আমার জীবনের প্রথম তুষারপাত দর্শন হয় লাবোকে। মাস্টার্স করতে আসার পরে। লাবোক পশ্চিম টেক্সাসে, বেশ অনেকটা উত্তরে এবং সেই সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উপরে। সব মিলিয়ে ভালোই ঠাণ্ডা পড়ে।
আসার কিছুদিন আগে টেক্সাস টেক থেকে একটা চিঠি এসেছিল আমার নামে, সেখানে বলা ছিল লাবোককে যেন টেক্সাসের গরম জায়গা না ভাবি আমি, শীতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসি। প্রস্তুতি হিসাবে সেই চিঠিতে বঙ্গবাজার সুপার মার্কেট থেকে শীতের কাপড় কিনে আনতে বলা হয়েছিল। আব্বা সেই চিঠি পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, কতদূরের দেশ লাবোক, ওরাও বঙ্গবাজারের কথা জানে।
চিঠিটা টেক্সাস টেক পাঠালেও, প্রস্তুত করে দিয়েছিল লাবোকের বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, আমার জীবনে যে কয়টা ভালো পরামর্শ পেয়েছি, তার অর্ধেকই ওই চিঠিতে ছিল মনে হয়। খুব গুছিয়ে বর্ণনা করা ছিল কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তখনও ইন্টারনেট সুলভ হয় নি। প্রতি কিলোবাইটের জন্য দাম দিতে হয় অগ্নি অনলাইন নামক আইএসপিকে।
লাবোকে ক্লাস শুরু করেছিলাম ফল সেমেস্টারে, দেখতে দেখতে নভেম্বর চলে আসলো। টেক্সাস টেকের ক্যাম্পাস থেকে আমি আর আমার রুমমেট জামিল বাড়ি ফিরছিলাম। ঠাণ্ডা পড়া শুরু হয়ে গেছে। লাবোক পুরোই সমতলভূমি, আর যথেষ্ট ফাঁকা। ক্যাম্পাস থেকে তাকালে রাস্তার অনেকদূর দেখা যায়, আকাশটা মনে হয় রাস্তার অন্য মাথাতে এসে মিশে গেছে। সেই আকাশের রংটা কেমন ঘোলা ঘোলা, ধূসর আর মলিন। সেই রাস্তা দিয়ে ধেয়ে আসছে শীতল বাতাস।
জামিল বিচক্ষণ ছেলে, কবিতার ধার ধারে না। কিন্তু সেই শেষ হয়ে আসা বিকেলে দূরের ঘোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জামিল বলল - শীতকালের রংটা এই রকম ঘোলাটে, মনে হয় শীতকাল ইজ কামিং। শীতের রং নিয়ে এমনই যুতসই বর্ণনা আমি আর কোথাও শুনিনি। জামিলের বর্ণনা শুনে ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হলো ক্যাম্পাসের উল্টোদিকের সরলরেখার মতো রাস্তা দিয়ে শীত আসছে, ঘোলাটে আর বিষণ্ণ একটা রং নিয়ে।
এর পরপরই আমাদের শহরে তুষারপাত হলো। আমরা বঙ্গবাজার মার্কেট থেকে কেনা জ্যাকেট চাপিয়ে সবিস্ময়ে বরফপড়া দেখতে লাগলাম। বৃষ্টির শব্দ থাকে, কিন্তু বরফ পড়ে নিঃশব্দে - আস্তে আস্তে সব কিছু ঢেকে গেল সাদা চাদরে। চারিদিক কেমন বাল্যকালে পড়া হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ন এন্ডারসনের রূপকথার মতো হয়ে গেল।
লাবোকের পরে আরও দুই বছর মিডওয়েস্টে ছিলাম। সব মিলিয়ে পাঁচটি শীতকাল দেখেছি। বরফ নিয়ে আমার রোমান্টিকতা উবে গেছে, শীতকাল শুরু হলে মনে হতো সেটা চেপে বসেছে বুকের উপরে। প্রতিবারই শীতের শুরুতে জামিলের কথা মনে হতো - মনে হতো দূর কোন পথ দিয়ে ধেয়ে আসছে ঘোলাটে শীতকাল।
মিডওয়েস্ট ছেড়ে গাড়ি চালিয়ে অস্টিনে রওনা দিয়েছিলাম এক নভেম্বর মাসে। সেইদিনও বরফ পড়ছিল, মনে হচ্ছিল এর পরে বরফ আর ছুঁতে পারবে না আমাকে। অস্টিনে বরফ বেশ দুর্লভ জিনিস। কয়েক বছর পর পর সে একবার দেখা দেয়, জীবন অতীষ্ট হওয়ার আগেই বিদায় নেয়। আমাদের কাজ খালি সেজেগুজে ছবি তোলা।
জানা ছিল আজ তুষারপাত হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেই আকাশটা দেখা পেলাম তাতে বহুকাল আগের লাবোক শহরের সেই ঘোলা ঘোলা শীতকালটা কথা মনে পড়ল। শীতের দেশের শীতকালটার রং আসলেই এই রকম। ঘোলা ঘোলা দুঃখ মাখা। যদিও শীতকালেও ঝলমলে সূর্য উঠে, কিন্তু আমার আজও মনে হয় শীতের রং-টাই ওই রকম।
আজকে অস্টিনে শীতকাল গেছে। একদম পাকা ঘোলা রং এর শীতকাল। সারাদিন বরফ পড়েছে, প্রায় চার ইঞ্চি। আমার প্রায় একুশ বছরের অস্টিন জীবনে দেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তুষারপাত। গত সপ্তাহেও অস্টিনে বসন্তের আবহাওয়া ছিল। ফোরকাস্ট বলছে আগামী বৃহস্পতিবার ৭০ ডিগ্রিতে উঠবে তাপমাত্রা। বরফ গলে বসন্তকাল চলে আসবে আবারও। অস্টিন ভালো লাগে আমার। শীতের দেশ থেকে পালিয়ে আসার জন্য নিজেকে আবারও বাহাবা দেই।
মেয়েরা মহা উৎসাহে বরফ নিয়ে খেলেছে, আর আমি বৃহস্পতিবারের অপেক্ষাতে আছি।
No comments:
Post a Comment