Friday, July 23, 2021

রান্না করার জটিলতা সমূহ

রান্না করা সহজ কাজ না। ছোটবেলাতে রুশদেশের বইতে মিশকার রান্নাবান্না নামে একটা গল্প পড়েছিলাম। সেই থেকে আমি জানি রান্না আদতে খুব কঠিন একটা কাজ। আমি পাঁচ বছর এই দেশে একদম একা থেকেছি। সেই জটিলতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। জটিলতাগুলোর কিছু উদাহরণ দেই

-১-
সকালে হালুয়া দিয়ে আটার রুটি আমার খুব প্রিয় ছিল। ক্ষমতার হালুয়া রুটির স্বাদ না পেলেও সত্যিকারের হালুয়া রুটির স্বাদ আমার জানা ছিল। প্রচুর ভারতীয় থাকার কারণে এইখানে ঘরে বানানো আটারুটি বিরল নয়। আমার ধারণা ছিল হালুয়া আর রুটির মধ্যে জটিল কাজ রুটি বানানো। কঠিন কাজটা আরেকজন করে দিচ্ছে, আমার কাজ শুধু হালুয়া বানানো। হালুয়া তৈরি করা কঠিন কিছু হতে পারে না, কেননা জিনিসের অবস্থা শোচনীয় হলেই সেটাকে হালুয়া বলে। এমন জিনিস কিভাবে জটিল হবে?
যাই হোক এক সকালে আমি সুজির হালুয়া বানানো শুরু করলাম। ফ্রেশ গরম রুটি কিনে এনেছি অলরেডি। আম্মা হালুয়া বানাতেন, ঠিক কিভাবে বানাতেন সেটা দেখিনি, কিন্তু বিভিন্ন স্টেপে কি রকম গন্ধ আসে সেটা জানা আছে। সেইটুকু ভরসা করে নেমে গেলাম। সিদ্দিকা কবীরের বইটাতেও চোখ বুলিয়ে নিলাম একটু।
ওপেনিংটা ভালোই হচ্ছিল। গন্ধটাও চেনা লাগছিল। এরপরে এক পর্যায়ে চিনি দিতে বলা হয়েছিল। আমার আত্মবিশ্বাস তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো। সিদ্দিকা কবীর ঠিক মতো পড়ে দেখার ঝামেলাতে গেলাম না। আমি হালুয়াতে চিনি দিতেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। হালুয়াটা জমাট বাঁধা শুরু করল। আমি ঠিক কি ভুল করেছি সেটার ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নই। কিন্তু হালুয়া টাইট শব্দের আক্ষরিক মানেটা দেখতে পেলাম। আমার চোখের সামনেই হালুয়াটা টাইট হওয়া শুরু করলো।
এহেন ব্যাটিং বিপর্যয়ে আমার অবস্থা সেই মিশকার পরিজ রান্নার মতোই হয়ে গেল। আগুনের তাপ বাড়ালে পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী কঠিন পদার্থের গলে যাওয়ার কথা, কিন্তু এর মধ্যে যে পুড়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে সেইটা ফিজিক্স বইতে লেখা নেই ঠিকমতো। প্রায় জমে যাওয়া হালুয়া পুড়ে যেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত হালুয়া এবং হালুয়ার পাত্র দুটোই বিসর্জন দিতে হলো।
হালুয়া টাইট পর্বের পরে আমি এই জীবনে সুজির হালুয়াসহ আর অন্য কোন হালুয়া বানানোর চেষ্টা করিনি। কাজের চাপে জীবন হালুয়া হয়ে গেছে, সেই হালুয়া নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থেকেছি, চুলার পাশে গিয়ে সেটার সচিত্র রূপ আর দেখতে চাইনি।
-২-
রান্নার বইতে একটা জিনিস লেখা থাকে - লবণ আন্দাজ মতো বা লবণ স্বাদের জন্য পরিমাণ মতো - এর কোন মানে হয়? আন্দাজ আর পরিমাণ সম্বন্ধে যদি ধারণা থাকতো তাহলে রান্নার বইটাই তো খুলতাম না। আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া সব কিছুর মাপ বলে দিচ্ছে কিন্তু লবণের বেলায় এমন বিমাতা সুলভ আচরণ কেন রান্নার বইয়ের?
লবণ অবশ্য জটিল জিনিস। ছোটবেলাতে নুনের মতো ভালোবাসার গল্প যারা পড়েছেন তারা জানেন সামান্য লবণ কতখানি ভালোবাসা আনতে পারে। আমি রান্নার বই লিখলে সবার আগে ঠিক কতো দানা লবণ দিলে মার খেতে হবে না সেই মাপ দিয়ে দিতাম।
লবণের জটিলতা আরও আছে। আমাদের বাসাতে আমি ডাল আর সব্জি রান্না করি। এইগুলো লো এন্ড কাজ বলে মারিয়া আমাকে আউট সোর্স করে দিয়েছে। ইন্সটাপটে ডাল গলাতে ২০ মিনিটের মতো লাগে, এরপরে বাগার দিলেই ঝামেলা শেষ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লবণ – সেই নুনের মতো ভালোবাসা। কোনদিন সেই ভালোবাসা কম বা কোনদিন বেশি! আরেকটা বিরাট সমস্যা হচ্ছে আগের দিনের রান্না করা ডাল পরের দিন একটু ঘন হয়ে যায়, আগের দিনের পারফেক্ট নুন দেওয়া ডাল পরদিন নোনতা ঠেকে। লাইফ মোমেন্ট, জীবন যে আসলে পারফেক্ট না, প্রতিবার বাসি ডাল খেতে গেলে আমার মনে হবেই। আমি চেষ্টা করি ঠিক ততটুকু ডাল রান্না করতে যেটা একবার খেলেই শেষ হয়ে যাবে।
তবে আমার ডালের নুন নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমি কানে তুলি না, বরং নুন খাই যার গুণ গাই তার – এই আপ্তবাক্য মনে করিয়ে দেই। বেশি নুন গেলে বেশি গুন গাইতে হবে।
-৩-
ধনেপাতার ইংরেজি নাম হচ্ছে সিলানট্রো (cilantro), বাজারে যেখানে ধনেপাতা রাখা থাকে তার ঠিক পাশেই পার্সলে (Parsley) নামের একটা জিনিস রাখা থাকে। দেখতে দুটো প্রায় একই রকম। আমাদের খাবারে ধনেপাতা লাগে কিন্তু পার্সলে খুব বেশি ব্যবহার হয় না। কিন্তু তাড়াহুড়া করে ধনেপাতার বদলে পার্সলে কিনে আনা খুব সাধারণ ঘটনা। আমি বহু বহু দিন রান্না করতে গিয়ে ধনেপাতার স্টেপে এসে আবিষ্কার করেছি যেটাকে আমি ধনেপাতা ভেবে বাজারের ব্যাগে ঠাঁই দিয়েছি, সে আসলে ছদ্মবেশি, প্রপঞ্চক পার্সলে।
এই প্রপঞ্চনাময় পার্সলেকে কেন ধনেপাতার পাশেই রাখে দোকানিরা? রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের শেষ কবিতায় লিখেছিলেন
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
পাশাপাশি রাখা ধনেপাতা আর পার্সলে এই কবিতার ভাবসম্প্রসারণে ব্যবহার হতে পারে। এহেন ছলনা আর মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ এই সংসারে কমই দেখা যায়। তাই দোকানে গেলে আমি একটু পাতা ছিড়ে ডলে গন্ধ নিয়ে চিনে নেই ধনে পাতা নিচ্ছি কিনা।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
পুরো কবিতাটা আমার কাছে আরও পরিষ্কার হয়। প্রতিবার ঠিকঠাক মতো ধনেপাতা কিনলে মহৎ কাজের আনন্দ পাই।
আমি যদি কোনদিন মুদির দোকান দেই – ধনেপাতা আর পার্সলে এই দুই বস্তু দোকানের দুই মাথাতে রাখবো। একই সঙ্গে পার্সলের উপরে বড় বড় লেখা থাকবে - আমি ধনেপাতা নই!!!

No comments: