"যে নারী কোনদিন সূর্যের মুখ দেখেনি, এক কথায় কি হবে - কে বলতে পারবে?” - জোবেদ আলী স্যার পুরো ক্লাসের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।
মোটা দাগে আমাদের ক্লাসকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একদল হচ্ছে যারা পড়াশুনা করে, স্যারেরা পড়া ধরলেই লাফ দিয়ে উত্তর দেয়। অপর দল হচ্ছে দার্শনিক টাইপের। পড়া ধরার সময়ে এরা উদাস মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এদেরকে স্যারেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে চোখেমুখে একটা বিশুদ্ধ বিস্ময় ফুটে উঠে। এরাই ক্লাসের সংখ্যাগরিষ্ঠ। পৃথিবীর সর্বত্রই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই দুই ভাগে বিভক্ত। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় আমার মনে হতো, ভালো ছাত্ররাই মূলত আসে এইখানে, কিন্তু ঢোকার পরে এরাও ভালো আর খারাপ ছাত্রের সেই মৌলিক বিভেদে বিভক্ত হয়ে পড়ে তারা।
জোবেদ আলী স্যারের প্রশ্নের উত্তরে একমাত্র বায়েজিদ হাত তুলল। বায়োজিদ সম্ভবত ভালো ছাত্রই ছিল। কিন্তু সে ঠিক সেই রকম চটপটে ভালো ছাত্র না। বাকিদের থেকে অনেকখানি লম্বা, ঢ্যাঙ্গা টাইপের, খুব শুকনো, চোখটা একটু জ্বলজ্বলে এবং খুবই চুপচাপ। বায়েজিদের সম্ভবত হৃদরোগের সমস্যা ছিল। ক্লাসের বাকি ভালো ও খারাপ ছাত্রদের সাথে ওর পার্থক্যটা বোঝা যেত। কেমন দুঃখী দুঃখী একটা চেহারা ছেলেটার।
জোবেদ আলী স্যারের কথা একটু বলা যাক। স্যার বাংলার শিক্ষক ছিলেন। স্যারের চেহারাটা মনে আছে। ছিপছিপে লম্বা, মাথাতে টাক, যত্ন করে রাখা ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি, মোচ – স্যারকে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের আশ্চর্য ডাবল বলা যায় প্রায়। ৫০ সিসির হোন্ডা চালান, সকালে স্কুলের এসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার দলকে স্যার নেতৃত্ব দেন, গাইতে গাইতেই মাঝে মাঝে হালকা চড় থাপ্পড় মারতেন – জাতীয় সঙ্গীতের দুই লাইনের মাঝখানে চাপাস্বরে ধমক দিতেন - গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না কেন?
জোবেদ আলী স্যার পত্রিকাতেও লিখতেন। ওনার লেখা চিত্রবাংলা পত্রিকাতে প্রায়ই ছাপা হতো। চিত্রবাংলা সিনে পত্রিকা। চিত্রবাংলার সম্পাদক মিজানুর রহমান ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, মাস্টারি ছেড়ে সিনেমার পত্রিকা বের করেছেন। ওইখানে রগরগে সব আর্টিকেলের পাশাপাশি কিছু জ্ঞানের কথা বের হতো, সেইগুলোর অনেকগুলোই জোবেদ আলী স্যারের লেখা।
বায়োজিদ আস্তে আস্তে জবাব দিল – স্যার এক কথায় একে বলে অসূর্যম্পশ্যা।
শব্দটা আমি প্রথম শুনলাম। স্যার চমতকৃত হলেন। এবার জিজ্ঞেস করলেন বায়োজিদকে যে সে এটা বানান করতে পারবে কিনা। পারলে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে। বায়োজিদ বোর্ডে গিয়ে গোটা গোটা করে লিখলো - অসূর্যম্পশ্যা। স্যার বানানটা শুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ক্লাসে হাততালির রোল উঠলো।
জোবেদ আলী স্যার আসলে বেশ ভালো পড়াতেন, সেটা আমি অনেক পরে বুঝেছি। স্যার খুব শুদ্ধ করে কথা বলতেন। আমাদের সম্ভবত ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করিয়েছিলেন – বার বার বলতেন অনুবাদ সরাসরি করতে হয় না। অনুবাদ হবে ভাবের অনুবাদ। আমি জীবনে একবার একটা অনুবাদ কর্মে হাত দিয়েছিলাম, করতে গিয়ে বার বার মাথার ভেতরের অদৃশ্য কোন জোবেদ আলী স্যারের ধমক শুনছিলাম। তিন লাইন অনুবাদ করার পরে আর সেই পথে পা মাড়াই নি। এর পাশাপাশি বানান ভুল না করার জন্যও বারে বারে বলতেন, বলতেন বানান নিয়ে সন্দেহ থাকলে অভিধান দেখতে।
ভাষা নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা অনেকটা ভাসাভাসাই ছিল। আমি বহু বহু বছর পরে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, যত্ন করে লালন করার চেষ্টা করেছি। পরিণত বয়েসে এসে জোবেদ আলী স্যারকে আবার হঠাৎ করে মনে করা শুরু করেছি। আরো একটা ব্যাপারও মনে পড়ল, স্যার ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে ছাত্রদের সালাম দিতেন। আমরা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার জানালেন এই ছাত্রেরা একদিন বড় মানুষ হবে, সেই মানুষগুলোকেই উনি সম্মান জানান। স্যারের ক্লাসে মারধোর হতো না, কথা বলাও বারণ ছিল না। তিনি চাইতেন তাঁর ছাত্রেরা সফল মানুষ হওয়ার বদলে ভালো মানুষ হোক। এমন একজন মানুষকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
আমরা নাইনে বা টেনে উঠতে উঠতেই স্যার বদলি হয়ে গেলেন অন্য কোথাও। আমরা টিচার্স রুমে স্যারকে বিদায় জানাতে গেলাম। অনেকদিন এই স্কুলে পড়িয়েছেন, একটু বিমর্ষই লাগছিল তাঁকে। বলেছিলেন – আবার দেখা হবে।
স্যারের সাথে এই জীবনে আর দেখা হয়নি, উনি বেঁচে আছেন কিনা সেটাও জানিনা। আর অনেকের মতো স্যারও হারিয়ে গেছেন। বায়েজিদের কোন খবর জানি না, স্কুল ছাড়ার পরে সেও হারিয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলবেঁধে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম জমা দিতে গিয়ে হঠাৎ দেখেছিলাম একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি পড়ে আছে মাটিতে। ছবিটা বায়োজিদের – আমরা এদিক ওদিক খুঁজলাম, ডাক দিলাম, সাড়া মিললো না। বায়েজিদকে পাওয়া গেল না কোথাও। সে বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানি না।
এই রকম বহু বহু মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলা আসলে চলমান প্রক্রিয়া, জীবনে চলতে চলতে যেমন অনেক প্রাপ্তি জুটে তেমনি হারাতেও হয় অনেক কিছু। যত দীর্ঘ জীবন ততই বড় হারানোর তালিকা। কাউকে হারিয়েছি সুদূর অতীতে, কাউকে বর্তমানে, কাউকে ভবিষ্যতে হারাবো। দুপুরের খর রোদে বাইরে বসে থাকতে বিচিত্র কারণে মনে পড়ে বহুদূরের এক শান্ত ক্লাসরুম, বাইরে আলোছায়ার খেলা আর গোটা গোটা অক্ষরে বোর্ডে লেখা - অসূর্যম্পশ্যা।
আমি মাঝে মাঝে টের পাই জীবনটাই আসলে একটা দীর্ঘ হারানো বিজ্ঞপ্তি।
No comments:
Post a Comment