Wednesday, May 25, 2022

বন্দুকবাজ আমেরিকা

 গর্ভনর এবোটের প্রেস কনফারেন্স দেখছিলাম। পুরো ব্লেইম মেন্টাল হেলথের। মুখ দিয়ে গালি বের হয়ে গেল, ঠিক ওই সময়ে দেখলাম বেটো দাঁড়ায়ে প্রতিবাদ করছে। একটা বাক্য বুঝতে পারলাম - ইউ আর ডুইং নাথিং। কথাটা সত্য না, এবোট এবং বাদবাকী রিপাবলিকান এবং তাদের সমর্থকের ইজ ডুইং এভ্রিথিং টু কিপ গানস এভাইবেল। ঈশ্বরের আদেশের মতো দ্বিতীয় সংশোধনী তাদের এই সুযোগ দিয়ে রেখেছে। বেটো মনে হয় বলেছিল এই ঘটনা আরও হবে। এই বক্তব্যের সাথে আমি এক মতো।


এংগ্রি, মেন্টাল হেলথ প্রব্লেমওয়ালা টিনেজার ছিল আর থাকবে, ইনফ্যাক্ট এই সমস্যাওয়ালা এডাল্ট ছিলো ও থাকবে। পৃথিবীর সব দেশেই ছিল ও আছে এবং থাকবেই। কিন্তু স্কুলে ঢুকে গুলির ঘটনা, দোকানে গুলি, চার্চে গুলি - এইগুলো ইউনিক। তালিবান অধ্যুষিত পাকিস্তানে একবার দুইবার হয়েছে কিন্তু প্রতি সপ্তাহে না।

আমরা ১৯৮৬ সালে ঢাকা কলেজে পড়তাম। আমার এই ফেসবুকে সেই সময়ের অনেক বন্ধু আছে। এংগ্রি টিন কত প্রকার সেটা আমরা দেখেছি। ঢাকা কলেজে ক্লাস করার দরকার ছিল না, সিগারেট ও গাঁজা সহজলভ্য ছিল। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, বলাকার ব্ল্যাকারদের সাথে মারামারি, ছাত্রলীগ ভার্সেস ছাত্রদল সংঘর্ষ কমন ব্যাপার ছিল। ছোটবড় মিলায়ে আমরা অন্তত ৮/১০ গোলযোগ দেখেছি।

কেউ মারা যায় নি। কেননা এংগ্রি টিনেজদের বন্দুক পাওয়া সম্ভব ছিল না। পেলেও সেমি আটোমেটিক হওয়ার কোন চান্স নেই।

আমেরিকার মতো বন্দুক সহজলভ্য হলে ঢাকা কলেজে রক্তের বন্যা বয়ে যেত বলে আমার ধারণা। মেন্টাল হেলথ ঠিক করে সমস্যাটার সমাধান করে যাবে এইটা আমার ধারণা রিপাব্লিকানেরাও বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশে যেকোন ঘটনা ধামাচাপার জন্য তদন্ত কমিটি তৈরি করা হতো, মেন্টাল হেলথ হচ্ছে সেই তদন্ত কমিটির মার্কিনি রূপ।

দরকার যেটা সেটা কেউ করবে না, সেটা হচ্ছে ভারী অস্ত্র খোলা মার্কেটে বেচা বন্ধ করা, যে সব অস্ত্র আছে সেইগুলো সরকারের সংগ্রহে নিয়ে আসা। অস্ট্রেলিয়া করেছে এইটা।

সমস্যা হচ্ছে অস্ত্র হচ্ছে আমেরিকার বিসমিল্লাহ। বাংলাদেশের মানুষের মুখ থেকে কেউ বিসমিল্লাহ কেড়ে নিতে পারবে না যেমন, তেমনি আমেরিকাতে বন্দুক মুক্ত করার সম্ভব না।

সুতরাং পরের হামলার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার।























Thursday, January 27, 2022

তার অন্ত নাইরে

সাগর সেনের রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার বিশেষ পছন্দ ছিল। ফার্মগেটের মোড়ে ছিল আলাপ ইলেকট্রনিক্স। ক্যাসেট বিক্রি ও রেকর্ডিং করার দোকান। ক্রেতাকে আকর্ষণ করার জন্য সারাদিনই গান বাজতো। কোন বাছবিছার নেই ইংরেজি গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত, ব্যান্ড সঙ্গীত, বয়াতির গান কিছুই বাদ যেতো না। সত্যিকার অর্থে গানের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ৮০ ও ৯০ এর দশকে নিজের পছন্দের গান ক্যাসেটে রেকর্ড করার চল ছিল। ঢাকাতে বিভিন্ন লেভেলের গান রেকর্ডিং করার দোকান আছে। রেইনবো, সুর বিচিত্রা কুলীন শ্রেণীর। সেই বিচারে আলাপকে সেকেন্ড ক্লাস বলা যায়। তবে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কালেকশন বিচার করলে আলাপ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। 


আমি তখন সাগর সেনের গান শুনি, দিনে পাঁচটা গান শুনলে দুটো থাকে তাঁর। আলাপে সাগর সেনের গাওয়া সবগুলো গানের রেকর্ড আছে। লং প্লের উপরে সৌমদর্শন এক ভদ্রলোকের ছবি, ব্যাকব্রাশ করা চুল, মোটা কাঁচের চশমা। বয়েস ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। অল্প বয়েসে প্রয়াত হয়েছেন, পাকস্থলির ক্যান্সারে। আমার মনে হতো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার জন্য ওনার গলাটা বিধাতা নিজ হাতে তৈরি করেছেন। আলাপে সাগর সেনের গাওয়া ৮৪ টি রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল, আমি সেগুলো সব টেপে বন্দী করেছিলাম। সাগর সেনের কিছু আধুনিক গান আর সিনেমার প্লেব্যাক গান ছিল, সেগুলোও আমি রেকর্ড করেছিলাম। ভদ্রলোকের গলা মধু দিয়ে মাখানো। আমার গলাতে সুর ছিল না কোনদিনও। বেসুরো বললে কম হবে, আমি প্রায় অসুর। আমার মনে হতো সাগর সেনের মতো গাইবার ক্ষমতা থাকলে আর কিছুই চাইতাম না। 

বহুদিন সাগর সেনের গান শুনিনি। ইউটিউব আসার পরে আমার সংগ্রহে থাকা একটি গান আপলোড করেছিলাম। ২০১২ বা ২০১৩ সালের পরে ইউটিউবে বাংলা গানের জোয়ার আসে। যৌবন আমার লাল টমেটো থেকে শুরু করে ধর্মীয় গানই সব পাওয়া যেতে লাগলো। এই সময়ে একবার খুঁজে দেখলাম সাগর সেনের প্রচুর গান আছে। গানগুলো আপলোড করছেন তাঁর সন্তান প্রীতম সেন। প্রীতমের গান আমি শুনেছি ইটিভির আজ সকালের আমন্ত্রণে। খুব বেশি পদের লাগে নি, তবে পিতার সাথে সন্তানের তুলনা করাটাও অনুচিত। প্রীতম নিজে গান গেয়ে যা আনন্দ দিয়েছেন তাঁর চেয়ে অনেক বেশি দিলেন সাগর সেনের গানগুলো  ইউটিউবে আপলোড করে। সেই ৮৪ টা গান কবে কোন দেশে ফেলে এসেছি, কোন বিস্মৃতির আড়ালে!!! প্রীতমের গানগুলো প্রায় হারানো সুর ফিরিয়ে আনলো। আমি দেখলাম আমি সাগর সেনের গাওয়া প্রায় সবগুলো গানই শুনেছি। অল্প কিছু নতুন গান পেলাম প্রীতমের সৌজন্যে। 

রবীন্দ্রনাথ "তার অন্ত নাইরে" নামে একটা গান লিখেছিলেন। গানটি শুনলে আমার থার্মোডিনামিক্সের সূত্রের কথা মনে পড়ে। বস্তু আর শক্তির কোন সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, শুধু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থাতে রূপান্তর চলে। যে আনন্দে দিয়ে আমরা তৈরি হয়েছি তার আসলেই কোন অন্ত নেই, তার অণু পরমাণু প্রতিদিন রোদে পুড়ছে, জলে ভিজছে। আমরা শক্তি সঞ্চয় করি, স্মৃতি সঞ্চয় করি সারা জীবন জুড়ে। আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের এই নশ্বর দেহ মাটিতে মিশে যায়, তাপগতিবিদ্যার আলোকে চিন্তা করলে আমরা কিন্তু হারাই না। আমাদের সঞ্চিত শক্তি আরও বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। আমরা তখন গাছের পাতার সবুজ রং হয়ে যাই, তার ডালে থাকা পাখির কুজন হয়ে যাই। দেহের বাইরে গিয়ে আমরা সর্বত্রই মিশে যাই। পুত্রের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 

"যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক্ আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে।... শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি— সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে।" 

শোককে এমনভাবে দেখার ক্ষমতা সবার থাকে না, অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার। সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথ গভীর দার্শনিক স্বত্ত্বাতে মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছেন, বিজ্ঞানের মোটা বইয়ের সূত্রকেও ধারণ করেছেন সেই দার্শনিকতাতে। জীবন আর মৃত্যু দুটাকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন আমাদের চেনা দুঃখ আর চেনা সুখের বাইরে গিয়ে। 

ফিরে আসি সাগর সেনে। তার অন্ত নাই গানটা ইউটিউবে খুঁজছিলাম। যে কয়টা পেয়েছিলাম তার কোনটাই তেমন ভালো লাগে নি (হেমন্তরটা ছাড়া)। এরপরে পেলাম মন্তব্যে দেওয়া গানটা। স্পেসিফিক শিল্পীর নাম দেওয়া না থাকলে আমি প্রায় নিশ্চিত যে এটা সাগর সেনের গলা। এই গানটির দুটো কপি আছে ইউটিউবে। একটাতে শিল্পীর নাম পূর্ণদাস বাউল বলা হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে সাগর সেনের গলাই মনে হয়েছে। কেউ কনফার্ম করলে আনন্দিত হব। 

আমার চেনা যেই দুই চারজন গান করেন, তাদের প্রায় সবাইকেই আমি এই গানটি গাইতে অনুরোধ করেছি। দুঃখের বিষয় কেউ গানটা গাননি। এলেম থাকলে আমি নিজেই গাইতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভবত সাগর সেনের গলাতেই পেয়ে গেলাম গানটা। এক দম ভুলে যাওয়া সময়ের দুরন্ত আনন্দ নিয়ে এলেন তিনি। এই আনন্দ অতুলনীয়, এর আসলেই অন্ত নাই!!! 

তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ।
তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।

তারে মোহনযন্ত্র দিয়ে গেছে কত ফুলের গন্ধ,
তারে দোলা দিয়ে দুলিয়ে গেছে কত ঢেউয়ের ছন্দ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
আছে কত সুরের সোহাগ যে তার স্তরে স্তরে লগ্ন,

সে যে কত রঙের রসধারায় কতই হল মগ্ন,
ও তার   অন্ত নাই গো নাই।
কত শুকতারা যে স্বপ্নে তাহার রেখে গেছে স্পর্শ,
কত বসন্ত যে ঢেলেছে তায় অকারণের হর্ষ,
ও তার   অন্ত নাই গো নাই।