Tuesday, January 5, 2021

ফাঁকা স্টেডিয়ামে হাফ সেঞ্চুরি

আজকে (ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখ) আমার ৫০ বছরের জন্মদিন। একদম ছোট ছিলাম যখন - তখন ৫০ বছরকে অনে--ক দূরের একটা সংখ্যা মনে হতো। আম্মা আমাকে অঙ্ক দিতেন, ১৯৭০ সালে আমার জন্ম হলে ৫০ বছর হবে কোন বছরে? আমি অনেক সময় নিয়ে অংক করে বের করতাম – ২০২০ সালে। ২০২০ সাল ছিল প্রায় আলোকবর্ষ দূরত্বের এক গন্তব্য, আমার চেনা "বুড়ো" লোকেরাও তখন অত বুড়ো হয় নি। আজকে এই ঈশ্বর পরিত্যক্ত হতচ্ছাড়া ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে আছি, সেই দিনটিতে, যেইদিন এই পৃথিবীতে থাকার আমার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। কে জানতো আমি ব্যাটিং ক্রিজে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করবো এই দর্শক শূন্য স্টেডিয়ামে?

যাই হোক, এই ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করি। নিজের গল্প, জীবনের গল্প। গত ৫০ বছর খুব মন্দ যায় নি। শারীরিক বিপর্যয় এসেছে, বিদায়ও নিয়েছে, মানসিক দুর্বিপাক এসেছে এবং চলেও গেছে। ভবিষ্যতেও এদের আনাগোনা থাকবে। মোটের উপর মন্দ যায় নি জীবন, দশের মধ্যে নম্বর দিতে হলে আমি সাড়ে সাত দিবো। অনেক কিছু করতে পারিনি, অনেক কিছুই হতে পারিনি, অনেক কিছুই হতে চাই নি কিন্তু হতে হয়েছে, অনেক কিছুই করতে চাইনি কিন্তু করতে হয়েছে - সবই জীবনের অনুষঙ্গ। নিজের ইচ্ছেতে জীবন কি সব সময়ে চলে?

কিন্তু একটা জিনিস বলতেই হয় - বন্ধু, আত্মীয়, পরিবার – সর্বত্রই আমি ভালোবাসা পেয়েছি, বন্ধুত্বের হাতটা পেয়েছি। মানুষের ব্যাপারে আমার একটা মৌলিক বিশ্বাস জন্মেছে - মানুষে আদতে ভালো একটা প্রাণী। ৫০ বছরে এই বিশ্বাস টুটে যায় নি - এটা বিশাল একটা অর্জন সেটা বলবো না, বরং এর কারণে রাতে আরামে ঘুমাতে পারি। সম্ভবত এই বিশ্বাসটা বেশ নাইভ (অপরিপক্ক)। এই রকম আরও নাইভ বিশ্বাস আমার আছে। আমি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারনাতে বিশ্বাস করি। বাস্তবে আমি রাষ্ট্রের অকল্যাণ কম দেখি নি। এরপরেও আমি মনে করি নানান দুর্যোগ, বিপর্যয়, কুরুক্ষেত্র, খাণ্ডবদাহনের পরে পৃথিবী একটা শান্তির জায়গা হবে। আমি সম্ভবত সেই দিনটাতে বেঁচে থাকবো না, কিন্তু সেই সুদিনের প্রত্যাশা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, স্বপ্ন দেখায়।

ও আরেকটা ব্যাপার। আমি আর দশ বছর কাজ করতে চাই এই দেশে। আমার দুই কন্যাই ততদিনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে আশারাখি। আজকে থেকে সেই কাউন্ট ডাউন শুরু। টেন, নাইন – এইভাবে চলবে। ৬০ বছর বয়েস হলে চাকরিকে বাই বাই করে দিবো। এরপরে ঘুরে বেড়াবো ইচ্ছে মতো, নিজের নিয়মে জীবন চালাবো, নিজের ইচ্ছেতে ঘুম থেকে উঠবো, ইচ্ছে মতো ঘুমাতে যাবো। যদিও সেই অর্থনৈতিক সঙ্গতি আমার হবে না হয়তো তাই সম্ভবত এটাও যথেষ্ট নাইভ একটা ইচ্ছে !!!
আজকে আমার আব্বারও জন্মদিন। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়েস হতো ৯৬। আমার জন্মের দিনটাতে তাঁর বয়েস হয়েছিল ৪৬। জন্মস্মৃতি থাকার কথা না কারোই, কিন্তু আমি কেন জানি ৫০ বছর আগের সেই দিনটা কল্পনাতে দেখতে পারি। ডিসেম্বর মাসের সকালে ঢাকা শহরে নরম একটা রোদ থাকার কথা। আমি আব্বার তৃতীয় সন্তান, জন্ম নিয়েছি দুই পায়ে ত্রুটি নিয়ে। আব্বার সামনে অনেক অনেক চ্যালেঞ্জ, বাংলাদেশ তখন উত্তাল - স্বাধীনতার দাবী বেগবান হচ্ছে, তিনমাসের মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হবে। এরই মধ্যে আমার দুই পায়ের জন্ম ত্রুটির চিকিৎসা করতে হবে।
যুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা অবরুদ্ধ নগরীতে বাস করেছি, মৃত্যু একদম হাতের নাগালে ছিল। এর মধ্যেই আমার চিকিৎসা হয়েছে। আমার প্রথম জন্মদিনের পর পর ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পরে, আমাদের বাসস্থানের খুব কাছেই ভারতীয়রা পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা করেছিল। আমাদের কিছু হয় নি। আমরা বেঁচে গেছি, আমরা বাঁচতে শিখে গেছি। আমার প্রথম স্মৃতির বাংলাদেশও এক বিক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি - দুর্ভিক্ষ, লাশ, রাজনৈতিক হত্যা, স্বৈরশাসন কি না হয় নি সেই আমার সেই শৈশবের বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের শৈশবে। এরই মধ্যে আমরা বড় হয়েছি, গান শুনেছি, সিনেমা দেখেছি, আড্ডা মেরেছি, প্রেম ভালোবাসা, সিগারেট, হরতাল, রেশনের কার্ড - সবই পেয়েছি।

প্রাচুর্য ছিল না কিন্তু কোন অপ্রাপ্তিও তাড়া করে ফেরেনি আমাকে। কোন অপ্রাপ্তি আমাকে এখনো ধাওয়া দেয় না মাঝরাতের দুঃস্বপ্নে। জীবন এখনও আমার কাছে বিস্ময়মাখা এক আনন্দযাত্রা, জীবনের ইংনিসের বাকি ওভারগুলোও একইভাবে কেটে যাবে এই প্রত্যাশাতে রইলাম।

আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
যারা যারা এই অর্ধশতাব্দী পূরণের দিনে আমাকে স্মরণ করেছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের সবার জন্য রইল আমার কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা।

No comments: