আনুশা তখন ছোট ছিল। ক্লাস ওয়ান বা কেজিতে পড়ত। আমি বাসায় আসতেই দুই বোন ছুটে আসতো। নানান গল্প।
আনুশা একদিন বলল - "আব্বু আই নো হাউ টু এড বিগ নম্বরস"। আমি বললাম তাই নাকি?
পরীক্ষা নেওয়ার আগেই আনুশা জানালো দুই মিলিয়নের সাথে দুই মিলিয়ন যোগ করলে চার মিলিয়ন হয়। ইজন্ট দ্যাট টু বিগ নাম্বারস?
আমার মনের ভার কেটে যেত। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল বিনোদন এবং সবচেয়ে সহজ সত্যগুলো আসে বাচ্চাদের কাছ থেকে। এই পৃথিবী যেই ভার নিয়ে বুকের ভেতর চেপে বসে, শিশুদের সঙ্গ সেই যন্ত্রণা শুষে নেয়।
বাড়ি ফিরে গল্প করতাম ওদের সাথে - ভূতের গল্প, বিড়ালের গল্প, আমার অফিসের সামনে বাস করা বাদামী সাপের গল্প। আনুশা ওদের স্কুলের গল্প করত। সামারাও কাল্পনিক এক স্কুলের গল্প করত।
কোন বন্ধুটা ভালো, কোন বন্ধুটা মিন, কোন বন্ধুটার হাসতে ভালোবাসে, কোন বন্ধুটা অল্পতেই দুঃখ পায়, আমি যেন সবাইকেই চিনতাম, কেউ আমার অচেনা নয়, দূর শৈশবে আমিও এই রকম অনেককে রেখে এসেছি।
কিন্তু এখন এক বিপরীত জীবন। আনুশাও বড় হয়ে গেছে - তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সমকামীদের অধিকার সব বিষয়ে তার অভিমত আছে। স্কুল থেকে ফিরেই টেক্সট করে - আজকে ম্যাথ হোমওয়ার্কে সাহায্য লাগবে। সেই অংকও বড়দের অংক - একটি রেখা থেকে ঢাল বের করে সেই রেখার লম্ব রেখার ইকুয়েশন বের করতে হবে। মিজাইলের মতো একেকটা অংক।
শৈশব যদি সরলতার সময় হয়, বড় মানুষের জীবন নিশ্চয়ই কুটিলতাতে পূর্ন থাকে। বাচ্চাদের কাছে ভালো আর খারাপের মধ্যে তেমন কিছু নেই। বড়দের সবই গ্রে এরিয়া, বড়দের জীবনের প্রায় পুরোটাই রিড বিটুইন দ্য লাইনস। তাই ভালোবাসার মোড়কে ঘৃণা থাকে, প্রশংসার মোড়কে বিদ্বেষ থাকে, আনন্দের আড়ালে বিষাদ থাকে। বড় হওয়া মানেই নিজেকে লুকিয়ে রাখা, আড়াল করে রাখা। সফল একজন মানুষ লুকোচুরি খেলার ওস্তাদ।
আমি অনেকবার বলেছি, আমি বড় হতে চাইনি। সত্যি সত্যি চাইনি। সময়ের ষড়যন্ত্রে বড় হয়েছি। পুরো বড় হতে পারিনি এখন যদিও এই বেঁচে থাকলে এই বছরই হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ হবে। হাঁটুর ব্যথা, রক্তের চাপ, কানের অসুখ থাকলেও কিছু শৈশব রয়ে গেছে এখনও।
আনুশা আর সামারা বড় হয়ে গেছে অনেকটাই। আমার সাথে গল্পে ওরা আগ্রহী নয়। কে-পপ, ওয়ান ডিরেকশন, টিকটক এইগুলোও আমি বুঝতে পারি না। তাই অনেকের মধ্যেও একা থাকতে হয়, আর সঙ্গী থাকে সেই পিটারপ্যান। এই দুঃসময় সে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, কোথা থেকে নিয়ে আসে বিশুদ্ধ হাওয়া।
আমার এক বন্ধু ছিল (এখনও আছে) তার নাম অঞ্জন। বাল্যকালে অতি বিচ্ছু ছিল সে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গম্ভীর শিক্ষক, আমি শুনেছি ধর্মচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এই বিষয়ে তার জ্ঞান প্রচুর। ক্লাস সেভেনে বাংলা ব্যকরণ স্যার ব্যাস বাক্য পড়াতে পড়াতে জিজ্ঞেস করলেন, এই কয়টা বাজে দেখতো। অঞ্জন উত্তর দিল - স্যার দুইটা বেজে পঁচাত্তর মিনিট। স্যার হুংকার দেওয়ার আগেই বলল স্যার, ৩ টা ১৫ এর ব্যাসবাক্য বললাম।
আজকে সারাদিনের কাজের আর নানান চাপের মধ্যে এই অতি তুচ্ছ গল্পটা মনে পড়েছে বার বার। তুচ্ছ বা লেইম যাই হোক না কেন - সারাদিন যেন ফুয়েল দিয়ে গেছে এই গল্পটা। বাচ্চারা বড় হয়ে যাচ্ছে, আমি এখনও পুরো পারিনি। কিন্তু সবিস্ময়ে আমি টের পাই - আমার দাঁড়াবার জায়গা সেই রোদ্দুর আর ছায়াতে ঘেরা একটু খানি শৈশব।
“আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙ্গিয়ে খায, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার।”
"জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দু:খ, যে দু:খে অনেক ভালোবাসা, যে ভালবাসায় অনেক ছেলেবেলা...”
(কালো বরফ/ মাহমুদুল হক)
No comments:
Post a Comment