আম্মা আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এই ঘটনা বেশি বিরল নয়, দুপুরে একটা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়তেন, সাথে আমি। বইটা হতে পারে "কেরি সাহেবের মুন্সি" অথবা "অনুবর্তন", যা-ই হোক না কেন, দুপুর বেলা ছাপার অক্ষরে চোখ বুলানো চাই। সেই সময় আমার দুপুরে ঘুমাতে অসহ্য লাগতো, যদিও এখন ফাঁক পেলেই আমি নিদ্রাদেবীর বন্দনা করি।
আম্মা ঘুমিয়ে গেলেই আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি। আমাদের বাসার পেছনে এক চিলতে একটা মাঠ আছে। বড় বহুরূপী এই মাঠ, কখন এটা ফুটবল খেলার স্টেডিয়াম, কখনো ব্যাডমিন্টনের কোর্ট, কখনো আমার শৈশবের জাহাজ, কখনো চোর-পুলিশ খেলা...কখনো আড্ডাস্থান...একই অঙ্গে এর এতো রূপ। মাঠের পাশেই তার টানা আছে। সেই তারে রোদের উষ্ণতার আকাঙ্ক্ষায় ঝুলছে বিছানার চাদর, সার্ট-প্যান্ট, শাড়ি...তাদের শরীর থেকে আসছে জেট সাবানের সতেজ ঘ্রাণ, যা মিশে আছে এই দুপুর বেলার খাঁ খাঁ বাতাসে।
ওদের একটু পেছনেই আমাদের দেয়াল, সেই দেয়ালের ওপারে পুরো রহস্যের খাসমহল। বিশাল একটা জায়গার মাঝে একটা ছোট্ট একটি পুরানো বাড়ি, তার চারপাশটা কেমন জংলা আর এরই মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল জাম গাছ। পড়শিদের সেই বাড়ি দেখলেই কেমন গা-ছমছম করে। একটা সতেজ সবুজ কামরাঙা গাছ দাঁড়িয়ে পাঁচিলের ঠিক ওপারে, যার বেশির ভাগ শাখা-প্রশাখাই হেলে আছে আমাদের বাসার সীমানার এপারে। বিনা যত্নেই সে দেদার ফল বিলায়, মাটিতে পড়ে থাকে তার সন্তানেরা অতি অবহেলাতে। এই গাছটাতে থাকে অনেকগুলো টিয়াপাখি, ওদের আহার ও বাসস্থান দুটোই দিচ্ছে এই গাছটা।
আমাদের সেই একচিলতে জমিতে দুই একটা ঘাসফুল ফুটে আছে। এই বাসায় ফুল খুব দুর্লভ নয়, আমার বাবার লাগানো ফুল ও ফলের গাছে চারিদিক শোভিত। সেই লোভে লোভে প্রতিদিন আসে বেশ কয়েকটা রঙিন প্রজাপতি। আমি তাদের পিছু নেই, ওদের চকমকে ডানাদুটো আলতো করে ধরেই যদি আবার ছেড়ে দেই, তবে হাতের আঙ্গুলে ওদের ডানার নকশা লেগে থাকে। কী অদ্ভুত এই প্রাণীগুলো!!!
প্রজাপতির পিছু ছেড়ে আমি রঙ্গন ফুলের গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে তার পেছনে মুখ লাগিয়ে টেনে নেই এক ফোঁটা মিষ্টি তরল, এটাই মনে হয় ফুলের মধু। মাঝে মাঝে কুড়াই সন্ধ্যামালতী ফুলের কালো রঙের বীজ। আবার কোনো কোনো দিন প্রজাপতি আর ফুল কেউই আমাকে টানেনা...আমি গেট খুলে স্টেশন রোডে দাঁড়াই।
বাসার সামনেই “আশ্চর্য হাড়ভাঙার তৈল”, যে কোন ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়ার আশ্চর্য ঔষধ, আবিষ্কর্তা হেকিম হাবিবুর রহমান। হেকিম সাহেব হাড়ভাঙা রোগীর হাতে তেল মাখিয়ে দিয়ে বড় একটা হাড় নাড়িয়ে মন্ত্র পড়তে থাকেন, রোগীর প্রবল আতর্নাদে চারিদিক ভেসে যায়। রোগী দেখার পাশাপাশি উনি কোক-পেপসি, চানাচুর, চকোলেট আর মাঝে-সাঝে ডিমও বেচেন। ওনার চিকিৎসা দেখা এবং আড্ডার লোভে প্রচুর লোকসমাগম হতো দোকানের সামনে। আড্ডাবাজরা অধিকাংশই তেজগাঁ স্টেশনের কুলির কাজ করেন। ঠিক উলটো দিকেই যে স্টেশনের মালের বুকিং অফিস আর গোডাউন।
দুপুর বেলা আমাদের বাসাটা যতই নিস্তব্ধ, স্টেশন রোড ততটাই সরগরম। সত্য বলতে কী, স্টেশন রোড সর্বদাই ব্যস্ত থাকে মানুষের ভীড়ে, এই এলাকায় গভীর রাতে চা “খেতে” মন চাইলেও সেটা খুবই সম্ভব। বুকিং অফিসের পাশ দিয়ে একটা সরু পথ গিয়েছে একদম রেললাইন পর্যন্ত। রেলগাড়ির আসা-যাওয়া দেখতে চাইলে মাত্র ১০০ গজ হাঁটতে হবে। আমার বাবার শৈশবে রেলগাড়ি বড় পছন্দের ছিল, উনি চাইতেন যেন বাসা থেকেই ট্রেন দেখা যায়। উনার সেই বাসনা পূর্ণ হয়েছে, আমিও অনেক দুপুরই রেলগাড়ির যাতায়াত দেখে কাটিয়েছি।
রেলগাড়ি দেখার পর একই পথে বাড়ি ফিরতে যে হবে সেরকম কোন কথা নেই। প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে স্টেশনের মূল ভবনে ঢোকা যায় অনায়াসে। আমার তেইশ বছরের তেজগাঁ জীবনে কোনদিন কেউ টিকেট দেখতে চায় নি। রেলের ব্যবসায় যে কেন লোকসান হয় সেটা আমার খুবই বোধগম্য। লাল ইঁটের তৈরি স্টেশনের ভবনটা অতি প্রাচীন মনে হতো আমার কাছে। অনেক বছর পরে আমেরিকার একটা ইন্ডিয়ান রেঁস্তোরাতে ভারতের একটা ছোট শহরের স্টেশনের পুরানো ছবি দেখে চমকে উঠেছিলাম। অনেক পুরানো সেই অজানা স্টেশনের ছবিটি যেন আমার শৈশবের সেই স্টেশন ঘর!! বৃটিশরা মনে হয় একই ডিজাইনে অনেক স্টেশন তৈরি করেছে। স্টেশনের ভেতরে রাখা যন্ত্রপাতিগুলোও স্টেশনের বয়েসের কাছাকাছি, সর্বত্রই একটা মিউজিয়াম মিউজিয়াম গন্ধ।
স্টেশনে দর্শনীয় তেমন কিছুই নেই। দু'তিনটা দোকান, ভ্রাম্যমান বিক্রেতা যাদের অধিকাংশই ঢোল কোম্পানির দাদের মলম বিক্রি করছে। এই রোগ আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। স্টেশনের উলটো দিকে আরামবাগ রেঁস্তোরার তখন স্বর্ণযুগ যাচ্ছে, এই দীনহীন স্টেশনের পাশে থেকেও ওরা জমিয়ে ব্যবসা করছে। ওদের ব্যবসা এখনো বেশ জমজমাট বলেই মনে হয়েছে আমার। আমার জীবনে দেখা অন্যতম বড় খোলা ড্রেনটাও এই অঞ্চলেই, সেটার পানির কোন কলকল ধ্বনি নেই, কেমন কেন যেন কালো থকথকে কাদা কাদা চেহারা তার।
