বেঁচে থাকার মধ্যে ক্লান্তি আছে। প্রতিদিন একই পথে হেঁটে যাওয়ার ক্লান্তি, একই কাজ করার ক্লান্তি, একই খাবার খাওয়ার ক্লান্তি, পুনরাবৃত্তির ছকে বন্দি হয়ে জানালার বাইরের হলুদ রোদ্দুর দেখার ক্লান্তি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন বরিশালের সেই সাদামাটা লোকটা। অমোঘ নিয়তির মতো তিনি লিখে রেখেছেন...
"অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;"
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের গল্প, উপন্যাস, সাহিত্য, গান আর শিল্প সব কিছুর পেছনেই যাপিত জীবনের ক্লান্তিটা বিরাট একটা কারণ। এই জঘন্য পৃথিবীর পুনরাবৃত্তিময় জীবনে কিছু লোক তাই খ্যাপার মতো স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখাতে চায়, ভালোবাসে, ভালোবাসাতে চায়। ভালোবাসা আর আনন্দ এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার ছোঁয়াচে রোগ। নিজের আনন্দে লেখা গল্প, নিজের আনন্দে গাওয়া গান তাই দেশ, কাল, সময়ের বাঁধা অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারে অন্য মানুষের কাছে। আমি দেখেছি চমৎকার একটা গান খুব সহজেই সাধারণ একটা দিনকে এক নিমেষেই অসাধারণ করে দিতে পারে।
ব্যান্ড সঙ্গীত ব্যাপারটা সম্ভবত বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। সব শিল্প সৃষ্টিরই যেমন কারণ থাকে তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উত্তাল সময়ের প্রোডাক্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত। এই সময়টা আসলেই ধরা পড়েছে ব্যান্ড সঙ্গীতে। অন্য কেউ যা বলতে পারেনি, লিখতে পারেনি - সেই সময়ে অর্বাচীন তরুণেরা অবলীলাতে বলে দিয়েছে...
"রেল লাইনের ওই বস্তিতে,
জন্মেছিল একটি ছেলে
মা - তার কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে
ও আমার বাংলাদেশে... "
আযম খান, লাকি আখন্দদের হাত ধরে যেই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আইয়ুব বাচ্চুরা তাকে অনেক পরিণত করেছেন। ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে শুরুতে অনেক কুলীন শিল্পীদের নাক সিঁটকানো থাকলেও ব্যান্ড সঙ্গীত সম্ভবত আজকের বাংলাদেশের মূলধারার সঙ্গীতের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল শিল্প মাধ্যমও। আইয়ুব বাচ্চুরা প্রমাণ করে দিয়েছেন আর সব কিছুর মতোই সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়, একে ভেঙ্গেচুরে গড়তে হয় - সঙ্গীতকেও বিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সহজিয়া কথার সাথে পাশ্চত্য যন্ত্রানুষঙ্গ সংমিশ্রন দিয়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছান যায় - আজকের বাংলাদেশে তাই সবচেয়ে বড় লোক সঙ্গীত সম্ভবত ব্যান্ডের গান।
আক্ষরিক অর্থে আজকের দিনটা শুরু হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। আজম খান, লাকি আখন্দের মতো বাচ্চুও চলে গেলেন অবেলাতে। আইয়ুব বাচ্চু প্রচুর গান গেয়েছেন, তার বহু বহু গান শোনার পরেও আমি আজকে টের পেলাম তার অনেক অনেক গান এখনও শোনা বাকি আছে। আর কোনদিন কোন কনসার্টে বাচ্চুর গান শোনা হবে না। আমি জানি না কোন কষ্ট, কোন ক্লান্তি আইয়ুব বাচ্চুকে গান করাতো। অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার। বাচ্চু আপনার কষ্টটা কি সেটা জানা হল না। কিন্তু গল্প শেষেও আপনি নিরব হননি, ভোর বেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যেই বাংলাদেশের ছায়াছবিটা আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে, তার আবহ সঙ্গীত আপনি আর আপনার বন্ধুরাই রচনা করেছেন। তাই এই মেঘলা সকালে আপনার মৃত্যু সংবাদ প্রিয়জন হারানোর কষ্ট নিয়ে আসে।
বিদায় প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু।
"হাসতে দেখ গাইতে দেখ
অনেক কথায় মুখর আমায় দেখ
দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা।।
বোঝে না কেউ তো চিনলো না
বোঝে না আমার কি ব্যথা
চেনার মত কেউ চিনলো না
এই আমাকে।।
আমার সুরের বুকে কান্না লুকিয়ে থাকে
আমার চোখের কোনে নোনা ছবি আকে
আমার গল্প শুনে হয় আলোকিত উৎসব
গল্প শেষে আমি আঁধারের মতো নীরব..."
No comments:
Post a Comment