মেরি এলেন মার্কের নাম আমি আগে শুনিনি। আমি যেই দিনটিতে রেডিওতে ওনার নাম শুনলাম, সেইদিনটিতেই উনি এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। বলা যায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ ও সংক্ষিপ্ত জীবনের গল্প শোনার পর আমি তাঁকে খুঁজতে শুরু করি। মেরি এলেন মার্কের কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষদের নিয়ে এবং অনেক অনেক কাজ তিনি করেছেন ভাগ্যহত শিশুদের নিয়ে। তিনি মুম্বাই শহরে বালিকা পতিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন সিয়াটল শহরের হোমলেস শিশুদের নিয়ে। আগ্রহীরা গুগল করলে বা লাইব্রেরিতে খোঁজ নিলে তার আরও অনেক অনেক কাজের খবর জানতে পারবেন।
যেকোন মানবিক, পাশবিক, অর্থনৈতিক বা নৈতিক সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরা। সংকট যে এদের শৈশব কেড়ে নেয় তা নয়, ভয়াবহ এই দানবিক পৃথিবীর সামনে তাদের ছেড়ে দেয় - সীমাহীন অসহায়তার মধ্যে। যুদ্ধবিদ্ধ্বস্ত জনপদ নয় - আপাত শান্ত, সুন্দর সাজানো শহরেও প্রতিদিন ঘটে চলছে এই অমানবিকতা। রাষ্ট্র বা ঈশ্বর কোথাও পর্যন্ত এদের কান্না পৌঁছে না - ধর্মস্থানের পুরোহিতই কখনও কখনও নিপীড়ক হয়ে থাকে, নিপীড়ক হয় আপনজনও। শুধু যে দারিদ্রই অসহায়তা নিয়ে আসে তা নয়, অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের ভেতরেও অসহায় শিশুদের দেখা মিলে। ব্যাপারটা আমাকে নিয়ত পীড়া দেয়।
মেরি এলেন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বছর তিনেক আগে। এর কিছুদিন পরেই ন্যাশানাল পাব্লিক রেডিওতে এই ছবিটার খোঁজ পাই। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে নয় বছর বয়েসি ধুমপানরত একটা মেয়েকে, যার চালচলন বেশভূষা বড়দের মত। মেয়েটার নাম আমান্ডা। পেছনে তার কাজিনের ছবিও দেখা যাচ্ছে। ছবিটা তোলা হয়েছিল ১৯৮৯ সালের কোন এক সময়ে, নর্থ ক্যারোলিনার হতদরিদ্র কোনো পাড়াতে। সে পাড়াটার ডাক নাম "সিন সিটি"।
এই ছবিটার মধ্যে কোথাও যেন একটা বিশাল ক্ষত লুকিয়ে আছে। ছবিটা বিষণ্ণ করে দিতে বাধ্য। আমি যদি মুনি-ঋষী কেউ হতাম, তাহলে এই ছবিটা দেখার পরে পৃথিবী ধ্ব্বংস করে দিতে চাইতাম। আমাদের সামগ্রিক প্রাপ্তি, সমাজব্যবস্থা, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি গালভরা কথাকে একদম সরাসরি উপহাস করছে সিগারেট হাতে ধরা আমান্ডা। এই লেখার সাথে আর্টিকেলটা জুড়ে দেব, তাই বেশি ডিটেইলে যাচ্ছি না। আমান্ডা মেয়েটা বুদ্ধিমান ছিল, সে ভেবেছিল এই ছবিটা প্রকাশিত হলে হয়ত তার নরকবাসের অবসান হবে এবং হয়ত সে সুস্থ একটা জীবন পাবে। বাস্তবে না হয় নি, তাকে নানান টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে, নেশাও তার সঙ্গী হয়েছে। বুদ্ধিমান আমান্ডার কথা মেরি এলেনের মনে ছিল। তেমনি মেরি এলেনের কথাও আমান্ডার মনে ছিল। যদিও তার নাম বা পরিচয় ভুলে গিয়েছিল সে। আমার মতো আমান্ডাও মৃত মেরি এলেনকে খুঁজে বের করেছে, আর সেই সঙ্গে পত্রিকার পাতায় আবারও উঠে এসেছে আমান্ডা আর কাজিনদের ভুলে যাওয়া গল্পগুলো।
আমান্ডার বর্তমান বয়েস ৪০ এর কাছাকাছি। শৈশবের মতো তার বর্তমান জীবনও জটিলতাতে পরিপূর্ণ। যদিও অনেকখানি বাধা সে অতিক্রম করেছে। এনপিয়ারের রিপোর্ট বলছে...
"Ellison's adulthood is still tumultuous. She has served time in prison and says she is still "surrounded by crazy people and drugs." But she says her life has improved, and she wishes she could talk again with "that photographer lady."
আমি গুহাবাসী মানুষ। আমার সাথে প্রান্তিক বা অপ্রান্তিক জনগোষ্ঠির কারও সাথেই দেখা হওয়ার কথা না। তবুও আমি শিশুদের নির্মমতার শিকার হতে দেখেছি। খুব সামান্য গল্প - তাও মনে হয়েছে, আমান্ডা আর তার কাজিনেরা সর্বত্রই আছে। সবখানেই আছে। অন্য রূপে, অন্য পোষাকে, অন্য মোড়কে। এই পৃথিবীতে সুস্থ আর স্বাভাবিক ও সহজ জীবন পাওয়াটা অনেক অনেক শিশুর জন্যই দুর্লভ।
আমরা সমকামীদের অধিকার নিয়ে বলি, নারীর অধিকার নিয়ে বলি, সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে বলি, গণতন্ত্র আর প্রতিবাদ করার অধিকার নিয়ে বলি - আমরা কয়জন শিশুদের অধিকার নিয়ে মাথা ঘামাই?
No comments:
Post a Comment