বাপি শাহরিয়ার নামে একজন তরুণ ছড়াকার ছিলেন। সেটা ছিল এরশাদের আমল। বাপি তেমন সুপরিচিত কেউ ছিলেন না। উনি সংবাদের শিরোনাম হলেন এক সড়ক দুর্ঘটনার পরে। ওনাকে আহত করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্তান। সেই সময়ে বিচার আশা করা অসম্ভব। কেউ আশাও করে নি বিচার হবে। এই ঘটনার কিছুদিন পরে আমি কলেজে সেই ঘাতককে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছি। এরশাদ জনপ্রিয় শাসক নন - তার মন্ত্রীরাও চূড়ান্ত অজনপ্রিয়। কিন্তু মন্ত্রীতনয় - যে কিনা একজন মানুষকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং আইন স্পর্শ তাকে করতে পারছে না রাষ্ট্রযন্ত্রের অহমিকায় - সে কিন্তু জনপ্রিয় - অবলীলাতে কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয় সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনের সাথেও জড়িত ছিল সে। এই ছিল আমাদের শৈশবের বাংলাদেশ!!! অন্যায়ের ব্যাপারে আমরা সর্বংসহা। এটাই সম্ভবত চিরকালীন বাংলাদেশ। দুঃখজনকভাবে বাপি আর জীবনে ফিরতে পারেনি। তিনি মারা গিয়েছিলেন চিকিৎসাধীন অবস্থাতে। বাপি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনাতে প্রান হারান বাপি শাহরিয়ারের পিতা। যতদূর মনে পড়ে উনি সন্তানকে দেখতে হাসপাতালে আসছিলেন।
এরশাদের যেদিন পতন হয় সেদিন বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম স্বপ্নের বাংলাদেশ এবার পাওয়া যাবে। আমি একা নই - আমার মতো আরও অনেকেই সেটা ভেবেছিলেন। আমরা স্বপ্নের বাংলাদেশ পাই নি। আমরা দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি সব দোষ শাসকের দেব না। আমরা স্বপ্নের দেশ পাওয়ার যোগ্য নই। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা আমাদের মজ্জাগত। আমাদের কাছে ন্যায় আর অন্যায়ের চেয়ে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের স্বার্থ। এরশাদের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্তান বিচার থেকে বাঁচতে পারতো কিন্তু এই গণতান্ত্রিক দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশে অত ক্ষমতা আর লাগে না। সড়ক দুর্ঘটনার বিচার হবে না। আপনাকে মন্ত্রী হতে হবে না, এম্পি হতে হবে না, ইনফ্যাক্ট কিছুই হতে হবে না। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয় - কোন হত্যারই বিচার হবে না, কোন দুর্নীতির বিচার হবে না, আপনার লাশ রাস্তায় পড়ে থাকলে রাষ্ট্র এসে খতিয়ে দেখবে আপনি কী করেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই গভীর রাতে আপনার বাসাতেই হাজির হবে উর্দি বাহিনী। আমাদের ৪৭ বছরের নিরবতার ফলাফল গণতন্ত্র নয় - তস্করতন্ত্র আর দুর্বৃত্ততন্ত্র। আমরা গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি না। আমরা তস্কর আর দুর্বৃত্তের দেশে বাস করি । এটা কোন দুঃখজনক পরিণতি নয় - এটাই ভবিতব্য ছিল। সর্বংসহা হলে এটাই হয়।
সড়কে হত্যাকান্ড নতুন কিছু নয়। এটার শুরু বা প্রসার বর্তমান সরকারের আমলেও নয়। এটা বহু পুরাতন একটা সমস্যা। অন্য দুর্বৃত্ত সরকারদের মতো বর্তমান সরকারও এর সমাধানের চেষ্টা করে নি বরং দুর্বৃত্তদের নেতাকে মন্ত্রীর পদ দিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে একে। এক সপ্তাহ আগে স্কুলের বাচ্চাদের আন্দোলন খুব সামান্য হলেও আমাকে আশা দেখিয়েছে। আমরা মেনে নেওয়া জনগণ। সড়কে প্রিয়জনের মৃত্যু হলে এক সময়ে চোখের পানি শুকিয়ে যায় - এরপর ঈশ্বরকে বিচার করার ভারটা দিয়ে কষ্টটা খুব যত্নে বুকের আলমারিতে রেখে দেই। কিন্তু এই বাচ্চাগুলো মানতে নারাজ। তারা সদর্পে রাজপথ দখল করে নিল, তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বদলানোর সময় এসেছে। আমাদের নিরবতা ছিল অসততার সমতুল্য। এরা এখনো অসৎ হতে শেখেনি।
আমাদের মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ বিরোধীদল এদের আন্দোলনকে পুঁজি করেছে, আমাদের জনবিচ্ছিন্ন অসৎ রাষ্ট্র এদের পিছে পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই শিউরে উঠি। এরা স্কুলের বাচ্চা। এদেরকে এতো ভয়? অথবা এদের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকারের ইচ্ছা? পোড়খাওয়া রাজনৈতিকদলগুলো এমনই দেউলিয়া। আমাদের অশ্লীল নিরবতার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এরা সাহস কাকে বলে।
"আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।"
(সুকান্ত ভট্টাচার্য)
No comments:
Post a Comment