ফ্রম ইয়োর পাস্ট লাইফ?"
"নারে মা। এই জন্মের অনেক স্মৃতিই এতো ফিকে হয়ে গেছে যে মাঝে মাঝে সেইগুলো আমার বিগত জন্মের ছায়াছবি মনে হয়।"
"এই রিসাইকেল কতদিন চলে রে?" - আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
"আমি জানি না। বাট আই থিং ফাইনালি ইয়ু উইল হ্যাভ এনাফ অফ ইট অ্যান্ড ইট উইল এন্ড দেয়ার"
অনেকটা নির্বাণপ্রাপ্তির কনসেপ্ট ধরে ফেলেছে আনুশা।
আমি ক্লান্ত বোধ করি। এই খরদুপুরে টাকোর দোকানে যাওয়ার পথটা বড় লম্বা মনে হয়। এই জীবন কোনমতে পার করলেও লাভ নেই তাহলে? টানেল দিয়ে আরেকটা জীবনে যেতে হবে। এরপর আরেকটা...তারপর আরো একটা...এই অনন্ত যাত্রার মানে হয় কোন? আমি ভাবার চেষ্টা করি। আমরা কেউই মরতে চাই না। স্বর্গে গভীরভাবে বিশ্বাসী মানুষও স্বর্গে যাওয়ার জন্য কোন ব্যগ্রতা দেখায় না। গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। পরজন্ম, আত্মা, পুনরুত্থান প্রায় সবগুলো ধর্মেরই অনুষঙ্গ। আমাদের যাবতীয় ধর্ম, বিশ্বাস, ফিলোসফি আমাদের সুক্ষ্মভাবে অমরত্বের লোভ দেখায়। এই জীবন শেষ হয়ে গেলে গাঢ় অন্ধকার - ঠিক জন্মের আগের মতোই, সেটা বড়ই আনরোমান্টিক, অজানা এবং কিছুটা ভীতি উদ্রেককর। সামনে মূলো না থাকলে ভালো বা খারাপ কোন কাজেই উৎসাহ আসে না।
কিন্তু অমরত্ব আমার কাছে ক্লান্তি নিয়ে আসে। নগদে যা আছে সেটাই উপভোগ করার চেষ্টা করি। পরজন্ম, স্বর্গ বা নরক আমাকে টানে না। এই জন্মটাই বড় ভালো লাগে। ভালো লাগে এই দুপুরবেলাটা, বাইরের কড়কড়ে রোদ্দুরটা, সামান্য জট লাগানো মাথার সুক্ষ্ম যন্ত্রণাটা, শাপশাপান্ত করা এই জীবনটাই ভালো লাগে, ভালো লাগে এই দুটো মেয়ের সাথে থাকতে। আমি আর কোথাও যেতে চাই না, অন্য কোন জীবনে, ভিন্ন কোন নরকে অথবা অচেনা কোন স্বর্গে।
টাকো চলে এসেছে। আমি কামড় দেই। ভালো লাগে।
"আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
(ঊনিশশো চৌত্রিশের/জীবনানন্দ দাশ)

Sunday, January 10, 2021

শীতের রং

আমার জীবনের প্রথম তুষারপাত দর্শন হয় লাবোকে। মাস্টার্স করতে আসার পরে। লাবোক পশ্চিম টেক্সাসে, বেশ অনেকটা উত্তরে এবং সেই সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উপরে। সব মিলিয়ে ভালোই ঠাণ্ডা পড়ে। 

আসার কিছুদিন আগে টেক্সাস টেক থেকে একটা চিঠি এসেছিল আমার নামে, সেখানে বলা ছিল লাবোককে যেন টেক্সাসের গরম জায়গা না ভাবি আমি, শীতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসি। প্রস্তুতি হিসাবে সেই চিঠিতে বঙ্গবাজার সুপার মার্কেট থেকে শীতের কাপড় কিনে আনতে বলা হয়েছিল। আব্বা সেই চিঠি পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, কতদূরের দেশ লাবোক, ওরাও বঙ্গবাজারের কথা জানে। 

চিঠিটা টেক্সাস টেক পাঠালেও, প্রস্তুত করে দিয়েছিল লাবোকের বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, আমার জীবনে যে কয়টা ভালো পরামর্শ পেয়েছি, তার অর্ধেকই ওই চিঠিতে ছিল মনে হয়। খুব গুছিয়ে বর্ণনা করা ছিল কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তখনও ইন্টারনেট সুলভ হয় নি। প্রতি কিলোবাইটের জন্য দাম দিতে হয় অগ্নি অনলাইন নামক আইএসপিকে। 

লাবোকে ক্লাস শুরু করেছিলাম ফল সেমেস্টারে, দেখতে দেখতে নভেম্বর চলে আসলো। টেক্সাস টেকের ক্যাম্পাস থেকে আমি আর আমার রুমমেট জামিল বাড়ি ফিরছিলাম। ঠাণ্ডা পড়া শুরু হয়ে গেছে। লাবোক পুরোই সমতলভূমি, আর যথেষ্ট ফাঁকা। ক্যাম্পাস থেকে তাকালে রাস্তার অনেকদূর দেখা যায়, আকাশটা মনে হয় রাস্তার অন্য মাথাতে এসে মিশে গেছে। সেই আকাশের রংটা কেমন ঘোলা ঘোলা, ধূসর আর মলিন। সেই রাস্তা দিয়ে ধেয়ে আসছে শীতল বাতাস। 

জামিল বিচক্ষণ ছেলে, কবিতার ধার ধারে না। কিন্তু সেই শেষ হয়ে আসা বিকেলে দূরের ঘোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জামিল বলল - শীতকালের রংটা এই রকম ঘোলাটে, মনে হয় শীতকাল ইজ কামিং। শীতের রং নিয়ে এমনই যুতসই বর্ণনা আমি আর কোথাও শুনিনি। জামিলের বর্ণনা শুনে ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হলো ক্যাম্পাসের উল্টোদিকের সরলরেখার মতো রাস্তা দিয়ে শীত আসছে, ঘোলাটে আর বিষণ্ণ একটা রং নিয়ে। 

এর পরপরই আমাদের শহরে তুষারপাত হলো। আমরা বঙ্গবাজার মার্কেট থেকে কেনা জ্যাকেট চাপিয়ে সবিস্ময়ে বরফপড়া দেখতে লাগলাম। বৃষ্টির শব্দ থাকে, কিন্তু বরফ পড়ে নিঃশব্দে - আস্তে আস্তে সব কিছু ঢেকে গেল সাদা চাদরে। চারিদিক কেমন বাল্যকালে পড়া হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ন এন্ডারসনের রূপকথার মতো হয়ে গেল। 

লাবোকের পরে আরও দুই বছর মিডওয়েস্টে ছিলাম। সব মিলিয়ে পাঁচটি শীতকাল দেখেছি। বরফ নিয়ে আমার রোমান্টিকতা উবে গেছে, শীতকাল শুরু হলে মনে হতো সেটা চেপে বসেছে বুকের উপরে। প্রতিবারই শীতের শুরুতে জামিলের কথা মনে হতো - মনে হতো দূর কোন পথ দিয়ে ধেয়ে আসছে ঘোলাটে শীতকাল। 

মিডওয়েস্ট ছেড়ে গাড়ি চালিয়ে অস্টিনে রওনা দিয়েছিলাম এক নভেম্বর মাসে। সেইদিনও বরফ পড়ছিল, মনে হচ্ছিল এর পরে বরফ আর ছুঁতে পারবে না আমাকে। অস্টিনে বরফ বেশ দুর্লভ জিনিস। কয়েক বছর পর পর সে একবার দেখা দেয়, জীবন অতীষ্ট হওয়ার আগেই বিদায় নেয়। আমাদের কাজ খালি সেজেগুজে ছবি তোলা। 

জানা ছিল আজ তুষারপাত হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেই আকাশটা দেখা পেলাম তাতে বহুকাল আগের লাবোক শহরের সেই ঘোলা ঘোলা শীতকালটা কথা মনে পড়ল। শীতের দেশের শীতকালটার রং আসলেই এই রকম। ঘোলা ঘোলা দুঃখ মাখা। যদিও শীতকালেও ঝলমলে সূর্য উঠে, কিন্তু আমার আজও মনে হয় শীতের রং-টাই ওই রকম। 

আজকে অস্টিনে শীতকাল গেছে। একদম  পাকা ঘোলা রং এর শীতকাল। সারাদিন বরফ পড়েছে, প্রায় চার ইঞ্চি। আমার প্রায় একুশ বছরের অস্টিন জীবনে দেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তুষারপাত। গত সপ্তাহেও অস্টিনে বসন্তের আবহাওয়া ছিল। ফোরকাস্ট বলছে আগামী বৃহস্পতিবার ৭০ ডিগ্রিতে উঠবে তাপমাত্রা। বরফ গলে বসন্তকাল চলে আসবে আবারও। অস্টিন ভালো লাগে আমার। শীতের দেশ থেকে পালিয়ে আসার জন্য নিজেকে আবারও বাহাবা দেই। 

মেয়েরা মহা উৎসাহে বরফ নিয়ে খেলেছে, আর আমি বৃহস্পতিবারের অপেক্ষাতে আছি।




Tuesday, January 5, 2021

করোনার টিকার জন্য অপেক্ষা

অফিসে শেষবার গিয়েছিলাম মার্চ মাসের ১১ তারিখে। এরপরে ৩০০ দিন কেটে গেছে। অফিসে যাই নি। অফিসটা যে আমার খুব প্রিয় জায়গা সেটা বলবো না, কিন্তু এই ৩০০ দিন শেষে নিজের পুরনো জীবনটাই মিস করি, যতই শাপশাপান্ত করি না কেন, পুরনো জীবনটাকে ১০ এর মধ্যে ৬ দিলেও সেটা এই গৃহবন্দীকালের চেয়ে অনেক শ্রেয়। 

মার্চের ১৫/১৬ তারিখ অফিস থেকে পুরোপুরি বাসায় বসে কাজ করতে বলা হয়েছিল। আমার কয়েকটা বই আনার দরকার ছিল অফিস রুম থেকে। আমেরিকার খুব অল্প কিছু অফিসে এখনও রুম আছে, আমাদের অফিস সেই দুর্লভ জায়গা, রুমের দরজা আটকিয়ে নিজেছে বিচ্ছিন্ন করা যায় সেখানে এখনো। অফিসটা একটু পরিস্কার করে আসতে পারলে ভালো ছিল, সম্ভবত কয়েকটা ফল রাখা ছিল টেবিলের পাশে। 

আমি ম্যানেজারকে বলেছিলাম অফিসে ঢোকা যাবে কিনা। জানা গেল যে মার্চে লকডাউনের পরে কেউ কেউ না বলে অফিসে ঢুকেছে। ফলশ্রুতিতে সবার ব্যাজ এক্সেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ঢুকতে গেলে টাইম স্লট নিতে হবে ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে, এরপরে অন্য এক বিল্ডিং এ গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা রেকর্ড করিয়ে সাময়িক ব্যাজ নিয়ে অফিসে যেতে হবে। এতো যন্ত্রণা নিতে ইচ্ছে ছিল না, তাই আর চেষ্টা করিনি। কিন্তু দীর্ঘ বিরতির পরে এক দেড় বছর লক করা রুমে গেলে প্রথম দিনটা যাবে মনে হয় সেটা পরিস্কার করতে। 

যাই হোক ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা হয়েছে এই বছরের জুন মাস পর্যন্ত সম্ভবত বাসা থেকেই কাজ চলবে। এই অতিমারী অতীত হলেও বাসা থেকে কাজ সম্ভবত স্থায়ী একটা রূপ পাবে। সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন অফিসে গেলেই চলবে। আমি অবশ্য আগে ২০ ঘন্টা বাসা থেকে কাজ করতাম। কিন্তু বর্তমানে ৪০ ঘন্টার কাজ বেড়ে ৬০ ঘন্টাও হয়ে যায়। গভীর রাতে বা উইকেন্ডেও লোকজন কাজ করছে। অতিমারী এসে বাসা আর কাজের যেই পার্থক্য থাকা দরকার ছিল সেইটা ঘুচিয়ে দিয়েছে। 

স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন নেওয়া ছাড়া আর উপায় নাই। আমেরিকার যেই অবস্থা তাতে লকডাউন বা অন্য কিছু আর কাজ করবে না। ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছি। আমার প্রাইমারি ডাক্তার অস্টিন রিজিওনাল ক্লিনিকে যুক্ত। এই ক্লিনিক অস্টিনের সর্ববৃহৎ ক্লিনিকগুলোর একটি। আমি টিকার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার কারণে আমার ফেইজ ১বিতে টিকা পাওয়ার কথা। বর্তমান ফেইজ ১এ হচ্ছে ফ্রন্ট লাইনের কর্মীদের জন্য। অস্টিন রিজিওনাল ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী ফেইজ ১এ এবং ১বি মিলিয়ে ওদের লিস্টে ৫০ হাজার মানুষ আছে। এর বিপরীতে ওদের কাছে টিকা আছে সাত হাজার। সুতরাং টিকাও খুব দ্রুত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। 

মারিয়ার কাজ স্কুলে, ওকে প্রতিদিনই স্কুলে যেতে হয়। স্কুলের শিক্ষক বা স্টাফদের ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কার হিসাবে ধরা হয়নি এখনও, যদিও স্কুলগুলো চাইছে দ্রুত টিকার আওতাতে আনার জন্য। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মারিয়াও হয়ত টিকা পেয়ে যাবে স্কুলের মাধ্যমে। আমাদের বাল্যকালে টিকাওয়ালিরা ঘরে ঘরে গিয়ে টিকা দিতো - এদের দেখলে আতংকে কাঠ হয়ে যেতাম আমরা। কে জানতো এই জীবনে টিকা পাওয়ার জন্যই এই রকম হাপিত্যেশ করতে বসে থাকবে হবে? টিকাওয়ালিরা আমাদের পেছনে নয়, আমাদেরকেই ছুটতে হবে ওদের পেছনে? 


আসাদুজ্জামান স্যার

 আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। কেউ কেউ তাকে আজাসি বলতো, দুষ্ট ছেলেরা আড়ালে আসাদুজ্জামান টিকটিকি বলে ডাকতো। উনি প্রায়ই সাদা প্যান্ট, হাফশার্ট পরে স্কুলে আসতেন। দেখে মনে হতো ক্রিকেট খেলতে বা মাছ ধরতে যাবেন। দ্বিতীয় কাজটা উনি সত্যি সত্যি করতেন। ছোটখাটো ঠাণ্ডা মানুষ। একবার তিনি ক্ষেপে গেলেন। স্যার কি একটা কাজে সেন্ট জোসেফ স্কুলে গিয়েছিলেন। ওইখানে গিয়ে দেখেছেন ক্লাসের বোর্ডগুলো অনেক চওড়া। আরও অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে চক দিয়ে লিখতে লিখতে অন্য মাথায় চলে গেলে সেখানেও মোছার জন্য একটা ডাস্টার। অর্থাৎ দুটো ডাস্টার। 

পক্ষান্তরে আমাদের ল্যাবরেটরি স্কুলে চিপা একটা ব্ল্যাক বোর্ড। দুঃখের বিষয় কোন ডাস্টারও নেই, চক মোছার জন্য একটা ময়লা ন্যাকড়া। স্যারের গলার স্বর সাধারণতঃ নিচু থাকতো, পড়ানোর সময় সেটা নিচে নামতে নামতে প্রায় শ্রবণসীমার নিচে নেমে যেত। কিন্তু স্যার মাঝে মাঝে ন্যাকড়া হাতে নিয়ে সেন্ট জোসেফ স্কুলের ডিলাক্স বোর্ড আর ডাস্টার নিয়ে হাহাকার করতেন। তখন স্যারকে আমরা পরিস্কার শুনতে পারতাম। না-দেখা সেন্ট জোসেফ স্কুলের বোর্ডের কারণে সংকুচিত বোধ করতাম। কিন্তু আমরা কোনদিন ডাবল ডাস্টারের লেভেলে পৌঁছাতে পারি নি। আমাদের ব্ল্যাকবোর্ডও বড় মনিটরের মতো উদার হতে পারেনি। 

আমার অফিস রুমে একটা হোয়াইট বোর্ড আছে। রুমে আরও লোক থাকার ব্যবস্থা থাকলেও লে-অফের কবলে পড়ে এখন আমি একমাত্র ব্যক্তি। সেইদিন এক সহকর্মী এসে বলল - আরে তোমার রুমের হোয়াইট বোর্ডটা দেখি বেশ চওড়া আর বোর্ডের দুই কোনাতে তুমি দেখি দুটো ইরেজার (ডাস্টার) রেখেছো।

আমি কিছুই রাখি নি, ওই দুটোর একটাও আমি জোগাড় করিনি। কে জোগাড় করেছে সেই ধারনাও আমার নেই, কে জানে সে হয়তো সেন্ট জোসেফ স্কুলের ছাত্র ছিল। 

কিন্তু এটা যে রাখলে অনেক সুবিধা, সেটা আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী স্যার বারবার বলতেন। অনেক হাহুতাশ করতেন। স্যার কলকাতায় চোখের চিকিৎসা করতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। নিঃসন্তান ছিলেন - কলাবাগানের বাসার সামনে বসে রেডিওতে খেলা শুনতেন। সামনের রাস্তায় ছাত্রদের কাউকে দেখতে পেলে ডাকতেন - আমার অনেক সিগারেট ফেলে দিতে হয়েছে ওনার কারনে। 

আমার কলিগ দুটো ডাস্টারের একটা নিয়ে চলে গেল। আমার দেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল না। আমি সাপ্লাই ক্যাবিনেট খুঁজে-পেতে আরেকটা ডাস্টার পেলাম, শূন্যস্থান পূরণ করে দিলাম। 

মনে মনে আমি ৩০ বছরের পুরনো একটা সমস্যার সমাধান করলাম - আর হঠাৎ করেই জেলখানার মতো এই অফিসে ঢুকে পড়ল এক টুকরো শৈশব।


মওদুদী সাপোর্টার

আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার ছিলাম। ব্রাজিলের খেলা হইলে টেনশন লাগতো। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে টেনশন চলে গেছে। নেইমারের গড়াগড়ি দেখে বিরক্ত লাগে, ব্রাজিল গোল খাইলে আনন্দে লাফ দিয়ে উঠি মাঝেমাঝে (এই আনন্দ গত বিশ্বকাপে ব্রাজিল কম দেয় নাই)।

সাপোর্টার হিসাবে সম্ভবত আমি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো হয়ে গেছি। আজকাল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দল সাপোর্ট করি। শুধু তাই না - সেই দিন পতুর্গাল গোল দেওয়ার পরে পতুর্গালের সাপোর্টার হয়ে গেলাম, স্পেন শোধ করার পরে স্পেনের - রোনালদো কটমট করে নেটের দিকে তাকায়ে ফ্রি কিকে গোল দেওয়ার পরে আবারও পতুর্গাল...একই খেলাতে এক হাফে একদল আর অন্য হাফে অন্য দল সাপোর্ট করে ব্যারিস্টার মওদুদের উচ্চতায় উঠে গেছি লাফে।

আজকে অনেকদিন পরে মেক্সিকোর খেলা দেখতে গিয়ে পুরা টেনশনে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো হয়ে গেছে। আজকে আর মওদুদ আহমেদের মতো হইতে পারি নাই। টেক্সাসে বাস করলে মেক্সিকো প্রায় নিজের দেশের মতো। আমি গুনে দেখলাম - আমার আর মারিয়ার সহকর্মী, পাড়া প্রতিবেশি, প্রিয় রেঁস্তোরা বা অফিসের ক্যাফে, ডাক্তার, বাসার হ্যান্ডিম্যান, ঘাস কাটার লোক, ক্লিনার, মেয়েদের বান্ধবী বা স্কুলের টিচার - সব মিলায়ে আমাদের পরিচিত লোকের অর্ধেকের বেশি মেক্সিক্যান বংশোদ্ভূত।

কিছুদিন ধরে কার্ল স্যাগানের প্রবন্ধ সংকলন - বিলিয়নস এন্ড বিলিয়নস পড়ছি। একটা প্রবন্ধের নাম হচ্ছে মানডে নাইট হান্টারস। মানুষ আসলে প্রকৃতিগতভাবেই "হান্টারস আর গেদারার" - খেলাধূলা সম্ভবত সেই শিকারি প্রবৃত্তির ভদ্র ও সভ্য (সব সময় না যদিও) বহিঃপ্রকাশ। খেলা দেখতে বসলে নিজের অজান্তেই আমরা কোন একটা দলকে সাপোর্ট করা শুরু করি।

"Suppose you’re idly flipping the dial on your television set, and you come upon some competition in which you have no particular emotional investment—say, off-season volleyball between Myanmar and Thailand. How do you decide which team to root for? But wait a minute: Why root for either? Why not just enjoy the game? Most of us have trouble with this detached posture. We want to take part in the contest, to feel ourselves a member of a team. The feeling simply sweeps us away...

...We want to be swept up into something like a small, safe, successful war."

মানুষ গোষ্ঠিবদ্ধ প্রাণী এবং মানুষ শিকারি প্রাণী - সব মিলিয়ে দলবদ্ধ শিকার তাই আমাদের কাছে এতো উপভোগ্য - নিজের লিভিং রুমের আরামে বসে মেক্সিকোর খেলা দেখতে গিয়ে আমি সেই হারানো উত্তেজনার সন্ধান পেলাম। মেক্সিকোর জার্মানিকে "হোতায়ে" ফেলানোর আনন্দ সম্ভবত ভেতরে লুকিয়ে থাকা শিকার থেকে ফেরা সুপ্রাচীন এক মানুষের আনন্দ।

যাই হোক - বাকি বিশ্বকাপে আর মওদুদ আহমদ হব না ঠিক করেছি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি - এইসব এলিটদের বাইরে গিয়ে আন্ডারডগ কাউকে সাপোর্ট দিব। মেক্সিকো আমার জন্য ভালো চয়েজ। আমরা বৃহত্তর মেক্সিকোতেই থাকি।

আন্ডারডগরা সাধারণত হৃদয় আর মন জয় করে নেয় - কাপ নিয়ে নেয় অন্য লোকে। এই বিশ্বকাপে আর কাপ থালা বাটি কিছু জুটবে না নিশ্চিত - হৃদয় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

মন্তব্যে একটা লিঙ্ক দিচ্ছি - সেখানে গেলে কার্ল স্যাগানের প্রবন্ধটা পড়া যাবে। পুরোটা পড়লে বুঝা যাবে প্রাচীন মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয় নি মোটেও - সত্যি কথা বলতে কী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদও একজন প্রাচীন চরিত্র।

"Initially, our loyalties may oscillate, first urging on one team and then the other. Sometimes we root for the underdog. Other times, shamefully, we even switch our allegiance from loser to winner as the outcome becomes clear. (When there is a succession of losing seasons, fan loyalties tend to drift elsewhere,) What we are looking for is victory without effort."

