।।১।।
"ব্যাধি হিসেবে এই তিনটিই মারাত্মক - এই ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা। তেমন করে ধরতে পারলে এ বস্তু কাউকে ছাড়ে না, রেহাই দেয় না সহজে, আজীবন ভোগায়, আপাদমস্তক গ্রাস করে বসে। সংসার, সারাৎসার আর...আর ভালোবাসার কী আখ্যা দেব?"
[ঈশ্বর পৃথবী ভালোবাসা - শিবরাম চক্রবর্তী]
উপরের লাইনগুলো শিবরাম চক্রবর্তীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থের। ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা - কালে কালে এই তিনটই ভয়াবহ ব্যাধি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তিনি বলেছেন বাল্যকালে অন্যান্য অসুখের টিকার মতো যদি এই তিনটার প্রতিষেধক টিকা দেওয়া যায় তাহলে পরবর্তী জীবনে এই তিন বস্তুর থেকে ভোগান্তি অনেক অনেক কম হয়। শিবরাম শৈশবেই একটু ঈশ্বর, একটু পৃথিবী আর একটু ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছিলেন - সেটা নিয়ে এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। এই বইটা পড়ার সময়ে আমার অনেকবার কিছু পুরনো এবং নতুন কথা মনে হয়েছে। আজকের লেখা সেই সব গল্প নিয়ে।
।।২।।
আমার দাদি এক সময়ে আমাদের সাথে থাকতেন। আমার তখন বালক বয়েস। তিনি খুব ঈশ্বরভক্ত মানুষ ছিলেন। ভোররাতে উঠে নামাজ পড়তে শুরু করতেন - অন্যদেরকেও সেটাই করতে বলতেন। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অসাধারণ। তাঁর অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও তিনি সংস্কারমুক্ত মানুষ ছিলেন। মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ - সবাইকে নিয়েই বিশ্বসংসার - কেউ কারো চেয়ে কম ভালো বা মন্দ নয়, এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল। দাদি নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বলতেন - সামান্য সর্দি বসা গলার স্বর। মাঝে মাঝে কথা বুঝতে একটু অসুবিধে হত। উনি রেগে গিয়ে বলতেন - আমি কি ইংরেজিতে কথা বলছি?
সেই সময়ে প্রায়ই আমি জ্বরে কাতর হয়ে থাকতাম। দাদি গভীর রাতে ঘরে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যেতেন। সেই স্পর্শের কোথাও হয়তো ঈশ্বরের অনুগ্রহ লেগে থাকতো। জ্বরতপ্ত কপালে কেউ হাত রাখলে এখনো নির্ভুল মনে পড়ে যায় তাঁর কথা। আমি গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যেতাম।
সেবার ক্লাস সিক্সের ফাইনালে আমার পরীক্ষা অংক পরীক্ষা খুব খারাপ হলো। পাশ মার্ক ৩৩। আমি কোন মতেই ৩০ এর বেশি পেতে পারি না। আমি দাদির শেখানো নিয়ম অনুযায়ী ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলাম। এই পরিস্থতিতে আর অন্য কিছুই মাথায় আসলো না। রেজাল্টের দিন যতই ঘনিয়ে আসলো ততই হাত-পা গুলো যেন পেটের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগলো।
রেজাল্টের দিন স্কুলে গেলাম না। একদিন পরে স্কুলের অফিস রুমে রমিজউদ্দীন মোল্লাকে (উনি স্কুলের কেরানি ছিলেন, স্যার বললে খুব খুশি হতেন) স্যার সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করলাম মার্কশিট পাওয়া যাবে কিনা। উনি আমাকে হেড স্যারের রুমে যেতে বললেন, রেজাল্টের দিন যারা ফল নেয়নি, তাদের মার্কশিট নিতে হবে হেডস্যারের রুম থেকে। আমাদের স্কুলের মার্কশিট দেওয়া হতো হালকা সবুজ রঙের একটা বইতে। বইতে দশ দু'গুনে বিশটা পেজ থাকতো। অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান থেকে টেন, হাফইয়ার্লি এবং ফাইনাল সব ফলাফল একসাথে রাখা থাকবে। ফেল্টুদের জন্য অতিরিক্ত পাতা নেই। ফেল করলে কি হবে সেইটা হয়ত আমি আজকেই জানতে পারবো।
হেড স্যার ফোনে কথা বলছিলেন। ব্যস্ত ছিলেন। সামনে একগাদা মার্কশিট। আমার সাথে কোন কথা না বলে তিনি সামনে মার্কশিটের স্তুপের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি মার্কশিট তুলে নিয়ে দেখলাম - অংকে আমি ৩৪ পেয়েছি। আমি হতবাক। প্রার্থনাতে কাজ হয়। ৩৩ পেলেই চলতো, বোনাস হিসাবে এক নম্বর বেশি। আমি ঈশ্বরের প্রতি খুব কৃতজ্ঞবোধ করলাম। বাসায় ফেরার সময়ে নিউমার্কেট থেকে শীর্ষেন্দুর "মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি" বইটা কিনে আনলাম। শীতের দুপুরবেলা একটানা সেই বইটা পড়ে শেষ করলাম। বাইরে শুনশান নিরবতা। শান্তি শব্দটা শুনলে আমার সেই নিস্তরঙ্গ দুপুরবেলাটার কথা মনে হয়। সেইরকম শান্তি আমার জীবনে দ্বিতীয়বার আসে নি। দাদি আমাকে ঈশ্বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছে ঈশ্বরের অনুগ্রহেই।
এরপরে অনেক কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন কেটে গেছে এবং যাচ্ছে। অসম্ভবকে সম্ভব করার আর কোন নজীর ঈশ্বর আমাকে আর দেখান নি। সম্ভবত দাদি আমাকে শিব্রামীয় ঈশ্বরের টিকা দিয়েছিলেন। তাঁর অস্তিত্ব অথবা অনস্তিত্ব আর আমাকে ভোগায় না। কিন্তু সেই সবুজ মার্কশিটটা এখনও কোথাও আছে - যেখানে তাঁর যাদুকরী নিদর্শন আছে।আমার কন্যাদের আমি ঈশ্বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই নি। ভদ্রলোককে আমি নিজেই পুরোপুরি চিনি না। তবে জানি চাইলে তিনি সিক্সের ফাইনালে ৪ নম্বর বাড়িয়ে দিতে পারেন।
।।৩।।
একটা কাজে কাছের শহরে গিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। বাচ্চাদের নিয়েই গিয়েছিলাম। বন্ধুর বাসাতে ছিলাম। ওইখানে সমবয়েসি বাচ্চা আছে। ওরা ধার্মিক। প্রচুর দৌড় ঝাঁপে সময় গেল। তিনদিন পরে গাড়ি চালিয়ে নিজ শহরে ফিরছি। তাড়াতে আছি - জোরেই গাড়ি চালাচ্ছি। পেছন থেকে বড় মেয়ে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল...
"আব্বু বেশি জোরে গাড়ি চালালে কুনাহ হবে না তো?"
বোঝা গেল কুনাহ মানে পাপ - গুনাহ শব্দটা ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেনি সে। মেয়ে বন্ধুর বাচ্চাদের কাছে নানান শিক্ষা পেয়েছে। জানা গেল ঈশ্বর বড় খতরনাক লোক। তিনি ক্ষেপে গেলে মানুষকে "কুনাহ" দেন এবং সেই কুনাহতে চোখ দিয়ে লাভা বের হয়ে যেতে পারে।
আমি নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। রাতে গাড়ি চালালে কুনাহ হয় কিনা, ঠিক মতো দাঁত ব্রাশ না করলে কুনাহ সম্ভবনা আছে নাকি, স্কুল কামাই করলে ঈশ্বর রাগান্বিত হন কিনা - নানাবিধ জিজ্ঞাসা ধেয়ে আসলো। ঈশ্বরের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে মেয়ে সারাপথ সংকুচিত হয়ে রইল।
আমি বিস্মিত হলাম। ঈশ্বরকে যতটুকু দাদি চিনিয়েছিলেন তাতে মনে হয়েছিল তিনি এই রকম নন। ক্লাস সিক্সের অংক পরীক্ষাতে ৪ নম্বর যোগ করে দিয়ে দেন - হয়ত এরবেশি নিদর্শন এক জীবনে দেখা যায় না। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরে তিনি এমন ক্ষেপে গেলেন কেন? এটা অবশ্য এখন আর অজানা কিছুই নয়। ক্ষ্যাপা ঈশ্বরভক্তের দেখা মেলা বিরল নয়। পৃথিবী ধনী দেশ থেকে শুরু করে দরিদ্রতম দেশগুলোতেও তারা আছে, তারা যেমন ক্ষ্যাপা, তাদের ঈশ্বরও ক্ষ্যাপাটে। আমি শৈশবে এদের দেখা পাই নি।
।।৪।।
আব্বু আই স' গড টুডে - উত্তেজিত হয়ে খবর দিল মেয়ে।
আমিও বিস্মিত। এই বয়সেই ঈশ্বর দর্শন। কত মুনি-ঋষী সারাজীবন ধরে চেষ্টা করেও যেটা করতে পারেনি, একরত্তি মেয়ে সেটা বন্ধুর বাসা থেকে ঘুরে এসেই পেয়ে গেল?
জানা গেল ঈশ্বর ওর ভারতীয় বন্ধু ঈশিতার রুমের উপরে রাখা তাকে থাকেন। সেই ঈশ্বরের হাতির মতো শুঁড় আছে - হালকা গোলাপী গাত্রবর্ণ। সেই ঈশ্বরের চেহারার সাথে কিছুদিন আগে পাওয়া তথ্যের বেশ মিল আছে বলে মনে হয়েছে। তাকের উপর থেকে ভদ্রলোক সর্বদাই কটমট করে তাকিয়ে ছিলেন - দেখে মনে হয় ক্ষেপে টেপে অস্থির হয়ে গেলে চোখ দিয়ে লাভার স্রোত বইয়ে দিতে পারেন তিনি। ঈশিতাও জানিয়েছে যে তাকের উপরে বাস করা ঈশ্বরে বেশ তোয়াজ করে রাখতে হয়।
ঈশ্বরের টিকা দেওয়াটা কতখানি দরকার সেটা আমি আরেকবার বুঝে যাই। টিভির সংবাদ, ফেসবুকের ফিড, পত্রিকার পাতা - এগুলো দেখেও প্রায়ই একই কথা মনে হয়।
আমি এতোদিনে বুঝে গেছি - আমাদের একদম ভেতরে একধরনের ভয় এবং একাকীত্ব আছে - সেখান থেকে ঈশ্বরের সাম্রাজ্য শুরু। তিনি অবশ্যই আছেন - বিশ্বাসী মানুষের যেমন আছে তেমনি বহু বহু অবিশ্বাসী মানুষের ভেতরেও ঈশ্বর আছে। সেই ভেতরের ঈশ্বর তাঁদের নিজেদের মতোই - জর্জ বুশের ঈশ্বর এফ-১৬ নিয়ে ধেয়ে আসে, কারও ঈশ্বর চাপাতি নিয়ে ধাওয়া দেয়, কারও ঈশ্বর গোমাংস খেলে রক্তস্রোত বইয়ে দেয়। কারও ঈশ্বর আবার আমার দাদির ঈশ্বরের মতোই - ভাত খেয়ে সুখে থাকার উপদেশ দেয়। আমি নিশ্চিত - আমার দাদির ঈশ্বর নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে - একটু সর্দিতে বসা গলা তাঁর।
এই বাজারে আর পাঁচটা জিনিসের মতো ঈশ্বরও পণ্য, নানান মাপে, নানান মতবাদে, নানান ঘৃণার মোড়কে, নানান ভাষায়, নানান ভয়ে ও ভালোবাসাতে তাকে নিয়ে ব্যবসা চলে। কিন্তু সেই বাজারের বাইরেও তাঁকে প্রতিদিন মানুষ একদম ভেতর থেকেই ডেকে চলে - সিরিয়ার দগ্ধ বালক তাকে ডাকে, আইসিসের বাজারে বিক্রি হওয়া ইয়াজেদি মেয়েরা তাকে ডাকে, রেঁস্তোরাতে খেতে গিয়ে জবাই হওয়া মানুষগুলো তাকে ডাকে, স্টক ব্যবসায়ী তাকে ডাকে, চোর, ডাকাত, ব্যর্থ প্রেমিক - সব্বাই তাকে ডেকেই চলছে। এতো এতো মানুষের ডাকেও তিনি সাড়া দেন না, তিনি নিরব থেকে যান। আমাদের পাপ-পূন্য-বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোন কিছুতেই যেন তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এক নির্মোহ সাংবাদিক - দ্রুত হাতে লিখে রাখছেন পৃথিবীর যাবতীয় নির্মমতা, ক্রোধ, মমতা আর ভালোবাসা কড়চা।
ঈশ্বরের চোখ
আমাদের শরীরের প্রতিটি ফুটোয়
জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ
ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস
ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের হাসি
তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে বালক তার
পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের
অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে
(রণজিৎ দাশ)
No comments:
Post a Comment