আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। কেউ কেউ তাকে আজাসি বলতো, দুষ্ট ছেলেরা আড়ালে আসাদুজ্জামান টিকটিকি বলে ডাকতো। উনি প্রায়ই সাদা প্যান্ট, হাফশার্ট পরে স্কুলে আসতেন। দেখে মনে হতো ক্রিকেট খেলতে বা মাছ ধরতে যাবেন। দ্বিতীয় কাজটা উনি সত্যি সত্যি করতেন। ছোটখাটো ঠাণ্ডা মানুষ। একবার তিনি ক্ষেপে গেলেন। স্যার কি একটা কাজে সেন্ট জোসেফ স্কুলে গিয়েছিলেন। ওইখানে গিয়ে দেখেছেন ক্লাসের বোর্ডগুলো অনেক চওড়া। আরও অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে চক দিয়ে লিখতে লিখতে অন্য মাথায় চলে গেলে সেখানেও মোছার জন্য একটা ডাস্টার। অর্থাৎ দুটো ডাস্টার।
পক্ষান্তরে আমাদের ল্যাবরেটরি স্কুলে চিপা একটা ব্ল্যাক বোর্ড। দুঃখের বিষয় কোন ডাস্টারও নেই, চক মোছার জন্য একটা ময়লা ন্যাকড়া। স্যারের গলার স্বর সাধারণতঃ নিচু থাকতো, পড়ানোর সময় সেটা নিচে নামতে নামতে প্রায় শ্রবণসীমার নিচে নেমে যেত। কিন্তু স্যার মাঝে মাঝে ন্যাকড়া হাতে নিয়ে সেন্ট জোসেফ স্কুলের ডিলাক্স বোর্ড আর ডাস্টার নিয়ে হাহাকার করতেন। তখন স্যারকে আমরা পরিস্কার শুনতে পারতাম। না-দেখা সেন্ট জোসেফ স্কুলের বোর্ডের কারণে সংকুচিত বোধ করতাম। কিন্তু আমরা কোনদিন ডাবল ডাস্টারের লেভেলে পৌঁছাতে পারি নি। আমাদের ব্ল্যাকবোর্ডও বড় মনিটরের মতো উদার হতে পারেনি।
আমার অফিস রুমে একটা হোয়াইট বোর্ড আছে। রুমে আরও লোক থাকার ব্যবস্থা থাকলেও লে-অফের কবলে পড়ে এখন আমি একমাত্র ব্যক্তি। সেইদিন এক সহকর্মী এসে বলল - আরে তোমার রুমের হোয়াইট বোর্ডটা দেখি বেশ চওড়া আর বোর্ডের দুই কোনাতে তুমি দেখি দুটো ইরেজার (ডাস্টার) রেখেছো।
আমি কিছুই রাখি নি, ওই দুটোর একটাও আমি জোগাড় করিনি। কে জোগাড় করেছে সেই ধারনাও আমার নেই, কে জানে সে হয়তো সেন্ট জোসেফ স্কুলের ছাত্র ছিল।
কিন্তু এটা যে রাখলে অনেক সুবিধা, সেটা আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী স্যার বারবার বলতেন। অনেক হাহুতাশ করতেন। স্যার কলকাতায় চোখের চিকিৎসা করতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। নিঃসন্তান ছিলেন - কলাবাগানের বাসার সামনে বসে রেডিওতে খেলা শুনতেন। সামনের রাস্তায় ছাত্রদের কাউকে দেখতে পেলে ডাকতেন - আমার অনেক সিগারেট ফেলে দিতে হয়েছে ওনার কারনে।
আমার কলিগ দুটো ডাস্টারের একটা নিয়ে চলে গেল। আমার দেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল না। আমি সাপ্লাই ক্যাবিনেট খুঁজে-পেতে আরেকটা ডাস্টার পেলাম, শূন্যস্থান পূরণ করে দিলাম।
মনে মনে আমি ৩০ বছরের পুরনো একটা সমস্যার সমাধান করলাম - আর হঠাৎ করেই জেলখানার মতো এই অফিসে ঢুকে পড়ল এক টুকরো শৈশব।
No comments:
Post a Comment