"আকাশের মেঘ থেকে গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি প'ড়ে ভিজে গেছে ধুলো,
এখন মাটির গন্ধ চারিদিকে টের পাওয়া যায়
স্টেশন ছাড়িয়া ট্রেন চ'লে গেল,- এঞ্জিনের কালো ধোঁয়াগুলো
চাঁদের আলোয় যেন বাদুড়ের মতন লাফায়!
আধ ঘণ্টা কেটে গেছে: একটা কি দুটো কালো মোটরের পিছে
ব্রুহ্যাম-ছ্যাকড়া গাড়ি চলে গেছে যে যাহার দিকে;
কারা এল? ঐ দূরে সাহেবের ল্যাণ্ডোর ল্যাম্প কি জ্বলিছে?
শব্দ নাই কোনো দিকে,- বাতাস ছাড়িয়া গেছে ঝাউ গাছটিকে।
এখন তোমার নাম ধরে ডাকি না আর- ভাবি শুধু- তুমি যে কোথায়!
এখানের ভিজে মাটি ঘাস পাতা ডালিয়ার কামিনীর ঘ্রাণে
কোনো পাখি জেগে নাই আমার মতন একা-একা অসহায়
এখন তোমার নাম ধরে ডাকি না আর- কই তুমি!- কেউ কি তা জানে!"
সাদাসিধে, একদম বিশেষত্বহীন লোকটা আজকে ধরাধম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই সময়, কলকাতা শহরে সেই অক্টোবরে তার জন্য শোকসভা হয়েছিল কিনা জানা নেই, কোথাও যেন পড়েছিলাম পত্রিকার একদম ভেতরের পাতায় তার মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছিল, কবি হিসাবে নয়, কলেজের শিক্ষক হিসাবে। কলকাতা শহরে নাকি ট্রাম দুর্ঘটনাতে একমাত্র মৃত্যুর ঘটনা এটা।
লোকটা দেশছাড়া হয়ে নিজের দেশের জন্য হাহাকার করত। স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। মাল্যবান নামে একটা উপন্যাস পাওয়া যায় (যেটা মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত) - সেটা পড়লে কবির দাম্পত্য জীবনের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। বইটা পড়ে আমার বইয়ের লেখককে তার ব্যক্তিত্বহীনতার জন্য পিটাতে ইচ্ছে করেছিল - বইয়ের আলোচনাতে লেখককে প্রহার করার ইচ্ছে নিয়ে লেখা নীতিবিরুদ্ধ কাজ হবে দেখে আর কোনদিনও সেটা নিয়ে লেখা হয় নি। জীবদ্দশাতে তিনি কবি হিসাবে খ্যাতি পাননি, কর্মজীবনে সফল হন নি, ব্যক্তিজীবনেও ব্যর্থতা বয়ে নিয়ে গেছেন - নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো লিখে গেছেন - মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে...
আপনার মৃত্যুতে কোথাও শোকসভা হয়েছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু জীবনানন্দ আপনার কবিতা নিজেই যেন শোকসভার মতো। কিসের শোক জানি না, কোথা থেকে উদ্ভব এই শোকের সেটাও জানা নেই, কোথায় এই শোকের শেষ কিছুই জানা নেই। হারিয়ে যাওয়া দেশ, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, হারিয়ে ফেলা আশ্রয় - সর্বহারা এক অসহায় শোক উঠে এসেছে কবি আপনার অতিপ্রাকৃত লেখনিতে। কবি মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কোন মানুষের পক্ষে এতো গভীর অন্তগর্ত শূন্যতা নিয়ে লেখা সম্ভব না। শুদ্ধতম কবি - আপনি নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো লিখে গেছেন - আর আপনাকে পাঠ করা তাই ঘোর লাগা অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে আসে।
"জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।"
No comments:
Post a Comment