২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ ছিল মঙ্গলবার। আমি তখন বেশ ভোরে অফিসে যেতাম। আমাদের অফিসে কোন কিউবিকেল ছিল না। সব রুম। আমার রুমে আর কেউ ছিল না। অফিসে পৌঁছানোর একটু পরে ঢাকা থেকে আমার ভাই ফোন করে আমাকে টুইন টাওয়ারে হামলার খবর দেয়।
খবর শুনে আমি আমার প্রায় গুহার মতো অফিস থেকে বের হয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে যাই। অফিসের ক্যাফে লোকে লোকারন্য। একটা বড় টিভিতে সিএনএন চলছে। এতোগুলো মানুষ তবুও সব নিস্তব্ধ, পিনপতন নিরবতা।
আমি পৌঁছানোর সাথে সাথে দ্বিতীয় ভবনে বিমান হামলা হল। ওই সময়ে আমরা কেউই বুঝতে পারি নি এটা দ্বিতীয় হামলা, সবাই ভাবছিল প্রথম হামলার রেকর্ড করা ছবি।
নিরবতা ভেঙ্গে অনেক মানুষের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। সারাদিন তেমন কোন কাজ হয়নি অফিসে। একটু পর পর টিভির পর্দাতে চোখ রাখছিলাম। এটা ইসলামী সন্ত্রাসীদের কাজ সেই সন্দেহ প্রায় সাথে সাথেই বলা হলো। অস্বস্তি নিয়ে আমিও সেই একই জিনিস ভাবছিলাম।
আমাদের কী হবে? এই দেশে বাস করা হাজার হাজার মুসলমানের কি হবে? মার্কিন দেশ এই হামলার উত্তর কিভাবে দিবে?
আমাদের জগৎ পুরো পালটে যাবে সেই সন্দেহ ছিল না। হামলার কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালালো। লাদেনকে ধরার লক্ষ্যে। সেই ইতিহাস আমরা সবাই জানি। আফগানিস্তানের পরে ইরাক। যদিও হামলার সাথে ইরাকের কোন সংযোগ মার্কিনিরা প্রমান করতে পারে নি।
লাদেন আমেরিকার নিজ হাতে তৈরি সন্ত্রাসীই বলা যায়। সোভিয়েট রাশিয়াকে আফগানিস্তানে মোকাবেলা করতে গিয়ে মার্কিন দেশ ইসলামী জঙ্গী গ্রুপগুলোকে শক্তিশালী করেছিল। সন্ত্রাসবাদের চাকরিতে রিটায়ারমেন্ট বলে কিছু নেই। সুতরাং রুশদের পরে মার্কিনিদের বিরুদ্ধেই জিহাদ শুরু করে দেয় তারা। সেই ইতিহাস অজানা কিছু নয়।
৯/১১ এর ১৬ বছর পূর্ণ হলো। মার্কিন দেশে স্কুলেও পড়ানো হয় এই ইতিহাস। এই ১৬ বছর ধরে মার্কিন দেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছে। মার্কিন দেশের বহু সামরিক ও বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে ৯/১১ এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়াতে। অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম হয় নি। কিন্তু এরচেয়ে অনেক অনেক বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি পৃথিবীতে। পৃথিবী আরও অনেক অনিরাপদ হয়ে গেছে। হামলা শুধু মার্কিন দেশেই নয়, প্যারিসে নয় বা লন্ডনে নয় - বাংলাদেশের বুকেও হয়েছে, এমনকি নাম না জানা গ্রামের দোকানদারকেও মরতে হয়েছে বিধর্মী বলে। ধর্মীয় সন্ত্রাস পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে মার্কিনিরা জিততে পারে নি।
এই সন্ত্রাসের পুরোভাগে নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের নাম লেখা আছে। কিন্তু অন্য দিকে চিন্তা করলে মূল্য তারাই সবচেয়ে বেশি দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে এই পৃথিবীর কাছে সন্ত্রাসী বলেও চিহ্নিত হয়েছে। শাঁখের করাত সম্ভবত একেই বলে।
৯/১১ আমার চিন্তাচেতনাতেও পরিবর্তন এনেছে। দিনে দিনে মানবজাতির উপর আমার আস্থা উঠে গেছে। সামগ্রিকভাবে মানবজাতি একটি আত্মঘাতী প্রজাতি। মানবধর্ম ব্যাপারটা খুব বেশি তাত্ত্বিক, বাস্তবে অসম্ভব। মানুষ নিজের সম্প্রদায়কে বেশি ভালোবাসে সেটা সমস্যা নয়, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি সামগ্রিকভাবে তাদের রয়েছে বিশুদ্ধ ঘৃণা। সব যুদ্ধ, সব অনাচার, সব অত্যাচার আসলে নিজের ভাইয়েরই রক্ত ঝরায়, সেখানে কেউ জিততে পারে না - সবাই হেরে যায়। এই বোধ না আসলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
মানুষের নির্মমতা আমাকে বিচলিত করে কিন্তু বিস্মিত করে না। মানুষের নির্বুদ্ধিতা আমাকে বিচলিত করে কিন্তু বিস্মিত করে না। মানুষের হিংস্রতা আমাকে বিচলিত করে কিন্তু বিস্মিত করে না।
বরং কোথাও সামান্য ভালোবাসা দেখলেই বিস্মিত হই। কোথাও ফুটে থাকা জংলী ফুল দেখলে সময়টা ভালো কাটে। কেউ হারিয়ে যাওয়া কুকুর ছানা ফেরৎ পেলে সফল মনে হয় দিনটাকে। এই বিন্দু বিন্দু প্রাপ্তি আর সামান্য একটু স্নেহ আর ভালোবাসাই মনে হয় টিকিয়ে রেখেছে এই পৃথিবীকে। তাই সকাল হলে পৃথিবীটাকে এখনও নিজের বাড়ি মনে হয়, তরল রৌদ্রালোকে স্নান করতে ইচ্ছে করে, গাছের ডালে বসা অচেনা পাখিটিকেও নিজের আত্মীয় মনে হয়।
আগামীকালের দিনটা হয় আজকেরটার চেয়ে ভালো হবে, আগামী মাসটা হয়ত আরও ভালো, সামনের বছর থেকে হয়ত যুদ্ধবিগ্রহ থেকে যাবে, দশ বছর পরে কেউ হয়ত আর উদ্বাস্তু হবে না। একটুখানি ভালোবাসা সেই অসম্ভব আশাটাকেই বাঁচিয়ে রাখে।
[এই গ্রীষ্মে ৯/১১ মেমোরিয়ালে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে সাদা রঙের একটা গোলাপফুল দেখেছিলাম। নিঃসঙ্গ কিন্তু সে একাই যেন পৃথিবীর সব নির্মমতার বিরুদ্ধে কথা বলছে।]
Where have all the flowers gone?
Long time passing
Where have all the flowers gone?
Long time ago
Where have all the flowers gone?
Girls have picked them every one
When will they ever learn?
When will they ever learn?
No comments:
Post a Comment