আমার আম্মা ঠিক বাংলাদেশের আর পাঁচটা পরিবারের মায়ের মতো ছিলেন না। আমি যেই সময়ে বড় হয়েছি সেই সময়ের তুলনাতে। ওই সময় খুব বেশি মহিলা বাইরে কাজ করতেন না। অথচ আম্মা প্রায় সারাদিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। বাসায় ফিরে বই পড়তেন।
বিকেলে চায়ের আয়োজন করতেন - সন্ধ্যাতে টিভি দেখতেন, রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেতেন। তাঁর ভাষাতে ছাপার অক্ষর দেখলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে। প্রায় রাত্তিরেই ওনার রুমের বাতি অন্য কেউ নিভিয়ে দিত। আমাদের পড়াশোনা নিয়ে চাপাচাপি করতেন না। আম্মার ধারনা ছিল অতিরিক্ত পড়ার চাপ পাঠবিমুখতা তৈরি করতে পারে - অন্তত নিচের ক্লাসে। আমাদের গল্পের বই পড়ার স্বাধীনতা ছিল।
পরীক্ষার নম্বর নিয়েও খুব মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। ক্লাস থ্রি-তে ফাইনালে আমার ইংরেজিতে ৩৬ পাওয়া নিয়ে মর্মাহত হয়েছিলেন একবার। সঙ্গত কারনও ছিল। ওই বইয়ের লেখিকা উনি নিজেই ছিলেন। আম্মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বড় হলে আমরা নিজে থেকেই পড়তে বসব। আমাদের শৈশব তিনি চুরি হতে দেননি।
ঘর সাজানোতে তিনি বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। পুরনো শাড়ি দিয়ে বাসার পর্দা বানাতেন। রিসাইকেল শব্দটা আমি তখনও শিখিনি - যদিও এর সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প বয়েসেই। এছাড়াও অল্প কয়দিন পরে তো মরেই যেতে হবে - এতো পয়সা খরচ করাটা পুরোই অপচয়।
তাঁর দৈনন্দিন কাজের তালিকাতে রান্নাবান্না ছিল না। বাসাতে রান্নার লোক ছিল। আমরা প্রতিদিন তাদের রান্নাই খেতাম। আইটেমে খুব কম দিনই পরিবর্তন আনা হত। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি রান্না করতেন। ছুটির দিনে, ঈদের অথবা কারো জন্মদিনে। বেশ ভালোই রান্না করতেন। তাঁর মা অর্থাৎ আমার নানি অসাধারণ রাধুনী ছিলেন। কিন্তু আম্মা সম্ভবত তাঁর কাছ থেকে রান্না শিখেন নি। রান্না সম্বন্ধে আমার একটা থিওরি আছে - যে ভালো রান্না খেয়েছে, সে নিজেও চেষ্টা করলে ভালো রান্না করতে পারবে - কেননা "হাইট অফ পারফেকশন" জানা থাকলে সেই উচ্চতায় পৌছানোর চেষ্টা করা যায়।
সিদ্দিকা কবিরের "রান্না খাদ্য পুষ্টি" বইটা বের হওয়ার সাথে সাথে সেটা আম্মা কিনে আনেন। আমি সেদিন আম্মার সাথে ছিলাম। বইটার দাম সম্ভবত ৩০ টাকা ছিল - ১৯৭৮/৭৯ সালে। আমি জানলাম যে আম্মা লেখিকাকে চিনেন। তিনি অতিবড় রাঁধুনী। সিদ্দিকা কবীর বেশ অনেকদিন আম্মার সহকর্মী ছিলেন। সিদ্দিকা কবির এই বইয়ের প্রতিটি আইটেম নাকি বেশ অনেকবার রান্না করেছেন - রেসিপি যাতে পারফেক্ট হয়।
এই বইটা আসার পরে আম্মা মাঝে মাঝে নানান পরীক্ষামূলক জিনিস রান্না শুরু করে দিলেন। হান্টার বিফ, চাইনিজ, রুটিতে মাখানোর মেয়োনিজ, পেয়ারার জেলি ইত্যাদি। মিষ্টি কুমড়ার জ্যামও বাদ গেল না।
একবার ঠিক করলেন কমলার মার্মালেড বানাবেন। আমি এই জিনিসের নামও শুনিনি। আম্মা জানালেন খোসা সহ কমলা দিতে বানাতে হয় এটা। মার্মালেড ঠিক জ্যাম ও নয় জেলিও নয়। জ্যাম, জেলি আর মার্মালেডের পার্থক্য বলেছিলেন - কিছুই মনে নেই এখন। মার্মালেড বানানোর পরে সেটা খাওয়া যাবে কিনা এই সন্দেহ ছিল আমার। কিন্তু দেখা গেল খেতে বেশ ভালোই।
আমেরিকাতে আসার সময়ে আম্মা রান্না খাদ্য আর পুষ্টির এক কপি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। ওই বইয়ের কলেবর অনেক বড় হয়েছে। সিদ্দিকা কবীর সেলেব্রিটি হয়ে গেছেন এই বই লিখে। টিভিতে তাঁর রান্নার অনুষ্ঠান হয়। আমিও জানতে পেরেছি ডিম চিংড়ি ফুঃ উঃ বলে একটা খাদ্য আছে এই পৃথিবীতে।
মার্কিন দেশের আমি জ্যাম ও জেলি থেকে দূরেই থাকি। এই দেশের কেক, পেস্ট্রি, জ্যাম, জেলি আমার কাছে বেশি পদের লাগে না। অতিরিক্ত মিষ্টি মনে হয়। খাওয়ার পরে বিস্বাদ লাগে।
গত সপ্তাহে স্বাদ বদলানোর জন্য মারিয়া এক বোতল কমলার মার্মালেড কিনে নিয়ে আসলো। বোতলটা খোলা মাত্রই আমার আম্মার কথা মনে পড়ে গেল। ঢাকনা সরাতেই হুড়মুড় করে বাল্যকাল এসে দাঁড়ালো খাবার টেবিলে। রুটির মধ্যে মার্মালেড মাখাতে মাখাতে আমি একদম নির্ভুল আম্মাকে দেখতে পাই রান্নাঘরে। মৃত্যুর তিন বছর পরেও হঠাৎ হঠাৎ তিনি হাজির হন সময়ে অসময়ে, মার্মালেডের বোতলের মতো সামান্য জিনিস অসমান্য স্মৃতি নিয়ে আসতে পারে সেটা আমি জানতাম না।
আমাদের বাধাহীন শৈশব, কৈশোরের জন্য আম্মাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানো হয় নি। আমার স্মৃতিতে তাই বড় একটা নীল রঙের আকাশ আছে, রাতে রেললাইনের পাশ থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর আছে, উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাটি আছে, আকাশ জোড়া মেঘ আছে - ধুম বৃষ্টি পড়া স্বপ্নের শহর আছে, সেই শহরে বৃষ্টি শেষে বাতাসে নাবিস্কো বিস্কুটের গন্ধ ভাসে। পড়া নেই, পরীক্ষা নেই, স্বপ্নের ছিনতাইকারীরা নেই।
“All grown-ups were once children... but only few of them remember it.”
― Antoine de Saint-Exupéry, The Little Prince
আম্মা আপনাকে ধন্যবাদ। সম্ভবত আপনার কারনেই আমি শৈশব ভুলিনি। এক বোতল মার্মালেডও বালকবেলা ফিরিয়ে আনতে পারে। এই আশ্চর্য ভ্রমণের রাস্তাটা আপনিই বানিয়ে রেখেছেন, কেউ জানেনি, কেউ দেখেনি, কেউ বলে দেয়নি, তাও খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় নি। আপনাকে ধন্যবাদ।
"যা যায় তা আর ফিরে আসে না কখনো
ঠিক আগেকার মতো। পাখির ডানার
শব্দে সচকিত
সকালবেলার মতো আমার শৈশব
প্রত্যাবর্তনের দিকে ফেরাবে না মুখ
কস্মিনকালেও।
বাকদেওয়া মোরগের ধনুকের ছিলার মতোন
গ্রীবা, চৌবাচ্চায় একজোড়া সীমাবদ্ধ
হাঁসের সাঁতার, ভোরবেলাকার শিউলির ঘ্রাণ,
গ্রীষ্মের বিকেলে স্নিগ্ধ কুলপি বরফ,
মেরুন রঙের খাতাময় জলছবি,
সন্ধ্যার গলির মোড়ে কাঁধে মইবওয়া বাতিঅলা,
হার্নি সাহেবের হল্দে পুরোনো দালান,
খড়বিচালির গন্ধভরা মশা-গুঞ্জরিত
বিমর্ষ ঘোড়ার আস্তাবল, মেরাসীনদের গান
ধরে আছে সময়ের সুদূর তরঙ্গেমেশা আমার শৈশব।
মনে পড়ে, যখন ছিলাম ছোট, ঈদে
সদ্যকেনা জামাজুতো পরে
সালাম করার পর আমার প্রসন্ন হাত থেকে
স্বপ্নের ফলের মতো একটি আধুলি কিম্বা সিকি
ঝরে যেত ঝলমলে ঝনৎকারে আমার উন্মুখ
আনন্দিত হাতে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সেই পাট চুকে গেছে কবে।
এখন নিজেই আমি ছোটদের দিই ঈদী বর্ষীয়ান হাতে,
আয়নায় তাকিয়ে দেখি আপনকার কাঁচপাকা চুল,
ত্বকের কুঞ্চন।
এই ঈদে জননীকে করলাম সালাম যখন,
অনেক বছর পরে আম্মা কী খেয়ালে অকস্মাৎ
দিলেন আমার হাতে দশ টাকার একটি নোট,
স্বপ্নে দেখা পাখির পালক যেন, আর
তক্ষুণি এল সে ফিরে অমল শৈশব
আমার বিস্মিত চোখে কুয়াশা ছড়িয়ে।"
(দশ টাকার নোট এবং শৈশব/শামসুর রাহমান)
No comments:
Post a Comment