আব্বার সাথে একবার চশমা কিনতে গেলাম। গ্রিন সুপার মার্কেটে। আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম, আমাদের এক বন্ধুর চশমার দোকান আছে। একটা ফ্রেম পছন্দ হল। আব্বার ব্যক্তিগত পলিসি হচ্ছে দরাদরি করে জিনিস কিনতে হবে। উনি একটা দাম বলতে যাচ্ছিলেন। এমনি সময় আমার বন্ধু উপস্থিত হল। আব্বা দাম বলার আগেই সে দাম কমিয়ে দিল। যেই মূল্য ধার্য করা হল সেটা সম্ভবত আব্বার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম। এই অপ্রত্যাশিত মূল্য হ্রাসে আব্বা পুরোই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন। ওনার ভাষাতে "মুলামুলি" না করে জিনিস কেনা মানেই হচ্ছে ঠকা। জীবনে সম্ভবত এই প্রথম উনি মুলামুলি করার কোন সুযোগ পেলেন না।
চশমার দোকান থেকে বের হলাম আমরা, হেঁটে হেঁটে ফার্মগেটে যাচ্ছি। আব্বাকে খুব চুপচাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে উনি একটা অস্বস্তির মধ্যে আছেন। আনন্দ হলের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আমাকে নিয়ে একটা হোটেলে গেলেন। আমাকে বললেন খাবার অর্ডার দিতে। উনি দ্রুত রেঁস্তোরা থেকে বের হয়ে রাস্তার উল্টো দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি সাত পাঁচ ভাবছি - বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। উনি একটু পরেই চলে আসলেন। কিছুক্ষণ আগের অস্বস্তি চলে গেছে। এই সংক্ষিপ্ত সফর শেষে ওনাকে অনেক প্রশান্ত মনে হচ্ছে।
আব্বা জানালেন উনি রাস্তার উল্টোদিকের চশমার দোকানগুলো ঢুঁ মেরেছেন। যেই ফ্রেমটা একটু আগেই উনি কিনেছেন গ্রিন সুপার থেকে - সেটা খুঁজে বের করেছেন। বের করে সেটা দামাদামি করে দেখেছেন। এটার কারণ হচ্ছে উনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে একটু আগে কেনা ফ্রেমটা উনি "ন্যায্য" মূল্যে পেয়েছেন। সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরে শান্ত হয়েছেন। রেঁস্তোরাতে খেতে খেতে উনি আমাকে বহুবার যেই উপদেশটা দিয়েছেন - সেটা আবারও দিলেন - মুলামুলি ছাড়া কোন কিছু কিনবা না, কিনলেই ঠকবা।
আব্বা বেশি উপদেশ দিতেন না, ইনফ্যাক্ট সব মিলিয়ে ৪/৫টার বেশি উপদেশ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ওনার উপদেশগুলো খুবই বাস্তবসম্মত ছিল। আরেকটা কয়েকটা উপদেশ হচ্ছে - টাকা নষ্ট করবা না, টাকা সবচেয়ে বড় বন্ধু - হ্যাভ দ্য এবিলিটি বাট ডু নট বাই। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ফিক্সড প্রাইজ বলে কিছু নেই। ইনফ্যাক্ট এই হানাহানিময় ভুবনে সবাই চাইবে গলা কাটতে, সেটার হাত থেকে বাঁচতে হলে লাইফস্কিল শিখতে হবে। মুলামুলি আসলে লাইফস্কিল বিশেষ। দ্বিতীয়ত - মানুষকে বিশ্বাস করার আগে তার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে দেখা উচিত। বুদ্ধিমান লোকেরা তাই করে।
এই ঘটনাটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে কেননা এর সমতুল্য কোন শিক্ষা আমি আর পাইনি। চাকরি, বিনিয়োগ, ভালোবাসা - সর্বত্রই অপরপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ের দরকার আছে, এবং সেই সঙ্গে দরকার উপযুক্ত দরাদরির। এই পৃথিবীতে পদে পদে মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পাতা আছে। আব্বা আমাকে এই পৃথিবীর অপার সত্যটা দর্শন করাতে চেয়েছেন। সফল হয়েছেন কিনা জানি না - কিন্তু ধরা খাওয়ার পরে আমি অন্তত বুঝতে পেরেছি ভুলটা কোথায় ছিল।
অনেক অনেক দূরে বসে আমি মাঝে মাঝে আব্বার কথা ভাবি। অসম্ভব দূরত্ব থেকে তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করি। মিনিমালিস্ট লাইভস্টাইল মুভমেন্টের উপর একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে আমার আব্বার কথা মনে হচ্ছিল - উনি নিশ্চিত ভাবে মিনিমালিস্ট মুভমেন্টের যুগ্ম আহবায়ক পদ পেতে পারতেন। উনার পুরো জীবনটাই ছিল বাহুল্য বর্জিত, যাবতীয় পার্থিব জিনিস একটা আলমারির দুটো ড্রয়ারে এঁটে যেত। রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়তেন, ভোর পাঁচটাতে উঠতেন। নিজের হাতে প্রচুর কাজ সারতেন। সবুজ ভালোবাসতেন, যত্রতত্র গাছ লাগাতেন। কোথাও গাছ কাটা হলে কষ্ট পেতেন।
যেই সময়টা আমি ওনার সাথে কাটিয়েছি, সেই সময়টাতে আমি ওনাকে বুঝতে চাইনি বরং বিদ্রোহী হয়েছি। অনেক অনেকদিন পরে সেই বোঝার কাজটি করার চেষ্টা করছি। আমি ঠিক জানি না সংসার থেকে কখনও উনি ছুটি চাইতেন কিনা, জ্যোৎস্না রাতে সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগের ইচ্ছে হত কিনা তাঁর। কোন এক ঝড়ের রাতে কি মনে হত - নাহ, এই জীবনটা আমি চাই নি? সকালবেলাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি ভেবেছিলেন কখনও এই মানুষটাকে আমি চিনি না? অথবা ফিরতে কী চাইতেন দূর শৈশবে, যেখানে বাতাসে বাতাবী লেবুর মতো আনন্দের গন্ধ মাখা থাকে?
কোন কিছুই জানা হয় নি, শুধু দেখে গেছি সংসারের অভিকর্ষে আটকে থাকা ঘোর বাস্তবতা নিয়ে বাস করা একজন মানুষ, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যার কেটে যায় দায়িত্ব পালনে। আমি আমার পিতাকে চিনি, কিন্তু একদম ভেতরের মানুষটাকে জানতে পারি নি। জানতে চাইও নি। আব্বা, আপনার কাছে আর ফেরার উপায় নেই, তবুও বাকিটা জীবন আমি খুঁজে যাবো আপনাকেই।
No comments:
Post a Comment