হিংস্রতা, ভালোবাসা, ক্রোধ বা প্রেম কোন কিছুই প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয় - এইটুকু মনে রাখলে রাতের সুনিদ্রা পেতে অসুবিধে হবে না।

বাপি শাহরিয়ার আর সড়কে হত্যাকান্ড

বাপি শাহরিয়ার নামে একজন তরুণ ছড়াকার ছিলেন। সেটা ছিল এরশাদের আমল। বাপি তেমন সুপরিচিত কেউ ছিলেন না। উনি সংবাদের শিরোনাম হলেন এক সড়ক দুর্ঘটনার পরে। ওনাকে আহত করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্তান। সেই সময়ে বিচার আশা করা অসম্ভব। কেউ আশাও করে নি বিচার হবে। এই ঘটনার কিছুদিন পরে আমি কলেজে সেই ঘাতককে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছি। এরশাদ জনপ্রিয় শাসক নন - তার মন্ত্রীরাও চূড়ান্ত অজনপ্রিয়। কিন্তু মন্ত্রীতনয় - যে কিনা একজন মানুষকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং আইন স্পর্শ তাকে করতে পারছে না রাষ্ট্রযন্ত্রের অহমিকায় - সে কিন্তু জনপ্রিয় - অবলীলাতে কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয় সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনের সাথেও জড়িত ছিল সে। এই ছিল আমাদের শৈশবের বাংলাদেশ!!! অন্যায়ের ব্যাপারে আমরা সর্বংসহা। এটাই সম্ভবত চিরকালীন বাংলাদেশ। দুঃখজনকভাবে বাপি আর জীবনে ফিরতে পারেনি। তিনি মারা গিয়েছিলেন চিকিৎসাধীন অবস্থাতে। বাপি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনাতে প্রান হারান বাপি শাহরিয়ারের পিতা। যতদূর মনে পড়ে উনি সন্তানকে দেখতে হাসপাতালে আসছিলেন।

এরশাদের যেদিন পতন হয় সেদিন বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম স্বপ্নের বাংলাদেশ এবার পাওয়া যাবে। আমি একা নই - আমার মতো আরও অনেকেই সেটা ভেবেছিলেন। আমরা স্বপ্নের বাংলাদেশ পাই নি। আমরা দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি সব দোষ শাসকের দেব না। আমরা স্বপ্নের দেশ পাওয়ার যোগ্য নই। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা আমাদের মজ্জাগত। আমাদের কাছে ন্যায় আর অন্যায়ের চেয়ে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের স্বার্থ। এরশাদের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্তান বিচার থেকে বাঁচতে পারতো কিন্তু এই গণতান্ত্রিক দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশে অত ক্ষমতা আর লাগে না। সড়ক দুর্ঘটনার বিচার হবে না। আপনাকে মন্ত্রী হতে হবে না, এম্পি হতে হবে না, ইনফ্যাক্ট কিছুই হতে হবে না। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয় - কোন হত্যারই বিচার হবে না, কোন দুর্নীতির বিচার হবে না, আপনার লাশ রাস্তায় পড়ে থাকলে রাষ্ট্র এসে খতিয়ে দেখবে আপনি কী করেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই গভীর রাতে আপনার বাসাতেই হাজির হবে উর্দি বাহিনী। আমাদের ৪৭ বছরের নিরবতার ফলাফল গণতন্ত্র নয় - তস্করতন্ত্র আর দুর্বৃত্ততন্ত্র। আমরা গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি না। আমরা তস্কর আর দুর্বৃত্তের দেশে বাস করি । এটা কোন দুঃখজনক পরিণতি নয় - এটাই ভবিতব্য ছিল। সর্বংসহা হলে এটাই হয়।

সড়কে হত্যাকান্ড নতুন কিছু নয়। এটার শুরু বা প্রসার বর্তমান সরকারের আমলেও নয়। এটা বহু পুরাতন একটা সমস্যা। অন্য দুর্বৃত্ত সরকারদের মতো বর্তমান সরকারও এর সমাধানের চেষ্টা করে নি বরং দুর্বৃত্তদের নেতাকে মন্ত্রীর পদ দিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে একে। এক সপ্তাহ আগে স্কুলের বাচ্চাদের আন্দোলন খুব সামান্য হলেও আমাকে আশা দেখিয়েছে। আমরা মেনে নেওয়া জনগণ। সড়কে প্রিয়জনের মৃত্যু হলে এক সময়ে চোখের পানি শুকিয়ে যায় - এরপর ঈশ্বরকে বিচার করার ভারটা দিয়ে কষ্টটা খুব যত্নে বুকের আলমারিতে রেখে দেই। কিন্তু এই বাচ্চাগুলো মানতে নারাজ। তারা সদর্পে রাজপথ দখল করে নিল, তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বদলানোর সময় এসেছে। আমাদের নিরবতা ছিল অসততার সমতুল্য। এরা এখনো অসৎ হতে শেখেনি।

আমাদের মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ বিরোধীদল এদের আন্দোলনকে পুঁজি করেছে, আমাদের জনবিচ্ছিন্ন অসৎ রাষ্ট্র এদের পিছে পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই শিউরে উঠি। এরা স্কুলের বাচ্চা। এদেরকে এতো ভয়? অথবা এদের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকারের ইচ্ছা? পোড়খাওয়া রাজনৈতিকদলগুলো এমনই দেউলিয়া। আমাদের অশ্লীল নিরবতার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এরা সাহস কাকে বলে।

"আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ

স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,

আঠারো বছর বয়সেই অহরহ

বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়

পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে

এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-

এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।"

(সুকান্ত ভট্টাচার্য)

উই আর ইন দ্য মিডল

"আব্বু, তুমি ডিস্টোপিয়া কী জানো?"

"ইউটোপিয়ার উল্টোটা।"

"ইউটোপিয়া যেমন মিথ্যা, ডিস্টোপিয়াও তাই" - আনুশা জানালো। পরীক্ষা, পড়ার চাপ আর নানান কারণে মনটা খারাপ। পড়া শেষে ওকে নিয়ে বের হয়েছিলাম, রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকলাম। আইস ক্যারামেল মাকিয়াটো আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ খেয়ে মন ভালো করাতে হলো।

গাড়িতে নানান জিনিস নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আনুশা গুগল করে বের করেছে অর্থের সাথে সুখের সম্পর্ক আছে কিনা। গুগল বলছে সুখী হতে যা টাকা দরকার সেটার জন্য বছরে ৭৫০০০ ডলার আয় করতে হবে। সেটা কঠিন না সোজা সেটা নিয়েও আলাপ হলো। নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলাপের শেষে এসে আনুশা অনেকটাই হাসিখুশি ফিরে পেয়েছে।

"আই থিং দিজ ওয়ার্ল্ড ইজ নাইদার গুড নর ব্যাড - উই আর প্রোবাবলি রাইট ইন দ্য মিডল।"

বাসায় ফিরেই ঘুমাতে চলে গেল।

কথাগুলো মাথাতে ঘুরছে।

আগামীকাল আরেকটা দিন শুরু হবে। বাচ্চাদের স্কুলে নামানো, অফিস, কাজের প্রচণ্ড চাপ, ক্লান্ত হয়ে ফেরা - আনুশার সারাদিন স্কুল, স্কুলে বীজগণিত শেখা, বিজ্ঞান পরীক্ষা - রাতে আমার সাথে অংক পরীক্ষার জন্য পড়তে বসা। আগামীকাল দিনটা ঠিক আজকেরই মত হবে, যেমন আজকের দিনটা ছিল গতকালের মতো। ইউটোপিয়া নয় ডিস্টোপিয়া নয়, রাইট ইন দ্য মিডল। সম্ভবত রাইট ইন দ্য মিডলের থাকার সুবিধা বা অসুবিধাই হচ্ছে দিনগুলো সব একই রকম হয়, না ভালো, না খারাপ। আনন্দগুলো তাই দুঃখের সাথে মাখামাখি করে একদম মিলেমিশে থাকে।

জন্ম থেকেই মেয়েরা কিছু না কিছু শিখাচ্ছে। কে জানতো জীবন যে আসলে একটা শিক্ষাসফর!!! আজকে প্রায় দশ বছর আগে তোলা ছোট্ট আনুশার একটা ছবি পেলাম।

এই ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ করে এমন দার্শনিক হয়ে যাবে সেটা কী ভাবতে পেরেছিলাম?




যীশু

প্রায়দিনই দরজার সামনে যীশুর আহবান রাখা থাকে। উনি সব সময়েই ইহকাল এবং পরকালের উন্নতি আর আলোর পথে আসার নানান সার্ভিস অফার করেন। ধর্মের সাথে বাজার ব্যবস্থা সম্পর্ক অনেক পুরানো। যীশুর সার্ভিস নিতে গেলেও পকেটের পয়সা খরচ হবে দেখে কোন দিন তার ডাকে সাড়া দেই নি। আজকে একটু ব্যতিক্রম দেখলাম। আজকে দরজার সামনের ফ্লায়ারে জেসাস গাছ কাটার জন্য ১৫% ছাড় দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে যীশুর অন্য কোন বাণীতে আমি এতোটা আপ্লুত হইনি। এইবার সত্যি সত্যি ওনাকে ফোন দিতে পারি। ইহকাল আর পরকাল ঠিক করার বহু বহু ব্যবস্থা থাকলে কম খরচে গাছ কাটার লোক পাওয়া কঠিন।

যীশু প্রসঙ্গে মনে পড়ল - বহুদিন আগে আমরা ৩ বন্ধু একই বাসায় থাকতাম। এর মধ্যে রুমি ছিল ধার্মিক। প্রায়ই রাতে সে ব্লকব্লাস্টার থেকে ধর্মীয় সিনেমা নিয়ে আসতো। নবী রসুলদের জীবনী নিয়ে করা। ইসলাম ধর্ম আর খৃষ্ট ধর্মের নবী রসুল প্রায় একই। সুতরাং মার্কিনি ধর্মীয় সিনেমা কার্যত আমাদের ধার্মিকদের জন্যেও প্রযোজ্য।

রাতে বাসায় ফিরে পানীয় পান করতে করতে আমরা রুমিকে জিজ্ঞেস করতাম - আজকে কোন নবী দোস্ত?

একদিন ইউসুফ নবীর সিনেমা দেখলাম। কাহিনি আমরা যা পড়েছি ঠিক সেই রকমই। সিনেমার শেষে ধর্মীয় গুরুগম্ভীর আলোচনাও হত। নিজে পান না করলেও আমাদের পানীয়তে রুমি বাঁধা দিতো না কদাচও।

রুমির কাছে শুনেছিলাম যে যীশু নাকি আবার ফিরে আসবেন। অস্থির এই পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য তিনি ফিরবেন সিরিয়াতে - দামেস্ক শহরে। ১৫ বছর আগে সিরিয়াতে যুদ্ধ শুরু হয় নি। মার্কিন দেশ মধ্যপ্রাচ্যের বারোটা বাজানোর জন্য ইরাক আর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে। ইংরেজিতে যেটাকে বলে গাং-হো - জাতীয়তাবাদ ঠিক সেই পর্যায়ে আছে। ফ্রান্স আর জার্মানি ইরাক যুদ্ধের বিরোধীতা করাতে কংগ্রেস ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজের নাম পালটিয়ে ফ্রিডম ফ্রাইজ করে দিয়েছে। ফরাসী চুম্বন (ফ্রেঞ্চ কিস) বিষয়ে অবশ্য কবি নীরব। সেটার নাম পালটায় ফ্রিডম কিস করা হয় নাই। জাতীয়তাবাদের চেয়ে বিপদজ্জনক অসুখ এই পৃথিবীতে আর দু'টি নেই।

সিরিয়াতে যীশু ফিরবেন শুনে আমার একটু দুঃখ লাগলো। আমি রুমিকে বললাম - যীশুকে তো মার্কিন দেশ ভিসা দিতে চাবে না। যীশু দেখতেও মধ্যপ্রাচ্যীয় হবেন (আসল যীশুও তা-ই ছিলেন), তার কপালে বহু খারাপি আছে। সকাল বিকালে যীশুর নাম জপা লোকজনও তাকে সন্ত্রাসী বলে ডাকবে। তাছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যসহ বাকি পৃথিবীতে শান্তি আনতে গেলে তো গণতন্ত্র আর শান্তির সোল এজেন্ট মার্কিনিরা ক্ষেপে যাবে।

প্রশ্নটা অমীমাংসিত রেখেই সেই আলোচনা বন্ধ করতে হয়েছে।

১৬ বছর পরে এখনো আমি মাঝে মাঝে যীশুর পুনর্জন্ম নিয়ে ভাবি। সিরিয়ার অবস্থা আরো টাইট। এখন ওখানে ফিরলে তাকে শরনার্থী হয়ে ইউরোপেও যেতে হতে পারে। সেখানে অনেক যীশুভক্তের লাথি আর গুঁতো অপেক্ষা করছে তার জন্য। ঈশা নাম নিয়ে তিনি নানাবিধ সমস্যাতে থাকবেন। তার পুর্নজন্ম পূর্বের জন্মের চেয়ে সুখের হবে না। আর এই ফ্লায়ারটা যেই যীশু রেখেছে (মেক্সিকান কোম্পানি, এই সব সার্ভিস ওরাই দেয় মূলত - Jesus এর উচ্চারণ হওয়া উচিত হিসুস) সেই জেসাসরাও কম ঝক্কি পোহাচ্ছে না এই দেশে ঢুকতে। Jesus নাম মেক্সিকোতে বেশ পপুলার। আমরা যেমন মোহাম্মদ রাখি নামের সামনে। মার্কিনিরা যীশুকে ডাকলেও যীশুর নামের মানুষ খুব বেশি দেখি নি।

আমার কৃতকর্মের জন্য ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করে দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু আমার উঠোনের বেয়াড়া হয়ে ওঠা গাছ উনি কাটবেন না এটা নিশ্চিত বলা যায়। অচিরেই গাছকর্তক যীশুকে ফোন দেব। নইলে দেখা যাবে এই যীশুও পলাতক। 

সেপ্টেম্বর ১১

২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ ছিল মঙ্গলবার। আমি তখন বেশ ভোরে অফিসে যেতাম। আমাদের অফিসে কোন কিউবিকেল ছিল না। সব রুম। আমার রুমে আর কেউ ছিল না। অফিসে পৌঁছানোর একটু পরে ঢাকা থেকে আমার ভাই ফোন করে আমাকে টুইন টাওয়ারে হামলার খবর দেয়।

খবর শুনে আমি আমার প্রায় গুহার মতো অফিস থেকে বের হয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে যাই। অফিসের ক্যাফে লোকে লোকারন্য। একটা বড় টিভিতে সিএনএন চলছে। এতোগুলো মানুষ তবুও সব নিস্তব্ধ, পিনপতন নিরবতা।

আমি পৌঁছানোর সাথে সাথে দ্বিতীয় ভবনে বিমান হামলা হল। ওই সময়ে আমরা কেউই বুঝতে পারি নি এটা দ্বিতীয় হামলা, সবাই ভাবছিল প্রথম হামলার রেকর্ড করা ছবি।

নিরবতা ভেঙ্গে অনেক মানুষের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। সারাদিন তেমন কোন কাজ হয়নি অফিসে। একটু পর পর টিভির পর্দাতে চোখ রাখছিলাম। এটা ইসলামী সন্ত্রাসীদের কাজ সেই সন্দেহ প্রায় সাথে সাথেই বলা হলো। অস্বস্তি নিয়ে আমিও সেই একই জিনিস ভাবছিলাম।

আমাদের কী হবে? এই দেশে বাস করা হাজার হাজার মুসলমানের কি হবে? মার্কিন দেশ এই হামলার উত্তর কিভাবে দিবে?

আমাদের জগৎ পুরো পালটে যাবে সেই সন্দেহ ছিল না। হামলার কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালালো। লাদেনকে ধরার লক্ষ্যে। সেই ইতিহাস আমরা সবাই জানি। আফগানিস্তানের পরে ইরাক। যদিও হামলার সাথে ইরাকের কোন সংযোগ মার্কিনিরা প্রমান করতে পারে নি।

লাদেন আমেরিকার নিজ হাতে তৈরি সন্ত্রাসীই বলা যায়। সোভিয়েট রাশিয়াকে আফগানিস্তানে মোকাবেলা করতে গিয়ে মার্কিন দেশ ইসলামী জঙ্গী গ্রুপগুলোকে শক্তিশালী করেছিল। সন্ত্রাসবাদের চাকরিতে রিটায়ারমেন্ট বলে কিছু নেই। সুতরাং রুশদের পরে মার্কিনিদের বিরুদ্ধেই জিহাদ শুরু করে দেয় তারা। সেই ইতিহাস অজানা কিছু নয়।

৯/১১ এর ১৬ বছর পূর্ণ হলো। মার্কিন দেশে স্কুলেও পড়ানো হয় এই ইতিহাস। এই ১৬ বছর ধরে মার্কিন দেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছে। মার্কিন দেশের বহু সামরিক ও বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে ৯/১১ এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়াতে। অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম হয় নি। কিন্তু এরচেয়ে অনেক অনেক বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি পৃথিবীতে। পৃথিবী আরও অনেক অনিরাপদ হয়ে গেছে। হামলা শুধু মার্কিন দেশেই নয়, প্যারিসে নয় বা লন্ডনে নয় - বাংলাদেশের বুকেও হয়েছে, এমনকি নাম না জানা গ্রামের দোকানদারকেও মরতে হয়েছে বিধর্মী বলে। ধর্মীয় সন্ত্রাস পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে মার্কিনিরা জিততে পারে নি।

এই সন্ত্রাসের পুরোভাগে নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের নাম লেখা আছে। কিন্তু অন্য দিকে চিন্তা করলে মূল্য তারাই সবচেয়ে বেশি দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে এই পৃথিবীর কাছে সন্ত্রাসী বলেও চিহ্নিত হয়েছে। শাঁখের করাত সম্ভবত একেই বলে।

৯/১১ আমার চিন্তাচেতনাতেও পরিবর্তন এনেছে। দিনে দিনে মানবজাতির উপর আমার আস্থা উঠে গেছে। সামগ্রিকভাবে মানবজাতি একটি আত্মঘাতী প্রজাতি। মানবধর্ম ব্যাপারটা খুব বেশি তাত্ত্বিক, বাস্তবে অসম্ভব। মানুষ নিজের সম্প্রদায়কে বেশি ভালোবাসে সেটা সমস্যা নয়, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি সামগ্রিকভাবে তাদের রয়েছে বিশুদ্ধ ঘৃণা। সব যুদ্ধ, সব অনাচার, সব অত্যাচার আসলে নিজের ভাইয়েরই রক্ত ঝরায়, সেখানে কেউ জিততে পারে না - সবাই হেরে যায়। এই বোধ না আসলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।

মানুষের নির্মমতা আমাকে বিচলিত করে কিন্তু বিস্মিত করে না। মানুষের নির্বুদ্ধিতা আমাকে বিচলিত করে কিন্তু বিস্মিত করে না। মানুষের হিংস্রতা আমাকে বিচলিত করে কিন্তু বিস্মিত করে না।

বরং কোথাও সামান্য ভালোবাসা দেখলেই বিস্মিত হই। কোথাও ফুটে থাকা জংলী ফুল দেখলে সময়টা ভালো কাটে। কেউ হারিয়ে যাওয়া কুকুর ছানা ফেরৎ পেলে সফল মনে হয় দিনটাকে। এই বিন্দু বিন্দু প্রাপ্তি আর সামান্য একটু স্নেহ আর ভালোবাসাই মনে হয় টিকিয়ে রেখেছে এই পৃথিবীকে। তাই সকাল হলে পৃথিবীটাকে এখনও নিজের বাড়ি মনে হয়, তরল রৌদ্রালোকে স্নান করতে ইচ্ছে করে, গাছের ডালে বসা অচেনা পাখিটিকেও নিজের আত্মীয় মনে হয়।

আগামীকালের দিনটা হয় আজকেরটার চেয়ে ভালো হবে, আগামী মাসটা হয়ত আরও ভালো, সামনের বছর থেকে হয়ত যুদ্ধবিগ্রহ থেকে যাবে, দশ বছর পরে কেউ হয়ত আর উদ্বাস্তু হবে না। একটুখানি ভালোবাসা সেই অসম্ভব আশাটাকেই বাঁচিয়ে রাখে।

[এই গ্রীষ্মে ৯/১১ মেমোরিয়ালে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে সাদা রঙের একটা গোলাপফুল দেখেছিলাম। নিঃসঙ্গ কিন্তু সে একাই যেন পৃথিবীর সব নির্মমতার বিরুদ্ধে কথা বলছে।]

Where have all the flowers gone?

Long time passing

Where have all the flowers gone?

Long time ago

Where have all the flowers gone?

Girls have picked them every one

When will they ever learn?

When will they ever learn? 



রাইফেল রোটি আওরাত

বইটার নাম শুনেছিলাম বেশ অনেকদিন আগে। পড়া হয় নি। বইটি শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার লেখা। ১৯৭১ সালের পটভূমিতে। বইয়ের লেখক নিজেও শহীদ হয়েছেন - ১৪ ই ডিসেম্বর।

বইটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। "রাইফেল রোটি আওরাত" পড়তে অনেকখানি মানসিক শক্তি অর্জন করতে হয়। গল্পের মূল চরিত্র সুদীপ্ত শাহিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ভাগ্যগুণে বেঁচে যান পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ থেকে। মূল চরিত্র কাল্পনিক হলেও ১৯৭১ সালের নির্মমতা কাল্পনিক নয়। সেই নির্মমতার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠে রাইফেল রোটি আওরাতে। বইটা লেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে জুন মাসের মধ্যে অর্থাৎ লেখক সীমাহীন অনিশ্চয়তা এবং ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতরে বসেই বইটা লিখেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত নিজেও সেই নির্মমতার বলি হয়েছেন।

কোন ভাষার অলংকার দিয়ে বইটা সাজানো হয় নি, বর্বরতার বর্ণনা ঠিক যেইভাবে আসা উচিৎ ঠিক সেই ভাবেই উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালকে জানতে হলে যেমন জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি এক অবশ্যপাঠ্য বই, আমি রাইফেল রোটি আওরাতকে ঠিক সেই কাতারেই রাখবো।

একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারও বলছি। অফিসের কাজে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম, বছর দশেক আগে। আমার কাউন্টার পার্ট এক পাকিস্তানি ভদ্রলোক, অফিসের কাজে অনেক অনেকবার ফোন এবং চ্যাটে কথা হয়েছে, সজ্জন ভদ্রলোক।

নিউইয়র্কের অফিসে প্রথমবার দেখা হলো। বয়স্ক লোক। তিনি আলাপচারিতা ১৯৭১ সালে নিয়ে গেলেন। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার জন্য ইন্ডিয়াকে দায়ী করলেন...এরপরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী ও রেপিস্ট বললেন। আমি স্থানুর মতো বসে রইলাম, জীবনে একবার আমার ইচ্ছে হলো সামনে বসে থাকা শুয়োরের বাচ্চাটার মাথা গুড়িয়ে দেই। সেই শক্তি আমার সেই মুহূর্তে ছিল। মানুষের সীমাবদ্ধতা প্রচুর -সন্তানদের কথা ভাবতে হয়, আগামীকাল দুপুরের বাজারটা কিভাবে করতে হবে সেটাও ভাবতে হয়। কিন্তু আমার এই জীবনে একবার ইচ্ছে হয়েছিল সামনে বসে থাকা এই ***র পোলাটার সানডে মানডে ক্লোজ করে দেই। সেটা না করতে পারার গ্লানি নিয়ে আমাকে বাঁচতে হবে।

আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক পাকিস্তানিদের সাথে ১৯৭১ নিয়ে কথা বলেছি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সজ্জন, টাউট - নির্বিশেষে আমি একজন পাকিস্তানিও পাইনি যে ১৯৭১ এর যুদ্ধ নিয়ে সত্যভাষণ করবে। ১৯৭১ সালের ব্যাপারে প্রতিটি পাকিস্তানিই এক একজন ইয়াহিয়া খান। আমি এখনো পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম দেখি নি।

আমার দুঃখটা পাকিস্তানিদের নিয়ে না। পাকিস্তানি ও পাকিস্তান দেশটাকে আমি মানুষ ও মানুষের দেশ বলে মনে করি না - এখনও পর্যন্ত আমি সেই নির্দশন দেখি নি। কিন্তু আমার নিজের দেশেও বহু বহু পাকিস্তানি বিদ্যমান, পৃথিবীর অন্য কোন দেশ এই পরিমাণ আবর্জনা উৎপন্ন করেছে বলে আমার জানা নেই। এই অবধারিত সত্যটাই আমাকে নিয়ত পীড়া দেয়।

"রাইফেল রোটি আওরাত" যারা পড়েন নি, তারা মন্তব্যের লিঙ্ক থেকে বইটা ডাউনলোড করতে পারবেন। এই ২০১৫ সালে এসে আমি যেই অবস্থা দেখছি তাতে আমার ধারনা নিকট কোন ভবিষ্যতে হয়ত এই গল্পগুলো শুধুই কল্পকাহিনি হয়ে থাকবে, লেখকের কল্পনাশক্তি বেশ ছিল বলে মনে হতে পারে।

সেটা যদি হতে দিতে না চান - তাহলে এই বইটা পড়ুন। রক্ত দিয়ে লেখা এই বই। পড়তে কষ্ট হবে, তবুও পড়ুন। বইটা যেন এক অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টারের বর্ণনা।


এইসব দিনরাত্রি

গত দশ দিনে তিনবার ডাক্তারের অফিসে যেতে হয়েছে। কানের সমস্যা নিয়ে। গত সাত বছর ধরে ভুগছি। চিরকাল ব্যাপিয়া সুখ না থাকলে চিরকাল ব্যাপিয়া অসুখ থাকা খুবই সম্ভব।

সুখের সাথে বসবাস করা শিখতে হয় কিনা জানি না - কিন্তু অসুখের সাথে বাস করাটা রীতিমতো শেখার বিষয়। কানের জন্য স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন নিতে হয়, একদম কানের গভীরে। এটা কোন মতেই আনন্দের অভিজ্ঞতা নয়। তবে খুব কষ্টকর কিছুও না। দশ দিনে তিনবার নিতে হলো। আজকে ছিল এই সিরিজের শেষ ইঞ্জেকশন। সম্ভবত আগামী চার থেকে ছয়মাস নিতে হবে না।

ইঞ্জেকশন নেওয়ার পরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হয়। ডাক্তার রুমের লাইট বন্ধ করে দেন - আমি কম্বল গায়ে দিয়ে গান শুনি। একেকদিন একেক টপিক নিয়ে চিন্তা করি। আজকের টপিক ছিল অমরত্ব।

নিশ্চিতভাবেই মানুষের অমরত্বের সুপ্তবাসনা আছে। চিন্তা করে দেখলাম সম্ভবত মৃত্যুভয়ের জন্যই মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। দিন যতই খারাপ হোক না কেন - আগামীকালটা ভালো হওয়ার সামান্য সম্ভবনা সব সময়েই রয়ে যায়।

"গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;

মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোতে ভালোবাসে।"

মানুষের ভয় অজানাকে - অন্ধকারে দেখা যায় না দেখে অনেকেই অন্ধকার ভয় পান। এই যাপিত জীবনে মৃত্যুই সবচেয়ে বড় অন্ধকার। মৃত্যুর পরে কী আছে সেটা জানা থাকলে মনে হয় আর মৃত্যুভয় থাকতো না - মানুষ সম্ভবত আরও বেশি বিপদজ্জনক হয়ে উঠত। যেই আত্মঘাতী বোমারু পেটে বোমা বেঁধে স্বর্গ যাত্রা করে - সেই নির্বোধের একদম মনে গভীরে অমরত্বের বীজ বুনে দিয়েছে কেউ।

এক হিসেবে মৃত্যুভয় মন্দ নয় - মৃত্যুভয়হীনতা ভয়ংকর হতে পারে - বিশেষত যখন সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যায়।

"চ’লে যাবে সেই সব উপকথা: সৌন্দর্য প্রতিভা-

মেধা;-এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা

নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে

অত্যন্ত উল্লাস ভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।"

ইঞ্জেকশনের পরবর্তী সময়টা ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেন। ফেসবুকে উঁকি দেওয়া বিশ্রামের অঙ্গ কিনা সেটা কোথাও লেখা নেই। তা-ই বাসায় ফিরেই দেখতে পেলাম শার্লট শহরে পুলিশের গুলিতে নিহত মানুষটার স্ত্রীর করা ভিডিও।

"হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং টু দিজ ওয়ার্ল্ড?" - এই বাক্যটার যুৎসই কোন বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাই নি এখন। বিশ বছরের মার্কিন জীবনে বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখানো একমাত্র ঘটনাটা একজন অফডিউটি পুলিশের করা। আমরা যেই মার্কিন সমাজে বাস করি - সেই সাজানো গোছানো মার্কিন দেশের বাইরেও বিশাল একটা দেশ আছে - সেই দেশে পৃথিবীর বাকি সব অনুষঙ্গও থাকতে বাধ্য। পুলিশের বর্ণবাদ আমাকে বিস্মিত করে না - এই দেশে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য বর্ণবাদী প্রার্থী যখন পাওয়া গেছে তখন আরও অনেক খান্ডবদাহন দেখে যেতে হবে।

তবে দিনটা সবটুকু মন্দ ছিল না। ফেসবুকের কল্যানেই অ্যালেক্সকে খুঁজে পেলাম - সে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অনুরোধ করেছে বোমায় দগ্ধ সিরিয়ান বালককে সে তার ভাই বানাতে চায়। তারা এক সাথে সাইকেল চালাবে - প্রজাপতি ধরবে।

ওবামা বলেছে অ্যালেক্সের কাছে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে পারেন ওবামা নিজেই এবং তাঁর সভাষদ এবং সহকর্মী রাজনীতিকরা। যুদ্ধ বেচে আর দেশ দখল করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে সেটার ফলাফল ওমরানরা ভোগ করে আর অ্যালেক্সরা কষ্ট পায়। পৃথিবীটা অ্যালেক্স বা ওমরানদের কেউই চালায় না - তাই ওদের ভয় বা ভালোবাসা ভুলে যেতে আমাদের সময় লাগে না।

(অ্যালেক্সের ভিডিওর লিঙ্ক)

https://www.facebook.com/potus/videos/537075249815653/

দ্বিতীয় আনন্দের ব্যাপার ছিল এই ভিডিওটা। মানুষ বাদে অন্য সব প্রাণীই আমাকে নির্মল আনন্দ দেয়। যদি দ্বিতীয় একটা জীবন পেতাম, জেন গুডালের শিষ্য হওয়ার চেষ্টা করতাম।

(আজকের প্রাণীজগতের লিঙ্ক)

https://www.facebook.com/andre.vanrooyen2/videos/10208642436391343/?pnref=story

তৃতীয় আনন্দের ঘটনা ছিল প্রণবেশ দাশের তোলা এই ছবিটা। বৃষ্টিভেজা রাতে ঢাকার রাস্তা। কোথাও কিছু লেখা নেই - তবুও অনেক আগের কোন দুরন্ত আনন্দ নিয়ে এলো ছবিটা। বৃষ্টির রাতে আমি ঢাকা শহর দেখেছি কিছুদিন আগেই - কিন্তু চোখে যেটা দেখতে পারিনি সেটা এই ছবিতে পেয়েছি। বালক রাজপুত্রের বইতে যথার্থই বলা আছে...

"It is only with the heart that one can see rightly; what is essential is invisible to the eye."

দিনশেষে ভালো ও মন্দের ফুটবল খেলাতে মন্দকে ৩-১ গোলে পরাজিত করেছে ভালো। ঠিক এই কারণেই আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকলে হয়ত আরও অনেক অনেক অ্যালেক্সের দেখা পাবো, নিজের জগতে একা হেঁটে যাওয়া মেরুভালুকের ছবি পাব এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এমন অনেক জিনিসের সন্ধান পাব যেটা চোখে না ধরা পড়লেও হৃদয়ে কাছে রেখে দেওয়া যায়।

আমি নির্বোধের মতো অমরত্বে বিশ্বাস করি না - শুধু বেকুবের মতো অমরত্বের প্রত্যাশা নিয়ে দিন কাটিয়ে যাই।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Pranabesh Das

শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ

কবিতা কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ ও হুমায়ূন আজাদ



আম্যান্ডা আর তার কাজিনেরা

মেরি এলেন মার্কের নাম আমি আগে শুনিনি। আমি যেই দিনটিতে রেডিওতে ওনার নাম শুনলাম, সেইদিনটিতেই উনি এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। বলা যায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ ও সংক্ষিপ্ত জীবনের গল্প শোনার পর আমি তাঁকে খুঁজতে শুরু করি। মেরি এলেন মার্কের কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষদের নিয়ে এবং অনেক অনেক কাজ তিনি করেছেন ভাগ্যহত শিশুদের নিয়ে। তিনি মুম্বাই শহরে বালিকা পতিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন সিয়াটল শহরের হোমলেস শিশুদের নিয়ে। আগ্রহীরা গুগল করলে বা লাইব্রেরিতে খোঁজ নিলে তার আরও অনেক অনেক কাজের খবর জানতে পারবেন।

যেকোন মানবিক, পাশবিক, অর্থনৈতিক বা নৈতিক সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরা। সংকট যে এদের শৈশব কেড়ে নেয় তা নয়, ভয়াবহ এই দানবিক পৃথিবীর সামনে তাদের ছেড়ে দেয় - সীমাহীন অসহায়তার মধ্যে। যুদ্ধবিদ্ধ্বস্ত জনপদ নয় - আপাত শান্ত, সুন্দর সাজানো শহরেও প্রতিদিন ঘটে চলছে এই অমানবিকতা। রাষ্ট্র বা ঈশ্বর কোথাও পর্যন্ত এদের কান্না পৌঁছে না - ধর্মস্থানের পুরোহিতই কখনও কখনও নিপীড়ক হয়ে থাকে, নিপীড়ক হয় আপনজনও। শুধু যে দারিদ্রই অসহায়তা নিয়ে আসে তা নয়, অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের ভেতরেও অসহায় শিশুদের দেখা মিলে। ব্যাপারটা আমাকে নিয়ত পীড়া দেয়।

মেরি এলেন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বছর তিনেক আগে। এর কিছুদিন পরেই ন্যাশানাল পাব্লিক রেডিওতে এই ছবিটার খোঁজ পাই। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে নয় বছর বয়েসি ধুমপানরত একটা মেয়েকে, যার চালচলন বেশভূষা বড়দের মত। মেয়েটার নাম আমান্ডা। পেছনে তার কাজিনের ছবিও দেখা যাচ্ছে। ছবিটা তোলা হয়েছিল ১৯৮৯ সালের কোন এক সময়ে, নর্থ ক্যারোলিনার হতদরিদ্র কোনো পাড়াতে। সে পাড়াটার ডাক নাম "সিন সিটি"।

এই ছবিটার মধ্যে কোথাও যেন একটা বিশাল ক্ষত লুকিয়ে আছে। ছবিটা বিষণ্ণ করে দিতে বাধ্য। আমি যদি মুনি-ঋষী কেউ হতাম, তাহলে এই ছবিটা দেখার পরে পৃথিবী ধ্ব্বংস করে দিতে চাইতাম। আমাদের সামগ্রিক প্রাপ্তি, সমাজব্যবস্থা, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি গালভরা কথাকে একদম সরাসরি উপহাস করছে সিগারেট হাতে ধরা আমান্ডা। এই লেখার সাথে আর্টিকেলটা জুড়ে দেব, তাই বেশি ডিটেইলে যাচ্ছি না। আমান্ডা মেয়েটা বুদ্ধিমান ছিল, সে ভেবেছিল এই ছবিটা প্রকাশিত হলে হয়ত তার নরকবাসের অবসান হবে এবং হয়ত সে সুস্থ একটা জীবন পাবে। বাস্তবে না হয় নি, তাকে নানান টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে, নেশাও তার সঙ্গী হয়েছে। বুদ্ধিমান আমান্ডার কথা মেরি এলেনের মনে ছিল। তেমনি মেরি এলেনের কথাও আমান্ডার মনে ছিল। যদিও তার নাম বা পরিচয় ভুলে গিয়েছিল সে। আমার মতো আমান্ডাও মৃত মেরি এলেনকে খুঁজে বের করেছে, আর সেই সঙ্গে পত্রিকার পাতায় আবারও উঠে এসেছে আমান্ডা আর কাজিনদের ভুলে যাওয়া গল্পগুলো।

আমান্ডার বর্তমান বয়েস ৪০ এর কাছাকাছি। শৈশবের মতো তার বর্তমান জীবনও জটিলতাতে পরিপূর্ণ। যদিও অনেকখানি বাধা সে অতিক্রম করেছে। এনপিয়ারের রিপোর্ট বলছে...

"Ellison's adulthood is still tumultuous. She has served time in prison and says she is still "surrounded by crazy people and drugs." But she says her life has improved, and she wishes she could talk again with "that photographer lady."

আমি গুহাবাসী মানুষ। আমার সাথে প্রান্তিক বা অপ্রান্তিক জনগোষ্ঠির কারও সাথেই দেখা হওয়ার কথা না। তবুও আমি শিশুদের নির্মমতার শিকার হতে দেখেছি। খুব সামান্য গল্প - তাও মনে হয়েছে, আমান্ডা আর তার কাজিনেরা সর্বত্রই আছে। সবখানেই আছে। অন্য রূপে, অন্য পোষাকে, অন্য মোড়কে। এই পৃথিবীতে সুস্থ আর স্বাভাবিক ও সহজ জীবন পাওয়াটা অনেক অনেক শিশুর জন্যই দুর্লভ।

আমরা সমকামীদের অধিকার নিয়ে বলি, নারীর অধিকার নিয়ে বলি, সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে বলি, গণতন্ত্র আর প্রতিবাদ করার অধিকার নিয়ে বলি - আমরা কয়জন শিশুদের অধিকার নিয়ে মাথা ঘামাই?








কমলার মার্মালেড

আমার আম্মা ঠিক বাংলাদেশের আর পাঁচটা পরিবারের মায়ের মতো ছিলেন না। আমি যেই সময়ে বড় হয়েছি সেই সময়ের তুলনাতে। ওই সময় খুব বেশি মহিলা বাইরে কাজ করতেন না। অথচ আম্মা প্রায় সারাদিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। বাসায় ফিরে বই পড়তেন।

বিকেলে চায়ের আয়োজন করতেন - সন্ধ্যাতে টিভি দেখতেন, রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেতেন। তাঁর ভাষাতে ছাপার অক্ষর দেখলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে। প্রায় রাত্তিরেই ওনার রুমের বাতি অন্য কেউ নিভিয়ে দিত। আমাদের পড়াশোনা নিয়ে চাপাচাপি করতেন না। আম্মার ধারনা ছিল অতিরিক্ত পড়ার চাপ পাঠবিমুখতা তৈরি করতে পারে - অন্তত নিচের ক্লাসে। আমাদের গল্পের বই পড়ার স্বাধীনতা ছিল।

পরীক্ষার নম্বর নিয়েও খুব মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। ক্লাস থ্রি-তে ফাইনালে আমার ইংরেজিতে ৩৬ পাওয়া নিয়ে মর্মাহত হয়েছিলেন একবার। সঙ্গত কারনও ছিল। ওই বইয়ের লেখিকা উনি নিজেই ছিলেন। আম্মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বড় হলে আমরা নিজে থেকেই পড়তে বসব। আমাদের শৈশব তিনি চুরি হতে দেননি।

ঘর সাজানোতে তিনি বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। পুরনো শাড়ি দিয়ে বাসার পর্দা বানাতেন। রিসাইকেল শব্দটা আমি তখনও শিখিনি - যদিও এর সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প বয়েসেই। এছাড়াও অল্প কয়দিন পরে তো মরেই যেতে হবে - এতো পয়সা খরচ করাটা পুরোই অপচয়।

তাঁর দৈনন্দিন কাজের তালিকাতে রান্নাবান্না ছিল না। বাসাতে রান্নার লোক ছিল। আমরা প্রতিদিন তাদের রান্নাই খেতাম। আইটেমে খুব কম দিনই পরিবর্তন আনা হত। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি রান্না করতেন। ছুটির দিনে, ঈদের অথবা কারো জন্মদিনে। বেশ ভালোই রান্না করতেন। তাঁর মা অর্থাৎ আমার নানি অসাধারণ রাধুনী ছিলেন। কিন্তু আম্মা সম্ভবত তাঁর কাছ থেকে রান্না শিখেন নি। রান্না সম্বন্ধে আমার একটা থিওরি আছে - যে ভালো রান্না খেয়েছে, সে নিজেও চেষ্টা করলে ভালো রান্না করতে পারবে - কেননা "হাইট অফ পারফেকশন" জানা থাকলে সেই উচ্চতায় পৌছানোর চেষ্টা করা যায়।

সিদ্দিকা কবিরের "রান্না খাদ্য পুষ্টি" বইটা বের হওয়ার সাথে সাথে সেটা আম্মা কিনে আনেন। আমি সেদিন আম্মার সাথে ছিলাম। বইটার দাম সম্ভবত ৩০ টাকা ছিল - ১৯৭৮/৭৯ সালে। আমি জানলাম যে আম্মা লেখিকাকে চিনেন। তিনি অতিবড় রাঁধুনী। সিদ্দিকা কবীর বেশ অনেকদিন আম্মার সহকর্মী ছিলেন। সিদ্দিকা কবির এই বইয়ের প্রতিটি আইটেম নাকি বেশ অনেকবার রান্না করেছেন - রেসিপি যাতে পারফেক্ট হয়।

এই বইটা আসার পরে আম্মা মাঝে মাঝে নানান পরীক্ষামূলক জিনিস রান্না শুরু করে দিলেন। হান্টার বিফ, চাইনিজ, রুটিতে মাখানোর মেয়োনিজ, পেয়ারার জেলি ইত্যাদি। মিষ্টি কুমড়ার জ্যামও বাদ গেল না।

একবার ঠিক করলেন কমলার মার্মালেড বানাবেন। আমি এই জিনিসের নামও শুনিনি। আম্মা জানালেন খোসা সহ কমলা দিতে বানাতে হয় এটা। মার্মালেড ঠিক জ্যাম ও নয় জেলিও নয়। জ্যাম, জেলি আর মার্মালেডের পার্থক্য বলেছিলেন - কিছুই মনে নেই এখন। মার্মালেড বানানোর পরে সেটা খাওয়া যাবে কিনা এই সন্দেহ ছিল আমার। কিন্তু দেখা গেল খেতে বেশ ভালোই।

আমেরিকাতে আসার সময়ে আম্মা রান্না খাদ্য আর পুষ্টির এক কপি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। ওই বইয়ের কলেবর অনেক বড় হয়েছে। সিদ্দিকা কবীর সেলেব্রিটি হয়ে গেছেন এই বই লিখে। টিভিতে তাঁর রান্নার অনুষ্ঠান হয়। আমিও জানতে পেরেছি ডিম চিংড়ি ফুঃ উঃ বলে একটা খাদ্য আছে এই পৃথিবীতে।

মার্কিন দেশের আমি জ্যাম ও জেলি থেকে দূরেই থাকি। এই দেশের কেক, পেস্ট্রি, জ্যাম, জেলি আমার কাছে বেশি পদের লাগে না। অতিরিক্ত মিষ্টি মনে হয়। খাওয়ার পরে বিস্বাদ লাগে।

গত সপ্তাহে স্বাদ বদলানোর জন্য মারিয়া এক বোতল কমলার মার্মালেড কিনে নিয়ে আসলো। বোতলটা খোলা মাত্রই আমার আম্মার কথা মনে পড়ে গেল। ঢাকনা সরাতেই হুড়মুড় করে বাল্যকাল এসে দাঁড়ালো খাবার টেবিলে। রুটির মধ্যে মার্মালেড মাখাতে মাখাতে আমি একদম নির্ভুল আম্মাকে দেখতে পাই রান্নাঘরে। মৃত্যুর তিন বছর পরেও হঠাৎ হঠাৎ তিনি হাজির হন সময়ে অসময়ে, মার্মালেডের বোতলের মতো সামান্য জিনিস অসমান্য স্মৃতি নিয়ে আসতে পারে সেটা আমি জানতাম না।

আমাদের বাধাহীন শৈশব, কৈশোরের জন্য আম্মাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানো হয় নি। আমার স্মৃতিতে তাই বড় একটা নীল রঙের আকাশ আছে, রাতে রেললাইনের পাশ থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর আছে, উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাটি আছে, আকাশ জোড়া মেঘ আছে - ধুম বৃষ্টি পড়া স্বপ্নের শহর আছে, সেই শহরে বৃষ্টি শেষে বাতাসে নাবিস্কো বিস্কুটের গন্ধ ভাসে। পড়া নেই, পরীক্ষা নেই, স্বপ্নের ছিনতাইকারীরা নেই।

“All grown-ups were once children... but only few of them remember it.”

― Antoine de Saint-Exupéry, The Little Prince

আম্মা আপনাকে ধন্যবাদ। সম্ভবত আপনার কারনেই আমি শৈশব ভুলিনি। এক বোতল মার্মালেডও বালকবেলা ফিরিয়ে আনতে পারে। এই আশ্চর্য ভ্রমণের রাস্তাটা আপনিই বানিয়ে রেখেছেন, কেউ জানেনি, কেউ দেখেনি, কেউ বলে দেয়নি, তাও খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় নি। আপনাকে ধন্যবাদ।

"যা যায় তা আর ফিরে আসে না কখনো

ঠিক আগেকার মতো। পাখির ডানার

শব্দে সচকিত

সকালবেলার মতো আমার শৈশব

প্রত্যাবর্তনের দিকে ফেরাবে না মুখ

কস্মিনকালেও।

বাকদেওয়া মোরগের ধনুকের ছিলার মতোন

গ্রীবা, চৌবাচ্চায় একজোড়া সীমাবদ্ধ

হাঁসের সাঁতার, ভোরবেলাকার শিউলির ঘ্রাণ,

গ্রীষ্মের বিকেলে স্নিগ্ধ কুলপি বরফ,

মেরুন রঙের খাতাময় জলছবি,

সন্ধ্যার গলির মোড়ে কাঁধে মইবওয়া বাতিঅলা,

হার্নি সাহেবের হল্‌দে পুরোনো দালান,

খড়বিচালির গন্ধভরা মশা-গুঞ্জরিত

বিমর্ষ ঘোড়ার আস্তাবল, মেরাসীনদের গান

ধরে আছে সময়ের সুদূর তরঙ্গেমেশা আমার শৈশব।

মনে পড়ে, যখন ছিলাম ছোট, ঈদে

সদ্যকেনা জামাজুতো পরে

সালাম করার পর আমার প্রসন্ন হাত থেকে

স্বপ্নের ফলের মতো একটি আধুলি কিম্বা সিকি

ঝরে যেত ঝলমলে ঝনৎকারে আমার উন্মুখ

আনন্দিত হাতে।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সেই পাট চুকে গেছে কবে।

এখন নিজেই আমি ছোটদের দিই ঈদী বর্ষীয়ান হাতে,

আয়নায় তাকিয়ে দেখি আপনকার কাঁচপাকা চুল,

ত্বকের কুঞ্চন।

এই ঈদে জননীকে করলাম সালাম যখন,

অনেক বছর পরে আম্মা কী খেয়ালে অকস্মাৎ

দিলেন আমার হাতে দশ টাকার একটি নোট,

স্বপ্নে দেখা পাখির পালক যেন, আর

তক্ষুণি এল সে ফিরে অমল শৈশব

আমার বিস্মিত চোখে কুয়াশা ছড়িয়ে।"

(দশ টাকার নোট এবং শৈশব/শামসুর রাহমান)

এনচ্যান্টেড রক

Enchanted Rock - এই পাহাড়টার নাম। অস্টিন থেকে ১০০ মাইল দূরে। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাটি ফুঁড়ে পাথরের একটা গ্রানাইটের স্তুপ বের হয়ে গেছে। পাহাড়টার শরীর বেশ মসৃণ - গ্রানাইটের তৈরি সেই জন্যই। আরেকটু ঘষামাজা করলে সম্ভবত কিচেনের গ্রানাইটের মতো মসৃণ হয়ে যেতে পারে। এনচ্যান্টেড রকের উপরে খুব বেশি গাছপালা নেই। যদিও চারিদিকটা বেশ সবুজ। প্রথম মানুষ এখানে পা রেখেছিল ১১ হাজার বছর আগে। আমরা সব কিছুতেই লেইট। আমরা আগে একবার গিয়েছিলাম, কিন্তু উপরে উঠা হয় নি। অনেকদিন ধরেই এই পাহাড়ের চূড়াতে উঠার শখ আনুশার। বাকেট লিস্টে আছে।

গত সোমবার লং উইকেন্ডে সেখানে যাওয়া হল। আমরা পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এনচ্যান্টেড রকের উচ্চতা ১৮০০ ফিটের মতো। এই এলাকার ডাক নাম হচ্ছে হিল কান্ট্রি। খুব উঁচু পাহাড় নয়, কিন্তু চারিদিক দৃষ্টি নন্দন ও সবুজ। সামান্য বৃষ্টিতে আরও সুন্দর লাগছিল। মেঘগুলো মাঝে মাঝে এসে পাহাড়ের চূড়াতে জমা হয়ে ছিল।

পাহাড়টাতে মূলত দুটো ট্রেইল। একটা ট্রেইল চূড়াতে উঠেছে। অপরটা চারিদিক বেষ্টন করেছে। চূড়াতে উঠতে ৪৫ মিনিটের মতো লাগে। চারিদিকে ঘুরে আসতে ঘন্টা তিনেকের মতো লাগে। পৌঁছে জানা গেলে উপরে উঠার ট্রেইলটা বন্ধ, কেননা গ্রানাইটের পাহাড়ে বৃষ্টি হলে সেখানে থেকে আছাড় খেয়ে নিচে পড়ার সমূহ সম্ভবনা থাকে।

রেঞ্জার স্টেশনে একটা ভিডিও চলছিল। সেখানে নানান ধরণের সাপের ছবি দেখানো হচ্ছিল। আমি সাপের কথা জিজ্ঞেস করলাম পার্ক রেঞ্জারদের। টেনিদার এক গল্পে (চারমূর্তি) একজন অবাঙ্গালী জিজ্ঞেস করেছিলেন - জঙ্গলে ভাল্লুক আছে কিনা, এবং তারা মানুষকে কামড়াচ্ছেন কিনা - উত্তর ছিল সুযোগ পেলেই কামড়াচ্ছেন। আমার প্রশ্নটাও সেই ধারার হল। ট্রেইলের আশেপাশে সাপ কোন বিরল বস্তু না। কিন্তু তারা সুযোগ পেলেই কামড়াচ্ছেন না। সাপ মানুষকে ভয় পায়। মানুষ দেখলে তারা পালাতে চায়। তাদের সাথে দেখা হলে ভয়ের কিছুই নেই। আমরা পৌঁছানোর ৩০ মিনিট আগেই ট্রেইলে সাপ দেখা গেছে। বৃষ্টির দিনে তারা ঘর থেকে বেশি বের হয়। কিন্তু ধাওয়া আর পাল্টা ধাওয়ার সম্পর্ক না থাকলে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান সম্ভব।

সবচেয়ে বেশি সর্পাতংক দেখা গেল আনুশার। ট্রেইলে প্রচুর মানুষ। প্রাণী জগতের সবচেয়ে হিংস্র আর ভয়াবহ প্রাণী মানুষ। অন্য সব প্রাণী আমাদের ভয় পায়। টেকনিক্যালি ট্রেইলে মানুষ থাকাই সবচেয়ে বিপদজ্জনক ব্যাপার। এইসব বলে আমি আনুশার ভয় কাটানোর চেষ্টা করলাম। চারিদিক মনোরম। আকাশে প্রচুর মেঘ। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। তাপমাত্রা খুব অনুকূল। সব দিকেই দিগন্ত দৃশ্যমান। কোথাও কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। চুপ করে একটা জায়গাতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি নৈঃশব্দ সঙ্গীত শোনা যায়। অস্টিন থেকে মাত্র দুই ঘন্টা দূরে এতো সুন্দর একটা জায়গা ছিল সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। বৃষ্টিটা আজকে বোনাস প্রাপ্তি।

উপরে ওঠার ট্রেইল বন্ধ। তাই অপর ট্রেইল, যেটা পাহাড়ের চারিদিকে ঘিরে সেটাতে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটছি, থামছি, দূরের মেঘ আর বৃষ্টি দেখছি, বুনোফুল দেখছি, কাঠবিড়ালি দেখছি, আনুশা তীক্ষ্ণ নজর রাখছে কোন পথভোলা সাপ সামনে এসে দাঁড়ায় কিনা। তবে সৌন্দর্যের সামনে ভয় কোন ব্যাপারই না। আমরা প্রায় এক ঘন্টা হাইক করলাম।

একটু পরে অবশ্য বৃষ্টি আর দূরে রইল না। আমাদের মাথার উপরেই টিপটিপ করে পড়া শুরু হল। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হল অচিরেই এটা টিপটিপ থেকে কুকুর বেড়ালে রূপ নেবে। আর হাইক নয়, আমরা অর্ধেক ট্রেইল থেকে উল্টো দিকে দৌড় দিলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হল। বাকি ট্রেইল আর সামিট পরের ট্রিপের জন্য রেখে দিলাম। সাপ ধাওয়া না দিলেও বৃষ্টি ধাওয়া দিতে পারে।

আবারও অনেকবার যেতে হবে এখানে। বারবার যাওয়ার মতো একটা জায়গা। শীতকালে যাবো - সাপেরা তখন টেনে ঘুম দিবে। পরেরবার যাওয়ার আগে এনচ্যান্টেড রকের সুন্দর একটা বাংলা নাম খুঁজছি। রবীন্দ্রনাথ সব কিছুর নাকি বাংলা নাম দিয়ে দিতেন। রবিদাকে মিস করি।

নিচে এনচ্যান্টেড রকের নামকরণের গল্পটা জুড়ে দিলাম।

Folklore of local Tonkawa, Apache and Comanche tribes ascribes magical and spiritual powers to the rock (hence the name 'Enchanted Rock'). While attempting to hide from Anglo settlers in the area, the natives would hide on the top two tiers of the rock, where they were invisible from the ground below.

The first European to visit the area was probably Álvar Núñez Cabeza de Vaca in 1536. The Tonkawa, who inhabited the area in the 16th century, believed that ghost fires flickered at the top of the dome.

In particular they heard unexplained creaking and groaning, which geologists attribute to the rock's night-time contraction after being heated by the sun during the day. The name "Enchanted Rock" derives from Spanish and Anglo-Texan interpretations of such legends and related folklore.

আইয়ূব বাচ্চু

বেঁচে থাকার মধ্যে ক্লান্তি আছে। প্রতিদিন একই পথে হেঁটে যাওয়ার ক্লান্তি, একই কাজ করার ক্লান্তি, একই খাবার খাওয়ার ক্লান্তি, পুনরাবৃত্তির ছকে বন্দি হয়ে জানালার বাইরের হলুদ রোদ্দুর দেখার ক্লান্তি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন বরিশালের সেই সাদামাটা লোকটা। অমোঘ নিয়তির মতো তিনি লিখে রেখেছেন...

"অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—

আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;"

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের গল্প, উপন্যাস, সাহিত্য, গান আর শিল্প সব কিছুর পেছনেই যাপিত জীবনের ক্লান্তিটা বিরাট একটা কারণ। এই জঘন্য পৃথিবীর পুনরাবৃত্তিময় জীবনে কিছু লোক তাই খ্যাপার মতো স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখাতে চায়, ভালোবাসে, ভালোবাসাতে চায়। ভালোবাসা আর আনন্দ এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার ছোঁয়াচে রোগ। নিজের আনন্দে লেখা গল্প, নিজের আনন্দে গাওয়া গান তাই দেশ, কাল, সময়ের বাঁধা অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারে অন্য মানুষের কাছে। আমি দেখেছি চমৎকার একটা গান খুব সহজেই সাধারণ একটা দিনকে এক নিমেষেই অসাধারণ করে দিতে পারে।

ব্যান্ড সঙ্গীত ব্যাপারটা সম্ভবত বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। সব শিল্প সৃষ্টিরই যেমন কারণ থাকে তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উত্তাল সময়ের প্রোডাক্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত। এই সময়টা আসলেই ধরা পড়েছে ব্যান্ড সঙ্গীতে। অন্য কেউ যা বলতে পারেনি, লিখতে পারেনি - সেই সময়ে অর্বাচীন তরুণেরা অবলীলাতে বলে দিয়েছে...

"রেল লাইনের ওই বস্তিতে, 

জন্মেছিল একটি ছেলে 

মা - তার কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে

ও আমার বাংলাদেশে... "

আযম খান, লাকি আখন্দদের হাত ধরে যেই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আইয়ুব বাচ্চুরা তাকে অনেক পরিণত করেছেন। ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে শুরুতে অনেক কুলীন শিল্পীদের নাক সিঁটকানো থাকলেও ব্যান্ড সঙ্গীত সম্ভবত আজকের বাংলাদেশের মূলধারার সঙ্গীতের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল শিল্প মাধ্যমও। আইয়ুব বাচ্চুরা প্রমাণ করে দিয়েছেন আর সব কিছুর মতোই সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়, একে ভেঙ্গেচুরে গড়তে হয় - সঙ্গীতকেও বিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সহজিয়া কথার সাথে পাশ্চত্য যন্ত্রানুষঙ্গ সংমিশ্রন দিয়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছান যায় - আজকের বাংলাদেশে তাই সবচেয়ে বড় লোক সঙ্গীত সম্ভবত ব্যান্ডের গান।

আক্ষরিক অর্থে আজকের দিনটা শুরু হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। আজম খান, লাকি আখন্দের মতো বাচ্চুও চলে গেলেন অবেলাতে। আইয়ুব বাচ্চু প্রচুর গান গেয়েছেন, তার বহু বহু গান শোনার পরেও আমি আজকে টের পেলাম তার অনেক অনেক গান এখনও শোনা বাকি আছে। আর কোনদিন কোন কনসার্টে বাচ্চুর গান শোনা হবে না। আমি জানি না কোন কষ্ট, কোন ক্লান্তি আইয়ুব বাচ্চুকে গান করাতো। অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার। বাচ্চু আপনার কষ্টটা কি সেটা জানা হল না। কিন্তু গল্প শেষেও আপনি নিরব হননি, ভোর বেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যেই বাংলাদেশের ছায়াছবিটা আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে, তার আবহ সঙ্গীত আপনি আর আপনার বন্ধুরাই রচনা করেছেন। তাই এই মেঘলা সকালে আপনার মৃত্যু সংবাদ প্রিয়জন হারানোর কষ্ট নিয়ে আসে।

বিদায় প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু।

"হাসতে দেখ গাইতে দেখ

অনেক কথায় মুখর আমায় দেখ

দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা।।

বোঝে না কেউ তো চিনলো না

বোঝে না আমার কি ব্যথা

চেনার মত কেউ চিনলো না

এই আমাকে।।

আমার সুরের বুকে কান্না লুকিয়ে থাকে

আমার চোখের কোনে নোনা ছবি আকে

আমার গল্প শুনে হয় আলোকিত উৎসব

গল্প শেষে আমি আঁধারের মতো নীরব..."

স্ট্যাঞ্জা তিনেক

"আকাশের মেঘ থেকে গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি প'ড়ে ভিজে গেছে ধুলো,

এখন মাটির গন্ধ চারিদিকে টের পাওয়া যায়

স্টেশন ছাড়িয়া ট্রেন চ'লে গেল,- এঞ্জিনের কালো ধোঁয়াগুলো

চাঁদের আলোয় যেন বাদুড়ের মতন লাফায়!

আধ ঘণ্টা কেটে গেছে: একটা কি দুটো কালো মোটরের পিছে

ব্রুহ্যাম-ছ্যাকড়া গাড়ি চলে গেছে যে যাহার দিকে;

কারা এল? ঐ দূরে সাহেবের ল্যাণ্ডোর ল্যাম্প কি জ্বলিছে?

শব্দ নাই কোনো দিকে,- বাতাস ছাড়িয়া গেছে ঝাউ গাছটিকে।

এখন তোমার নাম ধরে ডাকি না আর- ভাবি শুধু- তুমি যে কোথায়!

এখানের ভিজে মাটি ঘাস পাতা ডালিয়ার কামিনীর ঘ্রাণে

কোনো পাখি জেগে নাই আমার মতন একা-একা অসহায়

এখন তোমার নাম ধরে ডাকি না আর- কই তুমি!- কেউ কি তা জানে!"

সাদাসিধে, একদম বিশেষত্বহীন লোকটা আজকে ধরাধম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই সময়, কলকাতা শহরে সেই অক্টোবরে তার জন্য শোকসভা হয়েছিল কিনা জানা নেই, কোথাও যেন পড়েছিলাম পত্রিকার একদম ভেতরের পাতায় তার মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছিল, কবি হিসাবে নয়, কলেজের শিক্ষক হিসাবে। কলকাতা শহরে নাকি ট্রাম দুর্ঘটনাতে একমাত্র মৃত্যুর ঘটনা এটা।

লোকটা দেশছাড়া হয়ে নিজের দেশের জন্য হাহাকার করত। স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। মাল্যবান নামে একটা উপন্যাস পাওয়া যায় (যেটা মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত) - সেটা পড়লে কবির দাম্পত্য জীবনের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। বইটা পড়ে আমার বইয়ের লেখককে তার ব্যক্তিত্বহীনতার জন্য পিটাতে ইচ্ছে করেছিল - বইয়ের আলোচনাতে লেখককে প্রহার করার ইচ্ছে নিয়ে লেখা নীতিবিরুদ্ধ কাজ হবে দেখে আর কোনদিনও সেটা নিয়ে লেখা হয় নি। জীবদ্দশাতে তিনি কবি হিসাবে খ্যাতি পাননি, কর্মজীবনে সফল হন নি, ব্যক্তিজীবনেও ব্যর্থতা বয়ে নিয়ে গেছেন - নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো লিখে গেছেন - মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে...

