Tuesday, January 5, 2021

পারিপার্শ্বিকের আড়ালে

মাঝে মাঝে আমি স্বপ্নে ঢাকা শহর দেখি। আমার স্বপ্নগুলো চিত্রায়িত হয় অল্প কিছু জায়গাতে - তেজগাঁ, মগবাজার, উত্তরা, পলাশী, নিউমার্কেট - অর্থাৎ যেখানে আমার যাতায়ত ছিল। পুরনো ঢাকা অনেকটাই অচেনা আমার, আমার স্বপ্নেও সেও আসে না। গত রাতের স্বপ্নে রিকশাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করছিলাম। নীলক্ষেত থেকে ধানমন্ডি আট নম্বর রোডের ভাড়া সে এক হাজার টাকা চেয়েছিল। এর বিপরীতে আমি একশ টাকা বলেছিলাম। সেই থেকেই বাদানুবাদ।

ঘুম থেকে উঠে মনে হইলো একশও সম্ভবত বেশি। ভাড়াটা ঠিক কত হওয়া উচিত সেইটা চিন্তা করে বের করতে পারলাম না। একটা শহরে বাস্তবে না থাকলে এই রকম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে না থাকার সুবিধাও আছে। ঢাকা প্রায় নরকের মতো একটা শহর। স্বপ্নে সেই পীড়াটা আমাকে নিতে হয় না। বাংলাদেশে যা যা ঘটছে সেটা নিয়ে চিন্তা কম করি, কিছু লেখিও না। গত কয়েক বছর ধরে এক ধরণের "ডিসএনগেইজমেন্ট" (বাংলা কি হবে এর?) আনার চেষ্টা করেছি। কাজ হয়েছে। এরচেয়ে অনেক ভালো ভোর রাতে নীলক্ষেত থেকে ধানমন্ডির রিকশা ভাড়া নিয়ে চিন্তা করা। কিন্তু এই শহরে আমার অনেক আত্মীয় সুহৃদ বাস করেন, আমি মাঝে মাঝে ভাবি তাদের কাছে ঢাকা শহরকে কেমন লাগে? কেমন লাগে পত্রিকার পাতার শিরোনামগুলো? তারা বাস্তবতা থেকে কিভাবে দূরে থাকেন? পীড়িত হন নাকি ডিসএনগেইজ করার চেষ্টা করেন পারিপার্শ্বিক থেকে?
আমেরিকা নিয়েও চিন্তা কম করবো ঠিক করেছি। বাংলাদেশ উদ্ভট উঠের পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই ছেলেবেলাতেই শামসুর রাহমানের কবিতার এই লাইনগুলো বোধগম্য হয়েছিল। আমেরিকাও সম্ভবত উদ্ভট SUV এর পিঠে চড়ে যাচ্ছে কোথাও। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না ঠিকই, কিন্তু চোখ খোলা রেখে কি লাভ হবে সেই বিষয়ে কবি কোন নির্দেশনা দিয়ে যান নি।
আনুশা স্কুলে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়ছে। পড়ে টড়ে ওর মনে হয়েছে নির্বাণপ্রাপ্তি ব্যাপারটা খুবই চমৎকার একটা জিনিস। সমাজ, সংসার, দেশ বা শহর - আমরা যে মানবিক বা দানবিক সমাজে বাস করি সেইখান থেকে নির্বাণপ্রাপ্তি অসম্ভব, বরং চেষ্টাচরিত্র করলে নিজেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। নির্বাণপ্রাপ্তি সম্ভব না হলে আমরা নির্বাণ-Lite এর জন্য চেষ্টা করতে পারি। আমার ধারণা গল্প, কবিতা, গান এইগুলোর তৈরি হয়েছে এর জন্য। আমরা সাময়িক হলেও অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে চলে যেতে পারি। শামসুর রাহমান একটা কবিতা লিখেছিলেন ঢাকাকে নিয়ে, কবিতাটির নাম পারিপার্শ্বিকের আড়ালে - অল্টারনেট রিয়েলিটির মতো লাগে আমার কাছে।
মধ্যরাতে ঢাকা তার রহস্যের অন্তর্বাস খুলে বলে-
ফিরে এসো তুমি
শুধু মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হয়ে যায়,
অতিকায় টেলিফোন নেমে আসে গহন রাস্তায় জনহীন
দীর্ঘ ফুটপাত
ছেয়ে যায় উঁচু ঘাসে আর সাইনবোর্ডের বর্ণমালা
কী সুন্দর পাখি হয়ে রেস্তোরাঁর আশপাশে ছড়ায় সংকেত
একজন পরী হ্যালো হ্যালো বলে ডায়াল করছে অবিরাম
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড় ফাঁকা হয়ে যায়।
গত কয়েকমাস কোন বই পড়িনি (আমি বিশাল পাঠক না যদিও), নেটফ্লিক্সে নতুন কিছু শুরু করিনি, পুরনো কবিতা পড়ি নি শুধু কাজ করে গেছি, নির্বাচন ঘনিয়ে আসাতে টিভিতে খবর দেখেছি। দিনগুলো মনে হয়েছে অনন্তকালের সমান। দুই দিন ছুটি নিয়েছি, নিজের জন্য, নিজের কাছে বেড়াতে যাবার জন্য। গত সপ্তাহে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে নদীর পাড়ে একটা বাঁধের উপর উঠেছিলাম। চাঁদটা কেমন হলদেটে থেকে আস্তে আস্তে সাদা হয়ে গেল, সান্দ্র জোছনটা মিশে গেল চারিদিকে। এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। হাহাকারের মতো মনে হয়...
মনে হয় একদিন আকাশে শুকতারা দেখিব না আর ;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে একঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায় – দেখিব না আর আমি এই পরিচিত বাঁশবন ,
শুঁকনো বাঁশের পাতা -ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে – লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জোছনায় – হিজলের বাকা ডাল করে গুঞ্জরন ;
আজকের লেখার আরেকটা কারণ আছে। আমার ভুল না হলে গতকাল আমার এই অস্টিন শহর বাসের ২০ বছর পূর্ণ হলো। আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অধিকাংশ সময়টাই এই শহর কেটে গেছে। টেক্সাসের শহরগুলোর মধ্যে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হলে অস্টিনের প্রথম স্থান কেউ ঠেকাতে পারবে না। পাহাড়, নদী, লেক ঘেরা শহরটা নিয়ে তেমন কিছু লিখিনি, এই শহর এখনও বর্তমান, যদি অতীত হয়ে যায় কখনও, তখন হয়ত ভেতর থেকে এই শহরের গল্পগুলো উঠে আসবে।
লেখাটা শেষ করি গত সপ্তাহে দেখা চাঁদের ছবি দিয়ে। মোবাইলে তোলা, সৌন্দর্য খুঁজতে গেলে বৃথা হয়রানি হবে।



No comments: