"আব্বু দাদাভাইয়ের একবার নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স হয়েছিল না?"
আজ রবিবার। আমাদের টাকো দিবস। প্রায় প্রতি রবিবারই আমরা মেক্সিক্যান খাবার খাই। আজকে দুই কন্যাসহ চলছি টাকো বেল নামক ফাস্ট ফুডের দোকানে। এই সময়টাতে মেয়েদের সাথে বিশ্বসংসার নিয়ে আলাপ করি। আরিয়ানা গ্রান্ডে থেকে করে উত্তর কোরিয়া - আমাদের আলাপের কোন সীমারেখা নেই।
আব্বার কাছে শুনেছিলাম - উনি একবার বাল্যকালে কী একটা অসুখে প্রায় মরতে বসেছিলেন। সেই গল্প মেয়েদের কাছে বলেছিলাম। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে যেসব লেখা পড়েছিলাম আব্বার বর্ণনার সাথে সেইগুলোর মিল আছে। উনি আলোকময় এক টানেল নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।
"আমার ধারণা ওই টানেলটা আগের জন্ম আর পরের জন্মের ব্রিজ। জন্মের ঠিক পর পর যেই উজ্জ্বল আলো আমরা দেখি সেই আলোটাই আগের জীবনের শেষে টানেল দিয়ে দেখা যায়..."
আমি চমৎকৃত হলাম। এটা প্রায় উপন্যাসের প্লট হতে পারে। জন্ম থেকে জন্মান্তরে টানেল দিয়ে যাওয়া আসা...
আনুশা বলে চলে - আগের জন্মের মৃত্যুর কারণটা হয় এই জন্মের সবচেয়ে ভীতিকর জিনিস।
"আব্বু তুমি কী সবচেয়ে ভয় পাও?"
আমার ভয় মাকড়শা। আনুশার বক্তব্য অনুযায়ী আগের জন্মে আমি মাকড়শার কামড়ে পঞ্চত্ব পেয়েছিলাম। খুবই সম্ভব। ফেলুদার বইতে ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারের কথা পড়েছিলাম। এক কামড়ে পরকালের টানেলে ফেলে দিতে পারে তারা।
আনুশার ভয় এলিভেটর, সামারা ভয় পায় বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি। আগের আর এই জন্মের পারাপারের ব্যাখাটা সহজ - ঝড়বৃষ্টি, লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত কারণ হতে পারে।
"কিন্তু মা-যে বিড়াল ভয় পায়..."
আগের জন্মে মারিয়া কি বিড়ালের আক্রমণে নিহত হয়েছিল? সেটা কিভাবে সম্ভব?
"বাঘের কামড়ে হয়ত - বাঘ আর বিড়াল একই পরিবারের।" গত জন্মের সেই বাঘের ডিনার হওয়ার স্মৃতিই এই জন্মে বিড়ালদের প্রতি অসঙ্গত অপ্রীতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বাংলাভাষাতে জাতিস্মর বলে একটা শব্দ আছে, যার অর্থ হচ্ছে আগের জন্মের স্মৃতি মনে পড়া। আনুশাকে জানালাম। আমাদের অঞ্চলে সম্ভবত পূর্বজন্ম আর পরজন্ম স্বীকৃত বিষয়।
"ডু ইউ রিমেমবার এনি থিং ফ্রম ইয়োর পাস্ট লাইফ?"
"নারে মা। এই জন্মের অনেক স্মৃতিই এতো ফিকে হয়ে গেছে যে মাঝে মাঝে সেইগুলো আমার বিগত জন্মের ছায়াছবি মনে হয়।"
"এই রিসাইকেল কতদিন চলে রে?" - আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
"আমি জানি না। বাট আই থিং ফাইনালি ইয়ু উইল হ্যাভ এনাফ অফ ইট অ্যান্ড ইট উইল এন্ড দেয়ার"
অনেকটা নির্বাণপ্রাপ্তির কনসেপ্ট ধরে ফেলেছে আনুশা।
আমি ক্লান্ত বোধ করি। এই খরদুপুরে টাকোর দোকানে যাওয়ার পথটা বড় লম্বা মনে হয়। এই জীবন কোনমতে পার করলেও লাভ নেই তাহলে? টানেল দিয়ে আরেকটা জীবনে যেতে হবে। এরপর আরেকটা...তারপর আরো একটা...এই অনন্ত যাত্রার মানে হয় কোন? আমি ভাবার চেষ্টা করি। আমরা কেউই মরতে চাই না। স্বর্গে গভীরভাবে বিশ্বাসী মানুষও স্বর্গে যাওয়ার জন্য কোন ব্যগ্রতা দেখায় না। গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। পরজন্ম, আত্মা, পুনরুত্থান প্রায় সবগুলো ধর্মেরই অনুষঙ্গ। আমাদের যাবতীয় ধর্ম, বিশ্বাস, ফিলোসফি আমাদের সুক্ষ্মভাবে অমরত্বের লোভ দেখায়। এই জীবন শেষ হয়ে গেলে গাঢ় অন্ধকার - ঠিক জন্মের আগের মতোই, সেটা বড়ই আনরোমান্টিক, অজানা এবং কিছুটা ভীতি উদ্রেককর। সামনে মূলো না থাকলে ভালো বা খারাপ কোন কাজেই উৎসাহ আসে না।
কিন্তু অমরত্ব আমার কাছে ক্লান্তি নিয়ে আসে। নগদে যা আছে সেটাই উপভোগ করার চেষ্টা করি। পরজন্ম, স্বর্গ বা নরক আমাকে টানে না। এই জন্মটাই বড় ভালো লাগে। ভালো লাগে এই দুপুরবেলাটা, বাইরের কড়কড়ে রোদ্দুরটা, সামান্য জট লাগানো মাথার সুক্ষ্ম যন্ত্রণাটা, শাপশাপান্ত করা এই জীবনটাই ভালো লাগে, ভালো লাগে এই দুটো মেয়ের সাথে থাকতে। আমি আর কোথাও যেতে চাই না, অন্য কোন জীবনে, ভিন্ন কোন নরকে অথবা অচেনা কোন স্বর্গে।
টাকো চলে এসেছে। আমি কামড় দেই। ভালো লাগে।
"আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
(ঊনিশশো চৌত্রিশের/জীবনানন্দ দাশ)
No comments:
Post a Comment