আপনার মৃত্যুতে কোথাও শোকসভা হয়েছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু জীবনানন্দ আপনার কবিতা নিজেই যেন শোকসভার মতো। কিসের শোক জানি না, কোথা থেকে উদ্ভব এই শোকের সেটাও জানা নেই, কোথায় এই শোকের শেষ কিছুই জানা নেই। হারিয়ে যাওয়া দেশ, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, হারিয়ে ফেলা আশ্রয় - সর্বহারা এক অসহায় শোক উঠে এসেছে কবি আপনার অতিপ্রাকৃত লেখনিতে। কবি মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কোন মানুষের পক্ষে এতো গভীর অন্তগর্ত শূন্যতা নিয়ে লেখা সম্ভব না। শুদ্ধতম কবি - আপনি নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো লিখে গেছেন - আর আপনাকে পাঠ করা তাই ঘোর লাগা অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে আসে।

"জানি— তবু জানি

নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—

আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;

লাসকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাসকাটা ঘরে

চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।"

 

চলে যাওয়া

তৌফিক আমেরিকাতে যাওয়ার দিন ওর বাসার সামনে তোলা। ১৯৮৯ সালের অগাস্ট মাসে। আমার ডান পাশে দাঁড়ানো মিঠু এখন পরলোকে - দেখতে দেখতে মনে হয় দুই বছরের বেশি হয়ে গেল। ১৯৯২/৯৩ সালের পরে ওকে আর দেখি নি, সুতরাং ওর এই চেহারাটাই আমার মনে থাকবে আজীবন, আমরা বুড়ো হয়ে যাবো তবু মিঠু আটকে থাকবে ২২ শে - ম্যাজিকালি।

তৌফিকদের এই বাসাটার ঠিকানা আমার এখনো মনে আছে, ধানমন্ডি ২৬ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাসা। সামনে সাজানো বাগান, পেছনে অনেকখানি জায়গা। অনেকটা যেন মফঃস্বল শহরের রেস্ট হাউজ রেস্ট হাউজ ভাব।

জনপ্রিয় টিভি নাটক একান্নবর্তীতে এই ঠিকানাটা ব্যবহার করা হয়েছিল, নাটকটা দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম, কিন্তু বাসাটা দেখায় নি। তৌফিকরাও ওই বাসা ছেড়ে চলে গেছে অনেক বছর আগে। এখন সম্ভবত ভেঙ্গে টেঙ্গে ফ্ল্যাট বানায়ে ফেলা হয়েছে। গত ২৫ বছরে ঢাকা শহরের যা পরিবর্তন হয়েছে সেটা প্রায় অভাবনীয়। ভালো এবং খারাপ সব দিকেই।

অথচ এক শীতকালে সন্ধ্যাতে আমরা ভূতের তাড়া খেয়ে ধানমন্ডি লেকের পাড় থেকে বেন জনসনের গতিতে দৌড় মেরেছিলাম। বর্তমানের ঢাকা শহর থেকে মানুষের তাড়া খেয়ে ভূতরা সব বিতাড়িত, এই ঠেলা চললে কিছুদিন পরে ভূতদের মতো হয়তো ভবিষ্যতও বিদায় নিবে এই শহর থেকে।

লেকের পাড়ে আগে প্রায়ই ঢোঁড়া সাপ দেখা যেত। ওদের দেখলেই আমি শিউরে উঠতাম। ওরাও অদৃশ্য - কিন্তু কয়েক বছর আগে লেকের পাড়ে গিজগিজ করা মানুষের ভিড়ে হঠাৎ আমি আধমরা একটা সাপ দেখে ভয়ের বদলে আনমনা হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল পুরানো বন্ধুর সাথে অনেকদিন পরে দেখা হয়েছে।

ঢাকাতে গেলে আমার প্রিয় জায়গাগুলো থেকে দূরে থাকতে চাই - আমার স্মৃতির শহরের সাথে কিছুতেই মেলানো যায় না, তবু কিছু কিছু শব্দ, গন্ধ, ছবি ঠিকঠাক ডেকে আনে অক্ষয় বালকবেলা...মনে হয় যেন সবকিছু রয়ে গেছে আজও চমৎকার...





ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি

আজকে হঠাৎ করেই লিখতে ইচ্ছে করল। লেখালেখি করার ইচ্ছেটা চলে গেছে। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। একটু মেঘলা - বিষণ্ণ। সূর্যের আলোতে আনন্দ থাকে, মেঘের ছায়া থাকলে কেমন যেন বিষণ্ণ লাগে। ব্যাপারটা সার্বজনীন - আমার একার কল্পনা না। মিডওয়েস্টে থাকার সময়ে শীতকালে প্রায়ই সূর্যের দেখা মিলত না - গোমড়ামুখ হয়ে থাকতো আকাশের। আমি মনে মনে সূর্যের প্রত্যাশা করতাম। ইনকারা সূর্যের পূজারী ছিল কেন আমি দুই বছরে বুঝে গেছি সেটা। বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হল। শীতকালের টিপটিপে বৃষ্টি সেই সাথে কনকনে একটা ঠাণ্ডা। হ্যালোউইনের বারোটা বেজে গেল। প্রতিবছর দরজায় যে পরিমাণ শিশুদের আনাগোনা হয় এবার মনে হয় সেটার ৩ ভাগের একভাগও হয় নি। রাতে একটু ভারী বর্ষণ। মেঘলা আকাশ দেখে বিষণ্ণ লাগলেও রাতের বৃষ্টির শব্দ কেমন ছেলেবেলার মতো আনন্দ নিয়ে আসে।

পৃথিবী তার আপন নিয়মে চলছে। আজকে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, গতকাল ট্রাম্পের লোকজনদের এফবিআই ধরে নিয়ে গেছে, গত সপ্তাহে ঢাকাতে মানুষজন ১৪ টা কুকুরের ছানাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিয়েছে, ফারুকীর নতুন ছবি ডুব মুক্তি পেয়েছে, ৩ বছর বয়েসি ভারতীয় শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে ডালাসের উপশহরে, আমি কানের অসুখ প্রতিহত করতে গোটা তিনেক ইঞ্জেকশন নিয়েছি, আমাদের প্রতিবেশিদের কুকুর ছানা হারিয়ে গেছে, এক বছর মহাশূন্যে অবস্থান করে নাসার নভোচারী স্কট কেলি এখানে ওখানে সেমিনার দিয়ে যাচ্ছেন - জগতের কোথাও কিছু থেমে নেই। আমি থাকলেও থেমে নেই - আমি না থাকলেও নেই। এরই মধ্যে হয়ত কারো নতুন ভালোবাসা হয়েছে, কেউ পুরনো সম্পর্ক ছেদ করেছে, কেউ সন্তান লাভ করেছে, কেউ সন্তানহারা হয়েছে। অন্তহীন উপন্যাসের মতো এই পৃথিবীর এবং তার মানুষগুলোর গল্প অধ্যায়ের পর অধ্যায় লেখা হচ্ছে অবিরত।

অনেক কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। শেষ পর্যন্ত কোন কিছুই লেখা হয় না আর। গত সপ্তাহে ছবিতে দেখলাম ফার্মগেটের কাছে শতবর্ষের পুরনো কিছু বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে। ছবি দেখে চমকে উঠলাম। আমার বাবা এক সময়ে অফিস করতেন ওই ভবনগুলোর একটাতে। বাল্যকালে আমি এবং আমার মেজভাই অনেকবার গিয়েছি সেইখানে। পুরনো দিনের বাড়ি যেমন হয় তেমন। একটু নোনাধরা দেওয়াল, উঁচু সিলিং, ঘড়ঘড় করে চলা ফ্যান, কালো রঙের প্রাগৈতিহাসিক ফোন। নিচের তলাতেই আব্বার পিয়ন রশীদভাইকে পাওয়া যাবে। উনি চা-বিস্কুট খাওয়াবেন, খুব মজার গল্প করবেন। ভবনগুলোর ছবি এবং ভেঙে ফেলার খবর দেখে একটু কষ্ট লেগেছিল প্রথমে, পরে চিন্তা করে দেখলাম ঢাকা শহর এখন যেই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিরাট কম্পাউডওয়ালা ছোট্ট ভবনের চেয়ে অট্টালিকার বেশি প্রয়োজন। স্মৃতি মাথার ভেতরেই থাকে - সেটার জন্য ভবনকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। স্মৃতির শহর বেঁচে থাকে স্মৃতিতেই - বাস্তবে না।

আমার যখন বারো বছর বয়েস তখন রাস্তা থেকে নেড়ি কুকুরের একটা বাচ্চা নিয়ে আমি পালা শুরু করি। আমরা জানতাম সাহেব মরলে পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহন করে (লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়ার মতো এটাও সামাজিক শিক্ষা) - এই কারনেই কুকুরের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। সেই সব ব্যাপার মাথায় রেখে আমি আমার কুকুরের নাম দিয়েছিলাম জো। কুকুর খুবই প্রভুভক্ত প্রাণী। জো আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো পাড়ায়। আমি কনফেকশনারি থেকে খুব সস্তা বিস্কুট কিনে খেতে দিতাম জো-কে, এতেই সে মহানন্দের লেজ নাড়তো। আমি স্কুলে যাওয়ার সময়ে সেও আমার সাথে যাওয়ার চেষ্টা করত। কুকুরের সাথে মানুষের বন্ডিং খুব দ্রুত হয় - খুবই জোরালো বন্ধন। জো এর গল্প করেছি মেয়েদের সাথে। জো কিভাবে হারিয়ে সেটা মনে পড়ে এখন আর। সম্ভবত সে একদিন আর ফেরৎ আসে নি। ঢাকাতেও পশু অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য একাধিক সংগঠন আছে - আমি ফেসবুকের মাধ্যমে একটার সাথে যুক্ত। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে সারাদিন কুকুরেরা ঘুমায় - দেখে মনে হয়েছে স্থানীয় খাবারের দোকান থেকে ওরা খাবার পায়। লেকের পাড়ের কুকুরদের অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছিল পশুপাখির প্রতি হয়তো একটু সদয় হয়েছে মানুষজন। আমি যখনই মানুষের উপর আস্থা আনার চেষ্টা করি তখনই কিছু হারামজাদা সেটার বারোটা বাজিয়ে দেয়। কুকুরের ছানাদের জ্যান্ত কবর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয় নি। এটা সহজে ভুলতে পারবো না।

ঢাকাতে শীতের আমেজ শুরু হয়েছে - দুই একজন লিখেছেন ফেসবুকে। অস্টিনেও শীতের শুরু হয়েছে মোটামুটিভাবে। ঢাকার শীতকাল (যেটা ছোট হতে হতে এখন মাত্র কয়েক সপ্তাহে গিয়ে ঠেকেছে) খুবই উপভোগ্য একটা জিনিস। আমরা প্রথম টের পেতাম রমনা পার্কের পাশ দিয়ে রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময়ে। হঠাৎ করে সামান্য শীতল বাতাস মনে করিয়ে দিত দক্ষিণায়নের দিন চলে এসেছে। লেপ, কাঁথা, সোয়েটার, জ্যাকেট বের করে রোদে দিতে হবে, স্কুলের পরীক্ষা শেষে সকাল থেকে সন্ধ্যে কাটবে গল্পের বইয়ের পাতায়, দিনগুলো আস্তে আস্তে ছোট হবে, বিকেলটা হবে কমলাটে এবং ধূলোমাখা, একটা সর্দিজ্বর, নরম ভাত, হালকা ঝোল, আদা দেওয়া গরম চা...

লেখাটা কেন শুরু করেছিলাম জানি না। বাইরের বৃষ্টির শব্দ আর ঘ্রাণ কিছু এলোমেলো করে দেয় আমাকে। আমি সংসার থেকে ছুটি পাই, জাভা প্রোগ্রামিং এর কামলা দেওয়া থেকে ছুটি পেয়ে যাই। পৃথিবীর যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় অখবর আর দুঃসংবাদ আর আমাকে স্পর্শ করে না। হাঁটুর ব্যথা, কানের ক্রমাগত শব্দ, সামান্য জটলাগানো মাথাব্যথা আমাকে আর ভাবায় না। বরং বাইরের বৃষ্টির শব্দ, সোডিয়াম লাইটে ভেজা কুয়াশা মোড়া রাস্তা, মধ্যরাতে ছুটে যাওয়া গাড়ি হঠাৎ ডেকে নিয়ে আসে আমার শৈশবকে।

আমি চুপচাপ ভ্রমণ করি আমার স্মৃতির শহরে।

"অকস্মাৎ দুপুরে চিলের ডাকে আমার শৈশব ফিরে আসে

শ্লেট, চকখড়ি আর বাদামি রঙের

ব্যাগ হাতে। গলিতে আবছা কন্ঠস্বর। আরো কিছু

প্রিয় স্মৃতি আলোড়নকারী শব্দ শোনার আশায়

ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি।"

(শামসুর রাহমান/ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি)