Saturday, December 18, 2010

স্মৃতির শহর: বড় হওয়ার গল্প (শেষ পর্ব)

আমার স্মৃতির শহরটা বড়ই সুন্দর। সেখানের বিকেলগুলো লম্বা আর নরম, মোলায়েম রোদের আলোতে স্নান করে রাস্তার পাশের বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ, তাতে বসে থাকে হলুদ রঙের কুটুম পাখি। শব্দ আছে হরেক রকমের, গাড়ির হর্ণ থেকে ঝালমুড়িওয়ালার হাঁকডাক, আছে সুরের মত রিকশার টুংটাং আওয়াজ। দূর থেকে কান পাতলে মনে হবে যেন সঙ্গীত শুনছি। সেই শহরে হেমন্তের সকালগুলো ঘুম ঘুম কুয়াশা মাখা, বসন্ত হাজির হয় সংগোপনে; গ্রীষ্মের খরতাপ যেমন আছে তেমনি আছে শ্রাবণের প্রবল ধারাতে কাকভেজা হওয়ার সুব্যবস্থা। কিন্তু স্মৃতিময় এই শহরে আছে এক বিরাট জঞ্জাল...মাঝে মাঝে ভেসে আসে সেই আবর্জনার স্মৃতিও।

ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ। আমার মেজভাই তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন। সেদিন ছিল শেষ পরীক্ষা, কেমিস্ট্রি। সেসময় টিভিতে সকালে অনুষ্ঠান হত কয়েক ঘন্টা। আমরা নাদান বাচ্চা-কাচ্চা, সকালের কার্টুনগুলো দেখতে সাতসকালেই উঠে পড়ি। সেদিন সকালে কার্টুন-টার্টুন দেখা হয় নি, বাসাশুদ্ধ সবাই দেখলাম আমাদের সেনাপতি সাহেবকে। এই সেনাপতিকে আগে চিনতাম না। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে প্রথম টিভিতে দেখি, এরপর দেখেছি উনি সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কয়েকমাস আগে, বলেছেন সেনাবাহিনীর উচিত নয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাতে হাত দেওয়া। দেশের রাষ্ট্রপতি তখন আব্দুস সাত্তার, উনি জিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হওয়ার পরে উনি প্রথমে ভারপ্রাপ্ত এবং তারপরে নির্বাচন করে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন।

সাত্তার সাহেব খুব কঠিন লোক ছিলেন না। “আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রেসিডেন্ট দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন” – এই লাইনটা বলতে গিয়ে উনি হোঁচট খেয়েছিলেন বারংবার। আর সেই “দুষ্কৃতিকারীরাও” কেমন যেন – ক্ষমতা দখলের জন্য ক্যু করতে হয় ক্ষমতার কেন্দ্রে - সেটা না করে ক্যু করে বসল চট্টগ্রামে। নাকি ঢাকাতে কেউ ছিল যে গাছে উঠিয়ে মই সরিয়ে নিয়েছে? অনেক প্রশ্নের উত্তর আর জানা হবে না। সাত্তার সাহেব পরিস্থিতি বেশি ভালো মোকাবিলা করতে পারছিলেন না। বিএনপিতে দ্বন্দ্ব আর কলহ চরমে। মন্ত্রীর বাসা থেকে সন্ত্রাসী খুনি ধরা পড়েছে। তারপরেও দেশের মানুষ ক্ষমতার বদল চায় নি। রক্ত কম ঝরেনি স্বাধীনতার পরের দশ বছরে।

টিভিতে সেনাপতি সাহেব লম্বা একটা ফিরিস্তি দিলেন – দেশ রসাতলে যাচ্ছে, এই সময়ে দেশপ্রমিক সেনাবাহিনী কিভাবে চুপ করে থাকবে...তাই তিনি বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রপতির অনুরোধে ক্ষমতা নিচ্ছেন। সামরিক আইন দেশে আগেও এসেছে, কিন্তু এই প্রথম আমি নিজের চোখে দেখলাম এর রন্ধন প্রণালী।

সামরিক আইনে সেনাপতি হচ্ছেন রাজা - তাকে মানুষ ডাকবে সিএমএলএ – চিফ মার্শাল ল' এডমিনিস্ট্রেটর। সকালের আইন বিকালবেলা পালটে ফেলেন, তাই বদলোকে বলে - ক্যান্সেল মাই লাস্ট এনাউন্সমেন্ট। এর পাশাপাশি দরকার কিছু বেসামরিক মুখ – বিবেক ও মেরুদণ্ডহীন কিছু বিচারপতি আছেন এদের কুর্কমে সিল মারতে। সেই রকম এক বশংবদকে ধরে বানানো হলো প্রেসিডেন্ট। রাতের দিকে কারফিউ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে থাকে, তবে এই রাতে কারফিউ মনে হয় আগে থেকেই ছিল। প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো আর হ্যাঁ সব বিশ্বসুন্দরীরা যেমন বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করেন – তেমনি সকল সামরিক শাসকরাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদে যান। তাই অনেক রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হলেন।

সামরিক আইন বড় কঠিন এটা বুঝলাম। এর বিরুদ্ধে কথা বললেই জেল, আকারে ইঙ্গিতে বললেও একই বিপদ। আকারে ইঙ্গিতে কিভাবে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় সেটা আজও মাথায় ঢুকেনি। রশিদ ভাইও একই বক্তব্য দিলেন...ভাইয়া “সামরি” আইন চলতাছে...সাবধানে থাইকো। কথাটা ভুল নয় - আমাদের অখ্যাত আরামবাগ রেঁস্তোরা থেকেই দুই জনকে ধরে নিয়ে গিয়েছে সেনাবাহিনী, ওরা নাকি আর্মির সমালোচনা করছিল।

আমার চেনা প্রতিটা লোকই বিক্ষুদ্ধ, শুধু মুখ বন্ধ। স্কুলের স্যারেরাও অখুশি যদিও সেটা মুখে তেমন প্রকাশ করছেন না। শুধু খায়ের স্যার খুশি। উনি স্বাধীনতার আগে উর্দু পড়াতেন, এখন ধর্ম আর আরবি পড়ান। উনার মতে বাঙালির চরিত্র বুঝেছিল একমাত্র আইয়ুব খান-- বেতের বাড়ি ছাড়া এই জাতি ঠিক হবে না। সেই বেতের বাড়ি এখন বাঙালির পশ্চাৎদেশে যত্রতত্র পড়াটা একদম যথার্থই মন হয়েছে উনার কাছে। আমার বড়ভাই বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি করতেন, বাবা-মা সরকারি চাকরি। ভাইয়া অল্প কয়দিনের জন্য গা-ঢাকাও দিলেন। দেশের প্রতিটা লোককে ক্ষেপিয়ে এই লোক কিভাবে দেশ শাসন করবে? কিন্তু দেখা গেলো দেশ শাসন করতে গেলে জনপ্রিয় হতে হয় না, কালক্রমে সেনাপতির ভালো নাম হলো স্বৈরাচার, আমিও বড় হতে লাগলাম তার মিথ্যে কথা শুনতে শুনতে।

দেশে সুশাসনের বদলে কুশাসন আর অনাচার থাকলে বাচ্চাদের বড় হওয়াটা বেশ দ্রুতই হয়। দেখা গেলো এই অতি অপছন্দের এবং অতি অ-জনপ্রিয় স্বৈরাচারের কাছেও হরদম বিক্রি হচ্ছে ঘাগু নেতা, টিভি উপস্থাপক, কবি, তুখোড় ছাত্র নেতা। আমাদের দুর্নীতির গোপন রোগটাও স্বৈরাচারের অজানা নয়, উনি ভাত ছড়াচ্ছেন আর কাকের অভাব হচ্ছে না। ভাত ছড়াতে ছড়াতে পুরো দেশটাই কাকময় না হয়ে যায় আবার। টিভির সংবাদে স্বৈরাচারের দিনলিপি দেখি। একদিন পত্রিকা খুলে দেখলাম স্বৈরাচারের কবিতা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষিত হলো, সেই সঙ্গে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল হয়ে শুক্রবার ছুটির দিন ঘোষিত হলো। এই বাটপারের হাতে দেশ, ধর্ম, রাজনীতি সবই ধর্ষিত হলো।

আমাদের স্কুলের দিনগুলোও বেশ তথ্যবহুল ছিল। একদিন শুনলাম স্বৈরাচার শালা নাকি - "আটকুইড়্যা”...অর্থাৎ আঁটকুড়ে মানে নিঃসন্তান। এরসাথে রাজনীতির সংশ্রব কি সেটা জানি না কিন্তু এই বদনাম রটার অল্প পরেই স্বৈরাচারের স্ত্রী এক সন্তানের জন্ম দিলেন। এক সপ্তাহ আগেও উনাকে টিভিতে দেখা গেছে, আসন্ন প্রসবা বলে মনে হয় নি। তবে সিএমএলএ সাহেব চাইলে একমাসেও বাচ্চা পয়দা সম্ভব। সামরিক আইন এমনই কঠিন জিনিস।

স্কুলে অনেক মজার জোক - সেগুলোর প্রতিটাই চূড়ান্ত রকমের অশ্লীল। স্বৈরাচার আবার নাকি আবার লম্পটও, প্রায়ই নানান গুজব শোনা যায় তাকে জড়িয়ে। সে সময়ে গুজবও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যম ছিল। উঠতে বসতে স্কুলের বন্ধুরা গালি দেয় তাকে, বেশির ভাগ গালিই “চ” দিয়ে শুরু...আমার নিজের দেওয়া প্রথম “চ” বর্গীয় গালিটাও স্বৈরাচারকেই দেওয়া। বালক, যুবক, নবীন এবং প্রবীণ – সবাই তাকে গালি দিয়েই যাচ্ছে, অথচ উনি ক্ষমতায় অবিচল। মিথ্যে কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে উনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অল্প সময়েই। একবার টিভিতে দেখলাম উনি রাতের স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পরদিন দুপুরবেলায় মগবাজারের এক মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করছেন। মসজিদের কাছেই বন্ধুর বাড়ি, সে জানালো প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই গোয়েন্দা আর পুলিশ মিলে ওই জায়গার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে- বলা যায় না গোয়েন্দারা হয়ত স্বপ্নের খবরও আগেই পেয়ে যায়!!

আমি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন দেখিনি। কিন্তু এই মিথ্যে কথার মেরুদণ্ডহীন দেশে বড় হতে গিয়ে টের পেলাম ছাত্রদের শক্তি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চোখ তুলে কথা বলতে পারে শুধু ছাত্ররাই এবং প্রথম আন্দোলনের সূচনা হলো তাদের হাত দিয়েই। মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধাচারণ দিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৮২ সালেই। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে শহীদ হন জয়নাল, জাফর আর দীপালী সাহা সহ আরো কয়েকজন। শিক্ষাভবনের সামনে ঘটে যাওয়া সেই নারকীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন অনেকেই, আমার মা তখন ওই ভবনেই কর্মরত ছিলেন।

এ সমস্ত ঘটনার বিবরণ পত্রিকাতে বেশি আসতো না - সেন্সরশীপ ছিল প্রবল। সরকার থেকে প্রেসনোট দেওয়া হতো, গুগল করে ১৪ই ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরদিনের ইত্তেফাক রিপোর্টটা পুরো তুলে দিলাম।

গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সরকার এক প্রেসনোটে ঢাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের লক্ষ্যে পরিচালিত ক্রমবর্ধমান ও পরিকল্পিত ছাত্র গোলযোগ বন্ধের উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। প্রেসনোটে বলা হয়, এই ছাত্র গোলযোগ শান্তিপ্রিয় জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিতেছিল। ঢাকায় ছাত্রদের একদিনের উস্কানিমূলক গোলযোগের প্রেক্ষিতে সরকার নিম্নোক্ত ব্যবস্থাবলী ঘোষণা করিয়াছেন:

(১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হইবে। আজ (মঙ্গলবার) সকাল নয়টার মধ্যে ছাত্রদের সকল আবাসিক হল ত্যাগ করিতে হইবে।

(২) সভা, শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত বিধিসমূহ কঠোরভাবে প্রয়োগ হইবে।

(৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ধ্যা ৬টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত এবং মেট্রোপলিটন ঢাকার অবশিষ্ট এলাকায় রাত্রি ১০টা হইতে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকিবে।

ঘোষণায় বাংলাদেশ সচিবালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গোলযোগে পর্যবসিত ঘটনাবলীর উল্লেখ করা হয়। ১৪টি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনসমূহের মোর্চা তথাকথিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা কয়িয়াছিল যে, তাহারা সরকারী নীতির প্রতিবাদে সচিবালয় অবরোধ করিবে।

সকাল ১১টায় তাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বক্তারা সামরিক আইন ভঙ্গ করিয়া ছাত্রদেরকে আইন নিজের হাতে তুলিয়া লওয়ার আহ্বান জানাইয়া উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেয়। ছাত্রনেতা নামধারী এই সকল পেশাদার উস্কানিদাতাদের উস্কানিতে ছাত্ররা একটি শোভাযাত্রা বাহির করে, যা কিনা সামরিক আইনে নিষিদ্ধ। সরকারের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে দিতে তাহারা একযোগে সচিবালয়ের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে এবং পুলিশ পুরাতন হাইকোর্টের কার্জন হল সংযোগস্থলে তাহাদিগকে থামাইয়া দেয়। অতঃপর উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা কর্তব্যরত পুলিশের প্রতি ব্যাপকভাবে ইট নিক্ষেপ করিতে শুরু করে এবং পুলিশ কর্ডন ভাঙ্গার চেষ্টা করে।

সংখ্যাগত কারণে কোণঠাসা হইয়া শুধুমাত্র লাঠি ও বেতের ঢাল সজ্জিত পুলিশ বিপদগ্রস্ত হয় এবং জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিবার জন্য হোসপাইপের সাহায্যে পানি নিক্ষেপ করে। উহা ব্যর্থ হইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করিয়া ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়।


এই নিউজ পড়ে ও দেখে যে বড় হয়েছে, মিডিয়া সম্বন্ধে তার উচ্চধারণা থাকবে না। আমি ও আমার সমসাময়িক অনেকের মনেই মিডিয়ার ব্যাপারে চিরস্থায়ী অবিশ্বাস জন্মে গেছে।

স্বৈরাচারের শাসনকালেই আমি স্কুল থেকে কলেজে ভর্তি হই। আমাদের স্কুলের প্রায় সব ছাত্রই রাস্তার ওপারের ঢাকা কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখে, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমাদের স্কুলের বিরাট একটা দল ঢাকা কলেজে ঢুকে। ঢাকা কলেজ রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন একটা জায়গা। ছাত্রলীগের একনেতা আমাদের স্কুল সূত্রে বড় ভাই। উনি আমাদের প্রায় সবাইকে ঢুকিয়ে দিলেন ছাত্রলীগে। প্রথম দুই মাস সকালে একটা-দুইটা মিছিল – এইটুকুতেই আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ও শেষ। আমার ভূমিকা ছিল দর্শকের, আর মন দিয়ে পত্রিকার খবর পড়া।

সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটো দলই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছে। দু'জনে একসঙ্গে ঠেলা দিলে স্বৈরাচারকে সদর দরজা দেখানো যাবে - এই বিশ্বাসটা প্রবল ছিল। আমিও তখন এবং এখনো বিশ্বাস করি সেটা। ১৯৮৬ সালের প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নাম লিখিয়ে স্বৈরাচারকে আরও দীর্ঘায়িত করল, এর পরপর আমাদের কলেজে ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। দু'দিন আগেও ছাত্রলীগের মিছিল থেকে আন্দোলনের হুঙ্কার শোনা যেত, আর এখন সেখানে নির্বাচনমুখি কথাবার্তা। ওদিকে ছাত্রদল বলছে - নির্বাচনে যাওয়া জাতীয় বেঈমানী। ওদের নেত্রী স্বৈরাচার প্রশ্নে আপোষহীন। লীগের ছাত্রনেতারা বলছেন...আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়ার আমলেও নির্বাচন করেছে, সুতরাং...জানিনা এই বুদ্ধি কে দিয়েছিল জননেত্রীকে, কিন্তু এই ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে এবং পুরো জাতিকে।

স্বৈরাচারবিরোধী সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। দুই বড় দলের যুগপৎ আন্দোলনের এক পর্যায়ে শহীদ হন নূর হোসেন। কয়েক সপ্তাহ আগে লিটন ভাইয়ের এই [url=http://www.sachalayatan.com/riton/36205]লেখাটা[/url] পড়ে সেসব কথা মনে পড়ছিল। সেবারও স্বৈরাচার পতনের একদম কাছে গিয়েও আমরা শেষ হাসি হাসতে পারিনি।

সেই হাসি হাসতে আরো তিন বছর লেগেছে। আমি এরই মধ্যে কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ততদিনে অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে, আন্দোলন করলেই স্বৈরাচার হটে যাবে এই বিশ্বাসও কেমন যেন টলে গেছে। ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন শুরু হলো। কিন্তু এবার সেটা বেগবান হতেই থাকলো, নভেম্বর নাগাদ আমরা আবারো আশার আলো দেখতে পেলাম।

আমি তখন বুয়েটের প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি। ফিরে দেখলে মনে হয় এই সময়টা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বহুদূরে কিন্তু অসচেতন নই। স্বৈরাচার এবার ভাড়া করেছে অভি আর নীরুর মত বৃহৎ মাপের ছাত্রনেতা। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য আর সাধারাণ ছাত্রদের মুখে তারা ক্যাম্পাস থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে যেন আমি ইতিহাসই দেখতাম সেই সময়ে।

এর মধ্যেই এসে গেল ২৭ এ নভেম্বর। সেদিন সকালে একটা পরীক্ষা ছিল। আমি আর আমার বড়ভাই সকালে ফার্মগেট থেকে বুয়েটের সবেধন নীলমনি বাসটা ধরলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকার অনেকগুলো পথই বন্ধ। বাস বেশ ঘুর পথেই ক্যাম্পাসে ঢুকল। সকাল আটটার পরীক্ষাটাও হলো। এরপরই ক্লাস বর্জন। সকাল ১০ নাগাদ আমাদের ক্যাম্পাস থেকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিলটা বেরিয়ে গেল। এর পরপরই গুলির শব্দ শুরু হলো। চারধার প্রকম্পিত করার মত শব্দ। গুজব শুনলাম আমাদের বুয়েটের মিছিলটা আক্রান্ত হয়েছে - স্বৈরাচারের অস্ত্র তখন অভি আর নীরুর গুন্ডাবাহিনী। জানা গেল রাজু নামে এক বুয়েট ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়েছে। রাজুভাইকে আমি মুখে চিনতাম।

একটু পরেই গোটা শহর কুরুক্ষেত্রে পরিণত হলো। বুয়েট থেকে প্রায় পুরোটা পথই হেঁটে আর দৌড়ে বাসায় ফিরতে হলো। আর একটু পরেই শুরু হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। এর ভেতরই বিচ্ছিন্ন গুলির শব্দ, আমি ১৯৭১ দেখিনি কিন্তু ১৯৯০ তে দেখলাম মানুষের সেই একই ঐক্য। বিকেলে এক ডাক্তার বড়বোন জানালেন অভি-নিরু গ্রুপের গুলিতে ডাঃ মিলন নামে একজন ডাক্তারের শহীদ হওয়ার কথা। ডাঃ মিলনকে আমরা কেউ চিনতাম না, কিন্তু মুহূর্তেই যেন উনি সাধারণ থেকে অসাধারণত্বে উন্নীত হলেন। এই মিথ্যে বলার কাপুরুষ দেশ যেন অপেক্ষা করছিল যেন এক সাহসী পুরুষের, যে নিজেকে বিলিয়ে সবার জন্য আগুন নিয়ে আসবে। এরপরের ঘটনা সবারই জানা।

স্বৈরাচার পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সপ্তাহব্যপি বিজয় উৎসব চলে। আমরা প্রতিদিন সকালে যেতাম সেই অনুষ্ঠানে, সারাদিন থাকতাম, কনসার্ট দেখে, হৈচৈ করে আর রঙ মেখে সন্ধ্যায় ফিরতাম। বোকার মত ভেবেছিলাম যে দেশের যাবতীয় সমস্যার সমাধান এবার হয়ে যাবে, যেই বাংলাদেশ আমরা সবাই স্বপ্নে দেখি সেই বাংলাদেশ এবার ধরা দেবে।

স্মৃতির শহর আমার শৈশবের গল্প। শৈশবের শেষ কোথায় এটা বলা মুশকিল কিন্তু আমি জানি যে শৈশবটা স্বপ্ন দেখার সময় আর সেই স্বপ্নের পরাজয়টা বড়বেলার গল্প। শৈশবের তুলনায় তাই বড়বেলার গল্পগুলোই বড়ই ধূসর। আমিও এরপর স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েই আমি বড় হয়ে গেলাম। সেই গল্পগুলোও অন্য একসময়ে করব।

এটাই স্মৃতির শহরের শেষ পর্ব। দীর্ঘদিন আমার সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্রতিটা মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া আমি মন দিয়ে পড়ি এবং শিরোধার্য মনে করি। আমাকে যেসব জিনিস স্পর্শ করেছে ব্যাপকভাবে, আমার পরিবার, আমার পিতামাতা, শৈশবে বন্ধুরা, আমার বইপড়া, অতিপ্রিয় কবি, ইশকুল, ঘুম ঘুম তেজগাঁ ...সবাইকে নিয়েই আমি পর্ব লিখেছি একটি করে। আরো কিছু বিষয়ে লিখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু কিছু গল্প অপ্রকাশিত থাকাই হয়ত ভালো। সিরিজ শেষ হয়ে গেলেও আমার লেখনিতে শৈশব উঁকিঝুকি মারবে সুনিশ্চিত।

জীবন নিয়ে যদি আমার অভিমত জানতে চাওয়া হয়, তবে আমি বলব জীবন অত্যন্ত বিস্ময়কর এক যাত্রা, যতই এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছি সেই বিস্ময় যেন শুধু রঙ পাল্টাচ্ছে এবং আরো নতুন রূপে আসছে আমার কাছে। তবুও এই মাঝবয়েসের কাছে এসেও যেন বালকবেলার বিস্ময় রয়ে গেছে অমলিন অথবা হয়ত এখনো আমি শৈশবকে অতিক্রম করতে পারিনি। এতদিনেও যদি না পারি, তবে বাকি জীবনে যে এর থেকে মুক্তি নেই সেটাও সুনিশ্চিত। তবে শৈশব কৈশোরের স্মৃতি আছে বলেই জীবনযাপন বাস্তবতার কষাঘাত থেকে একটা সুরক্ষা পায়।

স্মৃতির শহর হুট করে লিখতে বসলেও এই গল্পগুলো আমার মাথার ভেতরে ছিল অনেকদিন। সচল আর অভ্রের কল্যাণে সেই গল্পগুলো আপনাদের শোনাতে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। সবার কপালে এই সৌভাগ্য জোটে না। এই সিরিজ পড়ে কেউ কেউ স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে নিজের শৈশব নিয়ে লিখেছেন - এটা আমার পরম পাওয়া। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের সবচেয়ে বেশি মিল মনে হয় থাকে শৈশবেই, এর পর পথগুলো সব নানান দিকে যেতে থাকে। তাই হয়ত শৈশবই আমাদের সম্মিলিত ঐক্যের স্থান। কাউকে শৈশব অভিমুখে যাত্রা করতে দেখলে আমরাও হয়ত আনমনে হৃদয় খুঁড়ে তুলে আনি এক টুকরো স্মৃতির শহর। আমরা শৈশব ছেড়ে গেলেও শৈশব আমাদের ছাড়ে না !!!

বেঁচে থাকুক -- আমাদের সবার স্মৃতির শহর।



শহরের টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়ে; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।


(বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় / শামসুর রাহমান)

স্মৃতির শহর: দুপুর বেলার গল্প

আম্মা আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এই ঘটনা বেশি বিরল নয়, দুপুরে একটা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়তেন, সাথে আমি। বইটা হতে পারে "কেরি সাহেবের মুন্সি" অথবা "অনুবর্তন", যা-ই হোক না কেন, দুপুর বেলা ছাপার অক্ষরে চোখ বুলানো চাই। সেই সময় আমার দুপুরে ঘুমাতে অসহ্য লাগতো, যদিও এখন ফাঁক পেলেই আমি নিদ্রাদেবীর বন্দনা করি।

আম্মা ঘুমিয়ে গেলেই আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি। আমাদের বাসার পেছনে এক চিলতে একটা মাঠ আছে। বড় বহুরূপী এই মাঠ, কখন এটা ফুটবল খেলার স্টেডিয়াম, কখনো ব্যাডমিন্টনের কোর্ট, কখনো আমার শৈশবের জাহাজ, কখনো চোর-পুলিশ খেলা...কখনো আড্ডাস্থান...একই অঙ্গে এর এতো রূপ। মাঠের পাশেই তার টানা আছে। সেই তারে রোদের উষ্ণতার আকাঙ্ক্ষায় ঝুলছে বিছানার চাদর, সার্ট-প্যান্ট, শাড়ি...তাদের শরীর থেকে আসছে জেট সাবানের সতেজ ঘ্রাণ, যা মিশে আছে এই দুপুর বেলার খাঁ খাঁ বাতাসে।

ওদের একটু পেছনেই আমাদের দেয়াল, সেই দেয়ালের ওপারে পুরো রহস্যের খাসমহল। বিশাল একটা জায়গার মাঝে একটা ছোট্ট একটি পুরানো বাড়ি, তার চারপাশটা কেমন জংলা আর এরই মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল জাম গাছ। পড়শিদের সেই বাড়ি দেখলেই কেমন গা-ছমছম করে। একটা সতেজ সবুজ কামরাঙা গাছ দাঁড়িয়ে পাঁচিলের ঠিক ওপারে, যার বেশির ভাগ শাখা-প্রশাখাই হেলে আছে আমাদের বাসার সীমানার এপারে। বিনা যত্নেই সে দেদার ফল বিলায়, মাটিতে পড়ে থাকে তার সন্তানেরা অতি অবহেলাতে। এই গাছটাতে থাকে অনেকগুলো টিয়াপাখি, ওদের আহার ও বাসস্থান দুটোই দিচ্ছে এই গাছটা।

আমাদের সেই একচিলতে জমিতে দুই একটা ঘাসফুল ফুটে আছে। এই বাসায় ফুল খুব দুর্লভ নয়, আমার বাবার লাগানো ফুল ও ফলের গাছে চারিদিক শোভিত। সেই লোভে লোভে প্রতিদিন আসে বেশ কয়েকটা রঙিন প্রজাপতি। আমি তাদের পিছু নেই, ওদের চকমকে ডানাদুটো আলতো করে ধরেই যদি আবার ছেড়ে দেই, তবে হাতের আঙ্গুলে ওদের ডানার নকশা লেগে থাকে। কী অদ্ভুত এই প্রাণীগুলো!!!

প্রজাপতির পিছু ছেড়ে আমি রঙ্গন ফুলের গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে তার পেছনে মুখ লাগিয়ে টেনে নেই এক ফোঁটা মিষ্টি তরল, এটাই মনে হয় ফুলের মধু। মাঝে মাঝে কুড়াই সন্ধ্যামালতী ফুলের কালো রঙের বীজ। আবার কোনো কোনো দিন প্রজাপতি আর ফুল কেউই আমাকে টানেনা...আমি গেট খুলে স্টেশন রোডে দাঁড়াই।

বাসার সামনেই “আশ্চর্য হাড়ভাঙার তৈল”, যে কোন ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়ার আশ্চর্য ঔষধ, আবিষ্কর্তা হেকিম হাবিবুর রহমান। হেকিম সাহেব হাড়ভাঙা রোগীর হাতে তেল মাখিয়ে দিয়ে বড় একটা হাড় নাড়িয়ে মন্ত্র পড়তে থাকেন, রোগীর প্রবল আতর্নাদে চারিদিক ভেসে যায়। রোগী দেখার পাশাপাশি উনি কোক-পেপসি, চানাচুর, চকোলেট আর মাঝে-সাঝে ডিমও বেচেন। ওনার চিকিৎসা দেখা এবং আড্ডার লোভে প্রচুর লোকসমাগম হতো দোকানের সামনে। আড্ডাবাজরা অধিকাংশই তেজগাঁ স্টেশনের কুলির কাজ করেন। ঠিক উলটো দিকেই যে স্টেশনের মালের বুকিং অফিস আর গোডাউন।

দুপুর বেলা আমাদের বাসাটা যতই নিস্তব্ধ, স্টেশন রোড ততটাই সরগরম। সত্য বলতে কী, স্টেশন রোড সর্বদাই ব্যস্ত থাকে মানুষের ভীড়ে, এই এলাকায় গভীর রাতে চা “খেতে” মন চাইলেও সেটা খুবই সম্ভব। বুকিং অফিসের পাশ দিয়ে একটা সরু পথ গিয়েছে একদম রেললাইন পর্যন্ত। রেলগাড়ির আসা-যাওয়া দেখতে চাইলে মাত্র ১০০ গজ হাঁটতে হবে। আমার বাবার শৈশবে রেলগাড়ি বড় পছন্দের ছিল, উনি চাইতেন যেন বাসা থেকেই ট্রেন দেখা যায়। উনার সেই বাসনা পূর্ণ হয়েছে, আমিও অনেক দুপুরই রেলগাড়ির যাতায়াত দেখে কাটিয়েছি।

রেলগাড়ি দেখার পর একই পথে বাড়ি ফিরতে যে হবে সেরকম কোন কথা নেই। প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে স্টেশনের মূল ভবনে ঢোকা যায় অনায়াসে। আমার তেইশ বছরের তেজগাঁ জীবনে কোনদিন কেউ টিকেট দেখতে চায় নি। রেলের ব্যবসায় যে কেন লোকসান হয় সেটা আমার খুবই বোধগম্য। লাল ইঁটের তৈরি স্টেশনের ভবনটা অতি প্রাচীন মনে হতো আমার কাছে। অনেক বছর পরে আমেরিকার একটা ইন্ডিয়ান রেঁস্তোরাতে ভারতের একটা ছোট শহরের স্টেশনের পুরানো ছবি দেখে চমকে উঠেছিলাম। অনেক পুরানো সেই অজানা স্টেশনের ছবিটি যেন আমার শৈশবের সেই স্টেশন ঘর!! বৃটিশরা মনে হয় একই ডিজাইনে অনেক স্টেশন তৈরি করেছে। স্টেশনের ভেতরে রাখা যন্ত্রপাতিগুলোও স্টেশনের বয়েসের কাছাকাছি, সর্বত্রই একটা মিউজিয়াম মিউজিয়াম গন্ধ।

স্টেশনে দর্শনীয় তেমন কিছুই নেই। দু'তিনটা দোকান, ভ্রাম্যমান বিক্রেতা যাদের অধিকাংশই ঢোল কোম্পানির দাদের মলম বিক্রি করছে। এই রোগ আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। স্টেশনের উলটো দিকে আরামবাগ রেঁস্তোরার তখন স্বর্ণযুগ যাচ্ছে, এই দীনহীন স্টেশনের পাশে থেকেও ওরা জমিয়ে ব্যবসা করছে। ওদের ব্যবসা এখনো বেশ জমজমাট বলেই মনে হয়েছে আমার। আমার জীবনে দেখা অন্যতম বড় খোলা ড্রেনটাও এই অঞ্চলেই, সেটার পানির কোন কলকল ধ্বনি নেই, কেমন কেন যেন কালো থকথকে কাদা কাদা চেহারা তার।

রেঁস্তোরা, নাপিতের দোকান আর যা কিছু জমজমাট আছে, সেগুলো পেরিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ফার্মগেটের দিকে। যতই ঢুকবেন সেই পথে, ততই সরু ও নির্জন হয়ে পড়বে সেটা। এই রাস্তার পাশে আছে অতি প্রাচীন একটা গীর্জা এবং তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মত পুরানো এক কবরস্থান। দিনের বেলায় ভূতদের ঘুমানোর সময়, তাই আমি অবলীলায় হেঁটে যেতাম তার পাশ দিয়ে। কবরস্থানের গা-ঘেঁষে বেখাপ্পা দাঁড়ানো কিছু শাল গাছ, স্টেশনের গমগমের পরিবেশ থেকে সাত মিনিট হাঁটলেই কেমন নৈঃশব্দের কবিতা শোনা যায়। এই গীর্জাতেই মাদার টেরেসা তাঁর নির্মলা হোম অফ চ্যারিটির শাখা খুলেন কিছু দিন পরে। এর পাশেই মেয়েদের বিখ্যাত স্কুল আর কলেজ হলিক্রস এবং একটু কম খ্যাতি সম্পন্ন স্কুল বটমলি হোমস। এইসব জায়গায় মিশে আছে ছেলেবেলা ছেলেবেলা গন্ধ। গীর্জায় বিকেলের ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং...নাহ...বাসায় ফেরা উচিত, আম্মা নিশ্চয় উঠে চায়ের সরঞ্জাম করছেন।

দুপুরবেলার গল্পগুলো খুব সহজেই অতিক্রম করে স্থান ও কালের সীমানা। এরা হুট করে ৩০ বছর পাড়ি দিয়ে চলে আসে আমার কাজের মাঝে, অন্য রকম এক দুপুরে, অন্য এক শহরে। কিছুতেই বাধা মানে না তারা, এমনই নাছোড়বান্দা। যে শহরকে কতকাল আগে বিদায় দিয়েছি এক মেঘলা সকালে, সে এতদিন পরেও কেন ফিরে ফিরে আসে এই ব্যস্ত দুপুরবেলায়?

আজকের দুনিয়ার মানুষ এক দেশে জন্মে অন্য দেশে অবলীলায় চলে যাচ্ছে, বদলে ফেলছে তার নাগরিক পরিচয়। কিন্তু মানুষের নাগরিকত্বের মানবিক ব্যাপারটা আমার মনে হয় শৈশবের সাথে সম্পর্কিত। বহুদূর দেশে থেকেও মানুষ চোখ বন্ধ করলেই যে শহরটা দেখতে পায়, সেই শহর থেকে তার মুক্তি নেই। সেই হিসাবে আমি ঢাকা শহর বা আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে তেজগাঁর নাগরিক। দেশে থাকার সময়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে গেলেই একধরণের অস্থিরতায় আক্রান্ত হতাম, কবে ফিরব, কবে ফিরব...সব সময়ে এটাই মনে হতো। এই প্রবাসে সেটা আজ আর নেই, তবুও কোথাও যেন রয়ে গেছে একরাশ শূন্যতা। সেই শূন্যতা ঢাকায় নামলেও আর পূরণ হয় না, হবারও নয়। সেই শহর হারিয়ে গেছে আমার শৈশবের সাথে সাথে, প্রত্যাবর্তনের দিকে ওরা ফেরাবে না মুখ কস্মিনকালেও। তবু তাকে ছোঁয়া যায়, তার গন্ধ নেওয়া যায়, তার কাছে যাওয়া যায়...শুধু এই স্মৃতির শহরেই।

তখন কি আমি জানতাম
দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?
হ্রদের ছলছলানি ? এমন সম্মোহনময় ?
পুলিশের বাঁশি, মাইল মাইলব্যাপি বুটের শব্দ,
বম্বারের মৃত্যুবর্ষী গর্জন, বাতিল শাসনতন্ত্রের হাহাকার
আর পাঁচশালা পরিকল্পনার আর্তনাদ ছাপিয়ে
একটা দুপুর চাইকোভস্কির সুর হতে পারে...

(একটি দুপুরের উপকথা/শামসুর রাহমান)

Sunday, December 5, 2010

জন্মদিনে...

বার্ধক্যের সাথে আপনার নিজের বয়সের যোগসূত্র আছে কোথাও। সেদিন এক আড্ডায় বলে বসলাম...টাবলু ভাই, উনিতো ইয়াং লোক আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়ার, বয়স মাত্র ৪৬। বন্ধুরাও সায় দিল তাতে। আমাদের বয়স যত বাড়ছে, তারুণ্যের সিলিং ততই বেড়ে যাচ্ছে। চল্লিশে এসে এখন মনে হয় ষাট পর্যন্ত মানুষ ছোকরা থেকে যায়। আর ত্রিশ বছর বেচে থাকলে হয়ত আশিকেও যুবক যুবক লাগবে। মনে মনে কেউ নিজেকে বুড়ো ভাবে না বোধহয়।

ক্লাসে টু'তে যখন শুনলাম সাত্তার স্যারের বয়েস ত্রিশ তখন রীতিমত বুড়ো লোক মনে হয়েছিল তাঁকে। এখন নিজের বয়স প্রতি বছর একটু একটু করে বাড়ছে, কমার নাম মাত্র নেই। বিশ বছর আগে যেসব মেয়েদের সাথে টাঙ্কি এবং ইয়ার্কির সম্পর্ক ছিল তারা সবাই বতর্মানে খালাম্মা বলে সম্বোধিত এবং জীবন নিয়ে দারুন ব্যস্ত, অনেকের টিনেজার সন্তানও আছে। আমরা ছেলেরাও পুত্র কন্যা নিয়ে ব্যস্ত; আমাদেরকেও আনায়াসে আঙ্কেল বলে ডাকে আজকের ২০/২২ বছরের ছেলেমেয়েরা। ঐ বয়েসী ভাগ্নে-ভাস্তে আমাদের সবারই আছে।

আমার আশি বছর বাঁচার কথা। এটা আমার হিসাব নয়, ছোটবেলায় একজন হাত দেখে বলেছিল। সে সময় এটাকে অনন্তকাল মনে হতো। এখনও যে খুব অল্প সময় মনে হয় তা না। আশি বছর বাঁচলে আমি অর্ধেক জীবন পাড়ি দিয়েছি। এইপথ পাড়ি দিতেই প্রচুর ঝামেলা হয়েছে, খুব মসৃণ ছিল এটা বলব না। ঠিক এর সমান আরও একটা পথ পাড়ি দিতে হবে, এটা ভাবলেই কেমন অলস অলস একটা ভাব হয়...একটু ছুটি নিতে ইচ্ছে করে জীবন থেকে। এগুলো সবই মধ্যবয়েসের ভাবনা - খুব কঠিন এই সময়, জীবনের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা দখল হয়ে যায় এ সময়ে। খালি মনে হয় পালাই-পালাই, স্কুল পালানোর যায় কিন্তু জীবন থেকে পালাবো কেমনে?

আমার যেদিন ত্রিশ বছর বয়েস হয়েছিল, সেদিন ভেবেছিলাম যে একটা মাইলস্টোন পাড়ি দিয়েছি। অথচ শরীরের কোথাও বিশ আর ত্রিশের পার্থক্য ছিল না। বিশ আর ত্রিশ দু'জনেই বেশ চটপটে জোয়ান ছোকরা। সে তুলনায় চল্লিশ অনেক গম্ভীর প্রকৃতির ভদ্রলোক, আজকে সকালে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে উঠে তাই মনে হলো। চল্লিশ সাহেব চোখে চশমা রাখেন, শৈশবের হারানো মাঠের কথা ভাবেন, উনার তুলনায় ত্রিশ একদম চটুল যুবক, প্রায় বিশের মতই। তার মনে শৈশব নিয়ে আদ্যিখেতা নেই, আছে যৌবনের বেদনাগুলো। অথচ চল্লিশ ভাবছে - দিন চলে গেলো...

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আজ এখান থেকে শৈশবের কোলাহলগুলো ঠিক যতদূরে - বার্ধক্যের হাতছানিও ঠিক প্রায় একই দূরত্বে। অবধারিতভাবে আমি উন্মুখ তাকিয়ে রই শৈশবের দিকে, বার্ধ্যকের দিকে নয়। আর কতদিন পারবো কে জানে? তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাব সুনিশ্চিত।