রেঁস্তোরা, নাপিতের দোকান আর যা কিছু জমজমাট আছে, সেগুলো পেরিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ফার্মগেটের দিকে। যতই ঢুকবেন সেই পথে, ততই সরু ও নির্জন হয়ে পড়বে সেটা। এই রাস্তার পাশে আছে অতি প্রাচীন একটা গীর্জা এবং তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মত পুরানো এক কবরস্থান। দিনের বেলায় ভূতদের ঘুমানোর সময়, তাই আমি অবলীলায় হেঁটে যেতাম তার পাশ দিয়ে। কবরস্থানের গা-ঘেঁষে বেখাপ্পা দাঁড়ানো কিছু শাল গাছ, স্টেশনের গমগমের পরিবেশ থেকে সাত মিনিট হাঁটলেই কেমন নৈঃশব্দের কবিতা শোনা যায়। এই গীর্জাতেই মাদার টেরেসা তাঁর নির্মলা হোম অফ চ্যারিটির শাখা খুলেন কিছু দিন পরে। এর পাশেই মেয়েদের বিখ্যাত স্কুল আর কলেজ হলিক্রস এবং একটু কম খ্যাতি সম্পন্ন স্কুল বটমলি হোমস। এইসব জায়গায় মিশে আছে ছেলেবেলা ছেলেবেলা গন্ধ। গীর্জায় বিকেলের ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং...নাহ...বাসায় ফেরা উচিত, আম্মা নিশ্চয় উঠে চায়ের সরঞ্জাম করছেন।
দুপুরবেলার গল্পগুলো খুব সহজেই অতিক্রম করে স্থান ও কালের সীমানা। এরা হুট করে ৩০ বছর পাড়ি দিয়ে চলে আসে আমার কাজের মাঝে, অন্য রকম এক দুপুরে, অন্য এক শহরে। কিছুতেই বাধা মানে না তারা, এমনই নাছোড়বান্দা। যে শহরকে কতকাল আগে বিদায় দিয়েছি এক মেঘলা সকালে, সে এতদিন পরেও কেন ফিরে ফিরে আসে এই ব্যস্ত দুপুরবেলায়?
আজকের দুনিয়ার মানুষ এক দেশে জন্মে অন্য দেশে অবলীলায় চলে যাচ্ছে, বদলে ফেলছে তার নাগরিক পরিচয়। কিন্তু মানুষের নাগরিকত্বের মানবিক ব্যাপারটা আমার মনে হয় শৈশবের সাথে সম্পর্কিত। বহুদূর দেশে থেকেও মানুষ চোখ বন্ধ করলেই যে শহরটা দেখতে পায়, সেই শহর থেকে তার মুক্তি নেই। সেই হিসাবে আমি ঢাকা শহর বা আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে তেজগাঁর নাগরিক। দেশে থাকার সময়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে গেলেই একধরণের অস্থিরতায় আক্রান্ত হতাম, কবে ফিরব, কবে ফিরব...সব সময়ে এটাই মনে হতো। এই প্রবাসে সেটা আজ আর নেই, তবুও কোথাও যেন রয়ে গেছে একরাশ শূন্যতা। সেই শূন্যতা ঢাকায় নামলেও আর পূরণ হয় না, হবারও নয়। সেই শহর হারিয়ে গেছে আমার শৈশবের সাথে সাথে, প্রত্যাবর্তনের দিকে ওরা ফেরাবে না মুখ কস্মিনকালেও। তবু তাকে ছোঁয়া যায়, তার গন্ধ নেওয়া যায়, তার কাছে যাওয়া যায়...শুধু এই স্মৃতির শহরেই।
তখন কি আমি জানতাম
দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?
হ্রদের ছলছলানি ? এমন সম্মোহনময় ?
পুলিশের বাঁশি, মাইল মাইলব্যাপি বুটের শব্দ,
বম্বারের মৃত্যুবর্ষী গর্জন, বাতিল শাসনতন্ত্রের হাহাকার
আর পাঁচশালা পরিকল্পনার আর্তনাদ ছাপিয়ে
একটা দুপুর চাইকোভস্কির সুর হতে পারে...
(একটি দুপুরের উপকথা/শামসুর রাহমান)
No comments:
Post a Comment