ছবিটা ১৯৮৫ সালে তোলা। দিন তারিখ মনে নেই, তবে গ্রীষ্মকালে তোলা ছবি। বেশ গরম ছিল সেদিন, এইটুকু মনে আছে। আমাদের পরিবারের সবাই দাঁড়িয়ে আছি আমাদের ২৯ নম্বর বাসার ছাদে। রোদের কারণে কিছু চোখ কুচকানো। আমাদের বাসাটা দোতলা, ঢাকা শহরে তখনও দোতলা বাসা বিরল হয়ে যায় নি। তবে কিছু কিছু ৪/৫ তলা বাসা তৈরি হচ্ছে, আস্তে আস্তে শহরের উচ্চতা বাড়ছে।
আমাদের বাসার পেছনেই এক পাঁচতলা বাসা দেখা যাচ্ছে। ওই বাসার পেছনে আরও তিনটা পাঁচতলা বাসা আছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। ছবিতে ডানপাশটা ফাঁকা। ছবিতে নেই, কিন্তু অনেকখানিই ফাঁকা জায়গার মধ্যে ছোট একটা একতলা বাড়ি আছে সেখানে। ঢাকা শহরে একতলা বা দোতলা বাড়ির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে যদিও। ওই একতলা বাসাটার কম্পাউন্ডে প্রকান্ড একটা জামগাছ ছিল, ছবিতে সেটার সামান্য অংশ কি দেখা যাচ্ছে? আমি নিশ্চিত নই। জামগাছটার প্রাণদন্ড কবে কার্যকর হয়েছে সেটা মনে করতে পারলাম না।
ডানদিকের ফাঁকা জায়গাতে আমাদের দেওয়াল ঘেঁষে একটা কামরাঙ্গা গাছ ছিল, ছবিতে দেখা সম্ভব না এবং আমার ধারণা এই ছবি তোলার আগেই সে নিহত হয়েছে। ওই গাছটার বিরাট একটা অংশ আমাদের বাসার ভেতরে ছিল। কামরাঙ্গা গাছে বিস্তর ফল হতো, আর সেই সাথে ছিল প্রচুর টিয়াপাখির আনাগোনা। ঠিক সন্ধ্যে নামার কেমন একটা গা ছমছমে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরতো যেন ওই গাছ দুটোকে।
ছবিতে সর্ববামে আমার বড়ভাইকে দেখা যাচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মেজভাই। ভাইয়া সম্ভবত ওই বছরই চাকরি শুরু করেছিলেন, এই গতমাসে তিনি অবসরে গেলেন। আমার মেজভাই তখন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন হয়ত, কিন্তু ক্লাস শুরু হয় নি। এখন উনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক। আব্বা এই ছবি তোলার বছর খানেক আগে অবসরে গেছেন। ছবিতে আম্মার যা বয়েস আমি সেই বয়েসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, অথচ এই ছবিতে আমি ক্লাস টেনের বালক, সামনেই হয়ত প্রিটেস্ট পরীক্ষা।
আব্বা আর আম্মা পরলোকে - এই জুলাইতে আম্মার চলে যাওয়ার ৮ বছর পূর্তি হবে। আব্বাও চলে গেছেন ৪ বছরের বেশি হয়ে গেল। আমরা তিন ভাই এখন থাকি তিন মহাদেশে। যেই বাড়িতে এই ছবিটা তোলা, সেটা টিকে ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত, পেছনের নারিকেল গাছগুলোও টিকে ছিল ততদিন- কিন্তু ঢাকা শহরের আর বাদবাকি বাড়ির মতো ওখানেও অট্টালিকা উঠে গেছে।
সময়ের হাত থেকে কারোই নিস্তার নেই, সে এসে থাবা বসাবেই - মাথার চুল থেকে, বাড়ির দেওয়াল, গাছের পাতা থেকে স্মৃতিকোষ - তার কবল থেকে কেউ পালাতে পারবে না। সময় শুধু থাবাই বসায় না, সে বাস্তবতাও পাল্টে দেয়। এই ছবিতে আমরা পাঁচজনই ঘর বলতে এই বাসাটাকেই বুঝতাম, আজকে প্রায় ৩৬ বছর পরে দিনের শেষে আমরা ভিন্ন ঠিকানাতে ঘরে ফিরি।
সুনীল তার সেই সময়ের বইয়ের ভূমিকাতে সম্ভবত লিখেছিলেন এই কাহিনীর প্রকৃত নায়ক সময় - আমি আসলে টের পাই পৃথিবীর যাবতীয় গল্পের নায়ক বা খলনায়ক হচ্ছে সময়।
"তবু এইটুকু জীবনের মধ্যে কত কি যে ঘটেছিল - কত মুগ্ধতা, সন্তাপ, উল্লাস, দ্রবণ! ভোলা যায় না। তবু তার উপর শান্তি নামে - সময়ের শান্তি, ক্ষয়ের শান্তি। অক্ষয় মালবেরি গাছকে ঘিরে তীব্র ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ টের পাই, কখন সঙ্গীদের হাত ফসকে গেছে। প্রৌঢ় মুখের উপর ছায়া পড়ে। নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয় না, প্রাণী বলে মনে হয়। নিশ্বাস নিই তাই বেঁচে থাকি। ভিতরে একা, সুখী না, দুঃখীও না। দশদিকে অসীম শূন্য এবং চিররহস্য।"
No comments:
Post a Comment