গত দশ দিনে তিনবার ডাক্তারের অফিসে যেতে হয়েছে। কানের সমস্যা নিয়ে। গত সাত বছর ধরে ভুগছি। চিরকাল ব্যাপিয়া সুখ না থাকলে চিরকাল ব্যাপিয়া অসুখ থাকা খুবই সম্ভব।
সুখের সাথে বসবাস করা শিখতে হয় কিনা জানি না - কিন্তু অসুখের সাথে বাস করাটা রীতিমতো শেখার বিষয়। কানের জন্য স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন নিতে হয়, একদম কানের গভীরে। এটা কোন মতেই আনন্দের অভিজ্ঞতা নয়। তবে খুব কষ্টকর কিছুও না। দশ দিনে তিনবার নিতে হলো। আজকে ছিল এই সিরিজের শেষ ইঞ্জেকশন। সম্ভবত আগামী চার থেকে ছয়মাস নিতে হবে না।
ইঞ্জেকশন নেওয়ার পরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হয়। ডাক্তার রুমের লাইট বন্ধ করে দেন - আমি কম্বল গায়ে দিয়ে গান শুনি। একেকদিন একেক টপিক নিয়ে চিন্তা করি। আজকের টপিক ছিল অমরত্ব।
নিশ্চিতভাবেই মানুষের অমরত্বের সুপ্তবাসনা আছে। চিন্তা করে দেখলাম সম্ভবত মৃত্যুভয়ের জন্যই মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। দিন যতই খারাপ হোক না কেন - আগামীকালটা ভালো হওয়ার সামান্য সম্ভবনা সব সময়েই রয়ে যায়।
"গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোতে ভালোবাসে।"
মানুষের ভয় অজানাকে - অন্ধকারে দেখা যায় না দেখে অনেকেই অন্ধকার ভয় পান। এই যাপিত জীবনে মৃত্যুই সবচেয়ে বড় অন্ধকার। মৃত্যুর পরে কী আছে সেটা জানা থাকলে মনে হয় আর মৃত্যুভয় থাকতো না - মানুষ সম্ভবত আরও বেশি বিপদজ্জনক হয়ে উঠত। যেই আত্মঘাতী বোমারু পেটে বোমা বেঁধে স্বর্গ যাত্রা করে - সেই নির্বোধের একদম মনে গভীরে অমরত্বের বীজ বুনে দিয়েছে কেউ।
এক হিসেবে মৃত্যুভয় মন্দ নয় - মৃত্যুভয়হীনতা ভয়ংকর হতে পারে - বিশেষত যখন সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যায়।
"চ’লে যাবে সেই সব উপকথা: সৌন্দর্য প্রতিভা-
মেধা;-এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাস ভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।"
ইঞ্জেকশনের পরবর্তী সময়টা ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেন। ফেসবুকে উঁকি দেওয়া বিশ্রামের অঙ্গ কিনা সেটা কোথাও লেখা নেই। তা-ই বাসায় ফিরেই দেখতে পেলাম শার্লট শহরে পুলিশের গুলিতে নিহত মানুষটার স্ত্রীর করা ভিডিও।
"হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং টু দিজ ওয়ার্ল্ড?" - এই বাক্যটার যুৎসই কোন বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাই নি এখন। বিশ বছরের মার্কিন জীবনে বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখানো একমাত্র ঘটনাটা একজন অফডিউটি পুলিশের করা। আমরা যেই মার্কিন সমাজে বাস করি - সেই সাজানো গোছানো মার্কিন দেশের বাইরেও বিশাল একটা দেশ আছে - সেই দেশে পৃথিবীর বাকি সব অনুষঙ্গও থাকতে বাধ্য। পুলিশের বর্ণবাদ আমাকে বিস্মিত করে না - এই দেশে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য বর্ণবাদী প্রার্থী যখন পাওয়া গেছে তখন আরও অনেক খান্ডবদাহন দেখে যেতে হবে।
তবে দিনটা সবটুকু মন্দ ছিল না। ফেসবুকের কল্যানেই অ্যালেক্সকে খুঁজে পেলাম - সে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অনুরোধ করেছে বোমায় দগ্ধ সিরিয়ান বালককে সে তার ভাই বানাতে চায়। তারা এক সাথে সাইকেল চালাবে - প্রজাপতি ধরবে।
ওবামা বলেছে অ্যালেক্সের কাছে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে পারেন ওবামা নিজেই এবং তাঁর সভাষদ এবং সহকর্মী রাজনীতিকরা। যুদ্ধ বেচে আর দেশ দখল করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে সেটার ফলাফল ওমরানরা ভোগ করে আর অ্যালেক্সরা কষ্ট পায়। পৃথিবীটা অ্যালেক্স বা ওমরানদের কেউই চালায় না - তাই ওদের ভয় বা ভালোবাসা ভুলে যেতে আমাদের সময় লাগে না।
(অ্যালেক্সের ভিডিওর লিঙ্ক)
https://www.facebook.com/potus/videos/537075249815653/
দ্বিতীয় আনন্দের ব্যাপার ছিল এই ভিডিওটা। মানুষ বাদে অন্য সব প্রাণীই আমাকে নির্মল আনন্দ দেয়। যদি দ্বিতীয় একটা জীবন পেতাম, জেন গুডালের শিষ্য হওয়ার চেষ্টা করতাম।
(আজকের প্রাণীজগতের লিঙ্ক)
https://www.facebook.com/andre.vanrooyen2/videos/10208642436391343/?pnref=story
তৃতীয় আনন্দের ঘটনা ছিল প্রণবেশ দাশের তোলা এই ছবিটা। বৃষ্টিভেজা রাতে ঢাকার রাস্তা। কোথাও কিছু লেখা নেই - তবুও অনেক আগের কোন দুরন্ত আনন্দ নিয়ে এলো ছবিটা। বৃষ্টির রাতে আমি ঢাকা শহর দেখেছি কিছুদিন আগেই - কিন্তু চোখে যেটা দেখতে পারিনি সেটা এই ছবিতে পেয়েছি। বালক রাজপুত্রের বইতে যথার্থই বলা আছে...
"It is only with the heart that one can see rightly; what is essential is invisible to the eye."
দিনশেষে ভালো ও মন্দের ফুটবল খেলাতে মন্দকে ৩-১ গোলে পরাজিত করেছে ভালো। ঠিক এই কারণেই আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকলে হয়ত আরও অনেক অনেক অ্যালেক্সের দেখা পাবো, নিজের জগতে একা হেঁটে যাওয়া মেরুভালুকের ছবি পাব এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এমন অনেক জিনিসের সন্ধান পাব যেটা চোখে না ধরা পড়লেও হৃদয়ে কাছে রেখে দেওয়া যায়।
আমি নির্বোধের মতো অমরত্বে বিশ্বাস করি না - শুধু বেকুবের মতো অমরত্বের প্রত্যাশা নিয়ে দিন কাটিয়ে যাই।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Pranabesh Das
শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ
কবিতা কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ ও হুমায়ূন আজাদ
No comments:
Post a Comment