Thursday, August 19, 2021

সুখী নীলগঞ্জ

মতিউল্লাহ স্যারকে সবাই ভয় পেত। কাঁচা পাকা চুল, ভারী চশমা, রাশভরী মানুষ। অংক করাতেন। একটু চিবিয়ে কথা বলতেন, আর কথাতে একটু চন্দ্রবিন্দুর প্রভাব থাকতো। এক সময়ে স্কুলের টেরর স্যার ছিলেন। সব গরম জিনিসই ঠান্ডা হয়ে যায় এক সময়ে। আমরা যখন স্যারের ক্লাস করি তখন স্যার অনেকটাই ঠাণ্ডা। একদিন ক্লাসে উনি ছয় ইঞ্চি একটি রেখাকে দুই ভাগ করতে দিলেন। আমি দ্রুত স্কেল বের করে ছয় ইঞ্চি রেখা টানলাম, মাঝের পয়েন্টটা মার্ক করে স্যারের কাছে নিয়ে গেলাম। সমস্যাটা আসলে স্কেল দিয়ে মেপে দুই ভাগ করার জন্য না, এরচেয়ে অনেক জটিল।
স্যার আমার কাজ দেখে হুংকার দিলেন। "এইঁ অংঁক কোঁথায় শিঁখেছো? ঘোঁড়ার ঘাঁসটাও কাটতে পারবা না। স্কুঁল পাঁশ করে সিঁটি কঁলেজের নাঁইট সেঁকশনে ভর্তি হতে হবে।"
স্যারের মতে অধঃপতনের দুটো ধাপ আছে। প্রথমটা ঘোড়ার ঘাস কাটা আর শেষ পর্যন্ত ভালো কোন কলেজে চান্স না পেয়ে সিটি কলেজের নাইট সেকশনে ভর্তি হওয়া। আমি নিজের বাসার ঘাস একবার কাটতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম ঘাস কর্তন সহজ কাজ না। সিটি কলেজও কালক্রমে খুব ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। দুটোই আদতে ফেলা দেওয়ার মতো কাজ না।
ধমক খেয়ে আমি ম্রিয়মান হয়ে গেলাম। স্যার অবশ্য মারধোরের দিকে গেলেন না। ক্লাসে মূলত মার খেতো টুলু। স্যারের কনিষ্ঠ পুত্র। আমাদেরই বাল্যবন্ধু। অংক শেখানোর জন্য টুলুর উপর স্ট্যান্ডিং অর্ডার ছিল যে সে যেন তার ক্লাসের প্রতিটি প্রাইভেট ব্যাচের সাথে অংক শেখার জন্য বসে। কিন্তু অংক জটিল জিনিস। প্যাঁচ লেগে যায়। দুর্গে ৫০ জন সৈন্যের খাবারে ৭০ জনের কতদিন চলবে এই জটিলতা অথৈ জলে ফেলে দেয়। এই অংক মনে হয় আফগানিস্তানে লাগতে পারে। ভীষণ গোলযোগের ভেতর ওদের ঐকিক নিয়ম করতে হয় ওদের।
যাই হোক পরীক্ষাতে একবার একটু ইয়ে হয়ে গেল টুলুর। অবস্থা বেগতিক দেখে সে এক সকালে গৃহত্যাগ করলো। টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের "এইসব দিনরাত্রি" প্রবল জনপ্রিয়। সেই নাটকের এক চরিত্র কবির মামা তাঁর গ্রামকে আদর্শ বানাবেন। সেখানে দুঃখ থাকবে না, অনাচার থাকবে, মানুষের মধ্যে থাকবে সমতা আর বন্ধুত্ব। সেই গ্রামের নাম দিয়েছেন উনি সুখী নীলগঞ্জ। পরীক্ষাতে একটু ইয়ে হয়ে গেলে সুখী নীলগঞ্জ এক অবশ্য গন্তব্য।
তবে গৃহত্যাগের পরে দ্রুতই টুলু ফিরে এলো। অল্প সময়ে সে আবিষ্কার করে ফেলল যে এই দুনিয়ার কোথাও সুখী নীলগঞ্জ নেই, নীললোহিতের দিকশূন্যপূরের মতো সে অস্তিত্বহীন। দুনিয়া জোড়া আছে দুঃখী নীলগঞ্জ। বঞ্চনা, অনাচার, অসাম্য আর কষ্ট সর্বত্রই, পালিয়ে কোন লাভ নেই।
টুলু অবশ্য সরাসরি বাসায় ফিরে নি। সে ঢুকে গেলে সকাল বেলার ছাত্রদের ব্যাচে। হঠাৎই স্যারের নজরে এলো।
আঁরে টুঁলু সাহেব যে? একটু বিরতি দিয়ে - আঁরো এক ঘঁড়া মাঁর্বেল কিঁনে দেঁই?
এরপরে কী হয়েছিল আমার জানা নেই। কিন্তু আন্দাজ করতে পারি।
একদিন আমরা সবিস্ময়ে টের পাই আমরাও বড় হয়ে গেছি। পালানোর সব পথই বন্ধ। কিন্তু ঘর পালানো কাউকে দেখলে আমার বালকবেলার কথা মনে হয়। কয়েক বছর আগে পত্রিকাতে দেখেছিলাম কয়েকজন কিশোর ঘর থেকে পালিয়ে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপে যাওয়ার প্ল্যান করার সময়ে ধরা পড়েছে। আমরা বুড়ো হয়ে গেলে কোথাও না কোথাও শৈশব আর কৈশোর বেঁচে আছে। কেউ না কেউ স্বপ্ন দেখছে।
স্বপ্ন আমিও দেখি। অনেক দূরের ফেলা আসা দিনের স্বপ্ন। ওরা একদম তাজা বাতাস দিয়ে আসে, এজমার টান ভুলে যাই, ভুলে যাই অদ্ভুত এই বাস্তবতাকে। টের পাই অনেক দূরের কোন এক সুখী নীলগঞ্জ এখনও বেঁচে আছে, এখনও তাকে স্পর্শ করা যায়, এমনকি চাইলে ঘুরেও আসা যায়। এই অস্থির সময়ে দূর থেকে দেখা সেই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্ন দেখায়, কানে কানে বলে - শোন কালকের দিনটা কিন্তু অনেক ভালো হবে।
সেই আশা নিয়ে এখনও বেঁচে আছি।

No comments: