-১-
সামারার জন্মের আগের রাতটা ছিল নভেম্বর মাসের ঠাণ্ডা এক রাত। পরদিন সকাল ছয়টার মধ্যে হাসপাতালে যেতে হবে। সি-সেকশন সার্জারি ঠিক করা হয়ে গেছে। আমাদের ঘরে তখন অলরেডি ২০ মাস বয়েসের একটা বাচ্চা আছে। সে তখনও পুরোপুরি কথা বলতে শিখেনি। সেই সন্ধ্যাবেলা আমার শিড়দাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। একটা বাচ্চা নিয়েই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। ২৪ ঘন্টা পরে এই সংখ্যা ঠিক দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আসছে ফাল্গুন না - পরদিনই আমরা দ্বিগুণ হতে চলছি।
-২-
পরদিনটা ছিল ঝকঝকে একটা দিন। শুক্রবার, ১০ই নভেম্বর ২০০৬ সাল। আমরা সময় মত হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। সামারাও সময় মত, অর্থাৎ সকাল ৭ঃ ৪৫ ধরাধামে আভির্ভূত হল। দুই দিন পরে ওকে নিয়ে আমরা বাসায় চলে আসলাম। মাত্র ২০ মাস আগে একই হাসপাতালে প্রথম সন্তানের জন্মের জন্য এসেছিলাম। উত্তেজনা, আনন্দ আর বিস্ময় নানান রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল, ঢাকা থেকে মারিয়ার মা-ও এসেছিলেন, আমরা জানতাম বাচ্চা পালা তত কঠিন কিছু হবে না। কিন্তু এই ২০ মাস পরে একই ভ্রমণে অনুভূতি ভিন্ন। আনন্দ আছে, উত্তেজনা আছে, এমনকি বিস্ময়ও আছে - কিন্তু এর সঙ্গে আছে মাত্রা ছাড়ানো শংকা। এই বার ঢাকা থেকে কেউ আসেনি, আর ২০ মাসের অভিজ্ঞতাতে আমরা বুঝে গেছি, ফেসবুকে বাচ্চাদের ছবি দেখা আর দিনরাত ২৪ ঘন্টা বাচ্চার দেখভাল করা সম্পুর্ণ ভিন্ন একটা জিনিস।
-৩-
আমরা দায়িত্বভাগ করে নিলাম। আনুশা আমার ভাগে, আর সামারা তার মায়ের। অচিরেই টের পেলাম, সামারা খুবই সুখী টাইপের বাচ্চা। খাওয়া, ঘুমানো আর বাথরুম - এই তিন জাগতিক কাজ ছাড়া আর কিছুই সে করে না। সারাদিন মায়ের সাথে লেপ্টে থাকে। ওর কান্নার আওয়াজ কদাচিৎ পাওয়া যায়। ওর সাথে বন্ধুত্ব করা একটু কঠিন। বড় হওয়ার পরে সামারাকে আমি বলেছিলাম ব্যাপারটা। সে স্মার্টলি জবাব দিল - আই ডিডন্ট নো ইউ দ্যাট ওয়েল। সামারা কথা বলা শুরু করল খুবই দ্রুত। এক বছর হওয়ার আগেই মোটামুটি মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারে। নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন, টনটনে জ্ঞান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবসার্ভেশন হল সামারার প্রিয় খাদ্য দুধ, যার ডাক নাম দুদু।
-৪-
সামারাকে বড় করার পেছনে সর্বশেষ আইটেম - মানে দুধের ভূমিকা বিস্ময়কর। সামারার হাতে প্রায় সব সময়েই দুধের একটা বোতল থাকে। আনন্দে থাকলে ওখান থেকে ঢোক গিয়ে দুধ খায়, দুঃখ আর বেদনার সময়েও একই ব্যাপার। আমাদের ফ্রিজে সব সময়েই প্রচুর দুধ মজুদ থাকে। একদিন অফিসে মারিয়া ফোন করে জানালো বাসায় কোন দুধ নেই। কোন এক ফাঁক দিয়ে ভুলবশত দুধ কেনা হয় নি। সামারা দুধের জন্য কাঁদছে। ফোনের পেছনে আমি সামারার ফোঁপানি শুনতে পেলাম - দুদু দুদু বলে হাহাকার করছে। আমি জরুরী মিটিং মুলতবি ঘোষণা করে দ্রুত দুধ কিনে বাসায় আসলাম।
-৫-
সামারা দুগ্ধপ্রীতির ব্যাপারটা গোপন রইল না। পাড়া প্রতিবেশি, এমনকি ডাক্তারও জেনে গেলেন। দুধ পেলেই সামারা শান্ত হয়ে যায়। সামারার ডাক্তার চার্টের এক কোনাতে লিখে রাখলেন - Dudu. টিকা দেওয়ার সব প্রস্তুত, উনি চার্টের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন - Get the dudu ready, আমরাও প্রস্তুত। ঘ্যাচাং করে সুই নেমে এল, চিৎকার থামানোর জন্য সাথে সাথে দুধের বোতল দিয়ে দেওয়া হল মুখের ভেতর। সব ঠাণ্ডা। আমার মাঝে মাঝে মনে হত বোরডেন ফুল মিল্কের একটা বড় ছবি টাঙ্গিয়ে রাখি বাসার দেওয়ালে।
-৬-
আনুশা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। হারমনি স্কুল অফ সায়েন্স। নানান জ্ঞান বিজ্ঞানের জিনিস শিখছে। একদিন শিখে আসলো ম্যামাল। আনুশা ম্যামালের অর্থ জানালো - যারা দুধ পান করে। স্কুলের হোমওয়ার্ক হচ্ছে পাঁচটা ম্যামালের নাম লিখতে হবে। সংগত কারণেই লিস্টের প্রথম নামটা উঠল সামারার। আমি জানালাম আমিও ম্যামাল প্রজাতির প্রাণী, আমারও নাম থাকা উচিত ওই লিস্টে। আনুশা এই যুক্তি নিল না। কার্যত আমাকে কোন দিন সে দুধ খেতে দেখে নি। আমি দুধের গন্ধই সহ্য করতে পারি না। অনেক বুঝিয়ে লাভ হল না। ম্যামালের খাতা থেকে আমার নাম কাটা গেল।
-৭-
আমার সেই দুগ্ধপ্রেমি মেয়েটা ১২ বছর শেষ করল এই পৃথিবীতে। সেই সাথে আরও অনেক পরিচয় আছে এখন। পশুপ্রেমি, এক রোখা, স্যারকাস্টিক, ম্যাথ হেইটার, ড্যাডি'স গার্ল ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবন একটা সময় পর্যন্ত খুব সরল পথে চলে। এখনও চলছে। কিন্তু সেই সরল পথ আর সরল থাকে না, জটিলতা এসে প্রবেশ করে নানান ফাঁকফোকর দিয়ে। দুধের বোতল দিয়ে আর সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যায় না। সেই জন্য লাগে সাহস । এই উপাদানটাও যথেষ্ট পরিমানে আছে সামারার। মুখের উপর উচিত কথাটা সে বলে দিতে পারে। স্যার্কাজম নামক অস্ত্রটাতে সে প্রতিনিয়ত শান দিয়ে রাখছে। টার্গেট প্র্যাক্টিস করার জন্য বাবা নামক ডার্টবোর্ড রেডিই আছে।
বাচ্চাদের বড় হওয়া সম্ভবত সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দুঃখজনক একটা ব্যাপার। প্রতিদিনই বাস্তব জীবন একটু একটু পায়ে এগিয়ে আসছে। সামারা প্রস্তুত। কিন্তু আমি না। আমার কাছে সামারা সেই দুধের বাচ্চা, সবুজ রঙের দুধের বোতল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সেই ছোট্ট পাখি।
সারজীবনই তাই থাকবে। সব সময়ের জন্যই, সদা এবং সর্বদা। শুভ ১২!!! শুভ জন্মদিন মা!!
No comments:
Post a Comment