Tuesday, January 5, 2021

ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি

আজকে হঠাৎ করেই লিখতে ইচ্ছে করল। লেখালেখি করার ইচ্ছেটা চলে গেছে। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। একটু মেঘলা - বিষণ্ণ। সূর্যের আলোতে আনন্দ থাকে, মেঘের ছায়া থাকলে কেমন যেন বিষণ্ণ লাগে। ব্যাপারটা সার্বজনীন - আমার একার কল্পনা না। মিডওয়েস্টে থাকার সময়ে শীতকালে প্রায়ই সূর্যের দেখা মিলত না - গোমড়ামুখ হয়ে থাকতো আকাশের। আমি মনে মনে সূর্যের প্রত্যাশা করতাম। ইনকারা সূর্যের পূজারী ছিল কেন আমি দুই বছরে বুঝে গেছি সেটা। বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হল। শীতকালের টিপটিপে বৃষ্টি সেই সাথে কনকনে একটা ঠাণ্ডা। হ্যালোউইনের বারোটা বেজে গেল। প্রতিবছর দরজায় যে পরিমাণ শিশুদের আনাগোনা হয় এবার মনে হয় সেটার ৩ ভাগের একভাগও হয় নি। রাতে একটু ভারী বর্ষণ। মেঘলা আকাশ দেখে বিষণ্ণ লাগলেও রাতের বৃষ্টির শব্দ কেমন ছেলেবেলার মতো আনন্দ নিয়ে আসে।

পৃথিবী তার আপন নিয়মে চলছে। আজকে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, গতকাল ট্রাম্পের লোকজনদের এফবিআই ধরে নিয়ে গেছে, গত সপ্তাহে ঢাকাতে মানুষজন ১৪ টা কুকুরের ছানাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিয়েছে, ফারুকীর নতুন ছবি ডুব মুক্তি পেয়েছে, ৩ বছর বয়েসি ভারতীয় শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে ডালাসের উপশহরে, আমি কানের অসুখ প্রতিহত করতে গোটা তিনেক ইঞ্জেকশন নিয়েছি, আমাদের প্রতিবেশিদের কুকুর ছানা হারিয়ে গেছে, এক বছর মহাশূন্যে অবস্থান করে নাসার নভোচারী স্কট কেলি এখানে ওখানে সেমিনার দিয়ে যাচ্ছেন - জগতের কোথাও কিছু থেমে নেই। আমি থাকলেও থেমে নেই - আমি না থাকলেও নেই। এরই মধ্যে হয়ত কারো নতুন ভালোবাসা হয়েছে, কেউ পুরনো সম্পর্ক ছেদ করেছে, কেউ সন্তান লাভ করেছে, কেউ সন্তানহারা হয়েছে। অন্তহীন উপন্যাসের মতো এই পৃথিবীর এবং তার মানুষগুলোর গল্প অধ্যায়ের পর অধ্যায় লেখা হচ্ছে অবিরত।

অনেক কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। শেষ পর্যন্ত কোন কিছুই লেখা হয় না আর। গত সপ্তাহে ছবিতে দেখলাম ফার্মগেটের কাছে শতবর্ষের পুরনো কিছু বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে। ছবি দেখে চমকে উঠলাম। আমার বাবা এক সময়ে অফিস করতেন ওই ভবনগুলোর একটাতে। বাল্যকালে আমি এবং আমার মেজভাই অনেকবার গিয়েছি সেইখানে। পুরনো দিনের বাড়ি যেমন হয় তেমন। একটু নোনাধরা দেওয়াল, উঁচু সিলিং, ঘড়ঘড় করে চলা ফ্যান, কালো রঙের প্রাগৈতিহাসিক ফোন। নিচের তলাতেই আব্বার পিয়ন রশীদভাইকে পাওয়া যাবে। উনি চা-বিস্কুট খাওয়াবেন, খুব মজার গল্প করবেন। ভবনগুলোর ছবি এবং ভেঙে ফেলার খবর দেখে একটু কষ্ট লেগেছিল প্রথমে, পরে চিন্তা করে দেখলাম ঢাকা শহর এখন যেই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিরাট কম্পাউডওয়ালা ছোট্ট ভবনের চেয়ে অট্টালিকার বেশি প্রয়োজন। স্মৃতি মাথার ভেতরেই থাকে - সেটার জন্য ভবনকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। স্মৃতির শহর বেঁচে থাকে স্মৃতিতেই - বাস্তবে না।

আমার যখন বারো বছর বয়েস তখন রাস্তা থেকে নেড়ি কুকুরের একটা বাচ্চা নিয়ে আমি পালা শুরু করি। আমরা জানতাম সাহেব মরলে পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহন করে (লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়ার মতো এটাও সামাজিক শিক্ষা) - এই কারনেই কুকুরের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। সেই সব ব্যাপার মাথায় রেখে আমি আমার কুকুরের নাম দিয়েছিলাম জো। কুকুর খুবই প্রভুভক্ত প্রাণী। জো আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো পাড়ায়। আমি কনফেকশনারি থেকে খুব সস্তা বিস্কুট কিনে খেতে দিতাম জো-কে, এতেই সে মহানন্দের লেজ নাড়তো। আমি স্কুলে যাওয়ার সময়ে সেও আমার সাথে যাওয়ার চেষ্টা করত। কুকুরের সাথে মানুষের বন্ডিং খুব দ্রুত হয় - খুবই জোরালো বন্ধন। জো এর গল্প করেছি মেয়েদের সাথে। জো কিভাবে হারিয়ে সেটা মনে পড়ে এখন আর। সম্ভবত সে একদিন আর ফেরৎ আসে নি। ঢাকাতেও পশু অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য একাধিক সংগঠন আছে - আমি ফেসবুকের মাধ্যমে একটার সাথে যুক্ত। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে সারাদিন কুকুরেরা ঘুমায় - দেখে মনে হয়েছে স্থানীয় খাবারের দোকান থেকে ওরা খাবার পায়। লেকের পাড়ের কুকুরদের অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছিল পশুপাখির প্রতি হয়তো একটু সদয় হয়েছে মানুষজন। আমি যখনই মানুষের উপর আস্থা আনার চেষ্টা করি তখনই কিছু হারামজাদা সেটার বারোটা বাজিয়ে দেয়। কুকুরের ছানাদের জ্যান্ত কবর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয় নি। এটা সহজে ভুলতে পারবো না।

ঢাকাতে শীতের আমেজ শুরু হয়েছে - দুই একজন লিখেছেন ফেসবুকে। অস্টিনেও শীতের শুরু হয়েছে মোটামুটিভাবে। ঢাকার শীতকাল (যেটা ছোট হতে হতে এখন মাত্র কয়েক সপ্তাহে গিয়ে ঠেকেছে) খুবই উপভোগ্য একটা জিনিস। আমরা প্রথম টের পেতাম রমনা পার্কের পাশ দিয়ে রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময়ে। হঠাৎ করে সামান্য শীতল বাতাস মনে করিয়ে দিত দক্ষিণায়নের দিন চলে এসেছে। লেপ, কাঁথা, সোয়েটার, জ্যাকেট বের করে রোদে দিতে হবে, স্কুলের পরীক্ষা শেষে সকাল থেকে সন্ধ্যে কাটবে গল্পের বইয়ের পাতায়, দিনগুলো আস্তে আস্তে ছোট হবে, বিকেলটা হবে কমলাটে এবং ধূলোমাখা, একটা সর্দিজ্বর, নরম ভাত, হালকা ঝোল, আদা দেওয়া গরম চা...

লেখাটা কেন শুরু করেছিলাম জানি না। বাইরের বৃষ্টির শব্দ আর ঘ্রাণ কিছু এলোমেলো করে দেয় আমাকে। আমি সংসার থেকে ছুটি পাই, জাভা প্রোগ্রামিং এর কামলা দেওয়া থেকে ছুটি পেয়ে যাই। পৃথিবীর যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় অখবর আর দুঃসংবাদ আর আমাকে স্পর্শ করে না। হাঁটুর ব্যথা, কানের ক্রমাগত শব্দ, সামান্য জটলাগানো মাথাব্যথা আমাকে আর ভাবায় না। বরং বাইরের বৃষ্টির শব্দ, সোডিয়াম লাইটে ভেজা কুয়াশা মোড়া রাস্তা, মধ্যরাতে ছুটে যাওয়া গাড়ি হঠাৎ ডেকে নিয়ে আসে আমার শৈশবকে।

আমি চুপচাপ ভ্রমণ করি আমার স্মৃতির শহরে।

"অকস্মাৎ দুপুরে চিলের ডাকে আমার শৈশব ফিরে আসে

শ্লেট, চকখড়ি আর বাদামি রঙের

ব্যাগ হাতে। গলিতে আবছা কন্ঠস্বর। আরো কিছু

প্রিয় স্মৃতি আলোড়নকারী শব্দ শোনার আশায়

ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি।"

(শামসুর রাহমান/ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি) 

No comments: