Thursday, July 2, 2015

অ্যালান টুরিং ও সমকামিতা

কম্পিউটারের জনক বলে পরিচিত অ্যালান টুরিং এর জীবন ও কাজ নিয়ে একটা ছবি বানানো হয়েছে গত বছর। নাম হচ্ছে "ইমিটেশন গেম", দেখার ইচ্ছে থাকলেও নানান কাজে দেখা হয়নি। গতকাল ছবিটা দেখলাম, দুবাই থেকে হিউস্টনের ফিরতি ফ্লাইটে। ছবিটা বেশ কয়েকটা অস্কার নমিনেশন পেলেও সম্ভবত একটি মাত্র ক্যাটাগরি পুরস্কার জিতেছে। ছবিটার কাহিনী মোটামুটি বলে দেওয়া হয়েছে, উইকিপিডিয়ার অ্যালান টুরিং ভুক্তিতে। নিচে জুড়ে দিলাম।


"অ্যালান ম্যাথিসন টুরিং একজন অগ্রণী কম্পিউটার প্রকৌশলী, গণিতজ্ঞ, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, গোপন সংকেত বিশেষজ্ঞ, গাণিতিক জীববিজ্ঞানী এবং ম্যারাথন দৌড়বিদ ছিলেন। কম্পিউটার প্রকৌশলের বিকাশে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি তাঁর টুরিং মেশিনের (Turing machine) মাধ্যমে গণনা (computation) ও অ্যালগোরিদম (algorithm) এর ধারণার প্রচলন করেন। টুরিংকে তাত্ত্বিক কম্পিউটার প্রকৌশল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টুরিং ব্লেচলি পার্কে (bletchly park) অবস্থিত ব্রিটেনের গভার্নমেন্ট কোড অ্যান্ড সাইফার স্কুলের (government code and cipher school) জন্য কাজ করতেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি জার্মান নৌবাহিনীর গুপ্তসংকেত বিশ্লেষণে নিয়োজিত হাট-৮ (hut-8) এর নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি জার্মান সাইফার বিশ্লেষণের বেশ কিছু কৌশল আবিষ্কার করেন। তিনি এনিগমা (enigma) মেশিনের বিন্যাস বের করার জন্য তড়িৎযান্ত্রিক (electromagnetic) যন্ত্র তৈরি করেন। গোপন সংকেত বিশ্লেষণে টিউরিং এর অবদান অ্যাটলান্টিকের যুদ্ধে নাৎসীদের হারাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ধারণা করা হয় ব্লেচলি পার্কের অবদানের কারণে ইয়োরোপের যুদ্ধের দৈর্ঘ্য দুই থেকে চার বছর কমে যায়।"

যুদ্ধের দৈর্ঘ্য কমাতে প্রায় ১৪ লক্ষ লোকের প্রাণ বেঁচে যায়। অ্যালান টুরিং এর নাম আমি শুনেছিলাম, তাঁর কাজ সম্বন্ধে সামান্য ধারনা ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। মুভির শেষাংশটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আবারও উইকি থেকে কোট করছি।


"১৯৫২ সালে টুরিংকে সমকামিতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সে সময়ে যুক্তরাজ্যে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। জেলে যাওয়া এড়াতে তিনি এস্ট্রোজেন (oestrogen) ইঞ্জেকশন গ্রহণ মেনে নেন। টিউরিং ১৯৫৪ সালে তাঁর ৪২তম জম্নদিনের ১৬ দিন আগে মারা যান।"

অ্যালান টুরিং এর কাজের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচে যায় - কিন্তু তিনি তাঁর জীবদ্দশাতে সম্মানের বদলে নির্যাতন পেয়েছেন - সমপ্রেমী হওয়ার "দোষে"। এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য - মাত্র ৬০ বছর আগেও ইংল্যান্ডে এইরকম বর্বর আইন বিদ্যমান ছিল। ছবিটা শেষ হওয়ার পরে আমার বেশ কিছুক্ষণ লেগেছে ধাতস্থ হতে।


কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা অস্বাভাবিক সেটা সম্ভবত ঠিক করে দেয় সংখ্যাগুরু মানুষেরা। যেই দেশে সবাই লুঙ্গি পরে অফিসে যায় সেখানে প্যান্ট পরাটাই অস্বাভাবিকতা। আমরা যেটা নিজেরা করিনা সেটাকেই অস্বাভাবিক মনে করি - ব্যাপারটা এই পর্যন্ত হলেই হয়তো অসুবিধা ছিল না - কিন্তু "অস্বাভাবিক" যেকোন কিছুকেই পিটিয়ে সিধে করার অভ্যাসটাও আমরা ত্যাগ করতে পারি না।


সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কিছু নয়, আবার মানুষ সমকামীদের সাথে নির্মম আচরণ করছে, সেটাও সম্ভবত প্রকৃতির বাইরের কিছু নয়। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার প্রকৃতিরই কোডিং এর একটা অংশ। এই প্রসংগে শিশুপালনের একপর্বে লিখেছিলাম...


"আমাদের বাসাতে প্রায়ই একটা বিড়াল আসে। নাম হচ্ছে গর্ডি। প্রতিবেশির বিড়াল। প্রায় সকালে আমরা খাওয়ার টেবিলে বসলে বিড়ালটাকে দেখতে পাই। আমাদের বাসার চরম বিড়ালপ্রেমী ব্যক্তি হচ্ছে আমার ছোট মেয়ে।


গর্ডি আসলেই সে Aww করে শব্দ করে। এইটার অর্থ আমাকে বুঝিয়েছে সে - "কিউট স্টাফ" দেখলে এইটা বলতে হয়। শুধু বিড়াল না সে প্রাণীজগতের প্রায় সবাইকে দেখলেই আপ্লুত হয়।


বৃষ্টি হলে একটা গম্ভীর ব্যাঙ বাসার সামনের শেডে আশ্রয় নেয়, ওটার নাম হচ্ছে ফ্রগি-ওয়াগি, গাছের শুঁয়োপোকার নাম হচ্ছে ফাজি-ওয়াজি...এদের সবাইকে সে "মাদার নেচার" মনে করে।


গর্ডি সাধারণত বাসার পেছনে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু সেইদিন ছিল ব্যতিক্রম। কোথা থেকে একটা ছোট ইঁদুর ঢুকে পড়েছিল। গর্ডি তাকে খেলার ছলে আক্রমণ করছিল। গর্ডির সাথে সেই ইঁদুরের মোলাকাত ছিল অসম যুদ্ধ, ইঁদুরটা যতবারই পালাতে চাইছিল ততবারই গর্ডি তার পথ আটকে দিচ্ছিল। টম আর জেরির যুদ্ধ আমি গত চল্লিশ বছর ধরে দেখছি, সেইখানে কোনদিন বিড়ালকে জিততে দেখিনি। বাস্তবতা আর ইচ্ছাপূরণ এক জিনিস নয় সেটাই প্রমাণিত হলো।


বাচ্চাদের ধারণা ছিল "মাদার নেচার" এক এবং অখন্ড স্বত্ত্বা। সেইখানে মোটামুটি সবার সাথে সবারই ভাব থাকে। মাদার নেচার ভার্সেস মাদার নেচার লড়াই সাধারণত দেখা যায় না, আমি একবার ভেবেছিলাম ইঁদুরটাকে বাঁচাবো, কিন্তু ততক্ষণে গর্ডি ইঁদুরটাকে আহত করে ফেলেছে, ওটাকে বাঁচানো মানে সেটার কষ্টকে বাড়ানোই হবে। সকালের মাখন আর জেলি মাখানো টোস্টও একটু একটু বিস্বাদ লাগলো - রোমান সম্রাটদের গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই দেখতে দেখতে কি মাঝে মাঝে বিবমিষা হতো?


আমাকে ওরা জিজ্ঞেস করল বিড়ালটা ইঁদুরটা খাবে নাকি? ইঁদুরটা হেভেনে যাবে কিনা? পঞ্চত্বপ্রাপ্তির পর ইঁদুরের ডানা গজাবে নাকি? বিড়াল ইঁদুর খাওয়ার জন্য মারে বলে মনে হয় না, গর্ডিও খেলার ছলেই হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল। আমি কুকুরের হাতে(?) বিড়াল হত্যাকান্ডও দেখেছি।


সম্ভবত দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এবং আধিপত্য বিস্তার মাদার নেচারেরই কোডিং এর অংশ - এই পিটাপিটিময় জগতে শেষ পর্যন্ত যোগ্যতমের জয় হয়। সবাই মিলেমিশে থাকাটা অলীক, অবাস্তব এবং কিছুটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ একটা ব্যাপার। সঙ্গত কারনেই এই যুক্তিগুলোও আমার বড় মেয়ের কাছে "নট ফেয়ার" মনে হল।


আমরাও মাদার নেচারের অংশ। শার্ট-প্যান্ট পরলেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না - ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালারা কবেই শিখিয়েছে এই আপ্তবাক্য। সুতরাং মনুষ্য সমাজও যে গর্ডির দূরবর্তী মামাতো ভাই সেই সন্দেহ আমার নেই। আমরা মানুষের সমতা তৈরির আইন করি, সমান অধিকারের আইন করি...কিন্তু দিনশেষে যেই লাউ সেই কদু...সবলের জয়ই সর্বত্র হয়। আমরা যেটা না সেটা কখনোই সামষ্টিকভাবে অর্জন করতে পারি না।"

সেই জন্যই হয়তো সংখ্যালঘু হওয়াটাই দোষের - কখনো কখনো  প্রাণ হারানোর মতো বিপদজ্জনক। একটা সমাজ আস্তে আস্তে যখন উন্নত হতে থাকে, তারা ধীরে ধীরে সংখ্যালঘুদের অধিকারগুলো মেনে নিতে থাকে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে - এই মেনে নেওয়ার ব্যাপারটাই "প্রকৃতিবিরুদ্ধ" - কিন্তু মানুষ যতই উন্নত হতে থাকে ততই বেশি লড়াই হতে থাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে। আমরা যতই উন্নতির দিকে এগিয়েছি ততই প্রকৃতির বাধ্যবাধকতাতে জয় করে সামনে এগিয়ে গিয়েছি। 


গত সপ্তাহে মার্কিন দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমপ্রেমিদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন। এই ব্যাপারে এই দেশের মানুষেরাও দ্বিধাবিভক্ত। রক্ষণশীলরা এর বিরুদ্ধে হলেও উল্লেখযোগ্য মানুষ সমপ্রেমিদের অধিকারের প্রতি সম্মান রাখেন।


অ্যালান টুরিং এর প্রসঙ্গে আবারও ফেরা যাক। ২০০৯ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন অ্যালান টুরিং এর শাস্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। টেলিগ্রাফ নিউজের রিপোর্ট বলছে...

"Thousands of people have come together to demand justice for Alan Turing and recognition of the appalling way he was treated. While Turing was dealt with under the law of the time, and we can't put the clock back, his treatment was of course utterly unfair, and I am pleased to have the chance to say how deeply sorry I and we all are for what happened to him. Alan and the many thousands of other gay men who were convicted, as he was convicted, under homophobic laws, were treated terribly. Over the years, millions more lived in fear in conviction."

এর কয়েক বছর পরে টুরিংকে ইংল্যান্ডের রাণী ক্ষমা করে দেন। বিবিসি রিপোর্টের অংশবিশেষ।

 "Computer pioneer and codebreaker Alan Turing has been given a posthumous royal pardon.It addresses his 1952 conviction for gross indecency following which he was chemically castrated.

He had been arrested after having an affair with a 19-year-old Manchester man. The conviction meant he lost his security clearance and had to stop the code-cracking work that had proved vital to the Allies in World War Two."

ওই সময়ে প্রায় ৪৯০০০ মানুষকে জেলদণ্ডসহ নানান শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, সমকামিতার অভিযোগে। তাদের অনেকেই হয়তো টুরিং এর মতো মেধাবি ছিলেন না। তাদের জন্য পিটিশন করার মতো কেউ ছিল না। কেউ চলচ্চিত্র বানায়নি তাদের জীবনের গল্পগুলো নিয়ে। তাঁরা কেন ক্ষমা পাবেন না? এই ৪৯০০০ মানুষের মধ্যে ১৫০০০ এখনো বেঁচে আছেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন টুরিং এর পরিবার। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার রিপোর্ট

"Turing's great-nephew, Nevil Hunt, his great-niece, Rachel Barnes, and her son, Thomas, will hand over the petition, which attracted almost half-a-million signatures on the website Change.org, to No 10 Downing Street.
 
Ms Barnes, 52, from Taunton, said: "I consider it to be fair and just that everybody who was convicted under the Gross Indecency Law is given a pardon. It is illogical that my great uncle has been the only one to be pardoned when so many were convicted of the same crime.

I feel sure that Alan Turing would have also wanted justice for everybody."

সমকামীদের বিয়ের সমতা নিয়ে মার্কিন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়াতে বাংলাদেশের মানুষের অভিমত দেখছি ফেসবুকে, কয়েকদিন ধরে। বাংলাদেশে এখনো সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সাধারণ মানুষ একেই বিকৃতি বা ব্যাধিই মনে করে। সেই হিসাবে আমি খুব বিস্মিত হই নি - কেননা ষাট বছর আগে ইংল্যান্ডেও অবস্থা এই রকমই ছিল। কিন্তু সমকামীদের অধিকারের পক্ষে অনেক অনেক মানুষকে দাঁড়াতে দেখেছি - আজকে থেকে ২৫ বছর আগেও এই নিয়ে কথা বলাটাই ট্যাবুর মতো ছিল। এটাও কম ব্যাপার নয়।

আমাদের সমাজও নিশ্চিতভাবে কিছুটা এগিয়েছে। হয়ত আরও একশ বছর পরে আমাদের সুপ্রিমকোর্ট এই রকম যুগান্তকারী কোন রায় দিবে। হয়ত একদিন আমরা মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতে পারবো - তার গায়ের রঙ, ধর্ম বা সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনগুলোকে সামনে আনবো না। সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ পরিচয়টাই হবে মানুষ। সেইদিনটা সম্ভবত আমি দেখে যেতে পারবো না - কিন্তু আমি জানি একদিন সেটা আসবেই।