হাশেম স্যার আমাদের অংক করাতেন। ছোটখাটো মানুষ। বাদামি রঙের প্যান্ট আর সাদা সার্ট পরতেন। আমি স্যারকে এর বাইরের কোন পোশাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। স্যারের আলমারীতে এই রঙের অনেকগুলো জামা কাপড় থাকার কথা। একদম ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা স্যারকে পেয়েছি। ওনাকে দেখলেই আমরা খুশি হতাম। হাশেম স্যারের ক্লাস মানেই অবাধ ছুটি, মারধোরের কোন সম্ভবনা নেই। আনন্দঘন পরিবেশে ক্লাস চলবে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আনন্দ। সেই উদ্দেশ্য পুরোই সফল।
বড় হয়ে আমরা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে আড্ডা দেওয়ার সময়ে প্রায়ই স্যারকে দেখতাম, রিকশা করে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে যাচ্ছেন। একদিন তাঁকে এক ঘন্টায় তিনবার দেখা গেল, প্রতিবারই তিনি যাচ্ছেন, ফিরছেন না। এই রহস্যটা নিয়ে আমরা অনেকদিন আলাপ করেছি। সেই সময়ে আমাদের উনি অংক শিখাতেন। চ্যাপ্টারের প্রথম অংকটা করিয়ে উনি দুই থেকে পঞ্চান্ন নম্বর অংক হোমওয়ার্ক হিসাবে দিয়ে দিতেন। সঙ্গত কারণেই কেউ কোনদিন সেই হোমওয়ার্ক শেষ করেছে বলে আমি শুনিনি। একদম নিপাট ভালো মানুষ বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই। আমরা এই ভালোমানুষীর পূর্ণ সদ্বব্যবহার করে চলছি তখন। হাশেম স্যারের ক্লাস ছিল টিফিন টাইম শেষ হওয়ার পরের পিরিয়ডে। আমরা টিফিন টাইমে স্কুলে থেকে বের হয় স্যারের ক্লাস শেষ হওয়ার ঠিক আগে আগে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সিটে বসে পড়তাম। ক্লাসরুমের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে, ততদিনে আমরা সেই তথ্য পেয়ে গেছি। বাইরের পৃথিবীটা আমাদের ডাকছে - চিটাগং হোটেলের কিমা পরোটা থেকে বেনসন হেজেস সব কিছুতেই হাতেখড়ি করতে হচ্ছে।
আমাদের এই প্রতিদিনের অভিযান একদিন হেডস্যারের কানে গেল। উনি স্কুলে রেইড দিয়ে আমাদের গ্রেপ্তার করে হাশেম স্যারের ক্লাসে নিয়ে আসলেন। সব মিলিয়ে ১৫/২০ জন ছাত্র, ক্লাসের প্রায় অর্ধেক ছাত্রই আটকা পড়েছে এই শুদ্ধি অভিযানে। হেডস্যার এবং আরো কয়েকজন স্যার বিরাট বক্তৃতা দিলেন, আমাদের ইহকাল আর পরকাল দুইটাই প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এটা জানলাম। ক্লাসের ক্যাপ্টেন (যে বর্তমানে আমার প্রতিবেশি) কোথায় খোঁজা হল, তাকেও পাওয়া গেল গ্রেফতারকৃতদের তালিকাতে। আমাদের শাস্তি হিসাবে বেত্রাঘাত ধার্য হল। সবাই ১০ টি বাড়ি পাবে, ক্লাসের ক্যাপ্টেনকে ১৫ টি বাড়ি দেওয়া হবে। হেডসার ছাড়াও সেই বিচারসভাতে স্কুলের যাবতীয় টেরর স্যারের হাজির। হাশেম স্যারের ক্লাসেই সব হচ্ছে। উনি ঘটনার আকস্মিকতাতে বিমূঢ় হয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে যেই কেয়ামত সমাসন্ন তাতে আমাদের চেয়ে ওনাকেই বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছিল। বিচিত্র কারণে হেডস্যার বা অন্য স্যারেরা কেউ মারলেন না। যেহেতু হাশেম স্যারের ক্লাস থেকে নিত্যই আমরা পালাচ্ছি, সেহেতু ওনাকে দেওয়া হল শাস্তি কার্যকরের গুরুদায়িত্ব। হেড স্যার বেতগুলো সাথেই এনেছিলেন। হাশেম স্যারের হাতে ওগুলো দিয়ে সবাই চলে গেলেন।
হেড স্যার চলে গেলে হাশেম স্যার নাতিদীর্ঘ একটা ভাষণ দিলেন। মারধোর ওনার পছন্দ না, কিন্তু আমাদের বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছে, এই শাস্তি হেডস্যার বাধ্য হয়ে দিয়েছেন। আমাদের মঙ্গলের জন্য এই শাস্তি, হেডস্যার যেহেতু দিয়েছেন, এই শাস্তি কার্যকর হতে হবে। হাশেম স্যার বেত হাতে এগিয়ে এলেন - প্রথম অভিযুক্ত প্রস্তুত - স্যার অনেক উঁচুতে বেতটা নিয়ে প্রবল বেগে নিচে নামালেন এবং মারার ঠিক আগের মুহূর্তে বেতের গতিবেগ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসলেন। হালকা একটা টোকার মতো লাগলো মনে হয়। বাকিরা তটস্থ হয়ে ছিল, কিন্তু দেখা গেল প্রবল বেত্রাঘাত শরীর স্পর্শ করার আগে মোলায়েম রূপ ধারণ করছে। আমাদের চাপা হাসি আর চাপা থাকলো না। হাশেম স্যার একদম হেডস্যারের বিধান অনুযায়ী শাস্তি দিচ্ছেন আর পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির হুল্লোড়। ভয়ানক হতে পারতো এমন একটি দিন শেষ পর্যন্ত আনন্দমুখর হয়ে উঠল।
হিসেব করে দেখলাম এই ঘটনার পরে প্রায় ৩৫ বছর পার হয়ে গেছে। স্কুলের দিনগুলো প্রায় আগের জীবনের গল্পের মতো লাগে। আমার প্রতিদিনের বাস্তবতাতে তাদের কোন চিহ্ন নেই। সেই স্কুল পালানো বালকেরা এখন একেকজন ধূসর ভদ্রলোক, জীবন থেকে পালানোর কোন উপায় নেই তাদের, হেডস্যারের ভূমিকাতে জীবন নিজেই আছে। বেত্রাঘাত আছে অন্য পোশাকে - তাদের নাম দুঃখ, শোক, পরিতাপ, স্ট্রেস। আমাদের ব্যক্তিগত ক্লজেটে আছে বিষাদ আর হাহাকার।
আজকে সকালে খুব খুব ব্যস্ত ছিলাম কাজে। হঠাৎ করেই ফেসবুক বন্ধু ইসমাইলের ছবি ভেসে উঠল। ইসমাইল হাশেম স্যারের ছেলে - আমাদের সাথেই পড়ত। আমি স্কুল ছাড়ার পরে আর দেখিনি, কিন্তু ফেসবুকের কল্যানে আজকাল খবরাখবর পাই। সেই মধ্যবয়েসি ইসমাইলের মুখের রেখাতে হাশেম স্যারের আদল হঠাৎ করে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল ল্যাবরেটরি স্কুলের ক্লাস টেনের বারান্দাতে দীর্ঘ হতে থাকা এক বিকেল বেলায়। একটা ডেডলাইনের মিট করার জন্য প্রাণপণ কাজ করছিলাম, সেই ব্যস্ত দিনে হাশেম স্যার বাদামী প্যান্ট আর সাদা সার্ট পরে হাজির, সত্যি কথা বলতে এই চাপময় দিনটা চমৎকার গেছে স্যারের কল্যানে, ঠিক ৩৫ বছর আগের দিনটার মতোই। স্যারের জন্য আজও বেঁচে গেলাম।
আমি "দৌড়" নামে একটা লেখা লিখেছিলাম। তাতে আমাদের স্কুলের ভয়াবহ সব স্যারদের কথা বলেছিলাম। একজন মন্তব্যে বলেছিলেন ভালো স্যারদের কথাও যেন লিখি। হাশেম স্যারের কথা না লিখলে সম্ভবত অন্যায় হয়ে যাবে। আমার মনে আছে স্কুলের বারান্দাতে স্যারকে দেখলেই আমাদের আনন্দ হত, অন্য কোন স্যারের বদলে হাশেম স্যার ক্লাস নিতে আসলে প্রত্যেকেই খুশি হত। ভালোবাসার শক্তি ব্যাপক, তার ব্যাপ্তি বহুদূর - এই যে আজকে ৩৫ বছর পরে আপনাকে এই ব্যস্ত সকালে মনে পড়ে গেল - এই "হতে পারতো কঠিন" দিনটাও চমৎকার হল সেই অলখ ভালোবাসাটার জন্যই। সেই ভালোবাসাটাই প্রতিদিন দুর্লভ থেকে দুর্লভতর হয়ে যাচ্ছে।
আপনাকে আমাদের ধন্যবাদ জানানো হয় নি। ধন্যবাদ জানানো হয় নি আরো আরো অনেককেই। ক্রোধ আর না পাওয়াতে পরিপূর্ণ এই পৃথিবীতে ভালোবাসার কথাও ভুলে যেতে হয় হরদম। আপনাকে ধন্যবাদ প্রিয় হাশেম স্যার, এতোকাল পরেও আপনাকে নির্ভুল ঠিক ঠাক মনে পড়ে ব্যস্ত দিনের মাঝে।
যেইখানেই থাকুন, স্যার ভালো থাকুন।
###
No comments:
Post a Comment