আনুশা স্কুল অপছন্দ করতো। শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে আনুশা হারমনি স্কুলে যেত। হারমনি স্কুলের অনেক সুনাম। কিন্তু আনুশার পছন্দ হয় নি। নিয়ম কানুন খুব কড়া, স্কুলের একটা ড্রেস আছে। খেলার জায়গা সীমিত। আনুশার লেজে লেজে সামারারও লেখাপড়ার শুরু একই স্কুলে। বোনের মতো তারও স্কুল অপছন্দ।
একদিন আমি হারমনি স্কুলের পার্কিং লট গাড়ি পার্ক করছি, ওদের অফিসে কি একটা কাজ আছে। স্কুলের মাঠ থেকে আনুশা আমাকে দেখতে পেল। সে দৌড়ে ছুটে এলো, বেড়ার ভেতর দিয়ে ছোট হাতটা দিয়ে আমার আঙ্গুল ধরল। আমাকে দেখে আনুশা খুশি, ও ভেবেছে আমি ওকে বাসায় নিয়ে যাবো। আনুশার মন খারাপ ছিল, একদম পাশে দাঁড়িয়ে আছে টার্কিশ মেয়ে মেরিয়াম, আনুশার হারমনি জীবনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। আনুশার মন খারাপ হলে সে আনুশাকে স্বান্তনা দেওয়ার কাজটা করত। সেইদিন আমি আনুশা স্কুল থেকে বাসায় নিতে আসি নি। মন খারাপ অবস্থাতে মেয়েটাকে রেখে এসেছিলাম।
এর কিছুদিন পরে স্কুলের অফিস থেকে আনুশার ফোন। ওকে বলা ছিল স্কুলে যদি কোন অসুবিধে হয় তাহলে যেন আমাকে ফোন দেয়। আনুশার মন খারাপ লাগছিলো, সে বাসাতে যেতে চায়। আমি এইবার আর ভুল করলাম না। ওকে দ্রুত বাসাতে নিয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে ঠিক করলাম, হারমনি স্কুল আর না। স্কুলের উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন, কিন্তু সেটা একমাত্র উদ্দেশ্য না। হারমনি স্কুল ছেড়ে আনুশা আর সামারা দুইজনই আবার পাব্লিক স্কুলে ফেরত এলো। দুই বোনই বিস্তর খুশি হয়েছিল।
আমি সারাজীবন পাব্লিক স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটিতে পড়েছি। যেই পৃথিবীতে আমরা বাস করি, সেই পৃথিবীর ছোটখাটো স্যাম্পল দেখতে হলে পাব্লিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে ভালো। পাব্লিক স্কুলে ফেরার পরে আনুশা আর কোন দিন ফোন করেনি, আমাকে স্কুলে দেখার পরেও বাড়ি ফিরতে চায় নি। দুই বোনই এরপরে স্কুলকে পছন্দ করা শুরু করেছে। আনুশা এলিমেন্টারি স্কুল শেষ করেছে, মিডল স্কুল শেষ করেছে, এই গত সপ্তাহে হাই স্কুলের প্রথম ক্লাস, যেটাকে ফ্রেশম্যান ইয়ার বলে, সেটাও শেষ করল। সামারা এলিমেন্টারি স্কুল শেষ করেছে, মিডল স্কুলের সপ্তম শ্রেণী শেষ করল। আর তিনমাস পরে ক্লাস টেন আর এইট শুরু হবে দুই বোনের।
অন্য সব কাজের মতো শিক্ষাটাও আনন্দময় পরিবেশে হলে সেটার ফলাফল ভালো হতে বাধ্য। আমার ক্ষেত্রে এটা সত্য, আমার মেয়েদের জন্যও সত্য। আনুশা আর সামারা দুইজনেই খুব ভালো ফলাফল করেছে, আনন্দ নিয়ে স্কুলে গেছে, ঝুড়ি ঝুড়ি এওয়ার্ড পেয়েছে, ন্যাশানাল অনার সোসাইটিতে যোগ দিতে পেরেছে। হাইস্কুলে আনুশা এডভান্সড কোর্স নিয়েছে, মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে এবং তার ফলাফলও পেয়েছে। এরপরেও স্কুলে যাওয়া কোনদিন নিরানন্দময় মনে হয় নি।
গত মার্চ মাসের ১২ তারিখের পর আর স্কুল যেতে হয় নি - তিন সপ্তাহ ছুটির পরে ডিস্ট্যান্ট লার্নিং শুরু হয়েছে স্কুলগুলোতে। সেখানেও বেশ চাপের মধ্যেই ছিল দুই বোন। যেই মেয়েরা স্কুল যেতে চাইতো না, তারাই এই দীর্ঘ বন্ধে স্কুলকে মিস করছে, মনে প্রাণে চাইছে যেন স্কুল খুলে যাক। আমরাও তাই চাইছি। আবারও আমি টের পাচ্ছি যে স্কুল শুধু পড়ালেখার জায়গা না। এতো বছর পরে আমি যখন আমি আমার স্কুলের কথা ভাবি তখন আমার বন্ধুদের কথা মনে হয়, মনে হয় স্কুলের বিশাল মাঠটার কথা - লেখাপড়ার কথা আমার মনেই পড়ে না। স্কুলের কথা মনে হলেই আমার মনে হয় এক অবাধ ছুটির সময়।
আমার দুটো মেয়ে আরও একটি ধাপ পেরিয়ে গেল। সব ঠিক থাকলে আনুশার স্কুলের পাঠ চুকে যাবে তিন বছর পরে, সামারার আর পাঁচ বছর। আমি চাই ওরা ওদের স্কুলের সময়টা আনন্দে শেষ করুক – সকালের বাস ধরে ঘুম ঘুম চোখে স্কুলে যাক, সারাদিন ক্লাস শেষে ঘরে ফিরুক ক্লান্ত হয়ে, এরই মাঝে চলুক বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্প আর হই হুল্লোড়।
আমরা সবাই যে সুখে ছিলাম সেটা এই অসুখের সময়ে আরও বেশি বেশি বুঝতে পারছি। আশাকরি এই দুঃসময়ের অবসান হবে, আনুশা সামারাসহ এই পৃথিবী লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোর ফিরতে পারবে স্কুলে। সবার পথাচলা হোক বাধাঁহীন।
No comments:
Post a Comment