আনওয়ারুল করিম নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। অংকের স্যার। আমরা যখন থ্রিতে পড়ি তখন স্যার ল্যাবরেটরি স্কুলে এলেন। আমাদের ক্লাসের শ্রেণী শিক্ষক। অতি দ্রুতই স্যারের নাম হয়ে গেল বাঁটু করিম, আমাদের বা আমাদের আশেপাশের ব্যাচেরই দেওয়া নাম। বাঁটু নামটার শানে নযুল ব্যাখ্যার দরকার নেই।
কিছুদিন পরে বাঁটু করিম নামটা সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া হলো। হয়ে গেল বিকে। মাঝে মাঝে টাইটেল আসল নামকে ছাড়িয়ে যায়। বিকের ব্যাপারে তাই হলো। বিকে নামটা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেল। সবাই তাঁকে বিকে স্যার হিসাবে জানে, জন্মসূত্রে "একে" কর্মসূত্রে হয়ে গেলেন "বিকে"।
আমার এবং আমাদের বন্ধুদের স্কুল জীবনটার একটা অংশ কেটেছে বিকের আতংকে। ক্লাস থ্রি, ফাইভ, সেভেন, নাইন, টেন - প্রতি শ্রেণীতে তিনি অংক শিক্ষক। যোগ বিয়োগ দিয়ে শুরু করে - ভগ্নাংশ, শতকরা, উৎপাদকে বিশ্লেষণ, ত্রিকোনমিতি, ঘন জ্যামিতি - সবর্ত্রই বিকে। পাঞ্জাবি, পায়জামা পরা সাদামাটা অংকের যাদুকর। এর হাত থেকে পালানোর উপায় নেই। নিউমার্কেটে স্যারের কাপড়ের দোকান আছে (নামটা মনে আছে - টপ ইন দ্য টাউন), ওখানে সন্ধ্যার পরে ঘোরাঘুরি করতে গেলে স্যারের নজরে আসার সম্ভবনা আছে - যেটার ফলাফল হবে পরদিন অংক ক্লাসে নাজেহাল।
নাজেহালের বর্ণনা দেওয়া যায়। স্যার নিজের ডাস্টার আনতেন, সেই সাথে স্কুলের পিকনিকের সময় মধুপর থেকে আনা ডোরাকাটা সাদা বাদামী বেত আসতো কখনো কখনো। বিকে প্রায় প্রতি ক্লাসে বোর্ডে অংক করতে পাঠাতেন। প্রায় সব ছাত্রের নাম ও রোল নম্বর জানা ছিল স্যারের - সেই সঙ্গে কে কেমন অংক জানতো সেটাও বিলক্ষণ জানতেন। স্যারের ভাষাতে যারা "দুর্বল সেন" তাদেরকে বোর্ডে পাঠানো হতো অঙ্ক করার জন্য।
যারা জানেনা তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি - স্কুলের বোর্ডে অংক ঠিকঠাক মতো করা পৃথিবীর পাঁচটা জটিল কাজের একটা। অংকে ভুল করা ছাত্রদের লাইনে দাঁড়া করানো হতো। সেই কঠিন জালে ভালো ছাত্রেরাও আটকা পড়ত প্রায়ই, কেননা বোর্ডের সামনে দাঁড়ালেই যাবতীয় জ্ঞান মাথা থেকে দূর হয়ে যায়।
যাই হোক মোটামুটি সংখ্যক ছাত্র জমা হলে স্যার বলতেন এই বার এরা খেলা দেখাবেন। এরপরে স্যার যত্ন করে নিজের হাতের ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখতেন, আস্তে আস্তে পাঞ্জাবির আস্তিন গুটাতেন...এরপর খেলা শুরু হতো। খেলাটা হচ্ছে ডাস্টার দিয়ে পিঠের মধ্যে দমাদম বাড়ি, অথবা বেত দিয়ে সপাং সপাং বাড়ি। প্রায়ই দেখা যেত বেত ভেঙ্গে গেছে। সেই বেত ভেঙ্গে গেলেও স্যার দমতেন না, অফিস রুম থেকে আরেকটা আনা হতো। স্যার এমনকি স্কুলের গাছের ডাল ভেঙ্গেও ছাত্রদের "পৃষ্ঠপোষকতা" করেছেন। একবার আমাদের বন্ধু জাকিরকে অন্ধের মতো পিটাতে পিটাতে ঘন্টা পড়ে গিয়েছিল, স্যার বিদায় নেবার সময়ে জানালেন সিক্সথ পিরিয়ডে এসে আবার জাকিরকে মারবেন। ক্লাসের প্রতিটি ছেলে মার খেয়েছে এমন ঘটনাও বিরল না। স্যার কৌতুক করে বলতেন যে - এমন জায়গাতে উনি মারবেন যে বাসাতে গিয়ে কেউ অভিভাবককে প্যান্ট খুলে দেখাতে পারবে না।
বাটু করিমের অংক বোঝানোর স্টাইলটা অবশ্য চমৎকার ছিল। সত্যিকথা বলতে এতো ভালো অংকের শিক্ষক আমি এই জীবনে আর দ্বিতীয়টি পাইনি। কিন্তু একই সঙ্গে বলতে হচ্ছে স্কুল জীবনে দেখা উল্লেখযোগ্য ধরণের সাইকো হচ্ছেন বাঁটু করিম। এমনও দিন গেছে যে আমি সকালে যে অংকটা বাসা থেকে করে এসেছি, সেটা বোর্ডে গিয়ে পারিনি। বহুরাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি, বহু রাতে দোয়া দরূদ পড়েছি যেন স্যার পরদিন স্কুলে না আসেন অথবা অকস্মাৎ ভূমিকম্পে যেন স্কুলের বিল্ডিংটা ধ্বসে পড়ে।
বলা বাহুল্য যে সেই সব দোয়া কবুল হয় নি। আমাদের এই স্টিম রোলারের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। বহু কষ্ট করে আমিও শেষ পর্যন্ত অংক শিখেছি - সত্যি কথা বলতে স্কুল জীবনের পরে যেসব অংক শিখেছিলাম সেগুলো সব মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে - শুধু রয়ে গিয়েছে ক্লাস টেনের পাটিগণিত আর সেই সঙ্গে রয়ে গেছে কালান্তক বাঁটু করিম। মেয়ের অংকে সাহায্য করতে গিয়ে আটকে গেলে এখন আমার মনে হয় ডাস্টার হাতে আড়ালে কোথাও দাঁড়িয়ে আছেন স্যার।
ঈশ্বর আমাদের অবশ্য একটা করুণা করেছেন। বাঁটু করিম নামটা পার্মানেট হয়ে গেছে - আমরা পাশ করে আসার ত্রিশ বছর পরেও স্যারকে এই নামেই ডাকতে শুনেছি সবাইকে। মনে হয় আমাদের তরফ থেকে এইটুকু প্রতিশোধটা রয়ে গেল। খ্যাতি বাড়তে বাড়তে তিনি হয়ে গেলেন প্রবাদতুল্য অংকের শিক্ষক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সবাই তাঁকে এই নামেই চিনে। অভিভাবকেরা স্যারের বাসাতে কলিং বেল চাপ দিয়ে খুব বিনীতস্বরে জিজ্ঞেস করেন - বিকে স্যার বাসায় আছেন? শুনেছি স্যার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন - কিন্তু অভিভাবককে তো আর ডাস্টার দিয়ে পিটানো যায় না!
কেমন আছেন স্যার? উনি বেঁচে আছেন কিনা জানি না, আমি ওনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি যেন এক সকালে কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করতে পারি - বিকে স্যার কেমন আছেন?
###
No comments:
Post a Comment