বইটার নাম শুনেছিলাম বেশ অনেকদিন আগে। পড়া হয় নি। বইটি শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার লেখা। ১৯৭১ সালের পটভূমিতে। বইয়ের লেখক নিজেও শহীদ হয়েছেন - ১৪ ই ডিসেম্বর।
বইটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। "রাইফেল রোটি আওরাত" পড়তে অনেকখানি মানসিক শক্তি অর্জন করতে হয়। গল্পের মূল চরিত্র সুদীপ্ত শাহিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ভাগ্যগুণে বেঁচে যান পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ থেকে। মূল চরিত্র কাল্পনিক হলেও ১৯৭১ সালের নির্মমতা কাল্পনিক নয়। সেই নির্মমতার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠে রাইফেল রোটি আওরাতে। বইটা লেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে জুন মাসের মধ্যে অর্থাৎ লেখক সীমাহীন অনিশ্চয়তা এবং ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতরে বসেই বইটা লিখেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত নিজেও সেই নির্মমতার বলি হয়েছেন।
কোন ভাষার অলংকার দিয়ে বইটা সাজানো হয় নি, বর্বরতার বর্ণনা ঠিক যেইভাবে আসা উচিৎ ঠিক সেই ভাবেই উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালকে জানতে হলে যেমন জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি এক অবশ্যপাঠ্য বই, আমি রাইফেল রোটি আওরাতকে ঠিক সেই কাতারেই রাখবো।
একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারও বলছি। অফিসের কাজে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম, বছর দশেক আগে। আমার কাউন্টার পার্ট এক পাকিস্তানি ভদ্রলোক, অফিসের কাজে অনেক অনেকবার ফোন এবং চ্যাটে কথা হয়েছে, সজ্জন ভদ্রলোক।
নিউইয়র্কের অফিসে প্রথমবার দেখা হলো। বয়স্ক লোক। তিনি আলাপচারিতা ১৯৭১ সালে নিয়ে গেলেন। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার জন্য ইন্ডিয়াকে দায়ী করলেন...এরপরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী ও রেপিস্ট বললেন। আমি স্থানুর মতো বসে রইলাম, জীবনে একবার আমার ইচ্ছে হলো সামনে বসে থাকা শুয়োরের বাচ্চাটার মাথা গুড়িয়ে দেই। সেই শক্তি আমার সেই মুহূর্তে ছিল। মানুষের সীমাবদ্ধতা প্রচুর -সন্তানদের কথা ভাবতে হয়, আগামীকাল দুপুরের বাজারটা কিভাবে করতে হবে সেটাও ভাবতে হয়। কিন্তু আমার এই জীবনে একবার ইচ্ছে হয়েছিল সামনে বসে থাকা এই ***র পোলাটার সানডে মানডে ক্লোজ করে দেই। সেটা না করতে পারার গ্লানি নিয়ে আমাকে বাঁচতে হবে।
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক পাকিস্তানিদের সাথে ১৯৭১ নিয়ে কথা বলেছি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সজ্জন, টাউট - নির্বিশেষে আমি একজন পাকিস্তানিও পাইনি যে ১৯৭১ এর যুদ্ধ নিয়ে সত্যভাষণ করবে। ১৯৭১ সালের ব্যাপারে প্রতিটি পাকিস্তানিই এক একজন ইয়াহিয়া খান। আমি এখনো পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম দেখি নি।
আমার দুঃখটা পাকিস্তানিদের নিয়ে না। পাকিস্তানি ও পাকিস্তান দেশটাকে আমি মানুষ ও মানুষের দেশ বলে মনে করি না - এখনও পর্যন্ত আমি সেই নির্দশন দেখি নি। কিন্তু আমার নিজের দেশেও বহু বহু পাকিস্তানি বিদ্যমান, পৃথিবীর অন্য কোন দেশ এই পরিমাণ আবর্জনা উৎপন্ন করেছে বলে আমার জানা নেই। এই অবধারিত সত্যটাই আমাকে নিয়ত পীড়া দেয়।
"রাইফেল রোটি আওরাত" যারা পড়েন নি, তারা মন্তব্যের লিঙ্ক থেকে বইটা ডাউনলোড করতে পারবেন। এই ২০১৫ সালে এসে আমি যেই অবস্থা দেখছি তাতে আমার ধারনা নিকট কোন ভবিষ্যতে হয়ত এই গল্পগুলো শুধুই কল্পকাহিনি হয়ে থাকবে, লেখকের কল্পনাশক্তি বেশ ছিল বলে মনে হতে পারে।
সেটা যদি হতে দিতে না চান - তাহলে এই বইটা পড়ুন। রক্ত দিয়ে লেখা এই বই। পড়তে কষ্ট হবে, তবুও পড়ুন। বইটা যেন এক অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টারের বর্ণনা।
No comments:
Post a Comment